নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রবাহূত

রবাহূত › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার শৈশব এবং যাদুর শহর (১৫)

০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩০



কোন এক সন্ধ্যা! কাছে কিংবা দূরে খুব গান বাজচ্ছে, চটুল হিট কোন হিন্দি গান। স্কুল থেকে এসেই ঘুমিয়ে পরেছিলাম। রাত নামছে আলগোছে, ঠিক এই সময় এক বাদাম ওয়ালা ডাকবেই “অ্যায়ই বাদাম”। পরাবাস্তব এক সন্ধ্যা ধীরে ধীরে পাখা মেলে অন্ধকার মথের মত, ঘরে তখনো আলো জ্বালিনি। ঘোর গ্রস্ত শুয়ে থাকি চুপ। পশ্চিমের জানালায় আকাশ দেখা যায়। ফিকে হলদে বাতিরা জ্বলে উঠছে একে একে এ শহরে, কাছে-দূরে, আরও দূরে। সড়কের ম্লান আলো গুলি সারাদিন জ্বলে থেকে থেকে, সন্ধ্যায় উজ্জল হতে থাকে। আবছায়ারা সারি সারি ঝুলে থাকে জানালার পর্দায়, ছাদের আলসেতে, লোকেদের জামার আস্তিনে।


কোন এক রোদ জ্বলা সকালে, রওয়ানা দিয়েছিলাম, ঢাকায় পৌঁছেই বাঘ মার্কা সিকি দিয়ে নীল কয়েন বক্স থেকে কল করে বড় বোনের বাসায় জানিয়ে দিলাম, তারপর রিকশা চেপে রওয়ানা দিলাম। আমরা আমাদের বড় বোনকে বলি “আপ্পা”। আপ্পার বাসা তখন ছিল মগবাজার ওয়্যারলেস পীর পাগলার গলি। রিকশা যাচ্ছে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে তেজগাঁও হয়ে, বিস্কুট গন্ধী সে প্রশস্থ রাজপথ, আমার এখনো ভালো লাগে সে পথ, আমার পথে পরলে। তারপর সাবান কি ডিটারজেন্টের গন্ধ। কসকোর সে রহস্যময় সৌরভ, সে মায়াবিনি বক্র কেশ রমণী! সব যেন ছবির মত মনে পরে। নিজেকে এমিলের গয়েন্দা বাহিনীর এমিলের মত মনে হয়! কিছু ভয়, কিছু ভালো লাগা, কাপা উত্তেজনা নিয়ে এ পথ ও পথ ঘুরে পৌঁছে যাই একটা তেতলা বাড়ীর সামনে। গলির শেষ মাথায়। বাড়ীর সামনে একটি টিনের বাসা, ডানদিকেও টানা লম্বা টিনের কয়েকটি ঘর। বড় বড় কয়েকটি নারিকেল গাছ, আর ছিল কিছু মোটা তাজা বানর। বুদ্ধদেব বসুর “পুরানা পল্টন” কিংবা “আমরা তিনজন” লেখাগুলি যত বার পড়েছি, এই জায়গাটিই কল্পনাতে এসেছে। আমি ভর্তি হয়ে গেলাম ধানমনন্ডী গভঃ বয়েজ হাই স্কুলে, সেই সময়ও মগবাজার থেকে স্কুলে আসতে ভাড়া নিত বিশ টাকা, মানে অনেকটা পথ ছিল আসা যাওয়ায়! রিকশায় চড়ে যেতেই থাকতাম, যেতেই থাকতাম, একটু ভয় ভয় যে করত না তা নয়! স্কুলে বন্ধু হল অনেকেই, যারা এখন পর্যন্ত প্রিয় আর সবচেয়ে আপন হয়ে রয়ে গেছে। কেউ কেউ দূরে চলে গেছে, কেউ বা দূরে থেকেও সবচেয়ে কাছে আছে। সে কথা বলে শেষ করা যাবে না! স্কুলের কথায় পরে আসছি।


