নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এই শহরে অনেক হাজার হাজার ছেলে আছে যারা চুপচাপ থাকে, কথা কম বলে। পৃথিবীতে তারা বোকা, লাজুক, হাঁদারাম নামে পরিচিত। আমাকে এর সাথে তুলনা করলে তেমন একটা ভুল হবে না। নিজের ব্যাপারে বলাটা অনেক কঠিন। তবে নিজেকে মাঝে মাঝে অনিকেত প্রান্তর ভাবি।

জাহিদুল হক শোভন

এই শহরের বোকা ছেলেটি।

জাহিদুল হক শোভন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: ওয়াল ওফ লাঈট

২৮ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ৮:০২


এক
.
চাদর গায়ে দিয়ে আসাদ ভাই যখন বললো “বুঝলি আশিক এখনকার আবহাওয়া দিনে রাতে দশবার বদলায়। এই সময়ে বৃষ্টি আসার কোন মানে হয় ?” আমি কোন জবাব দেই না। চুপ করে জানালার বাইরে উদ্ভেগপূর্ণের সহিত তাকিয়ে থাকি। পৌষ মাসের এই সময়টায় বৃষ্টির ছোয়া পাওয়ার কথা না। বৃষ্টি আসলে মাঝে মাঝে আমার কবিতা লিখার ইচ্ছা হয়। ইচ্ছা হয় বৃষ্টির টুপটাপ ফোটার শব্দের অনুভূতির ছাপ গুলো আমার খাতার মাঝে একটা রুপ দিতে। তবে এখন আমার এই কবিতা লেখার ঝোঁক বা ইচ্ছা নেই। মনস্থ করে আসাদ ভাইকে বলি “ এই বৃষ্টিটা একটা আগমন বার্তা। বাংলা সনের পঞ্চম ঋতু “শীত” এর আগমন নিয়ে আসছে। আসাদ ভাই ‘‘ ও আচ্ছা তাহলে এ কারনেই বৃষ্টি” এই বাক্যটা বলে আরাম করে খাটের মাঝখানটায় বসে। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাসে শীতের অস্থিত্ব। সাধারনত এই সময়টায় দিনের চেয়ে রাত অনেক বড় হয়। এর একটু পরেই আসাদ ভাই আবার বললো “ কি ভাবিস ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?”
.
গত পাঁচ দিন ধরে ‘‘স্বরনিকা লিমিটেড” এর আরফাজ ভাই বলে আসছে তার বিলটা যেন তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেই। আমি বলেছিলাম যত তাড়াতাড়ি পারি করে দিব। কিন্তু যখন বিলটা চেক করলাম তখন দেখলাম হিসেবে গড়মিল। সাথে সাথে আরফাজ ভাইকে ফোন করে জানালাম আপনার বিলে ঝামেলা আছে। ঘন্টা খানেক পরে উনি এসে নিরবতার সুরেই আমাকে একটা শূন্য রাত্রির পথে হাটার আগমন জানায়। উনি বলে ‘‘আপনাকে তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না আশিক সাহেব, আপনার ব্যবস্থা করে রেখেছি। আপনি শুধু বিলটা ছেড়ে দেন। আমি একটুও অবাক হয়নি, অভ্যস্থ হয়ে গেছি এই সব কাজের উপর। