নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অমিয় উজ্জ্বল

অমিয় উজ্‌জ্‌বল

অর্থ নয় কীর্তি নয় সফলতা নয় আরো এক বিপন্ন বিস্ময় অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে।

অমিয় উজ্‌জ্‌বল › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু...

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:৫০

###
তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিলনা। চিঠিতে লেখা হতো " কাজল - উজ্জ্বল - শেফালির বার্ষিক পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। তারা নানাবাড়িতে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়েছে....."।
আখাউড়া রেল স্টেশনে নেমেই আমরা নানা বাড়ির গন্ধ পেতাম।
গ্রামের পরিচিত রিকশাওয়ালা আম্মাকে দেখেই দাঁত কেলিয়ে বলতো - বুবাই (বুবুভাই- আম্মাকে সবাই কেন জানিনা এই ভাবেই ডাকে) আইছুইন? আমি আগেই খবর পাইছি আফনেরা আইবাইন।
একঘন্টা রিকশা চলার পর নানাবাড়ি।
পথে আসতে আসতে রিকশা ওয়ালা আব্দুল মালেক ওরফে মাইল্লা প্রায় সব কিছুর আপডেট দিয়ে ফেলতো। " বুবাই, নুইরা ফাগলা তো মইরা গেছেগা"।
###
আমাদের কাছে নানাবাড়ির অন্যতম আকর্ষণ ছিল ' নূরা পাগলা'।
নূরা পাগলা নোয়াগাঁও গ্রামের এক প্রভাবশালী চরিত্র। আমরা যেসময়টায় নানাবড়িতে যেতাম নূরা পাগলার তখন পাগলামির পিক টাইম, ফাল্গুন-চৈত্র মাস।
একেক পাগলের একেক নমুনা। নুইরা পাগলার নমুনা হলো তার গরম লাগে। একটা বক্সার আন্ডারওয়ার ছাড়া সে কিছু পরতোনা। আর সবাইকে ধমক ধামক দিত। হাতে থাকতো লাঠি। সবাইকে তেড়ে আসতো। গলার স্বর ছিল একদমই অন্যরকম। বাজখাঁই যান্ত্রব কন্ঠ। কথার সময় মনে হতো যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছে।
মহিলাদের দেখলেই বলতো " মাথাত কাফড় দেছনা ক্যারে"? ( মানে মাথায় কাপড় দিসনা কেন?) বলেই লাঠি নিয়ে তেড়ে আসতো। তবে কাউকে মেরেছে শুনিনি।
কেউ কেউ বলতো " তুমি দি হাপপ্যান পিন্দা ঘুর? নামাজ পড় নি? "
নূরা পাগলা জবাব দিত " আমি নামাজ পড়তাম ক্যান? আমার কইলজার ভিত্রে দুক দুক করে। আল্লাহু, আল্লাহু করে।"- এই বলে বুকের মধ্যে গায়ের সর্ব শক্তি দিয়ে একটা ঘুষি দিত। তারপর গুম গুম আওয়াজ করত।
সবাই ভাবতে শুরু করল নূরা পাগলা আল্লার ওলি। তার ভিতর কিছু আছে।
নূরা পাগলা অনেক কথা বলত। কিছু তার বুঝা যায়। কিছু যায়না।
শেখ মুজিবের কথা বলত। আবার বড়পীর সাহেবের কথাও বলতো।
" শ্যাখ মুজিবর আমার লগে একথালে বইয়া ভাত খাইছে। আহহা, মানুষটারে গুলি কইরা মারছে ঠ্য ঠ্য ঠ্য, ব্রাশ ফায়ার"।
" বড়পীর সাব আমারে সালাম দেয় ডেইলি সকালে। বাইগনের সালুন দিয়া রুটি খায়, আর আমারে ডাকে। আল্লা আল্লা আল্লা। "
তার এসব কথা বার্তা রহস্য তৈরি করত। কেউ কেউ বলত " নূর আলি বাই, সিধা কইরা কয়না কিছু। ঘুরাইয়া কয়। "
মাঝে মাঝে হাতে রঙ নিয়ে ঘুরত। নিজের গায়ে লাগাতো, অন্যদেরও লাগিয়ে দিত। আর বলতো - তৌহিদের রঙ, মুর্শিদের রঙ। আয় তরে রঙ দিয়া চুবামু।
গ্রামের মানুষ বিপদ আপদ হলে নূরা পাগলার কাছে যেতে শুরু করলো। নূরালি বাই, আলুইংগার বাপে জেলে গেছে। কবে ছাড়া পাইবো? কইতারেন নি?
