নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

Keep on the sunny side of life

শব্দ খুঁজি, সৃষ্টির অদম্য নেশায়

অক্টোপাস পল

সবই পারি, ভবিষ্যৎবাণী ছাড়া! (c) জিশান নিয়াজ

অক্টোপাস পল › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ পুতুল

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:৩৯

গ্রাম হিসেবে নবদিগঞ্জ আহামরি কিছু নয়। এ গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। সোঁদা বৃষ্টির পর স্যাঁতস্যাঁতে মাটির বুকে জন্মানো অসংখ্য ব্যাঙের ছাতার মতো হাতে হাতে পৌঁছেনি মোবাইল ফোন। গ্রামের বৈশিষ্ট্য বলতে আছে একটা নদী। ঘাঘট তার নাম। বড্ডো অকমনীয় তার রূপ। প্রবল বর্ষণে এ নদীতে ভাঙনের ধুম ওঠে। বিপুল জলরাশি একরাতেই আকণ্ঠ ডুবিয়ে দেয় নিকটস্থ জনপদ। নদীর জল গ্রামের পুকুর উপচিয়ে অবাধ্য বিপ্লবীর মতো মুক্ত করে সহস্র মাছের ঝাঁক। রাক্ষুসে বোয়ালের মতো প্রকান্ড হা করে গিলে ফেলে বসতভিটে, নারকেল-সুপুরির বাগান, আউশের ধানক্ষেত কখনোবা কেউটের গর্তসমেত বুড়ো বটগাছ।

শীত এলে ঘাঘট বদলে যায়। বাঁশের সাঁকো নদীর দু’পাড়কে যুক্ত করে। তীরবর্তী বালিয়াড়িতে লুটোপুটি খায় সাইবেরিয়ান হাঁস। বদলে যায় মানুষের জীবনও। উত্তরের বাতাসে বয়ে আসা কুয়াশার মতো আস্তে আস্তে গাঢ় হয় জীবনের রহস্যময়তা। আড়মোড়াভাঙ্গা আধো আলস্যে চঞ্চলতা আনে মেলার এলান। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ব্যাপার সেটি। বাঁশির সুর, ঢোলের বিস্তর উন্মাদনা শান্ত গ্রামবাসীর অনভ্যস্ত হাঁটুতে উদ্দাম নাচের অনুপ্রেরণা যোগায়। এই মেলা কবে শুরু হয়েছিল তা কেউ জানেনা। তবে, সে সময় এখনকার মতো জুয়ার বাড়াবাড়ি ছিলনা তা বোধহয় নিশ্চিত বলা যায়। থানার ওসি, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার থেকে গ্রামের বখাটে ছেলেপুলে সবাই দুহাতে কামিয়ে নেয় মেলার মৌসুমে। বাচ্চাদের জন্য মেলা খেলনা-মিষ্টিতে ডুবে থাকার। মেয়ে-বউদের জন্য সস্তা প্রসাধনে শরীর রাঙানোর। পুরুষদের জন্য সেটি জুয়ার মৌসুমী উপার্জনের। কখনো কখনো সব হারিয়ে কপাল চাপড়ানোর।

একটা নতুন সংযোজন আছে এবারের মেলায়। পুতুল নাচের দল আসছে। এ নিয়ে বড়দের মধ্যে কৌতূহল থাকার কথা নয়। কিন্তু সদরুল চেয়ারম্যান নিজে এই দল আনার পেছনের কলকাঠি নেড়েছেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের গদিনসীন ব্যক্তিটি সম্ভবত অর্থোপার্জন ছাড়া কিছু জানেন না এবং সেটি দেশের আইনের সাথে সঙ্গতি রেখে নয় অবশ্যই। এজন্য কোন অনুশোচনাও নেই সদরুলের।