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলেছিলাম “আরফাজ ভাই আপনার কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি”। এরপর বিলটা আমি পেন্ডিং অবস্থায় রেখে দেই। ম্যানেজার সাহেবকে যখন বিষয়টা অবহিত করলাম উনি একটা হাসি দিয়ে আরফাজ ভাইয়ের দেখানো পথে হাটতে বললেন। পরবর্তীতে চেয়ারম্যান ম্যাডামের নিকট বিষয়টা পেশ করলে ম্যানাজেরর চাকরি সাময়িক ভাবে অফ করে দেয়। ঠিক তখনি বুঝতে পেরেছিলাম আমার পিছনে শত্রুর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে চলেছে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসাদ ভাই এর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলি “না তেমন কিছু ভাবছি না। তোমার প্রেম কেমন চলছে বলো” আসাদ ভাই একটু হেসে বলে “ভালোই চলতেছে। বিষয়টায় একটা মায়া মায়া ভাব যেমন আছে তেমন একটা মজাও আছে বুঝছিস। তোর ভাবীকে যখন আজকে বিকেলে বললাম “তুমি আগে কখনো প্রেম করো নাই? সে চুপ করে কিছুক্ষন পর বলে “জ্বী না। আপনি কখনো প্রেম করছেন”? আমি তাকে বলি করেছি তো। সাথে সাথেই তোর ভাবী ফোন কেটে দেয়। আমি ফোন দিলে তোর ভাবী আর রিসিভ করে না। ঘন্টা খানেক বাদে আমাকে ফোন দিয়ে বলে “আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন কেন? আপনি অনেক খারাপ একটা মানুষ। ভালোবাসছেন অন্যজনকে আর বিয়ে করেছেন আমাকে”। তার কথা শুনে বিশ্বাস কর অনেক্ষন চুপ করে ছিলাম। সে ওপাশ থেকে বলতে থাকে “কি হয়েছে কথা বলেন না ক্যান”? আমি শুধু অনেক গভীর ভাবে একটা নিশ্বাস নিয়ে বলেছিলাম “আমার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগেই তার বিয়ে হয়েগিয়েছিল। কিছুই করতে পারি নাই আমি”। সে চুপ করে থাকে। আমিও চুপ করে থাকি। কথা বলার মাঝে যেন শান্তি অথবা নিশ্চুপ টাইপের কিছু প্রবেশ করে আমাদের কথা বলা থামিয়ে দেয়। আমি যেই বলতে যাবো তোমার সাথে আবার পরে কথা বলবো তখন সে ওপাশ থেকে বলে “মাফ করবেন আপনাকে ভাবোদ্দীক অবস্থায় ফেলে দিলাম। একটা কথা বলি”? আমি বললাম “বলো” সে ইতস্তত হয়ে বলে “এখন থেকে আমার সাথে প্রেম করবেন কেমন” আমি আচ্ছা বলে ফোনটা রেখে দি।
.
আসাদ ভাইয়ের কথা শুনে আমি অনুভব করি ওদের ভালোবাসা গুলো। একমাসও হয়নি আসাদ ভাই বিয়ে করেছে। বিয়ে করে তিন দিন পরেই এই শহরে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে চাকরি জীবনে চলে আসে। আমার সাথেই এই ব্যাচেলর বাসায় থাকে। ছাত্র জীবনে কলেজে পড়াকালীন সময়ে আফরীন নামের এক মেয়ের সাথে তার প্রেম হয়। তাদের স্বপ্ন গুলো হয়তো কোন এক আশার উপর নির্ভর করেছিল। যে আশা গুলো তাদের ভরসা দিত কোন একদিন তাদের এই ভালোবাসাকে একটা পূর্ণ নাম দিবে। একদিন হুট করেই সেই চমৎকার আফরীন নামের মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। আসাদ ভাইয়ের সাহস হয়নি সেই আলোকে তার করে নিতে। আধাঁরে বিলিয়ে দেয় তাদের স্বপ্ন গুলোকে। কষ্ট নামক শব্দটাকে আহ্বান জানায় তাদের জানালায়। অমাবশ্যা রাত্রিতে অপূর্ণ স্মৃতি গুলো যখন জানালায় কড়া নাড়ে তখন হয়তো আসাদ ভাই চুপ করে কষ্টগুলোকে অনুভব করে।
.
