নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কথা বলি..... বর্তমানের- কথা বলি ভবিষ্যতের.......

মাই নেম ইজ রেজাউল ইসলাম। এন্ড আই অ্যাম নট এ রাজাকার !!!

মোঃ রেজাউল ইসলাম

আমি নতুন সর্বদা----

মোঃ রেজাউল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের সত্য অসত্য -গোলাম মোর্তোজা

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:৫৩

ধর্ম নিয়ে যুক্তি-বিশ্লেষণ বা তর্কের প্রয়োজন হয় না, সুযোগও থাকে না- কারণ ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়। ধর্ম আগে বিশ্বাস করতে হয়, তারপর পালন।

রাজনীতি ধর্ম নয়। বিশ্বাস রাজনীতিরও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রাজনীতির বিশ্বাস আর ধর্ম বিশ্বাস সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। কোনো একটি রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি বিশ্বাস বা আনুগত্য গড়ে ওঠে যুক্তি-তর্কের ভিত্তিতে। যুক্তি-তর্কই বিশ্বাস বা আনুগত্য তৈরি করে।

বাংলাদেশের জন্ম ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে নয়, অধিকার আদায়ের যৌক্তিকতা থেকে। সেই যৌক্তিকতায় তর্ক ছিল, বিতর্ক ছিল, ছিল আবেগ। সবকিছুর পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধ, রক্ত-ত্যাগ-বঞ্চনার মধ্য দিয়ে জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশের। সেই বাংলাদেশের মানুষ, সমাজ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনও তর্ক-বিতর্ক খুব অস্বাভাবিক বিষয় নয়। তর্ক-বিতর্ক, তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সত্য ইতিহাস প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রায় ৪৩ বছর ধরে সত্য ইতিহাস প্রতিষ্ঠার চেয়ে ইতিহাস চাপিয়ে দেয়া নিয়ে বেশি আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। ফলে ইতিহাসে কোনো কিছু স্থিতি পাচ্ছে না। নির্মোহ বিশ্লেষণের অনুপস্থিতি প্রকট। ফলে তর্কের চেয়ে বেশি বিতর্ক জন্ম নিচ্ছে। বিতর্ক একপর্যায়ে গিয়ে পরিণত হচ্ছে কু-তর্কে। যার থেকে সত্য প্রতিষ্ঠা তো হচ্ছেই না, বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে জনমানুষের মনে, সমাজে, রাষ্ট্রে। কোনো কোনো সময়ে তা শ্রুতিকটু-দূষণীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। বারবার পেছনে ফিরতে হচ্ছে। বারবার শুরু করতে হচ্ছে শূন্য থেকে। ফলে সত্য ইতিহাসের প্রতিও দেশের মানুষের একটি অংশের ভেতরে বিতৃষ্ণা তৈরি হচ্ছে। একই তর্ক-বিতর্ক-কুতর্ক মানুষ শুনতে চাইছে না। কিন্তু ঘুরেফিরে মানুষ শুনতে বাধ্য হচ্ছে।

ইতিহাসের বিতর্কে এখন এ কে খন্দকারের ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’।

এখনকার তর্ক-বিতর্ক-কুতর্ক এ কে খন্দকারের বইয়ের কয়েকটি প্রসঙ্গ নিয়ে।

ক. ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন।

খ. বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। দিতে রাজি হননি।

গ. মার্চের প্রথম দিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে অনেক অল্প ক্ষয়ক্ষতিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যেত।

ঘ. যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি ছিল না রাজনীতিবিদদের।

ঙ. পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার বরণ করেছিলেন।

চ. গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু কাউকে কোনো নির্দেশনা দিয়ে যাননি।

ছ. মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন।

বইয়ের আরও অনেক বিষয় আছে। আলোচনা হচ্ছে মূলত এগুলো নিয়ে। প্রায় সাতদিন ধরে দেখছি যারা আলোচনা করছেন, বিষোদ্গার করছেন, তাদের প্রায় কেউই বইটি পড়েননি। পত্রিকায় আংশিক দেখে-পড়ে কথা বলছেন। সেসব আলোচনা বা কথা আবেগনির্ভর, যুক্তিনির্ভর নয়। স্মরণে রাখা ভালো যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আবেগ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। যুক্তি তো ছিলই। তবে আবেগ ছিল তার চেয়েও জোরাল। আক্রমণকারী সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরোধ গাছ কেটে, দা-বঁটি-লাঠি, বন্দুক দিয়ে করা যায় না। কোনো যুক্তিতে সেটা পড়ে না। কিন্তু ১৯৭১ সালে প্রথমাবস্থায় বাঙালি তা-ই করেছিল। এটা করেছিল যুক্তির চেয়ে অনেক বেশি আবেগ থেকে।

কিন্তু আজ যখন আমরা আলোচনা করছি, তখন বাংলাদেশের বয়স ৪৩ বছর। পরিণত বয়সে বাংলাদেশ। এখনকার কোনো আলোচনা আবেগের চেয়ে বেশি যুক্তিনির্ভর হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেই প্রেক্ষিতেই প্রাসঙ্গিক কিছু আলোচনা-বিশ্লেষণ।

১. ৭ মার্চের ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন কি বলেননি?

