নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রবাহূত

রবাহূত › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার শৈশব এবং জাদুর শহর (৬)

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:১৯


(লিখাটা বেশ আগেই লিখা কিন্তু আরও একটু লিখব বলে বসে ছিলাম, হয়ে উঠছে না তাই পোস্ট করে দিলাম)

আমার কাছে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কেই মনে হয় যেন এক একটা গদ্য বিশেষ, ঠিক গদ্য না গল্প সমগ্র। বেশ সাস্থ্যবান গোটা গোটা হরফে লিখা। কারোটা বেশ ঝলমলে, কারোটা বেশ বেদনা বিধুর কারোরটা বেশ রগরগে স্পাই থ্রিলার। একসময় জীবন অনেক বেশী সচল ছিল নানা জায়গায় যাতায়াত হত নানা শ্রেণী পেশার বিচিত্রতর লোকদের দেখতে পেতাম, বুঝতে পেতাম, চির কৌতুহলি মন অনেক অবান্তর প্রশ্ন করে জেনে নিতাম তাদের জীবন জিবিকা, হাসি কান্না। মার্জিনে মন্তব্যের মত মনের খাতায় এঁকে রাখতাম কত গল্প।
এইযে যে লোকটি ঝুলছে বাদুড় ঝোলা বাসের ফুট বোর্ডে , কিংবা দাঁড়িয়ে মুড়িমাখা খাচ্ছে বিস্তর, হয়ত তারা অফিস ফেরত পিয়ন কি সামান্য কেরানী, অফিসে জোড় ধমক খায় সাহেব কি বাবুর, কম্পমান ত্রস্ত এ লোকটিই বাড়ি ফিরে, ঘেমো জামা খুলেই বাড়ীর কর্তা, অবসরে মেয়ের অ্যালজাব্রা কসে দেন। মাস শেষে বাড়ী ভাড়া বাড়ানোর নাহক আবদারে বাড়িওয়ালাকে দাবড়ে দেন বেশ। ঈদে চান্দে বাড়ি গেলে সেই গাঁয়েরই এক জন কেউকেটে বনে যান।সালিস দরবার করেন। বেশ তখন একটা ব্যক্তিত্বও চলে আসে চোখে মুখে, এখন যাকে বেশ অকিঞ্চিৎকর মনে হচ্ছে, সে-ই কোথাও দায়িত্ববান স্বামী, স্নেহময় পিতা, নির্ভরযোগ্য ভাই। এ জীবনের এক অপূর্ব সুন্দর ছবি। এই যে দুঁদে পুলিশ অফিসার দাবড়ে বেড়াচ্ছেন এঁকে তাঁকে, সেই হয়তো রাত্তিরে কোঁকড়া চুল বালিকাটিকে ছাড়া ঘুমাতেই পারেন না, স্নেহময় বাবা। এমনি প্রায়ই ভাবি জীবনে কত মানুষের সাথে আমাদের যোগসূত্র ঘটে আবার হারিয়ে যায়। এক এক সময় মনে হত এঁকে ছাড়া বুঝি চলবেই না এক মুহূর্ত, আজ সে ঘটনার ঘনঘটায়, কোথায় ছিটকে গেছে। জীবন কত ঘটনার কত রটনার তাকে বোঝা দায়। এই অসহায় শহর আমার আগলে রাখছে কত সহস্র দিবস রজনীর গল্প, যার কাছে আরব্য রজনীর গল্পও বুঝি ম্লান।