দুই
অফিস শেষ করে ক্লান্ত শরীর নিয়েও যখন সি-এ ক্লাস করতে যেতে হয় আমার ভিতরে বিরক্ত জিনিসটা ভর করে। বৃহৎ আকাশে আমার ক্ষুদ্র মুখমন্ডলটা তুলে ধরতেই মনে হয় আমি আটকে পরে আছি বিষাদের জালে। তবু আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায় সি-এ কমপ্লিট করার নেশা। একটা ক্লাস করেই যখন আমি বের হয়ে গেলাম তখন পিছন থেকে কেউ একজন আমাকে ডাক দেয়। মাথাটা বেশ ধরেছে। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি অধিতি। সে আমার কাছে এসে বলে “শরীর খারাপ?” আমি তাকে স্বাভাবিক ভাবেই বললাম “মাথাটা ভারী হয়ে আছে। তুমি কিভাবে বুঝেছো? সে আমায় জানায় “আপনার চেহারা দেখেই বুঝেছি। আজকে অনেক চাপ গিয়েছে অফিসে তাই না?” আমি তাকে বলি “তা তো প্রতিদিনই হয় তবে এমনটা কখনো হয়নি।” তারপর দুজনেই চুপ করে হাটতে থাকি। ঘড়িতে তখন ৮:৩০ ছুই ছুই করছে। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে একটা ফার্ম থেকে সি-এ.সিসি শেষ করি। সি-এ. সিসি শেষ করার সময় আমি অডিট করেছিলাম কক্সবাজারের এক নামকরা হোটেলে আর আগ্রাবাদে একটা এনজিওতে। সি-এ.সিসি শেষ করেই একটা চাকরি নেই প্রাইভেট কোম্পানিতে। চাকরির পাশাপাশি সি-এ কমপ্লিট করার কোর্সে ভর্তি হই। এখানে ক্লাস করার এক পর্যায়ে অধিতি নামক এই পরমোৎকৃষ্ট বা চমৎকার মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়। ততদিনে আমার পার্ট- ১ শেষ হয়ে যায়। কিছুদিন পরেই আমার পার্ট-২ এর ফাইনাল এক্সাম। সি-এ কমপ্লিট করতে তিনটা পার্ট শেষ করতে হয়। কয়েক মাস আগে অধিতি আমার সামনে এসে চুপ করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ছিল। আমি খুব অস্বস্থি বোধ করছিলাম। আমি বললাম কি?” সে একটু ইতস্তত হয়ে বলেছিল “আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে?” আমি চশমাটা একটু ঠিক করে মাথা দিয়ে হ্যা সূচক ইশারা দিয়ে বলেছিলাম “হুম বলেন কি বলতে চান?”সে আমার প্রতুত্ত্যর শুনে বলে “না মানে আমি এখানে কয়েক মাস হলো ভর্তি হয়েছি। আমি প্রায় আপনাকে দেখি। আপনি আমাকে দেখেছেন কিনা কিংবা খেয়াল করেছেন কিনা তা আমি জানি না। আমি অধিতি। আর আপনি আশিক সেটা আমি জানি। সি-এ করার পাশাপাশি একটা চাকরিও করছেন।” একটানা কথাগুলা বলেই সে থামে। আমি একটু অবাক হলাম সে আমাকে নিয়ে অলরেডি পড়াশুনাও করে ফেলেছে। আমি যেই বলতে যাবো “আমাকে নিয়ে এতো জানার কারনটা কি বলেন তো?” কিন্তু তার আগেই সে আবার বলতে লাগলো “আপনি নিশ্চয় একটু অবাক হয়েছেন। অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। চেনা নাই, আগে কখনো কথা হয় নাই, একটা অজানা অচেনা মেয়ে আপনার সম্পর্কে জেনেছে একটু তো অবাক হওয়ার কথা।” তার কথা শুনে বিষ্ময়ের মুখ নিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশার দিয়ে বলি “হ্যাঁ একটু তো অবাক হওয়ারি কথা।” সে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতেই বললো “আমার এখনো পার্ট- ১ শেষ হয়নি। আপনি তো পার্ট-২ এর ফাইনাল দিবেন কয়েক মাস পর। আমি সব কিছু জেনেছি এইসব বিষয়ে আপনি অনেক ভাল বুঝেন। আমাকে যদি একটু হেল্প করতেন?
.
