নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রবাহূত

রবাহূত › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার শৈশব এবং জাদুর শহর (৯)

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫৭

শৈশব এমন এক কাল যেখানে কোন ভেদাভেদ থাকে না, থাকেনা অভস্ত্য জীবনের কড়াকড়ি। এমন উদার মন আর থাকেনা বয়সে, মানুষের। ঢাকার বিশাল লন, বাবুর্চি-খানসামার বিলাসিতাহীন জীবন বারেকের জন্যও হয়নি ভাবিত। “এই বেশ ভাল আছি” এই যেন জীবনের মন্ত্র। আমার এখনো তাই! এ শিক্ষা পিতার কাছ থেকে পাওয়া। কখন মনে হয় বাবা বুঝি ছিলেন দার্শনিক, হয়ত সবার বাবাই এমন! কে জানে আমার পুত্রও বুঝি এমনি বলবে, কে জানে হয়ত না ও হতে পারে, আমাদের বাবা যেমন ছিলেন আমরা তো আর তেমন না, কি বিশাল মাঠের মত, আড়িয়াল খাঁ বিলের মত, কিংবা দুরের পাহাড়ের মত, কি বিশাল আর গম্ভীর, সব খান থেকেই দেখা যায়, কাছে যাওয়া যায় কিন্তু চড়াই উতরে পেরুনো যায় না, যত উঠি তিনি আরও উঁচুতে উঠে যান। তাঁর বইয়ের ভাণ্ডারের দু চারটে বই উদ্ধার করতে পেরেছি, পার্ল এস বাক কিংবা রাসেলের ক্রিটিক্যাল হিস্টোরি অফ ফিলসফি কিংবা চে’র গেরিলা ওয়ার ফেয়ার, কি বিস্ময়! কি বিশাল কৌতূহলী মন ছিল উনার! মার্ক, এঙ্গেলস, লেনিন কি ছিল না তাঁর সংগ্রহে! জুল ভারনের দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড কিংবা রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ট্রেজার আইল্যন্ডের গল্প প্রথম তাঁর কাছেই শোনা। “কোয়সিমদোকে” ভালোবাসতে তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি। ভাগ্যে লিখা ছিল ভিন্ন! তাই হারাতে হল অকালেই, কিন্তু শিক্ষা আদর্শ হারায়নি এখনো, এই আক্রার বাজারে থাকে কত দিন বড় ভয় হয়! শৈশব আদর্শ বুঝে না! কিন্তু ঠিক বেঠিক বুঝে কখনও বড়দের থেকেও বেশী।
যে পাড়ায় আমরা ভাড়া এসে উঠলাম, সে পাড়ার সকলের সাথে বন্ধু হতে দুদিনের বেশী বুঝি সময় লাগলো না। সে কি উদ্দাম দিন, দিনমান ক্রিকেট কি ফুটবল, দুপুরে অবাধ সাঁতার! আর সন্ধ্যা হতেই চোখে রাজ্যের ঘুম! আর খুব সকালে ঘুমটা ভাঙ্গত। আর আমার একটা অভ্যাস ছিল ঘুম থেকে উঠেই বাইরের খোলা সিঁড়িটাতে বসে সকালটা দেখতাম। কিভাবে যে হত দিনের শুরু, কি যে তার রূপ! ফিকে একটা রং কিভাবে টগবগিয়ে রাঙ্গা একটা সকাল হয়ে উঠত! মনে হত আমি বুঝি একা,এই পৃথিবীর! না কোন অতীত, না কোন ভবিষ্যৎ! শুধুই ঘটমান বর্তমান! মানুষের এই একা থাকাটা খুব জরুরি! দিনের একটা সময় একান্ত নিজের দরকার! নিজেকে খুঁজে পেতে নিজের কিছুটা সময় চাই! যা আজ সত্যি বিরল! নিজেকে দেখতে হয় নিজের ছায়ায়!