মেলায় আগত দলটির নাম “নিউ বর্ণালী পুতুলনাচ”। বাইশ বছর ধরে নানা রঙের মানুষদের একাট্টা করে দলটি টিকিয়ে রেখেছেন প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল ওস্তাদ। গুরু সমীরণ পালের শেখানো বিদ্যা আলগোছে হস্তান্তর করেছেন প্রজন্মান্তরে। বয়স হয়েছে সিরাজুলের। নয় সদস্যের দলটি ঘিরেই তার বেঁচে থাকা। আঙুলের যাদুতে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা বড় সহজ ব্যাপার নয়। তাদের কামনার গোপন ভাঁড়ারের সুড়সুড়ি দেয়াটাও জরুরী। দলের হয়ে সে কাজটি করে তিনজন নারী। পুতুল নাচের ফাঁকে মেয়ে না নাচালে জোটে গ্রামবাসীর বিস্তর গালাগালি। কখনো কখনো শারীরিকভাবেও হতে হয় লাঞ্ছিত। নিষ্প্রাণ পুতুলের নাচানাচি দেখার চেয়ে চটুল গানের সাথে শরীরের অনাবিষ্কৃত মেদ-মাংসের উদ্দাম উন্মোচন বুভুক্ষু মানুষের রক্তে জাগিয়ে দেয় আদিমতম প্রবৃত্তি। হ্যাজাক লাইটের অবিশ্বস্ত আলোর ওঠানামার সাথে সাথে বাড়ে-কমে মানুষের কামনার উদগ্রতা। নারীদেহের এমনই আকর্ষণ!


হিসেবের জটিল ধাঁধায় উতরাতে ব্যর্থ হলে জীবন আবির্ভূত হয় কঠিনতম রূপে। আলামিনের জন্য সেটা আরো কঠিনতর কিছু। বারো বছর বয়সে বাড়ি পালিয়ে এ দলের সাথে যুক্ত হয়েছিল সে। তারপর এখানেই গড়েছে জীবন। বিয়ে করেছে দলেরই নর্তকী শিউলিকে। দেড় বছর বয়েসী একটি মেয়েও আছে তাদের। আলামিন দলের পাহারাদার। ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে এ পদে উন্নিত হয়েছে সে। সিরাজুল ওস্তাদের খুব কাছের মানুষ সে। রৌমারীর চরে তাদের দলের ওপর আক্রমণ করা হয়েছিল ওয়াজ মাহফিলের মাইকে ঘোষণা দিয়ে। আলামিন নিজে প্রচণ্ড প্রহৃত হলেও তার ওস্তাদকে অক্ষত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়াও কামোন্মাদ জনতার বেমক্কা বিশৃঙ্খলা সামলানোর জন্য তার গাঁট্টাগোট্টা শরীর যথেষ্ঠ। অথচ উচ্ছৃঙ্খল পুরুষের অণ্ডকোষে নির্দয় লাথি কষানো মানুষটি আশ্চর্য কোমল হয়ে যায় শিউলির কাছে, তাদের সন্তানের কাছে। প্রগাঢ় মমতায় সন্তানের অপরিণত অবয়বে খোঁজে মৃত মায়ের মুখ।

নবদিগঞ্জের মেলা হয় পৌষ মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার। ঘাঘটে তখন জলের জন্য তীব্র হাহাকার। মাছের দল নির্বংশ হয়ে তীরবর্তী জেলেদের জীবিকায় আনে ভাটার টান। ঘাটে নৌকার বদলে বাঁশের সাঁকোয় পারাপার হয় মানুষ। নদীতীরের বালিয়াড়ি ক্রমশ মিলিয়ে যায় বেপরোয়া বালি তোলার উৎসবে। সদরুল চেয়ারম্যান একে বলেন জনসেবা। খালি খালি নদীর বালি বর্ষায় ভাসিয়ে দিয়ে লাভ কী! তারচেয়ে এ দিয়ে গড়ে উঠুক ইমারত। রংপুর শহরের মহানগর হয়ে ওঠার পেছনে সদরুল চেয়ারম্যানের অবদান সোনার কালিতে লিখে রাখা উচিত। “জ্বী জ্বী চিয়ারমেন সাহেব” রব ওঠে মোসাহেব মহলে। সদরুল গর্বিত হন। চোখে জমা হওয়া দম্ভের মেঘে আশ্বিনের বান ডাকে।