সেদিনের পর থেকেই যখন সুযোগ পাই তখন তাকে একটু বুঝিয়ে দেই। সে অনেক চমৎকার করে কথা বলে। মাঝে মাঝে যখন তার বিশাল লাইনের বাক্য গুলা আমার নিকট প্রকাশ করে আমি চুপ করে তা শুনতে থাকি। একটা পর্যায়ে আমি অনুধাবন করলাম তার বিশাল লাইনের বাক্য গুলা শুনতে আমার ভালো লাগে। সেটা যে কথাই হোক না কেন। কিন্তু আমি তাও জানি তার কথা গুলা ভালো লাগার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া অন্যায়। কারণ সে একজন সনাতন ধর্মের মেয়ে। শীতটা চলেই এসেছে। অধিতি একটা শাল গায়ে দিয়ে জড়িয়ে আছে। তাকে এখন আমি তুমি বলেই সম্মেধন করি। হাটতে হাটতেই সে বললো “চলেন আশিক সাহেব আপনাকে ভাপা পিটা আর চা খাওয়াবো। গরম গরম ভাপা পিটা আর চা খেলে মাথা ধরাটা হয়তো কিছুটা হলেও সেরে যাবে।” রাস্তার একটা টঙ্গের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গরম গরম ভাপা পিটা খাওয়ার জন্য আমি অপেক্ষা করি। ভাপা পিটার নাম শুনলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম। আমার মা আমাকে বাবু বলে ডাকতো। শীতের কুয়াশা যখন চারপাশকে ঘিরে ধরতো আমার মা আমাকে উষ্ণতার ছায়ায় রাখতো। আমার মায়ের কথা মনে পড়লে আমি এখনো আমার মায়ের সেই উষ্ণতার ঘ্রান টুকু পাই।
.
কুয়াশা জড়িত সকালে আমি যখন ল্যাপের ভিতরে শুয়ে থাকতাম আমার মা আমাকে বলতো “বাবু উঠ তোর জন্য পিঠা বানাইছি।” আমি ল্যাপের ভিতর থেকেই লাফ দিয়ে উঠে যেতাম। মা আমাকে মুখ ধুয়ে দিয়ে গরম গরম পিঠা খাওয়াতো। যখন স্কুলে যাওয়ার সময় হতো মা গোসল করিয়ে মাথাটা মুছে আমার মাথায় এক গাদা তেল ঢেলে দিয়ে চুল আচড়িয়ে দিত। মায়ের একটা রোগ ছিল। কোমড়ের ব্যথা নিয়ে মাঝে মাঝে বিছানায় নিশব্দে পরে থাকতো। যেদিন মায়ের কোমড়ে ব্যথাটা উঠতো সেদিন ঘরে কোন কিছু রান্না হতো না। মা আমাকে বলতো “বাবু ক্ষিধা লাগছে?” আমি মাথা দিয়ে হ্যা সূচক ইশারা দিতাম। এইসব ব্যথার যন্ত্রনাটুকু আমি তখন কিছুই উপলব্দি করতে পারতাম না। বাবা অনেক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় মাকে। কোমড় ব্যথা অনেক কারনে হয়ে থাকে। আমার মায়ের হাড়, মাংসপেশি, সামঞ্জস্য ক্ষতিকর ছিল। একটা সময় আমার মা, বাবা আর আমাকে ফেলে অনেক দুরে চলে যায়। আর আসেনি। কেঁদে কেঁদে আমি কত দিন রাত মাকে ডেকেছি কিন্তু মা আসে না। মাঝে মাঝে আমি স্বপ্ন দেখতাম মা আমাকে ডাকে “বাবু আমার কাছে আসবি? আমার এখানে একা একা থাকতে ভালো লাগে নারে।” বাবাকে যখন বলতাম “বাবা মা আমাকে ডাকে। মায়ের একা একা থাকতে ওখানে ভালো লাগে না। আমি যাই মায়ের কাছে?” বাবা আমাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে থাকে কিন্তু বাবা কিছুই বলতো না। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা অনেকটা ভেঙ্গে যায়। কেমন যেন চুপচাপ থাকতো। রাতের বেলা বাবা আমাকে বুকে নিয়ে থাকতো যেন কেউ বাবার কাছ থেকে আমাকে নিয়ে যেতে না পারে। বাবা বুকে নিয়ে বলতো “বাবু আমাকে একা করিস না। আমার অনেক কষ্ট হয়রে।”
.
গরম গরম ভাপা পিঠা আর চা খেয়ে আমি অধিতিকে বাসায় পৌছানোর জন্য রিক্সায় উঠি। আমি তাকে বলি “তোমাকে আমার কেমন ছেলে মনে হয়?” সে একটা হাসি দিয়ে চুপ করে থাকে। তার চুপ থাকার কারণটা আমি বুঝতে পারি যার অর্থ সমাজটা অনেক কঠিন। আমরা যেভাবে কোন কিছুকে পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করি কিন্তু সমাজ তা হতে দেয় না। আমি আর কিছু বলি না। বাসার সামনে আসলে অধিতি রিক্সা থেকে নেমে বলে “আবার দেখা হবে শুভ রাত্রি।”
.
