নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জুবায়ের সুহান

সুহান সুহান

দ্বিধান্বিত

সুহান সুহান › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিক্ষা এবং শিক্ষক

২২ শে মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৫৪

আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক। নিজের যোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান আমি। কারণ আমি কখনোই ভালো ছাত্র ছিলাম না। স্কুলে মোটামুটি। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ছাত্র ছিলাম। সিজিপিএ ছিল ৪.৯৪। স্কুলের নাম ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল। এরপর ভর্তি হলাম নটর ড্যাম কলেজে। এবার আমার মা এর আশা ছিল যে ছেলে এইবার ৫ পাবে। ৫ ঠিকই পেলাম। কিন্তু সেটা ৪.৫০। খুবই হতাশ হলাম ফলাফলে। স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো। মনে হচ্ছিল স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। খুব জেদ করে প্রস্তুতি নিলাম। এত কঠিন প্রশ্ন হলো যে বলার মত না। আশা ছেড়ে দিলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইংরেজি’ বিষয়ে টিকেছিলাম। তাই ওটাতেই ভর্তি হয়ে থাকলাম। সান্ত্বনা একটাই যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে মায়ের টাকা নষ্ট করতে হলো না। কিন্তু ভাগ্য আমার আরো সুপ্রসন্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে গেলাম।



আমার মা বলতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কারো একবার হলে তার আর কোন চিন্তা নেই। তার ভবিষ্যৎ ঠিকঠাক। কথাটাকে আমি খুব বেশী গুরুত্ব দিয়েছিলাম। মানে একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলেই ভবিষ্যৎ সেট, আমি তো ঢুকে গিয়েছিই। আর কী লাগে!! তখন থেকে আমার পড়াশোনা না করা শুরু হলো। না আমি কখনো উচ্ছৃংখল ছিলাম না। ক্লাস করতাম নিয়মিত। খুব যে আড্ডা দিতাম তাও না। কিন্তু কেন যেন পড়াশোনার প্রতি আমি কোন মজা পেতাম না। আমার এই মজা না পাওয়াতে শিক্ষকদেরও খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না। প্রত্যেক ক্লাসেই প্রথম ৫ মিনিট শিক্ষকদের কথা শোনার চেষ্টা করতাম। তারা কেউ বই দেখে, কেউ পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড দেখে পড়াত। কিন্তু পড়াশোনাটা মূলত হত প্রথম বেঞ্চে বসা ছাত্রদের সাথে অপর দিকে বসা শিক্ষকের। প্রথমদিকে বসা ছাত্ররাই শুধু মাথা নেড়ে নেড়ে বুঝাত তারা সব শুনছে, সব বুঝছে। আর আমি বা আমার মত যারা শুনত না। আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতাম। কাটাকুটি খেলতাম। নাইলে শিক্ষকের দিকে তাকায়ে থেকে অন্য আকাশ কুশুম ভাবতাম। বেশী সকালে ক্লাস থাকলে কেউ কেউ এমন জায়গায় বসতাম যেন শিক্ষক দেখতে না পায়, আর আরাম করে একটু চোখ বুজে ঘুমানো যায়। এই ছিল আমি আর আমার মত কারো পড়াশোনা। আমার মা বলতো যে শিক্ষকদের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখতে হয়। তাহলে নাকি ভালো। কি ভালো তা ঠিক বুঝতাম না। যে লোকটা এত নিরানন্দভাবে পড়ায়ে যাচ্ছে, এর সাথে যেচে গিয়ে কথা বলতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা হতো না। কিন্তু প্রথম সারিতে বসা ছাত্ররা ঠিকই শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ রাখত। পরীক্ষা খারাপ হলে বলত, “স্যার একটু দেখবেন”। যথারীতি দেখা হত।



অনেক ছোটবেলায় আমাকে একজন শিক্ষক ‘সন্ধি’ পড়াচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন যে, “ তুমি যদি না বুঝো, এটা কিন্তু তোমার দোষ না। এটা আমার দোষ। আমি তোমাকে বুঝাতে পারিনি। ঠিক আছে?” কথাটা আমাকে খুব আলোড়িত করেছিল। এই প্রথম কেউ এই রকম কথা বলল। এই জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনাতেও আমার শিক্ষকদেরকেই দোষী মনে হত। আমার কাছে মনে হত এটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটা ব্যর্থতা যে আমাদের শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকে জোর করে পড়াশোনা করে। কেন করে তাও জানে না। সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশের পড়াশোনার একটাই লক্ষ্য। চাকরি পাওয়া। আর কিছু না। প্রকৃত শিক্ষার এরকম একটা লক্ষ্য কখনোই হওয়া উচিৎ না। আগ্রহের সাথে কিছু শিখা আর জোর করে কিছু শিখা কি এক? অবশ্যই না। কিন্তু সেই আগ্রহ তৈরি হওয়ার মত শিক্ষক, শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের নেই।