কাল মেলার দিন। ব্যাপ্তি মাত্র একদিন হলেও কিছু প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। পুতুল নাচের প্যান্ডেল বানানো হয়েছে। দারোগা সাহেব সদলবলে মেলার পরিস্থিতি দেখবেন। তার মেহমানদারির জন্য যথেষ্ঠ প্রস্তুতির দরকার আছে। মেলার ঢোল পাঠানো হয়েছে দূরদুরান্তের গ্রামগুলোতে। মেয়ের জামাইরা উপস্থিত হয়েছে বাড়িতে। তারপর নানাকিছিমের ঝুটঝামেলা সামলে সদরুল চেয়ারম্যানের আসলে দম ফেলারও ফুসরত নেই। এরমধ্যে পুতুল নাচের দলটা এসে পৌঁছেছে সন্ধ্যায়। তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে গ্রামের স্কুলটায়। সবকিছুই সামলাতে হচ্ছে তাকে। দুইটা ছেলে জন্ম দিয়েছেন তিনি। সারাদিন মটর সাইকেলে ফটফট করে ঘোরা আর ফেন্সিডিল গিলে ঘুমানো ছাড়া তাদের দিয়ে কোন কিছু হয় না। তাদের চেহারা মনে হলে চেয়ারম্যান সাহেব মনে মনে মুখ খারাপ করে গালি দেন। এমন সব গালি জনসম্মুখে কোন বাবা উচ্চারণ করেন না।

পুতুল নাচের দলটা আসার খবরটা গ্রামে চাউর হয়ে গেছে। উৎসুক শিশুর দল তাদের ক্লাসরুমের জানালায় ভীড় করে দেখছে অচেনা মানুষদের। গ্রামের ছেলেপেলের দল তাদের বারবার তাড়িয়ে দিচ্ছে। শিশুদের ধরনা এই মানুষগুলোই নাচের সময় ছোট্ট পুতুল হয়ে যায়। গলাধাক্কা দিলেও এই অদ্ভুত মানুষদের কাছ থেকে তারা নড়বে না। খানিকটা চোরপুলিশ খেলা চলে তাদের ও যুবকদের মাঝে। সিরাজ ওস্তাদ পান চিবাতে চিবাতে এইসব দেখেন। কাল চারটা শো করবে তার দল। বেশ প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। সন্ধ্যায় আবার রওনা হতে হবে শেরুডাঙ্গার মেলার উদ্দেশ্য। যাযাবর জীবনের এই সুবিধা। পৃথিবীর সব প্রান্তকেই মনে হয় নিজের ঘর।


গুঁজে দেয়া স্তন মুখে নিয়ে একটানা কেঁদে যায় শিউলির মেয়েটা। কান্নার বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি। “এহ! সোয়াগ উথলি ওটছে চেংড়ির। বাপের আদর পায়া ত্যাল ধরছে নোয়ায়?” বছর দেড়েকের শিশুটা যেন বুঝতে পারে মায়ের অনুযোগ। হাঁপাতে হাঁপাতে ইতিউতি চায় বাবার খোঁজে। দৃষ্টিসীমায় তাকে না পেয়ে আস্তে আস্তে উদ্যোগী হয় স্তন পানে। শিউলির মন আপ্লুত হয় মাতৃসুলভ মমতায়। তার বানভাসি জীবনে এই প্রথম একটা পিছুটান জন্মালো। পুতুল সে নাচাতে জানে না, জানে না কীভাবে শিল্পীর দক্ষ আঙুলের শ্রেণীবদ্ধ নাচনে নির্জীব পুতুলে প্রাণের সঞ্চার ঘটে। তবে পুরুষ মানুষকে কীভাবে নাচাতে হয় সে বিদ্যা তার ভালোই জানা আছে। শিউলির নামের সামনে তাই যুক্ত হয়েছে “প্রিন্সেস” উপমা এবং অর্জিত খ্যাতি উপভোগে তার কোন অস্বস্তি নেই। পুতুল নাচে সিরাজুল মিয়া ওস্তাদ হলে নৃত্যকলায় শিউলিকেও ওস্তাদ মানতে হবে।