এ বিষয়ে আহমদ ছফা লিখে গেছেন। তার লেখার কিছু অংশ-

“একটা কথা বলি, শেখ সাহেব যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে ‘জয় বাংলার’ সাথে সাথে ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দটিও উচ্চারণ করেছিলেন। এখন এই ভাষণ নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক-বিতণ্ডা চলছে। আমি ছোট মানুষ। আমাকে সাক্ষ্য দিতে কেউ ডাকবে না। আমি যেমন শুনেছি, তেমনি বললাম। হতে পারে, আমার শ্রুতির বিভ্রম ঘটেছিল।”

আহমদ ছফা, বেহাত বিপ্লব : ১৯৭১, সম্পাদনা : সলিমুল্লাহ খান। আগামী প্রকাশনী, ডিসেম্বর ২০১৩।



বদরুদ্দীন উমর আমাদের ইতিহাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধুর প্রতি সশ্রদ্ধ হয়ে খুব কমই বলেন, লেখেন। ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনায় তার লেখার কিছু অংশ।

“৭ই মার্চের বক্তৃতার শেষে ‘জয় পাকিস্তান’ বলা একদিক থেকে খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এটা এখন আওয়ামী লীগের লোকেরা অস্বীকার করে, কারণ তার কোনো রেকর্ড নেই। ৭ই মার্চের পর রেডিও তাদের দ্বারা পরিচালিত থাকার সময় তারা ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দ দু’টি মুছে ফেলেছিলেন। তখন কোনো ক্যাসেট রেকর্ডারের ব্যবহার ছিল না। একমাত্র রেকর্ড ছিল রেডিওতে। যারা শুনেছিল তাদের স্মৃতি ছাড়া এর অন্য কোনো চিহ্ন নেই। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান ‘বাংলাদেশের তারিখ’ নামক বইয়ের প্রথম সংস্করণে লিখেছিলেন যে, ‘৭ই মার্চ শেখ মুজিব ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলেছিলেন। কিন্তু বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে এই সত্য ভাষণ বাদ দেয়া হয়েছে।”

বদরুদ্দীন উমর, আমার জীবন, তৃতীয় খণ্ড



২. আহমদ ছফা, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বদরুদ্দীন উমরসহ সমাজের আরও দু’একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলছেন, ‘জয় পাকিস্তান’ বা ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলেছিলেন।

আহমদ ছফা অসত্য বলতেন, শুনিনি-বিশ্বাসও করি না। তিনি নিজ কানে শুনেছেন। আবার বলছেন ‘শ্রুতি বিভ্রম’ও ঘটতে পারে! তার মানে তিনি নিজেও পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না। বিষয়টি নিয়ে সংশয় তার ভেতরেও ছিল। আহমদ ছফা ছিলেন সাহসী, সত্যভাষী। কিন্তু তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ রীতিতে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে এ কথা বলেছিলেন, এমনটা বলা যায় না।

বিচারপতি হাবিবুর রহমান দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে বাদ দিলেন কেন? বিতর্ক তৈরি হলো বলে, নাকি পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণের অভাব?

তথ্যপ্রমাণ থাকলে, তিনি নিজে পুরোপুরি নিশ্চিত হলে, শুধু বিতর্ক তৈরি হলো বলে বাদ দিয়ে দেবেন- বিচারপতি হাবিবুর রহমানকেও তেমন মানুষ মনে হয়নি কখনো।

বদরুদ্দীন উমর নিজে সরাসরি এ বিষয়ে মন্তব্য করছেন না। তিনি বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে উদ্ধৃত করছেন। উদ্ধৃত করতে গিয়ে লিখছেন ‘সত্য ভাষণ’ বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো তথ্যপ্রমাণ বা ব্যাখ্যা দেননি বদরুদ্দীন উমর। যিনি লিখছেন, তিনি আবার বাদ দিচ্ছেন। যিনি উদ্ধৃত করছেন, তিনি বলছেন ‘সত্য ভাষণ’। অথচ কোনো তথ্যপ্রমাণ দিচ্ছেন না। ফলে যুক্তি অকাট্য হচ্ছে না।

প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমানের ‘কালের ধূলোয় লেখা’ এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ। ‘কালের ধূলোয় লেখা’ বই আকারে প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। আমি তখন ‘সাপ্তাহিক ২০০০’-এ। শামসুর রাহমান তার বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘জয় পাকিস্তান’ বলে শেষ করার কথা। শামসুর রাহমানের লেখা উদ্ধৃতি করে বেশ কয়েকটি চিঠি ছাপা হয় ‘সাপ্তাহিক ২০০০’-এর পাঠকের পাতায়।

এই চিঠি ছাপার সূত্র ধরে প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের একদিন আমাকে ফোন করেন। বলেন, কবি শামসুর রাহমান অন্য একটি ভাষণের সঙ্গে ৭ মার্চের ভাষণ মিলিয়ে ফেলেছেন। এটা একটা বড় ভুল। এতে বিভ্রান্তি তৈরি হবে। আলী যাকের নিজে থেকেই বললেন, ‘আমি এ বিষয়ে ছোট্ট একটি লেখা দেব।’

সানন্দে রাজি হলাম। লেখাটি দ্রুত দিতে অনুরোধ করলাম। দু’একদিনের মধ্যেই আলী যাকের লেখাটি পাঠালেন। ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ...’ শিরোনামে আলী যাকেরের ছবিসহ লেখাটি ছাপা হলো।

আলী যাকেরের লেখা দেখে আমাকে ফোন করলেন কবি শামসুর রাহমান। খুব ভালো, শ্রদ্ধা-স্নেহের একটি সম্পর্ক ছিল আমার সঙ্গে। আলী যাকেরের লেখার প্রসঙ্গ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। তার ভুল হয়েছে, আলী যাকের সঠিক- কোনো ভনিতা না করেই তা বললেন।

পরের দিন, ছোট্ট কিন্তু সুন্দর, কবিতার মতো একটি চিঠিসহ একটি লেখা পাঠালেন।

‘ক্ষমাপ্রার্থী আমার ত্রুটির জন্য’ এই শিরোনামে শামসুর রাহমানের ছবিসহ লেখাটি ছাপা হলো পাঠকের পাতায়।

এ কে খন্দকার বিতর্কে অনেকেই এখন শামসুর রাহমানের লেখা সূত্র হিসেবে উল্লেখ করছেন। কিন্তু জীবিতাবস্থায়ই শামসুর রাহমান ভুল স্বীকার ও দুঃখ প্রকাশ করে গেছেন।

আলী যাকের এবং শামসুর রাহমানের চিঠি প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে লেখেন সাংবাদিক মনজুর আহমেদ। সেই সময় (৭ মার্চ) মনজুর আহমেদ ছিলেন দৈনিক পাকিস্তানের (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) স্টাফ রিপোর্টার। ৭ মার্চ জনসভাস্থলে তিনি উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক হিসেবে। মনজুর আহমেদের লেখাটি প্রকাশ করি ‘প্রবাসজীবন’ বিভাগে।