সন্ধ্যায় ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে চাঁদের আলোতে আমরা খেলতাম “ছায়া পাড়াপাড়ি”!আমরা ছায়া কে বলতাম ছ্যামা! কি অদ্ভুতই না ছিল দিনগুলি! কে কার ছায়া মারাতে পারে। একদিন মনে আছে এমন ফিনিক ফোটা জোছনায় আমরা খেলছিলাম খুব। কিছু যে ঘটে ছিল তা কিন্তু নয়। শুধুই খেলেছিলাম খুব। দুধের সরের মত জোছনা! কী মায়া! আমার দুবোন এস, ভি স্কুলে ভর্তি হল, আমি হলাম কিন্ডারগার্টেনে। তখনও, এখনো ছিল সেরা স্কুল। ওদের ছিল সবুজ জামা, সাদা পাজামা। আমার ছিল নীল প্যান্ট, সাদা শার্ট, আমার ঢাকার স্কুলে উনিফর্ম ছিল না। তাই খুব মজা লাগতো উনিফর্ম পরতে, আরও মজা লাগতো স্কুলের সব্বাই এত চিনত আর এত আদর করত, অবাক লাগতো। তখন স্কুলে কেউই ব্যাগ নিয়ে যেত না, আমার ব্যাগ ছিল, দিন দুয়েক নিয়ে গিয়েছিলাম তারপর স্কুলের পিছের আলোর মেলার পুকুরে জলাঞ্জলি দিয়ে দেই, ফেলো ফিলিংস থেকে, কিন্তু খাদিমের হকি শু পায়ে থাকত কিংবা সাদা ক্যনভাসের স্কুল শু, যা বন্ধের দিন ধুয়ে চক ঘসে সাদা করে রাখতাম। বন্ধুরা ছিল অজয়, বিপুল, তুষার, শাওন,সজিব, মাহবুব, সবুজ, মাসুদ আরও অনেকে। দুষ্টু ছেলে ছিল কাম্রুল কখনও উনিফর্ম পরত না, এক ঈদে যে নতুন জামা প্যান্ট পেত পরের ঈদ পর্যন্ত নন স্টপ তাই পরত, কি অদ্ভুত খেয়াল। আমরা স্কুলে খুব খেলতাম। মাঝে মাঝে না খেলে পাশের আলোর মেলায় যেতাম, তখন সে আলোর মেলা হত যৌবন কিন্তু লাইব্রেরীতে বই ছিল প্রচুর, মজার মজার, চাইনিজ ছবির বই বিশেষ করে বাচ্চাদের যা সব থেকে প্রিয়। মাঠে ছিল খান দুয়েক ভাঙ্গা স্লাইডস আর সি-স (আমরা বলতাম ঢেকি)। এসব বেশী টানত না কিন্তু ঢুকবার গেইট্টা ছিল মজার কামরাঙ্গার মত একজন একজন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢুকতে হয়, পার্কে থাকে যেমন, আমরা ঘুরতেই থাকতাম। আর আমাদের স্কুলের বড় আপা ছিলেন একজন অসামান্য টিচার! বার দুয়েক দেশ সেরা শিক্ষিকার সম্মান পেয়েছেন, আপার হাসিটি ছিল বড় মিষ্টি। আর ছিল আশ্রাফ ভাই তার কমল আদর শাসন, আশ্রয় প্রশ্রয় বড় মনে পরে, গলাটা ঈষৎ ভাঙ্গা ছিল! ২৬ মার্চ কিংবা ১৬ই ডিসেম্বরের কুচ কাওয়াজের রিহার্সালের দিন গুলি কি যে ভালো লাগতো! মার্চ পাস্ট আর কোন না কোন দেশের গানের সাথে কসরত। “কচি শোনা মুখে হাসি খুশি ভরা মন, এক সাথে আজ চল ভাইবোন” মনের গহীনে বেজে যায়, ভাবলেই বুঝি পেরিয়ে যাই বয়সের বেড়াজাল।
