নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার গল্পটা হোক পৃথিবীর সেরা গল্প ।কারন আমি হতে চাই একজন সত্যিকারের জীবন শিল্পী ।

নুরুন নাহার লিলিয়ান

নুরুন নাহার লিলিয়ান › বিস্তারিত পোস্টঃ

উপন্যাস"অরোরা টাউন" পর্ব ১৩ নুরুন নাহার লিলিয়ান।

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৩৫




অরোরা টাউন
পর্ব ১৩
নুরুন নাহার লিলিয়ান।

রেস্তরাঁয় সন্ধ্যার দিকে প্রচুর লোকের আগমন হয়।কারন জাপানিরা ডিনার করে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে। এরপর আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টার মতো সময় লোকজনের সমাগম কম থাকে।তারপর আবার লোকজনের সমাগম বাড়তে থাকে।

অরুনিমা সন্ধ্যায় রেস্তরাঁয় ঢুকতেই দেখলো সেই কোনার চেয়ারটাতে রেশমা উবুকতা বসা। নিরবে বসে আগের স্টাইলে বই পড়ছে। আর কিছুক্ষন পর পর অল্প করে খাবার অর্ডার করছে।
সন্ধ্যায় ভিড়ের মধ্যে রেশমার সামনে যেতে পারেনি। ওদিকটায় নেপালি স্টাফের দায়িত্ব ছিল।

না গেলেও এখন একটু কম মানুষের আনাগোনা।দুই তিনটা টেবিলে লোকজন বসা। অরুনিমা মনে মনে ভাবছিলো সে নিজে থেকে তার কাছে যাবে না। কারন সে এখন রেস্তরাঁর অতিথি। গায়ে পড়ে আন্তরিকতা দেখানো ঠিক হবে না।
সে নিজের মতো কাজ করে যাচিছল। হঠাৎ কে যেনো ডাকলো। পেছন দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখে সে সত্যিই তাকে ডাকছে।

মনে মনে তাকে নিয়ে জমিয়ে রাখা কৌতুহল গুলো একটু একটু করে জীবন্ত হয়ে উঠছে। সেদিন অনেক প্রশ্ন আর কৌতুহল সাথে করে নিয়ে সে চলে গিয়েছিল।

অরুনিমা কাছে যেতেই একটা আন্তরিক হাসি দিল। সেই সাথে চোখের চশমাটা ও গুছিয়ে পড়ে নিলো।
তারপর খুব আপন করেই জিজ্ঞেস করলো “কেমন আছো?
অরুনিমার ভীষন ভালো লাগলো।সাথে সাথে সে ও আন্তরিকতা নিয়ে উত্তর দিল,” জী। ভালো আছি। আপনাকে অনেক দিন পর দেখলাম। ”
রেশমা বলল,” হুম। এইদিকে বেশি আসা হয়নি। মাঝে একটু টোকিও গিয়েছিলাম।”
অরুনিমা আন্তরিকভাবে বলল,” আপনাকে মনে মনে খুজেঁছি। ”
রেশমা একটু ভঙিতে আপন সুরে বলল,” ওহ! আমিও তোমার কথা ভেবেছি। কিন্তু কেন জানি আসা হয়নি।”
অরুনিমা বলল,” আপনি মনেহয় কোন কাজ করছিলেন। ”
রেশমা টেবিলে রাখা কাগজ পত্রের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল,” হুম। একটু কাজ করছিলাম। শিক্ষকতার সাথে বই ও অনুবাদ করি। ”
অরুনিমা বলল,”কি অনুবাদ করেন?”
রেশমা বলল,” এখন একটা জাপানি উপন্যাস কে ইংরেজিতে অনুবাদ করছি। ”
অরুনিমা বলল,” আপনার সাথে পরিচিত হয়ে গর্ব হচেছ।”
রেশমা একটু লজ্জা পেলো। ম্লান হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে রইলো। অরুনিমা এদিকে রেস্তরাঁর ভিতরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো। এর মধ্যে ম্যানেজার কোন একটা কাজে বাইরে বের হয়ে গেছে।