মনজুর আহমেদ লেখেন,

‘৭ মার্চের জনসভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম এবং আমার উপস্থিতি ছিল সাধারণ একজন শ্রোতা হিসেবে নয়, আমার উপস্থিতি ছিল সেদিনের সর্ববৃহৎ দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা)-এর স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে। জনসভা ও বক্তৃতার বিবরণ সংগ্রহ করাই ছিল আমার এবং অন্যান্য সাংবাদিকদের দায়িত্ব। এই গুরুদায়িত্ব পালনে চোখ কান সারাক্ষণ সজাগ রাখতে হয়েছে। সেই দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট করেই বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর ‘জয় পাকিস্তান’ স্লোগান আমরা কেউ শুনিনি। পরের দিনের কোনো পত্রিকাতেও এর কোনো উল্লেখ নেই। বক্তৃতার পুরো নোট ছাড়াও আমাদের অনেকেই সে বক্তৃতা টেপ করেছিলেন। রাতে রিপোর্ট লেখার সময় সেই টেপ বাজিয়ে আমরা নোট মিলিয়ে নিয়েছিলাম। না, ‘জয় পাকিস্তান’ কোথাও ছিল না। ছিল না বলেই পরের দিনের পত্রপত্রিকায় স্ববিস্তৃত বিবরণীতে কিংবা ওই জনসভা সংক্রান্ত আরও অসংখ্য ছোটবড় প্রতিবেদনে এর কোনো উল্লেখও ছিল না।’



মনজুর আহমেদ আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনা সরকার যখন দৈনিক বাংলা বন্ধ করে দেন, তখন অনেক সংবাদকর্মীর মতো তিনিও ক্ষতিগ্রস্ত হন। এরপরই তিনি নিউইয়র্কে চলে যান। এখন সেখানেই বসবাস করছেন।

সাংবাদিক নির্মল সেনের লেখায়ও প্রসঙ্গটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশই একজন আরেকজনের থেকে শুনেছেন। দু’একজন নিজ কানে শুনলেও, খুব জোর দিয়ে বলছেন না যে, ঠিক শুনেছিলেন। সুতরাং ভাষণ শেষে শেখ মুজিব ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। যেহেতু শেখ মুজিবের বলার বিষয়টি কোথাও রেকর্ড আকারে নেই, সেহেতু এটা একটা বিতর্কের বিষয় হিসেবে থেকে যাচ্ছে না।

ঘটনার তথ্য উপাদান বিশ্লেষণ করে কোনোভাবেই বলা যাচ্ছে না যে, শেখ মুজিব ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন।

৩. ‘জয় পাকিস্তান’ প্রসঙ্গে এ কে খন্দকার তার বইয়ে লিখেছেন। তিনি নিজে শুনেছিলেন এমন দাবি করেননি। কীভাবে নিশ্চিত হলেন তা-ও উল্লেখ করেননি। সুতরাং এই বক্তব্য তার নিজস্ব মতামত হয়েছে। খুব সাধারণ মতামত। গুরুত্বপূর্ণ মানুষের গুরুত্বপূর্ণ মতামত হয়ে ওঠার যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে এই মতামত।

৪. ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন কি বলেননি, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই সময়ের বাস্তবতায় ‘জয় পাকিস্তান’ বলাটা দূষণীয় কিছু ছিল না। ভাষণের গুরুত্ব বা তাৎপর্য সামান্যতম কমে যায় না। এটা একেবারেই অহেতুক একটি আলোচনা। এখন ‘জয় পাকিস্তান’ বলার প্রেক্ষিতে আওয়ামী নেতৃত্ব ও তাদের লেখক বুদ্ধিজীবী সমাজ যদি আবেগতাড়িত ক্ষিপ্ততা না দেখিয়ে, যুক্তি দিয়ে পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করে উত্তর দিতেন, তবে এই বিতর্ক এত ডালপালা মেলার সুযোগ পেত না।

কর্মী-সমর্থকরা ক্ষিপ্ত হতে পারেন। হয়ত ক্ষিপ্ত হতে পারেন অনেক তরুণ নেতাও। ইতিহাসের সাক্ষী, বর্ষীয়ান নেতা-লেখক-বুদ্ধিজীবীরা যখন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, তখন তাদের যুক্তির দুর্বলতাই প্রকাশ পায়।

যারা বলছেন ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন, তথ্য প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও তাদের কথা জনমনে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। মানুষ ভাবতে পারে, সত্য বলতে বাধা দেয়া হচ্ছে।

৫. এ কে খন্দকার লিখেছেন,

‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, তা তিনি পরিষ্কার করেননি।... ভাষণে চূড়ান্ত কোনো দিকনির্দেশনা পাওয়া গেল না।’



১৯৭১ সালের মার্চ মাসকে দেখতে হবে, বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে ১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে, ২০১৪ সালের প্রেক্ষাপটে নয়। এ কে খন্দকার মনে করছেন মার্চ মাসের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করে দিলে, অনেক কম ক্ষয়ক্ষতিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যেত। পূর্ব পাকিস্তানে থাকা বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকদের ওপর আক্রমণ করে বিজয়ী হয়ে যেত। অর্থাৎ পাকিস্তান ২৫ মার্চে আক্রমণ করার আগেই আমরা আক্রমণ করে তাদের পরাজিত করতে পারতাম।

এ কে খন্দকারের এই অংশটির বিশ্লেষণ অত্যন্ত স্থূল। বিশ্লেষণটি এতই দুর্বল যে, সামান্য বুদ্ধিমত্তার কোনো ছাপ পাওয়া যায় না। খুব বেশি রকমের ইম্যাচিউরড চিন্তা-বিশ্লেষণ।

যুক্তি-তর্ক, তথ্যপ্রমাণ দিয়ে তা প্রমাণ করা মোটেই কঠিন কাজ নয়। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বা লেখক বুদ্ধিজীবীদের তেমন কিছু করতে দেখা গেল না। দেখা গেল শুধু ক্ষিপ্ততা।