তখন এখনকার মত এত গরম ছিল না পৃথিবী কিংবা ছোট শহরে শীত শীত ভাবটাই বেশী থাকত, মোটামুটি আগস্টের শেষ থেকেই হাল্কা শীতের শুরু হত, মানে আশ্বিনের শেষে শেষে বাতাসে কেমন একটা শীতের গন্ধ চলে আসতো, হেমন্তের হিম হিম একটা হাওয়া দিত। “হেমন্তের নবান্ন”-এর শেষে,শস্যহীন জমি পরে থাকত শক্ত শক্ত নাড়া বুকে নিয়ে, আমাদের বাসাটা ছিল শহরের প্রায় শেষ দিকে, একটু হাঁটলেই বিশাল একটা বন্ধ (খোলা আবাদি জমি) ছিল, কখন কখন সকাল বেলা হাঁটতে হাঁটতে ওদিকে গেলে দেখতাম ছোট ছোট বাচ্চারা ঐ জমিতে টুকরি হাতে কি যেন কুরাচ্ছে । এগুলো আসলে ঝরা ধান বা মেঠ ইঁদুরের গর্তে লুকান ধান বের করে করে টুকরিতে জমাচ্ছে, ঠিক কালিদাস রায়ের কুড়ানি। ব্যাথিত হবার বয়স তখনও হয়নি। অন্যায় কি পাপ বুঝবার বয়স হয়নি, সাম্যবাদ কি গণতন্ত্রের যন্ত্রণা, দানা বাঁধেনি, কিন্তু বড় কষ্ট হত! যে মানুষ সামান্য নগণ্য ইঁদুরের সঞ্চয় থেকে নিজের আহার জোটায় এ কেমন “সেরা জীব”! এ কেমন ধারা সমাজ? অভাবের সে বীভৎস রূপ আমরা কতটুকুই জানি? কচি কচি পায়ে খড়খড়ে ধানের গোঁড়া ওয়ালা মাঠে হাঁটতে কি ব্যাথা, বুঝবার অবকাশ আমাদের কতটুকুই আছে? শীতে ফেটে চৌচির হাত পায়ের কমল কচি ত্বক, জামা খানা শুধু গায়ে সেফটি পিন দিয়ে লটকে রেখেছে, সকাল কি সন্ধ্যার ধূমায়িত খড়ের আগুন একটু উষ্ণতা আনে। হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত্রি পেরিয়ে কখন সূর্য উঠবে, উষ্ণতা ছড়াবে? মায়ের নিবিড় আলিঙ্গন কিংবা ভালবাসার ওম ও কখন কখন হেরে যায়। আজ এত দূর পেরিয়ে এসেও এ রাষ্ট্র কি পেরেছে দিতে ভাত, কাপড়, আশ্রয়ের নিরাপত্তা? সারি সারি নোংরা দালান আর ধুলিমলিন রাস্তার ধারে নির্লজ্জ ঝলমলে বাজারে পণ্যের পসরা, তেলে মাথায় তেল দেবার অর্থনীতি আড়ালে লুকতে চায় এইসব ছাই পাশ।
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে রেসকোর্সের কাঁটাতার,
কারফিউ, ১৪৪-ধারা,
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে ধাবমান খাকি
জিপের পেছনে মন্ত্রীর কালো গাড়ি,
কাঠগড়া, গরাদের সারি সারি খোপ
কাতারে কাতারে রাজবন্দী... ...

