নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অামি অতি সাধারণ, সাধারণ থাকতে চাই ।

পার্থ তালুকদার

আমি ভাই সাধারণ, সাধারণ থাকতে চাই।

পার্থ তালুকদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিকড়ের টানে গাই ধামাইল গান (৩য় র্পব)

২২ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:০২



‘ধামাইল’ শব্দটির উদ্ভব নিয়ে বিজ্ঞমহলে বিভিন্ন মতপার্থক্য রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বড়–চন্ডীদাস কর্তৃক রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ যেমন রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার রসমিশ্রীত কাহিনীনির্ভর, ঠিক তেমনি বাংলার ধামাইল গানেও রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা সুস্পষ্ঠভাবে ঠাই পেয়েছে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ যেমন তেরটি খন্ডে বিভক্ত, ধামাইল গানও কাহিনীর উপর ভিত্তি করে কয়েকটি পর্বে বিন্যাস করা হয়েছে। তাই বলা যায়- আধুনিক যুগের ধামাইলগান বড়ু চন্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর প্রভাবেই আচ্ছন্ন।

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এ রাধা যেমন বলেছেন-

আকুল শরীর মোর বেআকুল মন,

বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ রান্ধন।

তেমনি ইদানিং কালের ধামাইল গানেও বাঁশী নিয়ে অনেক গানের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন কাশীনাথ তালুকদার লিখেছেন- সামান্য বাঁশের বাঁশী বানাইল কি দিয়া/যমুনার নীল জল, উজান যায় চলিয়া।



আগেই বলেছি ধামাইলগানে সাধারনত রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-বিরহ, মান-অভিমান, অভিযোগ-অনুযোগ ইত্যাদি কঠিন বিষয়গুলো অতি সহজভাবে ঠাই পেয়েছে। তাই রাধার প্রতি কৃষ্ণের যেমন মান-অভিমান, বিপরীতভাবে কৃষ্ণের প্রতিও রাধার অভিযোগ-অনুযোগ কম নয়। আধুনিক কালে ধামাইলগানে শ্রীরাধিকা পুরুষহৃদয়-কে সবসময় ‘কঠিন হৃদয়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এর ব্যতিক্রম ঘটেনি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’এ। তাই ‘পুরুষ হৃদয়’ নিয়ে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’এ অনেক পদের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন-

সোনা ভাঙ্গিলে আছে উপাএ,জুড়িএ আগুন তাপে,

পুরুষ নেহা ভাঙ্গিলে,জুড়িএ কাহার বাপে।

আর ধামাইল গানের প্রবাদপুরুষ রাধারমন লিখেছেন-

পুরুষ জাতি সুখের সাথী নিদয়া নিষ্ঠুরা,

ওরে জানেনা সে নারীর বেদন কঠিন তার হিয়া।



আহমদ শরীফ বলেছেন- ‘বাংলা কেবল ধানের দেশ নয়, গানের দেশও। এখানকার মাটির ফসল ধান, মনের ফসল গান। শুধু বন্যাতেই দেশ প্লাবিত হয় না, গানেও হৃদয় প্লাবিত হয়।’ ঠিক তাই। শতকাজের ফাঁকে, হৃদয়ে কষ্টের পাহাড় নিয়েও যখন পল্লীর মানুষের মুখে মুখে এই গানগুলো ভেঁসে বেড়ায় তখন আশ্চর্যই লাগে।



ছোট বেলায় দেখতাম পাশের বাড়ীতে সন্ধাবেলায় গানের আসর বসতো। গ্রামের কর্মঠ মানুষ সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে একতারা, দুতারা হাতে নিয়ে বসে পরতেন এই আসরে। গান চলতো একের পর এক, ভিন্ন ধাচের, ভিন্ন লেখকের। তখন একজন লেখকের নাম কেন জানি মনের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল। তিনি হলেন শরতচন্দ্র দাস। গানের ভনিতা তে ‘দীন শরত’ নামেই পরিচিত। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার সাজিউড়া গ্রামে এই সাধক জন্মগ্রহন করেন। শৈশবে দৃষ্টিশক্তি হারানো এই সাধক আজ কালের স্রোতে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছেন। তাঁর লিখা মনঃশিক্ষা ও বিচ্ছেদ গানগুলো এখনও মানুষের মনে ভাবের রস যোগায়, বিচ্ছেদের করুন সুর মনে রক্তক্ষরণ ঘটায়।তিনি ধামাইল গানের বিচ্ছেদপর্বে একটি গানে লিখেছেন-