আমাকে গল্প সব সময় বড় বেশি টানে। গল্প কিচ্ছা গীত আমি বিস্তর শুনেছি। গাজি কালু চম্পাবতী, বেহুলা লখিন্দর আরও অনেক, আজ আর মনেও নেই। আমাদের বাসায় যে কাজের লোকটি শেষ মেষ ছিল সে ছিল এইসব কিচ্ছার ডিপো। কত অলস দুপুরে, কিংবা ঘুম ঘুম সন্ধ্যায় কত যে গল্প শুনেছি। লোকজ এই সাহিত্যের এই বিশাল ভান্ডার এর খোঁজ আমি তার কাছেই প্রথম পাই, যা আমার শিশু মনকে আন্দোলিত করেছিলো সেই সময়তেই। উদার খোলা আকাশ, ধুধু নিঃসঙ্গ মাঠ, আমার মন কেমন করে উঠত। ডাকঘর লিখার পর রবীন্দ্রনাথ দিন দুয়েক ছাদে মাদুর পেতে একাকি থাকতেন, এক বিষণ্ণতা তাঁকে গ্রাস করেছিলো, সেই দই ওয়ালার হাঁক, অমলের জানলার গরাদ ধরে ডাকা “দই ওয়ালা ও দই ওয়ালা...” কি যেন এক বিষণ্ণ মাধুর্য আচ্ছন্ন করে রাখে। আমার শৈশব এখন মনে হয় তেমনি বিষণ্ণ মধুর। চোখে ভাসে বিশাল ধু ধু চষা খেত, অপেক্ষায় বর্ষণের, ফালগুণ চৈত্রের বাউরি বাতাস সব এলোমেলো করে দিচ্ছে, দূরে রেইন্ট্রি গাছের ঝুপ্পুস ছায়া, আমার একাকি ঘুড়ি উড়ছে, কমলা কিংবা বেগুনী, দূরে রিক্সা দিয়ে আইস্ক্রিম ওয়ালা আইস্ক্রিম ফেরি করছে তার রিকশায় লাগানো চোঙ্গা মাইকে গান বাজছে...”মনটা যদি খোলা যেত, সিন্ধুকেরি মত দেখাইতে পারিতাম তোমায় ভালো বাসি কত...” সেই খাঁ খাঁ রোদ জ্বলা নিদাঘ দুপুরে মনটা হু হু করে উঠত, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যার জন্য। কত কি কল্পনা করতাম, কত দৈত্য দানো, ভুত প্রেতকে হারিয়ে পোঁছে যেতাম পাতাল পুরি। অজস্র বই ছিল আমাদের রূপকথার, কি ছোটদের রাশান বই কি যে আপুরুপ, তাই কল্পনার রসদের অভাব হত না। আর তার সাথে এই খোলা খোলা দিন গুলি। আমরা আমার ক্লাস টু কি থ্রীতে কিশোরগঞ্জ ফিরে আসি, তবে কিশোরগঞ্জ বাসা ভাড়া নেয়ার আগে এক দেড় কি দুই মাস আমাদের গ্রামে কাটিয়ে ছিলাম, এমনিতেও প্রতিবার ফাইনাল পরীক্ষার পর আমাদের গ্রামে যাবার একটা নিয়ম ছিলই, তবে সেবার যেমন হল এমনটি আর হয়নি। এমন বাঁধন হারা ভাবনাহীন উচ্ছল সময় বড় বিরল এই যাপিত জীবনে। হয়তো এ কোন জাদুর শহরের গল্প নয়, একান্তই আমার শৈশবের কথকতা, কিছু উচ্ছল দিন রোদ গন্ধ মাখা, কিছু খাপ ছাড়া মানুষের আনাগোনা, কিন্তু এই দূর থেকে বড় মুল্যবান বড় আদরের আজ। এমন গল্প কম বেশি সবারই একই, তাও স্মৃতির পাতা থেকে যেন মলিন হয়ে হারিয়ে না যায়, তাই সেই রোদ হাওয়া, সবুজ কি ঝুম বৃষ্টিকে বোতল বন্দী করার এই চেষ্টা।