ভাবনায় তন্ময় শিউলির ধ্যান ভাঙে সিরাজুল ওস্তাদের গলা খাঁকারিতে। শিশুটিকে আঁচলে লুকিয়ে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় ওস্তাদের দিকে। “চিয়ারমেন সাহেব হামার শো দেইখপার চাইছে বাহে। দারোগা সাহেবও থাকপে। তোমারগুলাক আইতোত একনা নাচ দেখান নাগবে।” শিউলি অবাক হয়। বিয়ের পর এমন প্রাইভেট শো করা যে সে ছেড়ে দিয়েছে তা ওস্তাদের অজানা নয়। তাছাড়া তার কোলে এখন শিশুকন্যা। আলামিনও এসব পছন্দ করে না। “ওস্তাদ মুই নাচিলে বেটির বাপ গোস্বা হইবে। এস্টেজোত না হয় নাচিম কিন্তু খালি ওমার জন্যে নাচিম...।”
চিন্তিত মুখে সিরাজুল শিউলির দিকে তাকান। এই নাচের বন্দোবস্ত তাকে করতেই হবে। জনপদ হিসেবে নবদিগঞ্জের কুখ্যাতি আছে। তার চেয়েও কুখ্যাত সদরুল চেয়ারম্যান নিজে। তিনি শিউলির নাচ দেখতে চেয়েছেন। এর অন্যথা করার সাহস বা শক্তি কোনটাই তার নেই। আলামিনকে বোঝানোর দায়িত্ব তিনি নেবেন। তাছাড়া এরা বড়লোক মানুষ। হাজার পাঁচেক টাকা দেবে। এই অভাবের দিনে দলের জন্য টাকাটার খুব প্রয়োজন। পিতৃস্নেহের ভঙ্গিতে শিউলির মাথায় হাত বোলান সিরাজুল। এমন পরিস্থিতিতে না বলার ক্ষমতা শিউলির নেই। সে রাজি হয়ে যায়।

মধ্যরাতের এলান ততক্ষণে হয়ে গেছে। পুতুল নাচের প্যান্ডেলে হ্যাজাক লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো জায়গাটা বিয়ে বাড়ির শামিয়ানা দিয়ে ঘেরা। মঞ্চের সামনে চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে আনা কিছু সুদৃশ্য চেয়ার পাশাপাশি বসানো হয়েছে। প্যান্ডেলের একটা অংশ ঘিরে বানানো হয়েছে ড্রেসিং রুম। সেখানে শিউলিসহ দলের আর দু’জন মেয়ে প্রসাধনে ব্যস্ত। আয়নার অপরিসর বিস্তারে আন্দাজ করে ঘসে ঘসে লিপিস্টিক লাগায় তারা। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মোছে আঁচলের ভাঁজে। মেলার জায়গাটা থেকে গ্রামের বসতি বেশ খানিকটা দূরে। গ্রামের যুবকের দল দূর থেকে আলোর উৎস দেখে বুঝতে পারে একটা কিছু সেখানে ঘটতে যাচ্ছে। কৌতূহলী কয়েকজন কাছে গিয়ে সদরুল চেয়ারম্যানের লোকদের ঝাড়ি খেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। নিজেদের আড্ডায় চেয়ারম্যানের সৌভাগ্যের মুন্ডুপাত করে তারা একের পর এক সিগারেট ধরায়। “সব সুখ দেখি বুড়ায় নিয়া নিলো!”

সদরুল চেয়ারম্যান ও তার অনুগত লোকজন আগে থেকেই প্যান্ডেলে উপস্থিত ছিলো। থানার দারোগার মটর সাইকেলের পরিচিত আলো দৃশ্যমান হলে তারা বাইরে এসে তাকে অভ্যর্থনা জানায়। দারোগা সাহেব শৌখিন মানুষ। তার জন্য ইন্ডিয়ান মদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আইন ভঙ্গের মধ্যে একটা বিমলানন্দ আছে যা কেবল ভাঙ্গলেই পাওয়া যায়। মদের নেশার চেয়েও সে নেশা মাদকতাময়, যৌনতার প্রবল সুখের চেয়েও আবেদনময়। নাচ শুরু হওয়ার পর সদরুলের নিজেকে সুখী সুখী মনে হতে থাকে। এই যে আজ তার এত ক্ষমতা, পায়ের কাছে পড়ে থাকা পুলিশের কর্তা এসব কী যথেষ্ঠ সুখের না? ভাবতে ভাবতে নাক চেপে আরেক পেগ মদ গেলে সদরুল। শিউলি ততক্ষণে স্টেজ মাতিয়ে নাচছে “রূপভানে নাচে কোমর দুলাইয়া”। শিউলির শাড়ির আবরণ ভেদ করে রূপের ছটা যেন শুদ্ধতম হীরকখণ্ডের মতো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। শরীরের অঙ্গভঙ্গিতে চড় চড় করে চড়িয়ে দিচ্ছে আদিম ক্ষুধা। বেসামাল হয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকে সদরুল।