৬. আমেরিকান সিবিএস নিউজ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে একটি সংবাদ প্রচার করে। সেখানে তারা বলে, পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আর্মিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়েছে। সেই সংবাদের পুরো অংশ-

“দ্য সিভিল ওয়ার ইন পাকিস্তান টু নাইট, দ্য ... রিপোর্টেড ফাইটিং মাস, আর্মস উইথ রাইফেলস ইভেন ... ঢাকা, চিটাগাং অ্যান্ড এনাদার প্লেস ইন পাকিস্তান। রেডিও ব্রডকাস্ট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একিউসড ইস্ট পাকিস্তান লিডার শেখ মুজিবুর রহমান এ ট্রিজন। অ্যান্ড অর্ডারড দ্যাট আর্মি, টু টেক অ্যানি স্টেপস নেসেসারি টু রিস্টোর দি অথরিটি টু অব দি গভর্নমেন্ট।

অ্যা রেডিও স্টেশন কলিং ইটস দ্য ভয়েস অব ইন্ডিপেনডেন্ট বেঙ্গল, ব্রডকাস্ট রহমান ডিকলেয়ার্ড ইস্ট পাকিস্তান অ্যান ইন্ডিপেনডেন্ট ন্যাশন। ঢাকা ইয়েস্টারডে, রহমান, হু হ্যাজ লং ফট ফর সেলফ গভর্নমেন্ট ফর ইস্ট পাকিস্তান, অ্যানাউন্সড ইন অ্যা র‌্যালি অব হিজ ফলোয়ারস। ... শেখ ইজ দ্য লিডার অব আওয়ামী লীগ, অ্যা পলিটিক্যাল পার্টি দ্যাট উন অ্যা ল্যান্ডওয়াইড ভিক্টোরি ন্যাশনাল ইলেকশন লাস্ট ডিসেম্বর। দ্য কান্ট্রিস ফার্স্ট ফ্রিলি ইলেক্টেড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি হ্যাজ টুয়েন্টি ইয়ার হিস্ট্রি। বিকস অব ডিফরেন্সেস বিটুইন রহমান অ্যান্ড প্রেসিডেন্ট খান। অ্যাসেম্বলি হ্যাস নেভার বিন কনভিং। সাম সেভেনটি ফাইভ মিলিয়ন পারসন্স অব ইস্ট পাকিস্তান ফিলিং স্ট্রংÑ দেয়ার সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট অ্যা থাউজেন্ড মাইল অ্যাওয়ে অ্যাট ওয়েস্ট পাকিস্তান ...। ফ্যাক্ট সেইজ, ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট ইভেন স্পিকস ইন ডিফরেন্ট ল্যাঙ্গুয়েজ। রহমান হ্যাজ আস্কড অ্যানিবডি ক্যান স্টপ ইস্ট পাকিস্তান ড্রাইভ ফর সেলফ গভর্নমেন্ট।

শেখ মুজিব : নোবডি ক্যান স্টপ ইট।

রিপোর্টার : অটোনমি অব ইস্ট পাকিস্তান।

শেখ মুজিব : নোবডি ক্যান স্টপ ইট। অটোনমি! ওহ ডেফিনেটলি!! নো ওয়ান স্টপ মাই অটোনমি।

রিপোর্টার : নো, নো, দেন অটোনমি।

শেখ মুজিব : নো কোশ্চেন অব দেন, আই ওয়ান্ট মাই রাইট। আই ওয়ান্ট মাই ইমান্সিপেশন।

রিপোর্টার : ওয়েস্ট পাকিস্তান ক্যান নট ডু এনিথিং এবাউট ইট?

শেখ মুজিব : হু ক্যান ডু অ্যানিথিং হোয়েন সেভেনটি মিলিয়ন পিপলস ইউনাইটেড বিহাইন্ড আওয়ার।

রিপোর্টার : ইভেন উইথ দ্য আর্মি?

শেখ মুজিব : হোয়াট ড্যাম আর্মি ক্যান ডু? উই ডোন্ট কেয়ার ফর দেম। দে ক্যান সাপ্লাইড মাই পিপলস বুলেট।

রিপোর্টার : সো, ইউ আর অলরেডি দ্য চিফ অব ইন্ডিপেনডেন্ট বেঙ্গল? নট লিগালি দি ফ্যাক্টর?

শেখ মুজিব : আই অ্যাম দ্য রিপ্রেজেনটেটিভ পিপল অব বেঙ্গল, লিগালি অ্যান্ড মোরালি। আই অ্যাম দ্য ম্যান, হু ক্যান গভর্ন দিস কান্ট্রি।”

সূত্র : সিবিএস নিউজের ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের খবর।

লিঙ্ক : যঃঃঢ়ং://িি.িুড়ঁঃঁনব.পড়স/ধিঃপয?া=ণটঈগঈঢভংপমপ



সিবিএস নিউজ থেকে এই সংবাদটি সংগ্রহ করে আপলোড করেছেন আমেরিকা প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এম এম আর জালাল। ২০১২ সাল ২৫ মার্চ তিনি এটা প্রথম ইউটিউবে দিয়েছেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে কথা বলে দেখেছি আওয়ামী লীগের খুব কম সংখ্যক কর্মী-নেতা-শুভানুধ্যায়ী, লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এটা দেখেছেন। এখন পর্যন্ত মাত্র ১২,৪২৫ বার ভিডিওটি দেখা হয়েছে। অথচ বিষয়টি ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল।