কিশোরগঞ্জে থাকতে যাবার আগে যতবার যেতাম, বাবা রেলের সেলুন পেতেন। সে যে কি রাজসিক ব্যাপার, কি বলব আর। ইয়া পুরু গদির বিছানা, তুলতুলিকা বালিশ, চামড়ার গদি আটা বিশাল সব চেয়ার, রিচ উডেন ফিনিশড ইন্টেরিওর, চকচকে ভার্নিস। উর্দি পরা বয় বেয়ারা! সে এক দারুন জমাটি ব্যাপার। আর খয়াওয়াটাও ছিল তেমনি, পুরু কাটলেট কি চপ যেন এখনো স্বাদ পাই। রাতের চিটাগং মেইলের সাথে জুড়ে দিত সেই বগি, আমরা ছুটতাম, ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক, আর খুব মজা পেতাম এই চাঁদটা এখন যেমন তখনও আমাদের সাথে সাথে খুব ছুট্ত। আমি আর শারমিন চাঁদ দেখতে থাকতাম একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতাম, কখন কখন ভৈরব ব্রিজ পার হওয়ার সময় সজাগ থাকলে অবাক বিস্ময়ে দেখতাম কি গম্ভীর বিষণ্ণ সে পারাপার, চাঁদের প্রতিবিম্ব ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে, কোথাও কেউ নেই, কি যে এক হাহাকার বালক মনে হত! এখনো তার রেশ রয়ে আছে, স্মৃতি এক অচিনব্যাধি, নিরারোগ্য! ঘুমিয়ে থাকে, ঘুমিয়ে থাকে সহসা ঘাই মেরে উঠে শুল বেদনা যেন! হারানোর ব্যথা বড় করুন! কি প্রিয়জন, কি ব্যবহার্য কি পরিধান বড় করুণ! হারানো সময় বুঝি তেমনি, কখন উঁকি দিয়ে যায়, মুহূর্তে তেড়ে ফুড়ে আসে হটকা বানের মত, খাড়িতে যেমন! কত কথা, কত স্বাদ, কত ঘ্রান। বাক্সের পুরনো চিঠির মত। ট্রেন কোন ষ্টেশনে থামলে, ঘুম জেত ভেঙে, খানিকক্ষণ ভম্বল হয়ে থাকতাম, কোথায় আছি? কি হচ্ছে বুজতাম নাহ। নাকে আসত ফস করে কারো ম্যাচ জ্বালানোর ঝাঁঝালো গন্ধ, খানিক পর পোড়া তামাকের, সহসা ছিলা মিষ্টি কমলার গন্ধ। হাজার শব্দ, বাক্য ফেরিওয়ালার হাঁক, কুলিদের ডাক সব মিলিয়ে এক গভীর শব্দবহুল বিহব্লতায় বিবস থাকতাম খানিক তারপর ক্রমশ শব্দরা হত শ্রূত, পেত আকার, পেত রূপ। এখনো রেলের ষ্টেশন গুলিতে সেই একই গন্ধ একই জমাট শব্দরা হাজির হয়। সময় শুধু হারিয়ে গেছে, কত চেনা মুখ প্রিয় মুখ হারিয়ে যায়। কখন কখন এমন হয় কিছু মানুষের সাথে দেখা হওয়ার পর, মনে হয় এই মানুষটির সাথে বুঝি আর কখন দেখা হবে না, আর মুখমুখি বসে গল্প হবে না! যার সাথে কখন কেটেছে সময় অপরিমেয়, অর্বুদ শব্দের হয়েছে বিনিময়, আজ জীবনের কোথাও সে নেই। এই জীবন, এই নাতিদীরঘ জিবনে কত সহস্র মানুষের আসা যাওয়ায় মুখরিত, সে এক বিশাল আনন্দ যজ্ঞ। জীবন নেহাত মন্দ নয় জানি, হয়তো আমার হারানোর পাল্লাটাই ভারি তাই বুঝি মন আমার শুধু হারানো দিন গুলির ভুল্ভুলাইয়াতেই ঘুরে ফিরে মরে। দুরের মেঘ, চলতি গাড়ী থেকে ভেসে আসা সুর, রোদ হাওয়ার হারানো গন্ধ বার বার আমায় নিয়ে চলে সেই রূপকথার দিনগুলিতে, হায় আজ সে সময় গুলি আমার কাছে রূপকথার দিনই হয়ে গেছে!