মঞ্চে স্ত্রীর নৃত্য আগ্রহ নিয়ে দেখে না আলামিন। পাহারাদার হিসেবে তার দায়িত্ব সবকিছুর খেয়াল রাখা। স্ত্রী যতক্ষণ মঞ্চে থাকে ততক্ষণ সে বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানে। কখনো কখনো মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে জনতার উন্মাদনায় লাগাম দেয়। স্ত্রীর জনপ্রিয়তায় তার সন্দেহ না হলেও স্বস্তি হয় না ঠিক। সদরুল চেয়ারম্যানের আচরণ তার নজর এড়ায় না। লোকটার কুতকুতে চোখদুটো জুলজুল করছে কামনায়। দীর্ঘশ্বাস চেপে সিগারেটে দম দেয় সে।

দারোগা সাহেব নেশায় টলে পড়েছেন। তার নাক ডাকার শব্দে কেমন একটা ছন্দ আবিষ্কার করে ফেলে চেয়ারম্যান। অদৃশ্য একটা তবলায় তাল দেয়ার মতো করে সে মাতোয়ারা হয় অবর্ণনীয় সুখে। সিরাজুল ওস্তাদের উশখুশে উপস্থিতি তার ভাবনায় ছেদ ঘটায়। “চিয়ারম্যান সাহেব, হামরা আইজ যাই বাহে। কাইল শো করা নাগবে ম্যালা গুলা”। সদরুল চেয়ারম্যানের মুখে একটা হাসি এসে মুহূর্তেই মিলিয়ে যায় কঠোরতায়। “তোমরা যাইমেন যান। শিউলিক থুইয়া যান। উয়ার সাতে একনা গল্প করিম”। সিরাজুল সন্ত্রস্ত হন। কন্ঠে অনুনয় ঢেলে বলেন,“সদরুল ভাই, শিউলির বিয়া হইছে। দুধের ছৈল আছে একনা। উয়ার সোয়ামী আলামিন হামার দলের চৌকিদার। শিউলিক থুইয়া হামরা যাবার নই”। একটা সামান্য লোকের এত বড় অবাধ্যতা সদরুলকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে সে মুখ গলে বেরিয়ে আসা অশ্রাব্য শব্দগুলোকে আটকায়। নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যায় ড্রেসিংরুমের দিকে। সিরাজুল প্রায় দৌড়ে ধরতে যান সদরুলকে। “চিয়ারম্যান সাহেব, খোদার গজব পড়বে! দুধের বাচ্চার কসম!” ততক্ষণে আলামিন টের পেয়ে গেছে সদরুলের অভিপ্রায়। স্ত্রীর সম্ভ্রম বাঁচাতে এগিয়ে গেলে দুপাশ থেকে জনাচারেক শক্তিমান পুরুষ তাকে ময়াল সাপের মতো জাপটে ধরে। বৃষ্টির মতো কিলঘুষি উপেক্ষা করে সে চিৎকার করে পালাতে বলে শিউলিকে। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে পালাতে উদ্যত শিউলি ধরা পরে সদরুলের প্রসারিত বাহুতে। টেনে হিঁচড়ে সদরুল তাকে নিয়ে যায় ড্রেসিংরুমের আড়ালে। মুহূর্তেই অবোধ শিশুর কান্না, শিউলির গোঙ্গানি ও দারোগা সাহেবের নসিকা গর্জনে এক আশ্চর্য রাতের জন্ম হয়।

জ্ঞান হারানোর আগে আলামিনের নিজেকে পুতুল মনে হয়। অদৃশ্য সূতোয় বেঁধে যাকে নাচিয়ে যাচ্ছে খুব নিষ্ঠুর কেউ।

মন্তব্য ৩২ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (৩২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:৩১

এরশাদ বাদশা বলেছেন: অনন্য, অসাধারণ! মন্ত্রমুগ্ধের মতো একটানে পুরোটা পড়েছি। কিন্তু এই ব্লগে এখন মৌলিক লেখা কেউ পড়েনা, এই হলো সমস্যা।

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৯

অক্টোপাস পল বলেছেন: ধন্যবাদ ভ্রাতা। অনেক প্রশংসা করলেন। অন্তত গল্পটা আপনার কাছে পৌঁছুতে পেরেছে বলে আমি সুখী। ভালো থাকবেন।

২| ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:২২

দিশেহারা রাজপুত্র বলেছেন: চমৎকার। ভালো লাগা জানবেন।

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৪১

অক্টোপাস পল বলেছেন: ধন্যবাদ রাজপুত্র। সুস্থির ও সুন্দর হোক জীবন। :)