নুরা পাগলা লাঠি দিয়ে মাটিতে বাড়ি দিত। তারপর গালাগালি করত। এতে সবাই ধরে নিত সহজে ছাড়া পাবেনা আলুইংগার বাপ।
অসুখ বিসুখে নুরালি ভরসা। আমার পুতের প্যাট লামছে। কাকা কিছু দেইন।
নূরালি বলতো " পানি লইয়া আয়। "
কাঁসার বাটিতে পানি নিয়ে আসা হতো। নূরা পাগলা সেই পানিতে তার ময়লা হাটু ডুবিয়ে দিত। বলতো " ল, এইডা খাওয়াইছ"।
পানি খাওয়ানো হয়েছিল আমাকেও। একবার পেট ভাল হয়েছিল দুইদিনের মাথায়। আরেকবার হয়নি।
বড় খালার কোমরে ব্যথা হয়েছিল।
-কাকা আমার কোমরে ব্যাথা।
- ঘুইরা ব।
খালা ঘুরে বসলেন। নুরা পাগলা কোমরে দ্রিম করে লাথি দিলেন। নানী হতবিহবল হয়ে ছুটে আসলেন " আহহা হা হা হা ভাইসাব করেন কিতা, করেন কিতা?"
নুরা পাগলা বলতো " যাহ, কোমর লইয়া আজমীর যা। "
দুদিন পরে আম্মা বলত " বড়বু, ব্যথা অহন কেমুন? "
খালা বলতো " কিছুডা ভালই"।
###
নানাবাড়ির গ্রামের সেই নূরা পাগলা একদিন মরে গেল। নূরা পাগলার ভাই জুহর আলী বলল, মউতের সময় টিনের চালে দাপাদাপি হইছে। একটা গায়েবি আওয়াজ শুনছি। কেডা জানি সালাম দিছে।
- হুম আজরাইলে, আবার কেডা?
মোজাম্মেল মাস্টার উত্তর দেয়।
নূরালির কবর হলো বিলের ধারে।
গ্রামের লোকজন বলল " তাইনে আল্লার ওলী। কবরে নিশান টানান লাগবো।"
নিশান টানানো হলো। অল্প স্বল্প মুরিদও যোগাড় হলো। ঠিক করা হলো প্রতিবছর চৈত্র মাসে ওরশ হবে।
আদমপুর গ্রামের যুবক ইদন খা মানত করেছিল "এই বার ডিভি লটারি লাগলে কবরটা পাকা করার খরচ দিব।"
ইদন খা ডিভি পেলো। আমেরিকা গিয়ে পচিশ হাজার টাকা পাঠালো প্রথম মাসেই।
কবর পাকা হলো। রোশনাই বাড়লো। আশেপাশের গ্রামে খবরটা বিদ্যুতের বেগে ছড়িয়ে পড়লো। যুবকেরা ডিভির ফরম পূরন করে আর মাজার জিয়ারত করে।
কবরটা হয়ে গেল বাবা নূরালি শাহ'র মাজার।
আমরা বড় হয়ে গেছি। নানা বাড়ির সেই পাকা দেওয়াল পুরনো হয়েছে। বারান্দার কোনায় কোনায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। আবদুল মালেকের ছেলে আলমগীর এখন রিকশা চালায়। তাদের ভাগ্যের তেমন বদল হয়নি। নুরালির কবরের রোশনাই বেড়েছে। প্রতিবছর বিদেশ প্রত্যাশী যুবকেরা মাজারে আসে। মান্নত করে।
এদের কেউ কেউ সহী সালামতে বিদেশ যায়। বিদেশ গিয়েই টাকা পাঠায়। নূরালি শাহ'র দরবারে সামান্য শ্রদ্ধাঞ্জলি।
বাবা নূরালি শাহ'র মুরিদানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে তার সুখ্যাত। ওরশের সময় দুরদুরান্ত থেকে নৌকা আসে।
মাজারের এখন কমিটিও হয়েছে। মোজাম্মেল মাস্টার তার সভাপতি।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:২১

শাহাদাৎ হোসাইন (সত্যের ছায়া) বলেছেন: B-)) নূরালি শাহের সাথে কয় দিন আগে আমার সাথে মোরাকাবায় নেসবতে বায়ান্নাসে এলহাম বিনিময় হয়েছে। নূরা বলেছে সে খুব চিন্তিত, মাজারের আয় দেখে সরকারের টাক মাথা মাল সাহেব টেক্স ধার্য করতে পারে। এই জন্য মোজাম্মেল মাস্টার কে ওবায়েদুল কাদের সাহেবের সাথে দেখা করতে বলেছে। আর মাজারের পশ্চিম পাশে সরুফা বেগম নামে একজন মহিলা আছে তাকে মাজারের টাকা থেকে মাসিক তিন হাজার টাকা ভাতা দিতে বলেছে। এটুকু বলার পর তার সাথে আমার সংযোগ বিছিন্ন হয়ে হয়ে যায়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.