নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অামি অতি সাধারণ, সাধারণ থাকতে চাই ।

পার্থ তালুকদার

আমি ভাই সাধারণ, সাধারণ থাকতে চাই।

পার্থ তালুকদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

কাশীনাথ তালুকদারঃ সুনামগঞ্জের সুসন্তান

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:০৮



সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার চারটি থানা যেমন জগন্নাথপুর, দিরাই,বানিয়াচুং ও নবীগঞ্জের কয়েকটি গ্রামের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বিবিয়ানা নদী। একসময় এই অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের মাধ্যম ছিল একমাত্র বিবিয়ানা নদীটিই। বর্ষায় পরিপূর্ন নদীটি ছিল আজকের পদ্মা অথবা যমুনার মত। লঞ্চ ও স্টিমার এই নদীর মধ্যদিয়ে অবাদে চলাচল করত। আর এই নদীটির দুপার ঘেসে অথবা কাছাকাছি প্রায় ২০ টি হিন্দু-মুসলিম জনবহুল গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠে ‘বাল্লা’ নামে একটি অঞ্চল। মানুষের ভালবাসা, চাওয়া-পাওয়া, আবেগ অনুভূতির প্রকাশ সবকিছু ছিল মোটামোটি বাল্লাবাসীকে কেন্দ্র করেই। প্রশাসনিক সীমারেখা বাল্লা অঞ্চলকে আলাদা করতে পারলেও মানুষের মনকে কখনও চ্ছেদ করতে পারেনি। এই ঐতিহ্যবাহী বাল্লা অঞ্চল যেমন ছিল হাওর ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু- এই প্রবাদের মত, তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল যোজন যোজন দূরে। পড়াশুনা অথবা চিকিৎসার জন্য যেতে হত প্রায় ২০ কিমি দুরে নবীগঞ্জ,দিরাই অথবা জগন্নাথপুর থানায়। এমনই প্রতিকুল অবস্থায় ১৯১১ ইং সালে জগন্নাথপুর থানার মেঘারকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাল্লাবাসীর প্রিয়মুখ, সবার প্রিয় মাষ্টারবাবু শ্রী কাশীনাথ তালুকদার। তার পিতা ডেঙ্গুর রাম তালুকদার এবং মাতা জয়তারা তালুকদার।

কাশীনাথ তালুকদার যেদিকেই পদার্পন করেছেন সেদিকেই মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। ছাত্র জীবনে সংস্কৃতে লেটার্স মার্কসহ প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। যদিও তার পিতার মৃত্যুর কারনে আর এগিয়ে যেতে পারেননি। তবে হার মনেননি তিনি। স্বশিক্ষিত হয়ে বাস্তব জীবনের অতি কঠিন ও ঝঞ্জাটপূর্ন প্রতিটি পরীক্ষায় সফলতার সাথে পাশ করেছিলেন। তিনি কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠার সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িত ছিলেন। করেছেন শিক্ষকতাও। প্রায় দশ বছর তিনি বাল্লার জগন্নাথপুর এস,এন,পি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সহসভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাছাড়া তার নিরলস প্রচেষ্টায় হরিনাকান্দি দ্বীপচাঁদ-প্রকাশচাঁদ মধ্যম ইংরেজী স্কুল, মেঘারকান্দি ঠাঁকুরধন প্রাইমারী স্কুল (বর্তমানে মেঘারকান্দি সঃপ্রঃ বিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠিত হয়। এপ্রসঙ্গে জননেতা কমরেড বরুণ রায় লিখেছেন- ‘দেশে শিক্ষা প্রসারে তাঁর উদ্যম ও কর্মপ্রয়াস তুলনাহীন। গ্রামাঞ্চলে শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক অনন্যসাধারণ পুরুষ।’



এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সবার সার্বিক সহযোগীতায় গোপালগঞ্জ বাজারে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি পোষ্টঅফিস আর ব্রাঞ্চ পোষ্টমাষ্টার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি নিজেই। তার কাজের বৈচিত্রতার এখানেই সমাপ্তি ঘটেনি। তৎকালীন “যুগভেরী” ও “জনশক্তি” পত্রিকায় এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তার লিখা কিছু কবিতা। তবুও তার মনে কোন ক্লান্তি নেই। মানব প্রেম তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ ছিল তার মর্মেমর্মে। তাই এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি ‘ The Eastern Pakistan Homeopathic College’ থেকে অর্জন করেছেন ‘Diploma of M.B.H’ ডিগ্রীটি। তারপর তিনি নিজ বাড়ীতেই ডিসপেনসারী খুলে বসেন।