৩| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৫৪

এনামুল রেজা বলেছেন: পুতুলনাচ সংস্কৃতির কুৎসিত দিকটা অনেকেই জানেনা। ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন, আমাদের স্কুল মাঠে সার্কাসের দল এসেছিলো। তার সাথে পুতুল নাচের একটা দল।
পুতুল নাচের আসর বসতো সন্ধ্যার পর। কৈশোরিক কৌতুহলে বন্ধুরা মিলে চলে যেতাম মাঠে। পুতুল নাচের তাঁবুর আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম, বুঝবার চেষ্টা করতাম ব্যাপার কি? সবাই এমন চাদরটাদর মড়িয়ে মুখ ঢেকে কেনো তাঁবুতে ঢুকছে? পাহারাদারেরা চলে আসতো এরপর। খুকা, যাও যাও.. ওদিকি যাও!
আপনার গল্প পড়ে সেসব দিন সামনে চলে এলো ঠিক।

ভালো লাগলো। নিয়তির পুতুল যে মানুষ, এই নির্মম ব্যাপারটা খুব সুন্দর ফুটে উঠেছে।
শুভেচ্ছা।

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৩

অক্টোপাস পল বলেছেন: ধন্যবাদ এনামুল রেজা। আপনার কয়েকটা গল্প পড়লাম সেদিন। বেশ ভালো লেগেছে। আপনি কী এসএসসি ২০০৬ ব্যাচ?

৪| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:০২

মহান অতন্দ্র বলেছেন: গ্রামীণ জীবন ও সেখানের এক চিরাচরিত সমস্যা। সাথে পুতুল নাচের কথা। ভাল লেগেছে । লিখতে থাকুন।

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৫

অক্টোপাস পল বলেছেন: ধন্যবাদ মহান অতন্দ্র। শুভকামনা জানবেন। :)

৫| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ভোর ৫:১৬

বিদ্রোহী বাঙালি বলেছেন: আপনার প্রথম কোন গল্প পড়লাম মনে হয়। পড়েই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। গ্রাম বাংলার হারিয়ে যেতে বসা একটা অধ্যায়কে কেন্দ্র করে সমাজের নোংরা কীটদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন। সদরুল আর পুলিশের দারোগা তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করেছে গল্পে। কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল পুতুল নাচকে কিংবা যাত্রাপালাকে কেন্দ্র করে গ্রামের মোড়লদের আর পুলিশের নোংরামি।
আলামিন এবং পুতুলকে এক সুতোয় বেঁধে দিয়ে গল্পের শেষ মেসেজটা চমৎকার দিয়েছেন। আলামিনরা আসলেই সুতোয় বাঁধা কোন পুতুল যেন। যাকে অন্য কেউ নাচ্ছে। খুবই কষ্টের জীবন ওদের।
পুরো গল্পটাই বেশ উপভোগ্য। আপনার শব্দচয়ন এবং বাক্য গঠনও যথেষ্ট সুন্দর হয়েছে। বয়ানে প্রাসঙ্গিকভাবে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারও ভালো হয়েছে। অনেক ভালো লাগলো।

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৫২

অক্টোপাস পল বলেছেন: গল্পটা মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন বলে শুরুতেই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি বিদ্রোহী বাঙালী ভাই।

পুতুল নাচ অথবা যাত্রাপালা আমাদের আবহমান সংস্কৃতির অংশ। এগুলো হারিয়ে যাক তা কখনোই চাইনা। আর অশ্লীলতার সমস্যাটা আসলে দর্শকদের দাবি। একবার শীতের রাতে এক যাত্রাপালায় গিয়ে দেখি বিরাট হৈ হল্লা। দর্শক ভাংচুর করছে চেয়ার ও প্যান্ডেল। কারণ যাত্রায় কোন অশ্লীলতা নেই। বুঝুন অবস্থা!