সেবার যখন আমাদের গ্রামের বাড়ি যাই, পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, তখনও বিদ্যুতের বিলাসিতা গ্রামে পৌঁছোয়নি। ঝুপ্পুস অন্ধকার, ছায়া আবছায়া শীতের সন্ধ্যা! কুপী কি হ্যারিকেনের লালচে আলো আর মানুষদের, আসবাবদের অপার্থিব লম্বা ছায়ায় ছিল মিশে কুয়াসার এক রাশ রহস্য। ঘুম ঘুম চোখে কেমন একটা দুরু দুরু ভয় কেঁপে কেঁপে উঠেছিলো মনে আছে এখনো খুব। যদিও পরদিনের ভোরের হাওয়ায় সব কোথায় উড়ে গেল। দিন মান ক্লান্তিহীন ছুটোছুটি, আর দিন মান সব বিস্ময়ের সন্ধানে আমি যারপর নাই আপ্লূত, পৃথিবীর পাঠশালার আনকোরা ছাত্রটি যেন। কত কিছু চিনছি, জানছি তার শেষ নেই। সেবার আমার কাকার সাথে শুধু আমরা শুধু ছোট তিনজন এশ্ছিলাম, কাকা আমাদের মজলিশি লোক, শাসনে বিশ্বাসী নয়, আর কাকিমার প্রশ্রয়ের তো শেষ নেই, আমার এই বড় বোন দুটিতো ইয়ার বন্ধু, আর সমস্ত অন্যায় আব্দারের জায়গা ছিল আমার তিন নম্বর চাচাতো বোনটি, গুলতির গুলতি বানাও, বাঁশের কঞ্চির লাঠি বানাও, অসময়ে ধরা মাছ রেঁধে দাও, শেষ নেই। যা হবার তাই হল, পায়ের চামড়া ফেটে ফুটি ফাটা হয়ে গেলো, রোদরে পুরে ঝাঁই কালো হয়ে গেলাম, গায়ে চিমসে গন্ধ নিয়ে দিনমান ছুটি, দুপুরে ঠান্ডা জলে চোখ লাল না হওয়া পর্যন্ত দাপাদাপি করে বেরাই। চোখ লাল হলে মন্ত্র পরি “আমার চোখ লাল না, কাউয়ার চোখ লাল”,এক এক দিন বোনরা ধরে গরম জলে ঝামা দিয়ে ঘসে গায়ের ছাল চামড়া তুলে দিত। দিন মান রুটিনে বাঁধা নেই কোন তবে কম বেশি একটা কাজ রোজই করতাম আমরা বিকেলে হাঁটতে যাওয়া, দল বেঁধে আমাদের সব্বাই আর দুই চার জন পারাপ্রতিবেশি খেলার সাথি সহ বিশাল এক দল। লাইন ধরে ন্যাড়া খেতের আল ধরে চলতাম, শীতের বিকেলের দীর্ঘ ছায়ারা দীর্ঘতর হত, সুন্দর দীঘল ছায়া। লালচে মায়ায় কি যে এক কোমল আলো হত তখন, কে জানে দেখার চোখই বুঝি বদলে গেছে এখন। সে মায়ার খেলায় হয়ত কোথাও কোন বালক মন আনচান করে উঠে, সে তো আমি আর নই, অন্য কোথাও অন্য কেউ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:১৪

শায়মা বলেছেন: সব সময় মুগ্ধ হই লেখা পড়ে ভাইয়া!:)

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:৪৬

রবাহূত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই। খুব ভালো থাকুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.