নেপালি দুজন স্টাফ সামনের
গেটে দাড়ানো।আজকেও তেমন কোন গেস্ট নেই। সামনের গেটের বাম পাশের টেবিলে দুজন গেস্ট আছে। আর এই দিকে অরুনিমা। ম্যানেজার চলে যাওয়াতে অরুনিমা মনে মনে ভীষন খুশি হলো। এবার একটু সিরিয়াস হয়ে কাছে দাড়ালো। একটা গভীর নিরবতা চারিদিকের থমথমে পরিস্থিকে আগলে ধরেছে।
অরুনিমার মনে নানা রকম কৌতুহল।মনের এক দিক থেকে অন্য দিকে দৌড়াদৌড়ি করছে।ম্যানেজার চলে যাওয়ার পর অরুনিমা এবং নেপালি স্টাফ গুলো যেনো ফ্রি মুডে আছে। ব্যাপারটা রেশমা ও বুঝলো।
সে হাসি হাসি মুখে আন্তরিকতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাদের ম্যানেজার কোন সন্দেহ করে না? ”
অরুনিমা ফের জিজ্ঞেস করলো, ” কেনো বলুনতো? ”
রেশমা বলল,” এই যে স্বাধীন ভাবে তোমাদের রেখে গেলো।ফিরে এসে কোন সন্দেহ করে না? ”
অরুনিমা বলল,” না। মনেহয় করে না। কারন গোপনে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। ”
রেশমা একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বলল,” সন্দেহ হলো আগুনের মতো সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়। ”
অরুনিমা বলল,” সত্যি কথা। ”
রেশমা বলল,” বাইশ বছর আগে প্রফেসর বরের সাথে এই নৈসর্গিক দ্বীপে এসেছিলাম। দুই বছর সুখের সংসার করলেও অবিশ্বাস আর সন্দেহ সেই সংসার তছনছ করে দেয়।”
অরুনিমা বিস্ময়ে তার দিকে তাকায়। তারপর শীতল কন্ঠে বলে, ” আমি সত্যি দু:খিত। ”
রেশমা বলল,” তুমি দু:খ প্রকাশ করছো কেনো?আমি নিজ থেকেই বলছি। এটাই জীবনের কঠিন সত্য। ”
অরুনিমা জিজ্ঞেস করলো, ” এরপর কি হয়েছিলো?”
রেশমা বলল,” এক সময় আমি আইনের আশ্রয় নেই। তৈরি হয়ে নিজেকে নিয়ে নতুন জগৎ।”
অরুনিমা বলল, ” আপনাকে একা একা অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ”
রেশমা চোখের চশমাটা এবার খুলে টেবিলে রাখলো। তারপর বলল,” নিজের পুরো দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়েছে। পুনরায় পড়াশুনা শুরু করা।স্কুলের চাকরি নেওয়া।নতুন করে নিজেকে সাজানো।”
অরুনিমা বলল,” শুনেছি এই সব ব্যাপারে জাপানিরাও আগে বেশ রক্ষনশীল ছিল।”
রেশমা অনেকটাই আবেগ প্রবন হয়ে উঠলো, ” খুব খুব কঠিন ছিল। নিজের জীবনের গল্পটা অনেক প্রশ্ন তৈরি করে ছিল। সমাজে সে গল্পকে ঘিরে নানা রকম প্রশ্ন আমাকে আরও বেশি কষ্টে ফেলে দিতো। তাই চেনা মানুষ আর জগৎ ছেড়ে আড়ালেই জীবন শুরু করি। ”
অরুনিমা ভীষন কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে রেশমা উবুকতা কি করে হলো?”
রেশমা নিরুত্তাপ উত্তর দেয়, ” অনেক দিন পর আমার জীবনে জাপানি চিকিৎসক সঙিগ আসে। কিন্তু দূর্ভাগ্য তাকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। একটা রোড এক্সিডেন্ট আমাকে আবারও কষ্টের সমূদ্রে ডুবায়। ”
অরুনিমা মাথা নিচু করে রইলো। তারপর সান্ত্বনার কন্ঠে বলল,” আপনি অনেক ব্যক্তিত্ববান একজন মানুষ। আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইলো। ”
কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বলল,” যে জীবন একাকীত্ব ভালবাসে সে সঙ্গী আশাও করে না। ”

কথা গুলো বলতে বলতে সে সব কিছু গুছাতে লাগলো। চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো।
অরুনিমা একটা কঠিন ধাক্কা খেলো মনে। রেশমার জীবনের ভয়ংকর গল্পটা খুব গভীরভাবে মনে দাগ কেটে গেলো। মনের ভেতরটা কেমন ভারী হয়ে উঠলো। জীবন নিয়ে অনেক ভাবনা আর ভয় আকঁড়ে ধরলো। চেনা সমাজ থেকে দূরে কতো অভিজ্ঞতা চোখের সামনে ধরা দেয়। কেমন করে একটা মানুষ ধীরে ধীরে অন্য সমাজের একজন হয়ে উঠে। ঘটনাগুলো জীবনের গল্প পাল্টে দেয়। আর জীবনের গল্প গুলো দেয় অভিজ্ঞতা।
এর মধ্যে অরুনিমার ও কম অভিজ্ঞতা হয়নি। অনেক রকমের পরিবার বিচিত্র জীবন যাপনে সময় পার করছে পৃথিবীর পথে পথে। অরোরা টাউনে অনেক বাংলাদেশি আসে।