অনেক ভালো থাকবেন ভাই। অনেক অনেক শুভকামনা।

৬| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১:৪০

হাসান মাহবুব বলেছেন: বেশ ভালো লাগলো গল্পটা।

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৩

অক্টোপাস পল বলেছেন: ধন্যবাদ হামা ভাই। বইমেলায় কী কী বেরুচ্ছে আপনার? কাল যাবো একবার ভাবছি।

৭| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:১৩

এনামুল রেজা বলেছেন: গল্প ভাল লাগলে সেটা আনন্দের।

আমি এসএসসি ২০০৭ ব্যাচের। কেন বলেন তো? :D

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৭

অক্টোপাস পল বলেছেন: এমনি জানতে চাইলাম। ভালো থাকবেন।

৮| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪০

সুমন কর বলেছেন: গল্পে গ্রাম্য একটি নোংরা বিষয় তুলে ধরেছেন।
ভাল লাগল।

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:২৯

অক্টোপাস পল বলেছেন: ধন্যবাদ সুমন। বিষয়টাকে ঠিক "নোংরা" বলা যাবে না। মানুষের জীবনকে যদি দর্পন মনে করেন তাহলে দেখবেন "নোংরা" ও "শুদ্ধের" একটা দ্বন্দ্ব আছে। এদের সংজ্ঞায়ন যে যার ইচ্ছে মতো করেছে। একে আদর্শ মানা না মানা বাকিদের নিজস্ব ব্যাপার। গল্পটাকে বরং বাস্তবের এক খন্ড বর্ণনা মনে করুন।

অনেক অনেক শুভকামনা। :)

৯| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১:০০

বৃতি বলেছেন: ভালো লাগা থাকলো গল্পটায় :)

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:৫০

অক্টোপাস পল বলেছেন: ধন্যবাদ বৃতি। নিরন্তর শুভকামনা।

১০| ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৩:৫৭

অদৃশ্য স্পন্দন বলেছেন: অসাধারণ লিখেছেন ভাই। আমার জ্ঞান খুব সীমিত তাই খুব বেশি কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই। তারপরও এই সামান্য জ্ঞানে বলতে পারি যে এমন গল্প একজন গল্প পিপাসুর তৃষ্ণা যথার্থই মেটাতে পারে।

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:৪৩

অক্টোপাস পল বলেছেন: আপনার মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। এত সুন্দর একটা নিকের মালিক হয়ে বলছেন আপনার জ্ঞান সীমিত!

অনেক ভালো থাকুন। :)

১১| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৩২

তুষার কাব্য বলেছেন: ভালো লেগেছে গল্প।

শুভকামনা।

১১ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১:৫৬

অক্টোপাস পল বলেছেন: ধন্যবাদ তুষার কাব্য।

অনেক ভালো থাকুন।

১২| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৫৩

শঙ্খচিল_শঙ্খচিল বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন! শুভ কামনা রইল।

১১ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১:৫৬

অক্টোপাস পল বলেছেন: ধন্যবাদ শঙ্খচিল।

আরো প্রসারিত হোক আপনার ডানা।

১৩| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:০২

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
গ্রামীণ পরিচিত প্রেক্ষাপটের লেখা হৃদয়ঘেষা ৷ বাস্তবতা ও সত্য মনে হয় অনেকসময় সাংঘর্ষিক ৷ শেষ দিকে মনে হল দ্রুত টেনেছেন ৷ তবে গল্পের মর্মস্পর্শী নৈবেদ্য সমাপ্তি ভাল লাগল ৷

১১ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১:৫৮

অক্টোপাস পল বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ জাহাঙ্গীর ভাই। একটু দ্রুতই বোধহয় শেষ হয়েছে।

অনেক ভালো থাকবেন।

১৪| ০১ লা মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৯

শায়মা বলেছেন: :(

১১ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১:৫৯

অক্টোপাস পল বলেছেন: অনেকদিন পর আপু! কেমন আছেন?

১৫| ১৬ ই মার্চ, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৭

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: অসাধারণ একটা গল্প!

এরকম গ্রামীণ মানুষের সংস্কৃতি এবং জীবন নিয়ে আরও গল্প আসা উচিৎ। আপনার কাছে আবদার করে রাখলাম।

প্রিয়তে।

২১ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ১২:৪৪

অক্টোপাস পল বলেছেন: ধন্যবাদ। শব্দের প্রকাশে অনেক আপ্লুত করলেন। অনেক ভালো থাকবেন ভ্রাতা।

আপনার চমৎকার গল্পগুলো থাকুক বিরামহীন।

১৬| ২৩ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ১১:১০

দীপংকর চন্দ বলেছেন: এতো নিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন দিক!!

বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের কথা মনে পড়লো কেন যেন!!

অনিঃশেষ শুভকামনা জানবেন ভাই।

ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক।

২৩ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ১১:৩৮

অক্টোপাস পল বলেছেন: আপনার কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। অনুপ্রেরণা দিয়ে কৃতজ্ঞ করে তুললেন।


অনেক ভালো থাকুন দাদা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.