সিবিএস নিউজ কিন্তু পরিষ্কার করে বলছে বাঙালি নেতা শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। ঘোষণা রেডিওতে কে পাঠ করেছেন, সেটা একটি বিষয়। কিন্তু সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এই সংবাদে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারের অংশটি গ্রহণ করা হয় ২৫ মার্চের আগের কোনো একদিন। সেই সময় যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে শেখ মুজিবের নামেই হচ্ছে। শেখ মুজিব অনেক বিষয়ের পরিষ্কার নির্দেশনা দিয়ে না গেলেও, তাকে কেন্দ্র করেই ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিত হয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতা, লেখক-বুদ্ধিজীবীরা তাদের বিশ্লেষণ এভাবে করছেন না, করেননি। তারা সুনির্দিষ্ট করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেছেন এবং তিনি তা দিয়েছেন ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বেই। এই তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বেশ কিছু যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। এই যুক্তিগুলো যে যৌক্তিক নয়, তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন এ কে খন্দকার। আওয়ামী লীগ এই জায়গাটিতে সত্যিকারের বিপদে পড়ে গেছে। ঘটনা যা ঘটেনি, যেভাবে ঘটেনি, সেভাবে আওয়ামী লীগ ইতিহাস তৈরি করতে চেয়েছে।

৭. ৭৫-এর পর থেকে ইতিহাস বিকৃতির শিকার হয়েছেন বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ। ২১ বছর বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ উদারতার পরিচয় দিতে পারেনি। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আওয়ামী লীগ সুস্থ রাজনীতি করেনি। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আওয়ামী লীগ কিছু বিষয় এমনভাবে সামনে এনেছে, যা তথ্য-যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যায় না। তা আবার ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

এই ঘোষণা নিয়ে যে বিতর্ক আছে, সেই তথ্য কিন্তু এই প্রথম লেখা হচ্ছে না। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর : কথোপকথন’ বইয়েও এ প্রসঙ্গ ছিল। এই বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন শ্রদ্ধেয় ইতিহাসবিদ সালাউদ্দিন আহমদ।

সেই বইয়ের সূত্র ধরে এ কে খন্দকার লিখেছেন,

‘অবাক করার বিষয় হলো, পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা ঘোষণার সেই ছোট্ট খসড়াটি, যা তাজউদ্দীন আহমদ তৈরি করেছিলেন, তার প্রায় হুবহু একটি নকল বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের ঘোষণা হিসেবে প্রচার হতে দেখি। ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাতেও তাজউদ্দীনের সেই খসড়া ঘোষণার কথাগুলো ছাপা হয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের আক্রমণ করে, সেই রাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাটি জনসমক্ষে কীভাবে এল? ২৬ মার্চ তারিখে তো সারা দেশেই সান্ধ্য আইন ছিল। আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মী এবং ছাত্রলীগের নেতারা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে মার্চ মাসে বেশ চাপ দিচ্ছিল। ধারণা করা যায়, সেই সময় তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর খসড়াটি তাঁদের দিয়েছিলেন এবং এঁদের মাধ্যমে যদি এটা স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে প্রচারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমি বিস্মিত হব না।’



ঘটনা যেভাবে ঘটেনি, সেভাবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে, একটি ঘোষণা কয়েক রকম হয়ে গেছে।

‘পরবর্তী সময়ে ঘটনার প্রায় এক বছর পর আরেকটা কথা প্রচার করা হয় যে, ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার ঠিক আগে শেখ সাহেব ইপিআরের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন। এই তথ্যটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রথমত, সামরিক বাহিনীতে থাকার ফলে আমি জানি যে সিগন্যাল সেন্টার বা বার্তাকেন্দ্র সব সময় অত্যন্ত বিশ্বাসী লোক দ্বারা পরিচালনা করা হয়। সিগন্যালই কোনো বাহিনীর প্রতিরক্ষা ও আক্রমণের মূল যোগাযোগমাধ্যম। সেখানে তো বিশ্বাসীদের বাদ দিয়ে সন্দেহের পাত্র বাঙালিদের হাতে সিগন্যাল-ব্যবস্থা থাকতে পারে না। বাস্তবেও পাকিস্তানি বাহিনী আগে থেকেই পিলখানায় ইপিআরের বেতারকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখেছিল। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু যাঁর মারফত এই ঘোষণা ইপিআরের বার্তাকেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তি স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও জনসমক্ষে এলেন না কেন। বঙ্গবন্ধুও তাঁর জীবদ্দশায় কখনো সেই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেননি কেন। একইভাবে চট্টগ্রামের ইপিআর বেতারকেন্দ্র থেকে কে, কীভাবে জহুর আহমেদকে বার্তাটি পাঠালেন, তা রহস্যাবৃতই থেকে গেছে। কাজেই ইপিআরের বার্তাকেন্দ্র ব্যবহার করে শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন-এটা সম্ভবত বাস্তব নয়।’



বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে পাঠানোর বিষয়টি আওয়ামী লীগ অত্যন্ত দুর্বলভাবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করেছে, যা বইটিতে লিখেছেন এ কে খন্দকার।

‘ইপিআরের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠানÑএ দাবিটির প্রচার শুরু হয় ১৯৭২ সালে। এর আগে এটি শোনা যায়নি। অথচ ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টায় টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে শেখ মুজিব চাইলে শুধু একটি ফোন করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (এখন রূপসী বাংলা) ভিড় করা যেকোনো বিদেশি সাংবাদিককে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানাতে পারতেন। তাহলে মুহূর্তের মধ্যে সেটি সারা পৃথিবীতে প্রচার পেয়ে যেত।

বেশ পরে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে আরেকটি তথ্য প্রকাশ পায়। এতে বলা হয় যে বঙ্গবন্ধু টেলিগ্রামের মাধ্যমে কাউকে কাউকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন। সেই ঘোষণার একটি কপি কিছুদিন আগে পত্রিকায় ছাপানো হয়। এই ঘোষণায় পাওয়া বিবৃতি আগের ঘোষণা থেকে পৃথক। ঘোষণা-সংবলিত টেলিগ্রামটি হাতে লেখা এবং প্রাপকের স্ত্রী দাবি করেছেন যে এটি বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা। মিথ্যা প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় সাধারণ বিবেচনা বা জ্ঞানও রহিত হয়ে যায়। টেলিগ্রাম যে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে পাঠানো হয় এবং এখানে প্রেরকের হাতের লেখা প্রাপকের কাছে যায় না, তা তারা ভুলে যান।