বড় বোন যাকে আমরা আপ্পা বলি সে আমার সব খাতায় আর বইতে নাম লিখে দিল তার সোনা ঝরা হাতের লিখা দিয়ে, সে লেখা একদম আমার মায়ের হাতের লেখার মত, এদের “অ”, “ত” অক্ষর গুলি একদম অন্যরকম, গোল মাথা থেকে রেখাটি এসে মুক্ত দিকে একটু ডানে ঢুকে আবার বাঁয়ে এসে শেষ হয়, যেন স্টাফ নোটেশনের চিহ্ন। প্রফেসর লাইব্রেরী থেকে থরে থরে খাতা কিনে সুন্দর করে সব লিখে দিয়েছিল, তার একটা খাতা এখন আমার পুরনো কাগজের ফাইলে রয়ে গেছে। তার সব কিছুই ছিল ডিসিপ্লিন্ড। আরও আগে ওর বিয়ে হওয়ার আগে ঠিক চারটে বাজলেই ছোট বোনদের কষে কলা বেণী বেঁধে দুধ খাইয়ে খেলতে পাঠাত। আমি খেলতে যেতাম ঠিক চারটে। রাত আটটা মানে বেড টাইম। কোন চেঞ্জ নেই। সোনার সংসার দেখেছি, পরিচ্ছন্ন পরিপাটি যারা মা’কে দেখেছেন তাঁরা সবাই বলেছেন একদম মায়ের মত সংসার করে নেলী, এটি ওর ডাক নাম। আর মা হারা এই ভাইটির প্রতি তার স্নেহ সব সময়ই ছিল পক্ষপাত দুষ্ট, তাঁর সন্তানদের চেয়ে কম ভাবেনি কখন, যে ভালবাসা শুধু পেয়েই গেলাম তার প্রতিদান দেবার মত যোগ্যই জীবনে হয়ে উঠতে পারলাম না। আর কিছু ভালবাসার কোন উত্তরও হয় না। সে যে কেমন সজল ভালবাসা, সে যে কেমন ভেজা হাওয়া সে আমি এই অধমর্ণই শুধু জানি। মা’এর ভালোবাসা কেমন সে তো আর এ জীবনে জানাই হল না, সে ভালবাসার রূপ আমি এখানেই পেয়েছি। তার সন্তানরা বড় হয়ে গেছে, নাতি নাতনিও হয়ে গেছে তবু যেন মনে, আমি বুঝি এখন তার অনেকটাই, সে নিয়ে নাতনীদের সাথে জোড় ঝামেলা চলতেই থাকে আমার! কিছু ভালোবাসা ভাগ করতে বুঝি কারুরি মন চায় না!


দিন গুলি কেটে যাচ্ছিল প্রজাপতি যেন, কিন্তু রোজ এত দূর আসা যাওয়া বিশাল এক ঝক্কি, দরখাস্ত দিয়ে বেশ একটা লম্বা ছুটি নিয়ে নিলাম, ফাইনাল পরীক্ষার আগে আবার ক্লাস শুরু করব। কিছুদিন ঘুরে এলাম নেত্রকোনা তারপর গেলাম রংপুর, সেখানে আমার এক বোনের হাসবেন্ড সায়েন্টিফিক অফিসার, কারমাইকেল কলেজের উল্ট দিকে রাইস রিসার্চ ইন্সিটিটিউটে সদ্য বদলী হয়ে গেছেন। ধান শুকানোর বিশাল পেভমেন্টে দিনরাত সাইকেল চালাই। সাইকেল চালানো বোধ হয় পৃথিবীর অন্যতম আনন্দময় একটি কাজ! অনেক বছর পরে আমার বড় ছেলেটি যখন সাইকেল চালাতে শিখল, আর যেদিন শিখল সেদিনের পরদিন স্কুল থেকে এসেই সাইকেল চালাতে অস্থির হয়ে গেল, ওর মা ফোন করল আমাকে যেন ওকে বুঝিয়ে বলি এই রোদে না বের হয়। তাই কি হয় আমি নিজের কথা ভেবে বললাম থাক “না” কর না , একটু চালাক! এইতো প্রথম মুক্তির স্বাদ গতির স্বাদ। এর তুলনা জগতে খুব কমই আছে, মানুষ তো নিরন্তর ছুটতেই চায়। গতিই তো জীবন, গলিত স্থবির ব্যাঙ্গও তাই কিছুটা সময় চায়, কিছুটা গতি চায়।