রাষ্ট্র মানেই পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত
ব্যর্থ সেমিনার
রাষ্ট্র মানেই নিহত সৈনিকের স্ত্রী
রাষ্ট্র মানেই ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে যাওয়া
রাষ্ট্র মানেই রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতা
রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতা মানেই
লেফট রাইট, লেফট রাইট, লেফট ।

হতে পারত রাষ্ট্র মানে ... ফ্যান তোলা গরম ভাতের উষ্ণতা, হতে পারত শীতের আশ্রয় গভীর ভালবাসায়, রাষ্ট্র মানে বই বুকে শিশুদের ছুটে যাওয়া ক্লাসে, হতে পারত বালকের হাতে হাতুরির কাস্তের বদল ঘুড়ির নাটাই, হতে পারত প্রসুতি মায়ের নিরাপত্তা। হায় এ তো এক ভানুমতির খেল! বাউদিয়া বাজিকরের ডুগডুগির নাচনে অনুকরণ প্রিয় বাঁদর কি ভালুর কসরত। যেমনে নাচায় তেমনি নাচি। ডুগডুগি বাজিয়ে বলে “নয়া বউরে লিয়া নওশা যায়” অমনি বাঁদর লাল টুপিখানা মাথায় চড়িয়ে মুখে রুমাল গুঁজে। আবার বলে “ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় কেঙ্কে?” নিজের গলার শিকল কি রসি এক হাতে উপরে তুলে আধ হাত জিহবা বের করে লটকে দেয় মাথা। হাজার বছরের এ পথ চলায় কখন কোথাও কি মানুষ সব দাড়িয়েছে এক কাতারে। আমাদের সৌভাগ্য দেশ এখন সিরিয়া কি লেবানন নয়। রাষ্ট্র যা পারেনি পারছে তা শত শত মানুষ। কত মানুষ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে শিক্ষা, চিকিৎসা, আশ্রয় নিয়ে। তাঁদের সেলাম। এক সময় জানি, জানি নিশ্চিত, সুদিন আসবেই। সবাই সবার কাজটা করে যাওয়াই অনেক বড় কাজ।

সে অভাব ক্লিষ্ট সমাজের কেউ কেউ আমাদের সাথে খেলা ধূলা করত তুই তুমির সম্পর্কই ছিল। বুঝিনি কোন দূরত্ব। কি খেলাই না খেলতাম। ক্রিকেট, ফুটবল, রাউন্ডটাচ ( দেশি বেইস বল সংস্করণ), ডাংগুলি, হকি, সাতচারা, বম্বাস্টিং, গোল্লাছুট এমন কি বউ-চি পর্যন্ত। বউ-চি খেলার সময় এক এক জন দম দিত কি যে অদ্ভুত সব ছড়া বলে। দু এক খানা কিছুটা ছাপার অযোগ্যও যে ছিল না তা কিন্তু নয়। তবে আমি এসব ব্যাপারে নিতান্তই দুর্বল ছিলাম। যে পাড়াটায় আমরা থাকতাম সেখানে একটা বন্ধু জুটেছিল জুয়েল পরে জেনেছিলাম আমার স্কুলেই পড়ত অন্য সেকশনে। অবস্থাপন্ন গেরস্ত ঘর বেশ ক’খানা বাড়ি ভাড়া দিয়ে রাখা, বাড়ির নামটা মনে নেই কিন্তু ওর বাবার নামের আগে লিখা ছিল “প্রো” তারপর সেমিকোলন ভাবতাম বুঝি প্রফেসর কিন্তু গুঁফো স্থুল চেহারা খানা ঠিক প্রফেসর সুলভ ছিল না, পরে জানলাম “প্রো” মানে “প্রোপ্রাইটর”, এ শব্দখানা সেখান থেকেই শেখা আনার এ শব্দটির সাথে সবসময় উনার কথা মনে আসে। মন এক অদ্ভুত ধাঁধাঁ কিংবা ধাঁধাঁর থেকেও জটিল। তো এ হেন জুয়েলের সাথে