চিন্তা হইতে চিতা ভাল, চিতায় মরা মানুষ পুড়ে,

এগো জিয়ন্তে পুড়াইয়া মারে, চিন্তায় যারে ধরে।



বাউল সম্রাট আব্দুল করিমের বেশ কিছু ধামাইলগান লোকমুখে পরিচিত। তাঁর সেই জনপ্রিয় গান - ‘সখি কুঞ্জ সাজাও গো/ আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে’ ধামাইলের ‘কুঞ্জসাজানি’ পর্বের অন্তর্ভূক্ত। এই পর্বে দেখা যায় শ্রীরাধিকা আতর, গোলাপও চন্দন দ্বারা কুঞ্জ সাজিয়ে রাখেন আর অপেক্ষায় থাকেন তাঁর প্রাণপ্রিয় শ্যামকালিয়ার জন্য। সাজানো কুঞ্জে না আসায় শ্রীকৃষ্ণের প্রতি রাধার অভিমান রাধারমনের এই গানে ধরা পরেছে। ‘দূতী কইও গো কইও গো বন্ধুরে/ এগো কাইল নিশিতে একা কুঞ্জে রইয়াছি বাসরে।’ একই বিষয়ে চমৎকার একটি গান লিখেছেন সাধক আব্দুল আজিজ। তিনি লিখেছেন- কথা দিয়া কালা আমার কুঞ্জে না আসিল/ গাঁথিয়া ফুলের মালা বাসি হইয়া গেল।



শ্রীকৃষ্ণকে কাছে পেয়ে রাধিকার দীর্ঘ,তিক্ত অপেক্ষার প্রহর-এর একসময় মধুসমাপ্তি ঘটে। এতদিনের জমানো মনের কষ্ট যেন বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত উপছে পরে। আর সেই জোয়ারের চিত্ররূপ মনে ধারন করে ধামাইল গানের ‘সাক্ষাত ক্ষেদ’ পর্বে বেশ কিছু গান লেখকগন আমাদের উপহার দিয়েছেন। কৃষ্ণ যখন রাধার মান ভাঙ্গানোর জন্য সোহাগমাখা কথা বলেন তখন প্রতাপরঞ্জন রাধার মনের কথা ব্যক্ত করেছেন ঠিক এই গানে- ‘ যাওরে বন্ধু, মন বিরক্ত কইরো না/ সোহাগ ঢালা প্রেমের আলাপ আর কইরো না।’ আরেকটি গান লিখেছেন ধামাইলগান লেখক শ্রী স্বপনকুমার। তাঁর এই গানেও কৃষ্ণের প্রতি রাধার অভিমানের তীক্ষè তীর সুক্ষভাবে ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন- ‘বন্ধু পাষাণ তোমার হিয়া, কেমনে রহিলায় বন্ধু আমারে ভুলিয়া।’ তবে রাধার সব মান-অভিমান-অভিযোগ এর বিপরীতে শ্রীকৃষ্ণ প্রেমমাখা বাণী দিয়ে রাধাকে আশ্বস্ত করেছেন এই গানে- ‘রাধে স্থির কর মন, তোমার প্রেমে বান্দা আমি আছি আজীবন।’



ধামাইল গানের আরেকটি রসাত্মক, হাসিব্যঞ্জক বা সামাজিক সচেতনমুলক পর্ব হচ্ছে ‘আউটগান’। ধামাইলের বিচ্ছেদ যেমন পীড়াদায়ক, মিলন যেমন সুখদায়ক, স্বপন যেমন কল্পনাদায়ক তেমনি আউটগান মানুষের মনে হাসির খোরাক যোগায় সাথে সচেতনতার বানী হৃদয়ের কোনে পৌঁছে দেয়। একটা মানুষের বলনে-চলনে-মননে শিক্ষার প্রভাব যে অপরিসীম, তা হৃদয়াঙ্গম করে ধামাইল গান লেখক শ্রী যতিন নিরক্ষর সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন- ‘যে না জানে লেখাপড়া, প্রাণ থাকিতে সেজন মরা’। ঠিক তেমনি প্রতাপরঞ্জন লিখেছেন- ‘ দস্তখত করিতে খাতায়, তখন বাবুর প্রাণটি শুকায়/হেট মাথা হয় গো লজ্জায়, নয়ন ভরে জলে।’



যৌতকপ্রথা আমাদের সমাজজীবনে ক্যান্সার ব্যধির মত বাসা বেঁধেছে। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় যেখানে সুশিক্ষিত মানুষ মন-মানসে উদার, প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা সযতনে পোষবে তা না করে এখনও আমরা গোড়ামিকেই মনে আশ্রয় দিয়ে লালন করছি। যৌতকদাবী মেটাতে না পারা পাত্রীদায়গ্রস্ত পিতা-মাতার মাতম লোক চক্ষুর আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। শ্রী প্রতাপরঞ্জন সমাজের এই কঠোর রীতি তাঁর কিছু গানে তুলে ধরেছেন।তিনি লিখেছেন-

দেশদরদী ভাই বন্ধুগন সবার কাছে নিবেদন,

ছেলের দাবী বন্ধ করা প্রয়োজন।



তাই পল্লীতে বাস করেও ধামাইলগানের লেখকগন শুধু যে মনের সুখে গানই রচনা করেছেন তা নয়, তাঁরা সমাজের যত অসংগতি,অনাচার,অশুভন তা চিহ্নিত করে তাদের লেখনীর মাধ্যমে সমাজে তুলে ধরছেন, আবার কখনও বা দিচ্ছেন সঠিক পথের সন্ধান আর সঠিক সমাধান।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.