যাহোক, বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত কথিত স্বাধীনতা ঘোষণার কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ বাজারে আছে। এই সংস্করণগুলো সরকারি গ্রন্থ ও আওয়ামী লীগের প্রচারিত গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন জায়গায় কেন এই ভিন্নতা, তার উত্তর কেউ দিতে পারে না। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র ৩য় খণ্ড-তে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাগুলোর একটিকে সংযুক্ত করে। পরে, ২০০৪ সালে, এই ঘোষণাটির দালিলিক কোনো প্রমাণ না থাকার কথা বলে উল্লিখিত বই থেকে তা বাদ দেওয়া হয়।’



৮. আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-বুদ্ধিজীবী এই বিষয়গুলো ইতিহাসে সংযুক্ত করেছেন, এখন তাদের উচিত এর ব্যাখ্যা দেয়া। ব্যাখ্যা না দিয়ে ক্ষিপ্ততা দেখালে উল্টো ফল হবে।

৯. মার্চের সেই উত্তাল সময়ে সবকিছু স্বচ্ছ ছিল না। অনেক কিছু নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল। মানুষ বঙ্গবন্ধুর থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা সুস্পষ্ট করে শুনতে চাইছিলেন, সেটাও মিথ্যে নয়। বঙ্গবন্ধু কেন বাড়িতে থেকে গ্রেপ্তার হলেন, বিষয়টি নিয়ে নানা রকমের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।

বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক নেতা, এ কে খন্দকার একজন সামরিক বাহিনীর সদস্য। রাজনৈতিক নেতা কী ভাবছেন, কী কৌশলে এগুবেন, তা একজন সামরিক বাহিনীর সদস্যের পুরোটা বোঝা সম্ভব নয়। এ কে খন্দকার সেই সময় তা বোঝেননি। ক্ষিপ্ততা না দেখিয়ে ইতিহাসের কিছু বিষয়কে মেনে নিয়ে, যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করলে, অনেক বিতর্কের অবসান সহজ হতো। এবং তাতে বঙ্গবন্ধুর অবদান-বীরত্ব-বিচক্ষণতার কোনো অসম্মান হতো না। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা-বুদ্ধিজীবীরা ইতিহাস নিয়ে কথা বলছেন গায়ের শক্তি দিয়ে, যুক্তি দিয়ে নয়।

১০. এ কে খন্দকার তার বইয়ে লিখেছেন, তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যেতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। কেন রাজি হননি, তার কিছু ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়।

কিন্তু আসল কারণ কী, তা হয়ত অজানাই থেকে যায়। অধিকাংশ ইতিহাসেই কিছু রহস্য অজানা থেকে যায়। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় নেতা, বিশেষ করে তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যা করায় অনেক ইতিহাসের সত্য জানার সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

সে কারণে এসব বিতর্কের কিছু বিষয় সম্ভবত বাঙালির সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে গেছে।

১১. বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে রাজি হননি। তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের কথা বলতেই তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজি হয়ে যান।

এ কে খন্দকারের বইয়ের দু’টি অংশের ব্যাখ্যা এভাবে অনেকে দেখতে চাইছেন। দেখতে চাইলে দেখতে পারেন। সেই সময় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি বা দিতে রাজি হননি, ধরে নেই ওই বক্তব্য সত্যি। তাহলেও এত সরলভাবে উপস্থাপন করা যায় না যে, বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিতে রাজি হননি, জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর এই না চাওয়ার নিশ্চয়ই অনেক তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ছিল। অথবা হতে পারে এটা বঙ্গবন্ধুর সেই সময় যা করার দরকার ছিল তিনি তা করেননি। তিনিও তো মানুষ ছিলেন। সব সময়, সব কিছু তার চিন্তার মতো করে ঘটেনি।

কোনো মানুষ তো সম্পূর্ণ নির্ভুল হতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুকে মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে, দেখতে হবে, মূল্যায়ন করতে হবে।

১২. মেজর জিয়া ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। সেই ভাষণ খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। অনেক মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্দীপ্ত করেছিল।

বাংলাদেশের ইতিহাসে যত উপাদান আছে, সবকিছু বিশ্লেষণ করলে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়। মেজর জিয়ার এই ভাষণটি তাৎপর্যপূর্ণ, জিয়ার নিজস্ব ঘোষণা হিসেবে নয়। দ্বিতীয়বার তিনি যখন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই কারণে। কারণ তখন বঙ্গবন্ধু সবকিছু, ব্যক্তি বা মেজর জিয়া কিছু নন।

এই বক্তব্য দিয়ে আবার কোনোভাবেই জিয়াউর রহমানের অবদানকে ছোট বা অসম্মান করা যাবে না। ঘটনা এবং সময় জিয়াউর রহমানকে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দিয়ে গেছে। এটা ইতিহাসের অনিবার্য বাস্তবতা।

বঙ্গবন্ধুর বিকল্প বা তুলনীয় পর্যায়ের কোনো নেতা বা সামরিক অফিসার ছিলেন না। সেই বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে মেজর জিয়ার ঘোষণা পাঠকে অসম্মান, অবমাননা করার পরিকল্পনা নেহাতই নির্বুদ্ধিতা। দলীয় নেতারা এটা কেন করেন, বোঝা যায়। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা যখন এটা করেন, তখন একটা সমাজের অধঃপতিত অবস্থার প্রমাণ পাওয়া যায়। আওয়ামী লেখক-বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ যা করেছেন। এটা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু যা-যেভাবে করেননি, তারা সেটা বঙ্গবন্ধুর নামে চালানোর চেষ্টা করেছেন। করে মহা অন্যায় করেছেন। তাদের সেই অন্যায়ের সুযোগ নিয়ে এ কে খন্দকাররা বই লিখতে পারছেন। যার জবাব আওয়ামী নেতা-বুদ্ধিজীবীরা দিতে পারছেন না।

এ কে খন্দকারের ‘কী করিলে কী হইত’ জাতীয় তথ্যের জবাব দিতে পারে না, তারা পদপদবি, সুযোগ সুবিধার আশায় তোষামোদী করে।