অরুনিমার কাজটা কেউ কেউ সম্মানের সাথে দেখে। কেউ কেউ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। জীবনের অর্থ সব মানুষের কাছে সমান নয়। সব মানুষের চিন্তা এক নয়।
এই জীবন সহজ কোন বিষয় নয়। এই জীবনটা যুদ্ধের। আর যুদ্ধ করেই এগিয়ে যেতে হবে।কাজ শেষে বিষন্ন একটা মন নিয়ে সে রেস্তরাঁ থেকে বের হলো। তাঁর গল্পটা না জানলেই হয়তো ভালো হতো। ট্রেনটা আজ তাড়াতাড়ি এসেছে। আজকে সাইকেলটা স্টেশনের সামনের নির্দিষ্ট স্থানে রাখা।সেখান থেকে সাইকেলটা নেওয়ার জন্য এক স্টপেজ আগে নেমে গেল। নিজের সাইকেলটা নিয়ে আপন মনে হেটে যাচিছল।
কিছু দূর যেতেই এক পরিচিত কন্ঠে গান ভেসে আসছিলো।

সাকুরা সাকুরা
ইয়া য়োই নো সোরা ওয়া
মিওয়া তাসু কাগী-রি কাসুমি কা খুমো কা?
নিওই যো ইজুরু
ইযায়া ইযায়া
মিনি ইউ – কান।

অর্থাৎ চেরী চেরী
আকাশে যত দূর দেখা যায়
শুধু চেরী আর চেরী
এমন সুগন্ধ কোথা থেকে আসছে?
মেঘের মাঝ থেকে না কুয়াশার মাঝে থেকে?
এসো, এসো আমরা সাকুরা দেখতে যাই।

চেরী ফুলের দেশ জাপানে সাকুরা, সাকুরা গানটা সর্বত্র গাওয়া হয়। লোকমুখে শোনা যায় এই গানটা এতোই জনপ্রিয় যে শিশুরা আব্বা,আম্মা বলতে শেখার পরই সাকুরা, সাকুরা এই গানটা শুনতে শুনতে শেখা শুরু করে।আর এই গানটাই পিংকি গাইতে গাইতে সাইকেল নিয়ে অরুনিমার কাছে এসে থামলো।পিংকিকে দেখে অরুনিমা হেসে দিলো।
তারপর বললো, ” তোমার গানের কন্ঠ খুব সুন্দর।
পিংকি ও হেসে দিলো, ” আপু জাপানে এটাতো খুব জনপ্রিয় সাকুরা গান। রাতে নিরব রাস্তায় নিজেকে সঙ্গ দিতে এই গানটা গাই। ”
অরুনিমা বলল,” হুম। খুব ভালো বুদ্ধি। চারিদিকে এতো চেরী ফুল। মনের অজান্তে এমনিই গান চলে আসে। তাই না?”
পিংকি বলল,” একদম সত্যি।মার্চ থেকে মে মাস হোক্কাইডোতে বসন্ত থাকে। কতো যে আয়োজন। মারুয়ামা পাহাড়ে বাংলাদেশ কমিউনিটি থেকে হানামি ফেস্টিভ্যাল মানে সাকুরা উৎসবে সবাই যাচেছ। সেখানে বারবি কিউ পার্টি হবে। আপনি জয়েন করছেন তো?
অরুনিমা বলল,” হুম। সবাই গেলে তো যেতেই হবে। ”
পিংকি বলল,” রবিবার ক্লক টাউয়ারের সামনে থেকে সবাই বাসে উঠবে। ”
অরুনিমা জিজ্ঞেস করলো, ” তুমি কি যাচেছা? ”
পিংকি উত্তর দিলো, ” যাবো। সেদিন আমার আর বরের দুজনেরই ডে টাইমে কাজ নেই।সেখান থেকে এসে বিকেলে কাজে যাবো। ”
অরুনিমা জিজ্ঞেস করলো, ” ক্লান্ত হয়ে যাবে না?”
পিংকি বলল,” মাত্র দুই ঘন্টার কাজ। সমস্যা নেই। ”
অরুনিমা বলল,” রেস্তরাঁয় রবিবারটা আমার বেশ ব্যস্ততায় কাটে। অবশ্যই ডে টাইমে আমার কাজ নেই। ”
হঠাৎ পিংকি প্রসঙ্গ পাল্টে দিয়ে বলল,”আপু আমার স্কুলে ইন্টারন্যাশনাল ডিভিশনে ইংরেজি শিক্ষক লাগবে। আপনি জয়েন করতে পারেন। ”
অরুনিমা বলল, ” আমি তো ইংরেজি নেটিভ স্পিকার না।”
পিংকি বলল,” আমিও কিন্তু নেটিভ স্পিকার না। তবে বাচ্চা পড়ানোর কাজটা আমি বেশ ইনজয় করি। আগ্রহী হলে আপনি যোগাযোগ করেন। ”
অরুনিমা আন্তরিকতা নিয়ে বলল, ” স্কুলের চাকরি হলে আমার জন্য ভাল হয়। ফ্রি টাইমে পড়ে তোমার সাথে এই বিষয়ে কথা বলবো।”

তারপর দুজনে পাশাপাশি সাইকেল নিয়ে হাঁটতে লাগলো। প্রতিদিনের সহস্র অভিজ্ঞতাময় জীবনের গল্প নিয়ে ঘরে ফেরা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.