তিন
.
আমি এখন বসে আছি একটা ফুটপাথের উপর সাদেকুর রহমান সাহেবের সাথে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের লেকচারার ছিলেন। তার চেয়ে বড় কথা তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ সে ভয়ানক রাতে মিলিটারীরা বাংলার মাটিতে যে বিভীষিকা জ্বালিয়ে ছিলো বাংলার মানুষের উপর যে নৃশংস্য হত্যা চালিয়েছিল সে সবের কথা শুনলে আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। প্রচন্ড ঘৃনা ও জেদ জন্ম হয় ঐসব নরপিশাচদের প্রতি। সেই কালো রাত্রির ঘটনার পর সাদেকুর রহমানের স্ত্রী ও মেয়েকে উনার শ্বশুর বাড়ি চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। ঢাকা শহরের অলি গলিতে তখন চলছিল লাশের মিছিল। সাদেকুর রহমানের সাত বছরের ছোট্ট মেয়েটার নাম ছিল নিশি। নিশি নামের ছোট্ট মেয়েটাকে তিনি অনেক ভালোবাসে। উনার স্ত্রী ও মেয়েকে চট্টগ্রামে রেখে আবার ঢাকায় চলে যায়। কয়েক মাস পর যখন এই হত্যা কান্ডের মাত্রা বাড়তে লাগলো সাদেকুর রহমানের ভিতরের আত্নাটা জেগে উঠে। সাদেকুর রহমানের মনে প্রশ্ন জাগে আমার কি কিছুই করার নেই এই দেশের জন্য? যেদিন তিনি যুদ্ধে যাবে তার আগের দিন উনার স্ত্রী ও মেয়ের সাথে দেখা করেছিল। উনার স্ত্রী মারিয়াম বেগম স্তব্দ হয়ে তখন দাঁড়িয়েছিল। ছোট্ট নিশিকে কোলে নিয়ে সাদেকুর রহমান বলে “বাবার কপালে চুমু দিবি?” নিশি কপালে চুমু দিয়ে বলে “আমার জন্য কি আনবা?” মারিয়াম বেগম বাবা আর মেয়ের এমন কথা শুনে কান্না করতে থাকে। সাদেকুর রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেছিল “মা আমি তোর জন্য একটা দেশ আনবো। এই যে এখন ঘরে বন্দি হয়ে থাকিস দরজা জানলা বন্ধ করে। আমি এমন দেশ তোকে দিতে চাই না। আমি তোকে সেই দেশ এনে দিব। যে দেশে অনাবিল আকাশে ঘুরি হয়ে উড়বি। আমি তোকে লাল সবুজের দেশ দিব, নিবি না?”
.
সাদেকুর রহমান ঠিকি যুদ্ধে যায়। যুদ্ধ শেষে এক পা হারিয়ে একটা স্বাধীন দেশ নিয়ে যখন ছোট্ট নিশির কাছে যায় তখন দেখে চারপাশের সব কিছু যেন বদলে গেছে। কিন্তু উনার পরিবারকে উনি দেখতে পান না। ছটফট করতে থাকেন এদিক ওদিক। তারপর থেকেই উনি এখানে থেকে গেছেন। এখনো মনে করে উনার পরিবার একদিন উনার কাছে আসবে। তখন তিনি তার মেয়েকে নিশ্চয় বলবে মা আমি তোকে যে দেশের কথা বলেছিলাম সে দেশ এনেছি।” কিন্তু উনার পরিবার কি কোন দিন আসবে? তবু মানুষ আশায় বুক বাধে। আর এইসব শোকে শোকে লোকটা কেমন যেন ছন্নছড়া হয়ে গেছে। চুল দাড়িগুলাতে পাক ধরেছে। আমি ওনাকে চাচা বলেই ডাকি। আমি এইসব কথা সাদেকুর চাচা থেকেই শুনেছি। আমার যখন মন ভালো থাকে না আমি সাদেকুর রহমান চাচার কাছে চলে আসি। উনার কাছ থেকে দেশের কথা শুনি। দেশের গল্প শুনি। আমি চাচাকে বলি “তোমরা যে দেশ এনেছিলা, যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলা সেই দেশ আর নেই চাচা। এই দেশে, হত্যা, লুটপাট, যুগ যুগ ক্ষমতা ভোগ করার নোংরা রাজনীতিতে ভরে গেছে।” চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকায়। তিনি আমায় বলে “আশিক বাবা আজকে আমার শরীরটা ভালো নাই। তোমাকে আজকে কোন ঘটনা শোনাতে পারবো না।”
.