তখনকার দিনে মানুষ কত সহজেই না ন্যায় বিচার পেতেন। আর এখন গ্রামের সহজ সরল মানুষ আদালতের মারপ্যাচ বুঝার আগেই নিজের সর্বস্ব খুইয়ে বসেন। আর ন্যায় বিচার! সে তো কল্পনাতীত। বাল্লাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, কাশীনাথ তালুকদারের যে গুনটি মানুষকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করত তা হলো তার সততা । মামলা মকদ্দমা মীমাংসার জন্য তিনি ছুটেছেন এগ্রাম থেকে ঐগ্রামে। একটা সময় গ্রামে সালিশ আদালত ও পঞ্চায়েত প্রথা প্রচলন ছিল। অনেক সময় আদালত থেকে দেওয়ানী ও ফৌজদারী সংক্রান্ত মামলা দুই পক্ষের অনুমতিতে গ্রামের সালিশ আদালতে হস্তান্তর করা হত। এই সমস্ত মামলা কাশীনাথ তালুকদার অত্যান্ত ন্যায় ও সততার সাথে সুরাহা করে দিতেন। এক সময় তার নাম এলাকার গন্ডী ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পরে পাশের জেলা গুলোতে। বিশেষ করে বাল্লার কৃষক-শ্রমিক সম্মেলন এবং কিশোরগঞ্জ কৃষক সম্মেলনের মাধ্যমে তার বিশিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ যেমন- প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ পীর হাবিবুর রহমান, কমরেড তারা মিয়া, করুনাসিন্ধু রায়, জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদ সহ আরোও অনেকের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে।



তবে তাঁর জীবনের শেষ একটি বছর সম্পূর্ন ব্যতিক্রম। মনের পরিশুদ্ধিতার জন্য, জানার তীব্র ক্ষুধা নিবারনের জন্য তিনি ভারতের প্রধান প্রধান তীর্থক্ষেত্র ভ্রমন করেন। তীর্থ ভ্রমন শেষে তিনি ১৩৮৬ বঙ্গাব্দে “শ্রীমদ্ভাগবত” কাব্যানুবাদ ও গান লিখায় পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। তিনি ভাগবতে লিখেছেন-



তেরশ ছিয়াশি অব্দে মাস হয় মীন

চতুর্দশ দিবসেতে ভৃগু বাসর দিন ।

রচনা আরম্ভ করি আমি অভাজন

বাসুদেব কৃপাই শুধু আমারি প্রার্থন ।



একুশে পদক প্রাপ্ত কবি দিলওয়ার শ্রীমদ্ভাগবত প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘শ্রী কাশীনাথ দাশ মহাশয় পয়ারছন্দে ৫০৮ পৃষ্ঠার এই বিরাট গ্রন্থে যে সত্যকে তুলে ধরেছেন, সেটা কবিতার শিল্পরূপে খোঁজ করে পাওয়া যাবে না। একমাত্র বিশ্বাস এবং ভক্তিমিশ্রিত অনুরুক্তির শিল্পরূপেই সেই সত্যের সন্ধান লাভ সম্ভব।’ বিভিন্ন সাহিত্য গবেষকদের মতে -বাংলাদেশে আধুনিককালে কাশীনাথ তালুকদারই সর্বপ্রথম ভাগবতের বাংলা কাব্যনুবাদক।



‘ধামাইলগান’ বাল্লা তথা ভাটিবাংলার এক জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচলিত গান। এই গানগুলো সাধারনত বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে পরিবেশিত হয়ে থাকে। কতদিন শীতের রাত জেগে মা-মাসীদের কুলে বসে অথবা পড়া ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে এই ধামাইল গান উপভোগ করেছি, তার ইয়ত্তা নাই। যদিও বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে অতি আধুনিকতার নামে এই ধামাইল গানগুলো হারতে বসেছে। কাশীনাথ দাশ তালুকদার প্রায় শ’দুয়েক ধামাইল ও বাউল গান সম্বলিত দু’খানা বই “ শ্রী শ্রী কৃষ্ণলীলা কীর্ত্তন” ও “রাধাকৃষ্ণ লীলা সংগীত” রচনা করেছেন। তার রচিত গান গুলোর মধ্যে ধামাইলের বন্দনা বা সুচনা সংগীত ‘প্রথমে বন্দনা করি গুরু পদ স্মরি .......’ বিশেষভাবে পরিচিত। উল্লেখ্য কাশীনাথ তালুকদার ১৬ কার্ত্তিক ১৩৮৭ বঙ্গাব্দে (১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ) পরলোক গমন করেন। তাই স্পষ্টতই বলা যায় তার এক বছরের সাহিত্য সাধনায় আমদের প্রাপ্তি অনেক।

দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা, আমাদের এ সমাজ কাশীনাথ তালুকদার-এর মত গুনীজনদের সম্মান দেই না। যার অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পড়ে ও তার মত শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়ে আমরা এদ্দুর এসেছি অথবা যার একফোঁটা ঔষধের গুনে জটিল সব অসুখ থেকে মুক্তি পেয়েছি, আমরা সেই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কাশীনাথ তালুকদারকে মনে রাখি না। মনে রাখার প্রয়োজন অনুভব করি না। যা সত্যিই পীড়াদায়ক।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:৩৭

মামুন রশিদ বলেছেন: শ্রদ্ধেয় কাশীনাথ তালুকদার সম্পর্কে জেনে ভালো লাগল । আমার বাড়ি বানিয়াচং ।

২| ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:৩৯

পার্থ তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ, সময় নিয়ে পড়ার জন্য। আমার বাড়ি আপনার কাছেই, জগন্নাথপুর। :-)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.