আমার একবার লাগলো খুব। দু একজনের মুখে শুনলাম, আমাকে নাকি মারবে সে। কিন্তু পাত্তা দিলাম না। কোন এক দিন বাসার সামনের খোলা জায়গায় বসে আছি হঠাৎ পিঠে যেন কি লাগলো, আর জুয়েল কে দৌড়ে চলে যেতে দেখলাম, হাতে ইলেক্ট্রিক তার পেঁচিয়ে বানানো চাবুকের মত কিছু একটা। লাগেনি খুব কিন্তু খুব অবাক হয়ে ছিলাম আর একটু গর্বও যে হচ্ছিলো না তা বলব না, আমাকে ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। বেশ একটা শ্লাঘা অনুভূত হচ্ছিল। প্রতিশোধ আর নেয়া হয়নি ক্ষমাই করে দিতে হল, কিছু দিন এড়িয়ে চলত তারপর একদিন শুনলাম ইলেক্ট্রিক শখ খেয়ে মারা গেছে জুয়েল। সহজ সরল ছিল বড় সে। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব করুন।মাঝে মাঝেই ওর কথা মনে হয়। কত মানুষ হারিয়ে যায় হারিয়ে যাওয়াই বুঝি জীবন। সময়, মানুষ, বর্ণ- গন্ধ সবই হারায়।স্থির, নিশ্চল-নিত্য কিছুই নয় এ সংসারে।

সেই সব দিনগুলি যা গেছে তা গেছেই। আজকের এই দিনটিও একদিন সেই সব দিনের খাতায় লিখাবে নাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলা, এই শ্বাসরুদ্ধ যাপিত দিনগুলিই হবে প্রজাপতি রঙ্গিন। তাই অত পিছনে দেখতে নেই, এগিয়ে যেত হলে। কিন্তু কারুর যে হায় এতেই আনন্দ, পথ চাওয়ার মতই আনন্দ! আমার স্কুলের পাশেই আমার বোনেদের স্কুল ছিল, আমার ছুটি হলে ওদের স্কুলে যেতাম, স্যার আপারা কি ভালই না বাসতেন। তারপর তিন ভাই বোন এক সাথে ফিরতাম রিকশায়। এ ব্যবস্থা হল যখন ক্লাস ফাইভে কি ফোউরে উঠবার পর, আগে যখন স্কুল ছুটি হত আরও আগে বারটার দিকে, আমি বাসায় ফিরেই চলে যেতাম পুকুরে, বাবা ফিরতেন চেম্বার থেকে আড়াইটায়, ঠিক ততক্ষণ থাকতাম পানিতে। কোন এক বরষায়, ঘন ঘোর আঁধিয়ার, নিমেষেই নেমে এল ঝঞ্জা, এই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পরছে। পুকুরে একটা লোকও নেই। আমি একা পাঁচ নম্বর বল আঁকড়ে সাঁতার কেটে যাচ্ছি, ঘন কাল দীঘির জল, সবুজ চারিদিক, ঢোল কলমির পাতা বাতাসে-বৃষ্টিতে অস্থির দুলছে, এরই মাঝে নির্ভয় আমি সাঁতরে যাচ্ছি। জলে শুধু আমার ঢেউ-এরই জ্যামিতি, হঠাৎ সে বৃত্তে দেখি আর কারুর জেগে উঠা ঢেউ, আমার সমান্তরাল সন্তরণে, সে কি সাবলীল চলা, কালচে সবুজ তেল চিক্কণ তেকোনা মাথাটি শুধু জেগে, স্থির চোখের দৃষ্টি অবহেলায় শুধু একবার হেনে নিশ্চল আমায় ফেলে চলে গেল সামনে, সময় যে কখন কখন থমকে যায় সে তখন বুঝলাম, নিজের বুকের শব্দে স্মবিৎ এল ফিরে। সুধিন দাশের লিখা একখানা গান আছে “তোমার দেহের ভঙ্গিমাটি যেন বাঁকা সাপ, পায়ে পায়ে ছড়িয়ে রাখো যৌবনেরই ছাপ”... এই গানটি শুনলে আমার সেই গরবিনী ভুজঙ্গিনীর কথাই আসে