এদিকে আসাদ ভাইয়ের মান অভিমানের ভালোবাসা যেন দ্বিগুন বেড়েই চলছে। এইসব ভালোবাসা যখন চোখের সামনে ছুটাছুটি করে আমার ভিতরে বিষন্নতা প্রবেশ করে। আমার ইচ্ছা করে অধিতিকেও আমার ভালো লাগার কথা জানাবো। কিন্তু ভয় হয়, ভালোলাগা বা ভালোবাসা প্রকাশ করলে কখনো কখনো প্রিয় মানুষটাকে হারাতে হয়। তার চেয়ে ভালো একজন বন্ধু হয়ে সবসময় কাছে থাকা। তবুও একদিন তাকে আমি বলেছিলাম “অধিতি তোমার জন্য কবিতা লিখতে ইচ্ছা করে।” আমার এই ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথার ধরনটা অধিতি বুঝতে পেরেছিল। সে জানায় তার একজন ভালোবাসার মানুষ আছে। এই বছরের শেষের দিকেই তাদের বিয়ে। তাছাড়া আমরা দুজন দু ধর্মের। এইসব শোনার পর আমার আর সাহস হয়নি দ্বিতীয় বার কোন শব্দ উচ্চারন করার।
.
পরিশিষ্ট
.
পাঁচ বছর পর আমি দেশে ফিরেছি। বাবার মৃত্যুর পর একদম একা হয়ে গিয়েছিলাম। কি ভালোবাসা নিয়ে বাবা আমাকে মানুষ করেছিল। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবাই আমার সব কিছু ছিল। প্রার্থনা করি তোমরা দুজন যেখানেই থাকো আল্লাহ যেন তোমাদের ভালো রাখে। আমার পক্ষে চাকরিটা আর করা হয়নি। মানুষ গুলো কি পরিমান ভাবে আমাকে ঘিরে ধরেছিল আমি একটু একটু করে বুঝতে পেরেছিলাম। সি-এ কমপ্লিট করার পর নিজ থেকেই চাকরিটা ছেড়ে এ দেশের মানুষ গুলোর উপর মান অভিমান নিয়ে আমি পারি দেই ফ্রান্সে। ফ্রান্সের প্যারিসের রাস্তায় প্রতিদিনের চলাচলে সমগ্র পৃথিবীর থেকে গমন করা মানুষদের পদচারন দেখতে পেতাম আমি। তাদের মাঝে আমি বাংলার মানুষের মুখ খোঁজার চেষ্টা করতাম। খোঁজার চেষ্টা করতাম বাংলা ভাষায় মনের মত কথা বলার। প্যারিস শহরের একটা এজিওতে কাজ করি। মাঝে মাঝে আসাদ ভাই এর কথা মনে পড়তো। তার সাথে আমার আর যোগাযোগ নেই। সব আলো যেন আমার চারপাশ থেকে নিভে গিয়েছিল। পাঁচ বছর ওখানে থাকার পর কেন যেন আমার দেশ আমাকে খুব কাছে টেনেছিল। বাবা মায়ের স্মৃতি গুলো সব সময় আকড়ে ধরেছিল।
.