মেজর জিয়ার ভাষণ সম্পর্কে এ কে খন্দকার আসলে কি লিখেছেন, তা পুরোটা না পড়েই বিএনপি-জামায়াত অনেক বেশি হইচই করছে।

‘২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযানের পর ইস্ট পাকিস্তান রেডিওর চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বাঙালি কর্মকর্তারা বেতারের মাধ্যমে কিছু করার পদক্ষেপ নেন। চট্টগ্রামে সান্ধ্য আইনের মধ্যেই তাঁরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে কিছু প্রচার করতে উদ্যোগী হন। সেখানকার বেতার কেন্দ্রের বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে বেতারে কিছু-না-কিছু বলা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাঁরা সবাই মিলে স্বাধীনতা ঘোষণার একটা খসড়া তৈরি করেন। ২৬ মার্চ বেলা দুইটায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গিয়ে তাঁরা সেই খসড়াটি নিজেদের কণ্ঠে প্রচার করেন। পরবর্তী সময়ে সেই ঘোষণা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানও পাঠ করেন। তাঁর ভাষণটি সেদিন সাড়ে চারটা-পাঁচটার দিকে পুনঃপ্রচার করা হয়। তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে-এমন কথা বলা হয়েছিল। তবে প্রথম যে ঘোষণাটি পাঠ করা হয়েছিল, তার থেকে পরবর্তী সময়ে পাঠ করা ঘোষণাটি একটু আলাদা ছিল।

এ সময় বেতারের কর্মীরা দুটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। প্রথমত, যদি কোনো সামরিক ব্যক্তিকে দিয়ে এই কথাগুলো বলানো যায়, তাহলে এর প্রভাব আরও ব্যাপক হবে। দ্বিতীয়ত, নতুন চালুকৃত বেতার কেন্দ্রটির নিরাপত্তা প্রদানের জন্য সামরিক বাহিনীর লোক প্রয়োজন। তাঁরা জানতে পারলেন, সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিকেরা চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ করছেন। তাঁরা খোঁজ নিয়ে আরও জানতে পারেন যে মেজর জিয়াউর রহমান নামের একজন ঊর্ধ্বতন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্যান্য কর্মকর্তা, সৈনিকসহ পটিয়ায় রয়েছেন। ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে এসব বেতারকর্মী পটিয়ায় যান। তাঁরা মেজর জিয়াকে বেতার কেন্দ্রের প্রতিরক্ষার জন্য কিছু বাঙালি সেনাসদস্য দিয়ে সাহায্য করার অনুরোধ জানান। মেজর জিয়া সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে সম্মতি দেন। এ সময় তাঁদের মধ্যে কেউ একজন মেজর জিয়াকে অনুরোধ করে বলেন, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার একটি ঘোষণা তিনি পড়তে রাজি আছেন কি না। মেজর জিয়া বেশ আগ্রহের সঙ্গে এই প্রস্তাবে রাজি হন। তিনি পটিয়া থেকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথম যে ঘোষণা দিলেন, সেটা ভুলভাবেই দিলেন। কারণ, তিনি প্রথম ঘোষণায় নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে সম্বোধন করেছিলেন। পরে সংশোধন করে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সেটি টেপে ধারণ করা হয় এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে তা পুনঃপ্রচার করা হয়। আর এভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ ঘটল।

রেডিওতে আমি মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনেছি। আমি ওই সময় জিয়াকে চিনতাম না। তবে এই ঘোষণায় আমি স্বস্তিবোধ করলাম এবং আশ্বস্ত হলাম যে অন্তত মেজর পর্যায়ের একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এই যুদ্ধে জড়িত হয়েছেন। আমি পরে শুনেছি, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি শিল্পপতি এম আর সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ঘোষণা সারা বাংলাদেশের মানুষ শুনেছে। আমার ধারণা, আমার মতো অনেকে যাঁরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, এই ঘোষণা শোনার পর তাঁরা আরও উৎসাহিত হন। এবং দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে তাঁরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে যুদ্ধ আমরা আরম্ভ করেছি, তা সফল হবেই। এই ঘোষণা শুনে আমি নিজেও খুব উৎফুল্ল এবং আনন্দিত হয়েছিলাম। তবে এটাও সত্য, যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি, স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারকর্মীরা নিজ নিজ মতো করে আগেই দিয়েছিলেন।

এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ উদ্যোগে মেজর জিয়ার কাছে গিয়েছেন এবং তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। মেজর জিয়া নিজস্ব উদ্যোগে তাঁদের কাছে আসেননি। এটা ঠিক, জিয়া তাঁদের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তিনি নিজে স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগ নেননি। ২৬ মার্চ দুপুরে এম এ হান্নান সাহেব স্বাধীনতার যে ঘোষণাটি পড়েছিলেন এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যার দিকে মেজর জিয়া যেটা পড়েন, তার মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য ছিল। ২৬ মার্চেরটা অনেকে হয়তো শুনতে পাননি। কারণ, সেদিন তো সবাই বিভিন্ন কারণে উদ্বিগ্ন-হতবিহ্বল ছিলেন। তবে হান্নান সাহেবের কথারও একটা মূল্য ছিল, যদিও তিনি বেসামরিক লোক ছিলেন এবং জাতীয়ভাবে পরিচিত ছিলেন না। অন্যদিকে যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি মেজরের মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার ছিল।’



মেজর জিয়ার ঘোষণাটিকে কিন্তু এ কে খন্দকার ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ বলছেন না। এ প্রসঙ্গে লিখেছেন-