ঠিক এই জায়গা থেকেই আমার মত মানুষের শিক্ষক হওয়ার এই গর্হিত ইচ্ছা প্রকাশ। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর কিছুদিন মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে দেখলাম যে আমার আত্মা তৃপ্তি পাচ্ছে না। তখন ঠিক করলাম যে একটা দুঃসাহস করি। শিক্ষক হই। কিন্তু আমার ক্লাস হবে মজার ক্লাস। সবাই মজা করে শিখবে। এখন আমার মত ব্যাকবেঞ্চের ছাত্র তো বললেই শিক্ষক হতে পারে না। শিক্ষক হতে হলে প্রথম বেঞ্চের শিক্ষার্থী হতে হয়। যারা শিক্ষকদের কথা একটা মানুষরূপী যন্ত্রের মত শোনে। তথাকথিত শিক্ষকরাও শুধু যেন তাদেরই পড়ান। প্রথম বেঞ্চের পরেও যে আরো অনেক বেঞ্চ আছে তা যেন তারা পাত্তাই দিতেন না। আমার ইচ্ছা হল এই জিনিশটার একটা পরিবর্তন আনতে। ফাঁকিবাজদের থেকে একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমি শিক্ষক হবো। যে জানবে ফাঁকিবাজদের মন মানসিকতা। ক্লাস এর সবচেয়ে ফাঁকিবাজকে যদি আমি কিছু শিখাতে পারি তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রথম বেঞ্চের পুতুলের মত মাথা নাড়তে থাকারাও শিখবে।



কিন্তু বললেই তো আর শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষক হতে অনেক জ্ঞান লাগে। আমি তো পড়াশোনা কিছুই করিনি। কিছু করলাম। অনেক মজার মজার বিষয় আছে যেগুলো খুব মজা করে পড়ানো যায়। কিন্তু আমাদের শিক্ষকরা এত তিতা করে পরাতেন যে বলার না। সেগুলো একটু শিখলাম। জানলাম। একদিন একটা সুযোগ আসলো। একটা নামকরা কলেজ এর বিবিএ বিভাগে পার্ট টাইম শিক্ষক নেবে। পরীক্ষা হিসেবে শিক্ষার্থীদের ১০ মিনিটের ক্লাস নিতে হবে। যারটা ভালো হবে তাকে নেয়া হবে। যথারীতি গেলাম। মজা করে উদাহরণ দিয়ে ক্লাস নিলাম। শিক্ষার্থীরাও আমাকে খুব তালি দিয়ে স্বাগত জানালো। আমার সাথে যারা প্রতিযোগী হিসেবে ছিল তারা সবাই প্রথম বেঞ্চের অধিকারী। আমিই মনে হয় একমাত্র পিছনের বেঞ্চের।



অবশেষে ফলফল হলো যে প্রেজেন্টেশানে সর্বোচ্চ পেয়েছি আমি। আমাকেই শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশী পছন্দ করেছে কিন্তু আমার সেই পিছনের বেঞ্চে থাকার সময়কার ফলাফল আমাকে বিবেচনার মধ্যেই রাখেনি। কী আর করা!!

অবশেষে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমি হতে পেরেছি। সম্ভবত খুবই অযোগ্য একজন। তাও যেন আমার মত করে যোগ্য হতে পারি। আমি যেন আমার মত পিছনের বেঞ্চের যারা, ওদেরকে একটু মজা করে পড়াতে পারি। এটাই আমার চাওয়া।



আমি মনে করি না সামনের বেঞ্চের সেই শিক্ষার্থীরাই খালি শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখে। পিছনের দিকে থাকা অনেক ডানপিটে বখাটে ছেলেও অনেক ভাল শিক্ষক হতে পারে। সবার শেখা একভাবে হয় না। শিক্ষাটা সব ধরনের মানসিকতার মানুষের জন্য হওয়া উচিৎ। আমি বলছি না সবাই রবীন্দ্র নজরুল। কিন্তু কে বলতে পারে যে একদিন এদেরকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার মত ক্ষমতাসম্পন্ন আমার আপনার পাশে নেই। আমরা দেখতে পারছি না অথবা দেখতে চাইছি না। প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। সবাইকে এক খোঁয়াড়ে ঢুকালে চলবে না।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে মে, ২০১৩ রাত ৮:০০

কালোপরী বলেছেন: :)

২| ২২ শে মে, ২০১৩ রাত ৮:০৫

বাংলার হাসান বলেছেন: খুব ভাল লাগলো। আপনার মত করে যদি সবাই ভাবতো।

৩| ২২ শে মে, ২০১৩ রাত ৮:০৭

খেয়া ঘাট বলেছেন: প্রথম বেঞ্চের পরেও যে আরো অনেক বেঞ্চ আছে তা যেন তারা পাত্তাই দিতেন না ।
আপনার লিখাটি খুবই পছন্দ হয়েছে। অনেক শুভকামনা রইলো।
ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষকই শুধু না, প্রাণের শিক্ষক হয়ে ওঠুন।

৪| ২২ শে মে, ২০১৩ রাত ১০:৩২

পড়শী বলেছেন: অভিনন্দন আপনাকে। আমি এমন একজন কে চিনি, যিনি ভার্সিটি থেকে সেকেন্ড ক্লাস পাওয়া। এখন বিদেশের একটা নামকরা ভার্সিটির টিচার।

আপনার চিন্তা-ভাবনা খুব ভাল লাগল। আশা করি লেগে থাকবেন এটায়।

৫| ২৩ শে মে, ২০১৩ রাত ২:০২

ইসেট বলেছেন: ভালো। আমিও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.