দেশে ফিরেই অধিতির সাথে আমার দেখা হবে এটা আমি আশা করিনি। ব্যাংকে কিছু পার্সোনাল কাজের জন্য যখনযাই সেখানে আমি তাকে দেখতে পাই। জানলাম সে ওখানে কাজ করে। তার সাথে যখন আমার কথা হয় সে বলে “আমি জানতাম আশিক সাহেব আপনার সাথে আমার কোন একদিন আবার দেখা হবে। কোথায় চলে গিয়েছিলেন কোন কিছু না বলে? এভাবে কেউ না বলে উধাও হয়?” আপনি কেমন মানুষ বলেন তো?” আমি শুধু চুপ করে মুখে একটু হাসি নিয়ে তাকে বলি “কেমন আছো?” ওদের ব্যাংকের নিচ তলার ক্যান্টিনে গিয়ে তার সাথে অনেক্ষন কথা বলেছিলাম। আমার ফ্রান্সের শহরের কথা জানাই তাকে। কিন্তু তাকে জানালাম নিজ দেশের মত আর কোন দেশ হয়না।আমি তার চেহারার মাঝে একটা অপূর্ণতার ছাপ পেয়েছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম সে ভাল নেই। আমি তাকে বলি “তোমাদের কথা বলো” সে জানায় তার একটা মেয়ে আছে। নাম আনিতা। কিন্তু তার মনে এক ধরনের বিষন্নতা গ্রাস করেছিল দিব্বি আমি বুঝতে পেরেছিলাম। অনুভূতি গুলো কোথায় যেন জমাট বেধে আটকে পড়ে আছে। শূন্যতার শহরের মাঝে ঘুমন্ত হয়ে পথ গুলো অতিক্রম করছে অধিতি। তার সেই বিষন্নতার আহত মনে আমায় জানায় তার স্বামী আর নেই, ঈশ্বর একটা দূর্ঘটানার কারন দেখিয়ে তাকে অপারে নিয়ে যায়। চারপাশে যেন নিরবতা ছড়িয়ে যায়। আমি চুপ করে থাকি। সে চোখের কোনের জল মুছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলে “বাদ দিন এসব কথা, আপনার বউ দেখতে কেমন?” আমি তাকে হাসতেই হাসতেই বলি সেই কপাল এখনো হয়নি।
.
একবার সাদেকুর রহমান চাচার কথা মনে পড়তেই উনার সাথে দেখা করতে গেলাম। কিন্তু তার সাক্ষাত আমি পাইনি। গত বছর শীতের মাঝামাঝি সময়ে ইন্তেকাল করেছেন। তিনি যাদের জন্য এতো বছর অপেক্ষা করেছিল নিশ্চয় অপারে গিয়ে তার ছোট্ট নিশি ও স্ত্রী মারিয়াম বেগমকে খুঁজে পেয়েছে। আমি সাদেকুর রহমান চাচাকে মন থেকে সালাম জানালাম আর বললাম “চাচা যতদিন বেঁচে থাকি এই আশিক তোমাকে মনে রাখবে কথা দিলাম।”
.
অধিতির সাথে আমি আবার দেখা করলাম। এই মুহুর্তে আমি অধিতি আর তার তিন বছরের ছোট মেয়ে আনিতা রয়েছে। গতকাল রাতে যখন ওকে ফোন করে বলেছিলাম “আগামীকাল তো তোমার ছুটি, ছুটির দিনে কোথাও যাও না?” সে বলে “এখন আর ইচ্ছা হয় না আশিক সাহেব।” আমি তাকে বললাম “আমার সাথে যাবে” সে চুপ করেছিল। খানিক বাদে বললো “কোথায় যাবেন?” আমি বললাম “পতেঙ্গা।”
.
আনিতাকে কোলে নিয়ে খালি পায়ে আমি সমুদ্রের পারে হাটছি। সমুদ্রের ঢেউ পা ভিজেয়ে দিচ্ছে। অধিতিও চুপ করে হাটছে। আমি তাকে বললাম “এইভাবেই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিবা?” সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উড়ন্ত চুল কানে গুজে বলে “তাছাড়া যে আর কিছুই করার নেই” আমি তাকে বলি “যদি কেউ দ্বিতীয়বার তোমার হাত ধরতে চায় তাকে কি সুযোগটা দিবা?” সে থমকে যায় হাটা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে “আমার জন্য এখন কেউ করুনা করুক এটা আমি চাই না। আনিতার বাবা হয়তো আমার মাঝে নেই কিন্তু ওর জন্য আমার সমস্ত কিছুতেই রয়েছে অগাড় ভালোবাসা। এটা আমি কাউকে দিতে পারবো না। হ্যাঁ আনিতার বাবা আমাদের মাঝে নেই কিন্তু এই যে আনিতার মাঝে ওর বাবাকে আমি দেখতে পাই। আমার মেয়েকে নিয়েই বাকিটা পথ কাটিয়ে দিব। কিন্তু আমার জীবনে দ্বিতীয় একজন যদি কেউ আসে বিশ্বাস করুন আশিক সাহেব তার প্রতি আমার কোন অনুভূতি কাজ করবে না এমনকি কোন ভালোবাসা জন্মাবে না। কারন আমার সব কিছুতেই আনিতা বাবা জুড়ে রয়েছে।”
.