মনে, কালচে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে কলমির সবুজ পাতায়, আমায় যেন সে গ্রাহ্যই করলো না, এমন তার চলে যাওয়া। সে পুকুরে আমার আরেক খানা ভয়ের স্মৃতি আছে, ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। পুকুরের ধারেই একখানা হিন্দু বাড়ি ছিল, তাদের ঠাকুর এ পুকুরেই বিসর্জন দিত। বোধকরি কালীপূজোর পরের ঘটনা। বিসর্জন হয়ে গেছে। দিন দুয়েক বাদে সব ছেলে পুলের দল পুকুরে সাঁতরাচ্ছি, আর ডুব দিয়ে ডুব দিয়ে খুব খেলছি। খেলতে খেলতে এক সময় আমি ডুব সাঁতারে মাঝপুকুরে এসে গেছি, দম ফুরিয়ে যাচ্ছে , পা’এর পাতা দুটোকে নাড়িয়ে ভেসে উঠছি উপরে হঠাৎ কি যেন জড়িয়ে গেল পায়ে কাপড় কি দড়ি কে জানে হাত দিয়ে ছুটাতে গেলাম ঠিক মানুষের হাতের মত কি যেন লাগলো হাতে, পিচ্ছিল কিন্তু ঠিক কয়েক খানা আঙ্গুলও যেন হাতে ঠেকল, ভয়ে কলজে উঠে আসছে গলার কাছে সর্ব শক্তিতে নিজেকে ঠেলে দিলাম উপরে ভুশ করে উঠে এল মাথাটা খোলা হাওয়ায় ফুস্ফুস ভরে উঠল, কোন মতে পারে উঠে এলাম পায়ে তখনও জড়িয়ে জরি, দড়ি এই সব। ঘটনা শুনে সাহসী দু এক জন আবার গেল এ দিকটায়, রহস্য হল ভেদ, মা কালীই আমায় আটকে রাখতে চাইছিলেন, সাহস হারাইনি তাই জোর বেঁচে গেছি। সে পুকুরটির কথা আমার খুব মনে পরে। বহু বছর পরে দেখতে গিয়েছিলাম সে গহীন দিঘীটিরে, হায় সেও আজ বিলীন, ঘর বাড়ি উঠে গেছে বেশুমার, এল মেল পদ রেখায় হারিয়ে গেছে সবুজ দীঘিটির চিহ্নটুকু! পুকুর যায়, মাঠ যায়, শহরে আকাশ যায়, এক সময় শেষ সবুজটুকুও ঝড়ে পড়লে কে আমায় দিবে ছায়া। সারি সারি বাড়িদের ক্লান্ত ছায়ায় যে দম আটকে আসে। তিলত্তমা নগর থেকে ছোট ছোট শহর গুলো সব আজ পথ হারিয়ে বসে আছে। খোলা হাওয়ায় পাতাদের যে শিঞ্জন, শুনিনি কতদিন, সে কেঁপে উঠা শিহরণ, দেখিনি কত দিন! বড় ঢাকা চাপা পরে আছে এ জীবন। শিশুরা যেন ইট চাপা ঘাস। হলদে বিবর্ণ! কোন কুহক খুঁজে ফিরবেনা আর গাছেদের ছায়ার নকশায়। কি নিঃকান্ড সুপুরি গাছ, কি ছায়াময় কড়ই গাছ, কত গাছ জড়িয়ে ছিল জীবনের সাথে। শুধু কি গাছ, পাখিদের চিনতাম, আমাদের ধান্মন্ডি বাসার ঝাউ গাছের সে বেয়াড়া কাকেদের কথা খুব মনে আছে। কিংবা সেই কড়ই গাছের চিল! হায় চিল, সোনালি ডানার চিল! কি রাজসিক তার উড়ে যাওয়া, হাওয়ায় ভেসে যাওয়া অচঞ্চল পাখনায় যখন ভেসে থাকত মনে হত এ জগত সংসার সবই বুঝি তার পদানত। কি বিশাল তার ছায়া একে গেছে সে মনে। রূপকথার সে দিনগুলি যদি জমিয়ে রাখতাম কৌটোয়। জিম ক্রসের গানের মত...
“If I could save time in a bottle,
The first thing that I'd like to do, Is to save every day ...”
হায় যদি পারতাম!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.