‘মেজর জিয়ার ঘোষণাটিকে কোনোভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলা চলে না। মেজর জিয়া রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন না বা স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিও ছিলেন না। যে ঘোষণা চট্টগ্রাম বেতার থেকে তিনি দিয়েছিলেন, ঠিক একই ধরনের একাধিক ঘোষণা ২৬ ও ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাও দিয়েছিলেন, এমনকি বেতারকর্মীরাও একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে মেজর জিয়ার এই ঘোষণাটি প্রচারের ফলে সারা দেশের ভেতরে ও সীমান্তে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সেই সংকটময় মুহূর্তে জিয়ার ভাষণটি বিভ্রান্ত ও নেতৃত্বহীন জাতিকে কিছুটা হলেও শক্তি ও সাহস জোগায়। যুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে শুনেছি এবং যুদ্ধের পরবর্তী সময়ও শুনেছি, মেজর জিয়ার ঘোষণাটি তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে কতটা উদ্দীপ্ত করেছিল। মেজর জিয়ার ঘোষণায় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, হ্যাঁ, এইবার বাংলাদেশ সত্যিই একটা যুদ্ধে নেমেছে। হান্নান সাহেব বা অন্য ব্যক্তিদের ঘোষণা ও মেজর জিয়ার ঘোষণার মধ্যে তফাতটা শুধু এখানেই ছিল। মেজর জিয়া যে কাজটি করতে পেরেছিলেন, তা করা উচিত ছিল জাতীয় পর্যায়ের প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের এবং এর জন্য তাঁদের একটা পূর্বপরিকল্পনাও থাকা প্রয়োজন ছিল।’



১৩. এখন আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এ কে খন্দকার সুবিধাবাদী। সংসদের মাইক ফাটিয়ে ফেলছেন। গলার রগ ফুলিয়ে কথা বলছেন। এমপি, মন্ত্রী হয়ে বই পোড়াচ্ছেন। দেশদ্রোহী বলছেন, রিমান্ডে নিতে চাইছেন। অথচ জবাব দিয়ে একটি লেখা কারও হাত দিয়ে বের হচ্ছে না। এ কে খন্দকার কি সুবিধাবাদী আজকে থেকে?

বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদ পেয়েছেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাকের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছেন। জিয়াউর রহমানের পুরো মেয়াদকালে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এরশাদের মন্ত্রী।

তারপর ১৯৯৮ সালে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ থেকে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী।

তো এরকম একজন মানুষকে আপনারা এমপি-মন্ত্রী বানালেন কেন?

এই প্রশ্নটি কি খুব স্বাভাবিকভাবেই সামনে চলে আসে না যে, আপনাদের সঙ্গে থাকলে মুক্তিযোদ্ধা। বিরুদ্ধে গেলেই রাজাকার, সুবিধাবাদী?

এই প্রশ্নের জবাব কী?

১৪. এ কে খন্দকার একটি বই লিখেছেন। গুরুত্বহীন মনে করলে চুপ থাকা শ্রেয়। গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, প্রতিটি প্রসঙ্গের যৌক্তিক, ইতিহাসভিত্তিক জবাব দেয়া বাঞ্ছনীয়-প্রত্যাশিত। ক্ষিপ্ততা বাঞ্ছনীয় নয়, প্রত্যাশিত নয়। ইতিহাসে ক্ষিপ্ততার কোনো স্থান নেই। যে প্রশ্নগুলো এখন উঠেছে, এই প্রশ্নের কিছু অতীতেও উঠেছে, ভবিষ্যতেও উঠবে।

জবাব দেয়ার তথ্য-যোগ্যতা-যুক্তি থাকতে হবে। অসত্য মিথ গায়ের জোরে টিকিয়ে রাখা যাবে না। যেমন ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন- এটা প্রমাণ করা যাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ যেভাবে দিয়েছেন বলে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে- তাও প্রমাণ করা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, বঙ্গবন্ধু এত বড় নেতা যে, তাকে নিয়ে কোনো মিথ তৈরির প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে যে মিথগুলোর পক্ষে তথ্যপ্রমাণ নেই। বঙ্গবন্ধুর অবদান ইতিহাসে এত বড়, এত পোক্ত যে, একটি কেন, এক কোটি বই লিখেও তা অস্বীকার করা যাবে না। অসম্মানও করা যাবে না।

বঙ্গবন্ধু যা করেননি, যেভাবে করেননি, সেটা বলার, প্রমাণ করার চেষ্টা হলে, ক্ষিপ্ততা-শক্তি দিয়ে সেটা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে বঙ্গবন্ধুকেই অসম্মান করা হবে। এটা কোনোভাবে, কারও থেকেই প্রত্যাশিত নয়।



link: http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=9552



** এটা একটা copy-pest পোষ্ট। লেখাতে তথ্য বা মতামত লেখকের। আমি শুধু শেয়ার করলাম।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:২৩

হরিণা-১৯৭১ বলেছেন:



শেখ সাহেব 'জয় পাকিস্তান' বললে কোন ক্ষতি হয়নি; তখনো চেস্টা চলছিল সামরিক সরকারের উপর চাপ সৃস্টি করে শেখ সাহেবের সরকার গঠনের।

৭ই মার্চের পরেও সরকারের সাথে শেখ সাহেবের কথা হয়েছে, ফলাফল শুন্য।
বর্তমান আওয়ামী লীগ চুরি-ডাকাতী করছে, তাই তাদের ভাবনা পরিস্কার নয়/

খন্দকার মুক্তিযোদ্ধা, উনি সঠিক বলেছেন; ওটাই ইতিহাস।

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪০

মোঃ রেজাউল ইসলাম বলেছেন: ক্ষতিটা শেখ মুজিবের না। কিন্তু মহা ক্ষতি শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগের। মুক্তিযুদ্ধই যাদের একমাত্র রাজনৈতিক পুঁজি, তাদের কাছে শেখ মুজিব শুধু জাতির পিতাই না, তিনি তাদের আদর্শিক নবী।

আমরা মুসলিমরা যেমন কোনভাবেই আমাদের নবীর কোন ভুল, দুর্বলতা বা মানবিক ত্রুটি থাকতে পারে এটা কোন ভাবেই মানব না............ এই সব আওয়ামী ফ্যাসিস্ট রাও মানতে পারে না, শেখ মুজিব স্বাধীনতা চাননি, বা জয় পাকিস্তান......... এমন কিছু বলতে পারে.........।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.