অধিতি একটানা কথা গুলা বলে থামে। তার সেই একটানা বিশাল লাইন একসাথে বলার ধরণটা এখনো রয়ে গেছে। একটু চুপ করে থেকে আবার বলতে লাগলো “আপনার কথা গুলো আমি বুঝতে পেরেছি আশিক সাহেব।দ্বিতীয় বার যদি ঈশ্বর আবার পুন জন্ম দেয় তখন আমি ঈশ্বরকে অনুরোধ করবো আমাকে যেন মুসলিম ধর্মের বংশের মানুষ করে পাঠায়, আমি জানি না দ্বিতীয়বার পাঠাবে কিনা। যদি পাঠায় কথা দিচ্ছি আপনার হাতটাই আমি প্রথম ধরবো। আমার সমস্ত কিছুতেই তখন আপনার প্রতি অনুভুতি তৈরি করবো। কিন্তু এখন আমি পারবো না। কারন আনিতার বাবাই আমার সব কিছুতে মিশে আছে।” অধিতির এমন কথা শুনে তার প্রতি আমার সম্মানটুকু বেড়ে গেল। একটা মানুষকে এই রকম ভাবে চাইতে পারে আমার ধারনা ছিল না। মনে ভালো লাগা কাজ করে এমন পবিত্র ভালোবাসার কথা শুনলে। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই হেসে আনিতাকে কোলে করে নিয়ে হাটছি। এই প্রসঙ্গে আমার আর কথা বলার ইচ্ছা নেই। আমি অধিতির কোলে আনিতাকে দিয়ে বললাম “দেখি এই পাশে দাঁড়াও তোমাদের একটা ছবি তুলি।” আমি ছবি তুলি, সে ছবিতে মা মেয়ের কি চমৎকার হাসি ফুটে ওঠেছে। এই হাসির মাঝে একটা পবিত্র ভালোবাসার ঘ্রান পাচ্ছি আমি। আমারো বিশ্বাস অধিতির মত আমার জীবনে কেউ একজন আসবে। অধিতির মত আমায় অনুভব করবে ভালোবাসবে তার সমস্ত কিছুতেই আমি থাকবো। সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম…
.
বিঃদ্রঃ এই গল্পটা আশিক ভাইয়ের জন্য। অফিসে আমাকে বলেছিল “ধরেন একটা মেয়ে আছে। মেয়েটা দেখতে চমৎকার। টুকটাক কথা হয় তাও খুব কম মাঝে মাঝে। অল্প দিনের পরিচয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মেয়েটা হিন্দু তাই আর আগ বাড়াইনি। এই থিম টা দিলাম এবার আপনি আপনার মত তৈরি করেন।” আমি আমার মত লিখলাম আশিক ভাই। কি রকম হয়েছে জানি না।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে আগস্ট, ২০১৮ সকাল ৯:৩৩

রাজীব নুর বলেছেন: পৃথিবীর পেছনে না ছুটে আপনজনদেরকেই নিজের পৃথিবী বানান। না হলে দিনের শেষে আপনার চাইতে একা আর কেউ হবেনা।

এরপর একদিন হঠাৎ থেমে যেতে হবে; হয়ত সেই দিনটা খুব তাড়াতাড়িই আসবে।

২| ২৯ শে আগস্ট, ২০১৮ সকাল ১০:৩৭

মোঃ ফখরুল ইসলাম ফখরুল বলেছেন: জাস্ট ওয়াও :-B

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.