সেই রংপুর তখন এরশাদের শহর, ঢাকার পরে শুধু নিওনের হলুদ আলো সেখানেই জ্বলে। বিশাল সে কারমাইকেল কলেজের মাঠ, কি সবুজ সতেজ! মাস খানেক কাটিয়ে ছিলাম সে শহরে, সুন্দর সাজাচ্ছিলেন তখন এরশাদ সাহেব।


ফিরে আসি আবার ঢাকায়, যাদুর শহর! যে শহরে বার বার ফিরে আসি, বার বার জড়াই, বার বার হারাই! “এ শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু” । আমার রবীন্দ্র নাথ, সুমনের লিখা! এ শহর আসলেই জানে আমার সব কিছু, দ্রোহ কিংবা প্রেমই শুধু নয়, হেরে যাওয়া, ফের ঘুরে দাঁড়ানো, আবার লড়াই কিংবা বসন্ত, সব, সব, সব! আর চোখের সামনে ধীরে ধীরে এ শহরের এই অচল শহরে রূপ নেয়া, মেনে নেয়া এক কঠিন কাজ। কিন্তু তাই দেখছি, সেই বুড়িগঙ্গা থেকে শহর বাড়তে বাড়তে তুরাগ ছুলো, শুধু আয়তনেই বাড়ল আর কিছুতেই নয়, নাই ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট, নাই ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট! একটা শহর একটা জাতিকে খুব সহজেই চিনিয়ে দেয়। একটা শহরকে সবার আগে রিপ্রেজেন্ট করে আর্কিটেকচার তারপর ট্রাফিক। একজন বিদেশী যখন এদেশে এসে এয়ারপোর্টে নামেন তখন থেকেই আসলে তিনি একটা শহর কে জানতে পারেন। তার আগে নয়, ইন্টারনেট কিংবা লোনলি প্ল্যানেট এর বই পড়ে শহর কে জানা যায় না!


দুই কোটির উপরে বাস এ শহরে আয়তন মজাওয়ায় ১২০ কি ১৬০ বর্গ মাইল। ম্যানেজ করা প্রায় অসম্ভব। পৃথিবীর সব বড় শহর গুলতে কমিউটার সার্ভিস খুব জোড়াল, ফলে শহর এর বাইরে থেকেই প্রচুর লোক যাতায়াত করতে পারে, এমন কি পশ্চিমবঙ্গেও ট্রেইন সার্ভিস খুবই শক্তি শালী, হাজার হাজার লোক ডেইলি প্যাসেঞ্জার হয়ে কর্ম করে খাচ্ছে, কিন্তু শহরের উপর চাপ বাড়াচ্ছে না। আর এ শহরে যত মানুষ কাজে আসে, যত মানুষ পড়তে আসে, কিংবা যে কোন কারনে আসে আর যায় না, বাড়তেই থাকে মানুষ। এ এক যাদু, কিভাবে এত মানুষকে সে আশ্রয় দিচ্ছে, অন্ন দিচ্ছে, কর্ম দিচ্ছে!


আশির শেষ দিক কিংবা নব্বই এর শুরুতেও শহরটা ছিল বসবাসযোগ্য, নড়াচড়া করা যেত, রিকশা করে চলে যাওয়া যেত যে কোন দূরত্বে। নিরাপদও ছিল শহর। ঘটনা দুর্ঘটনা যে ঘটত না তা নয়, কিন্তু অত আঁচ সবার গায়ে লাগতো না। পাড়ায় পাড়ায় ঝামেলা লাগতো, যাকে বলা হত গ্যাঞ্জাম, পাড়ার বড় ভাই কি মাস্তানরা সো ডাউন করত। খুড়, ড্যাগার আর খুব বেশী হলে পাইপগান। কাটা রাইফেলও চলত। তবে আজকালকার ছোকরা “গ্যাংস্টাহ” যত সফিস্‌টিকেটেড আর্মস পায় সে সময় এগুলো এতো সহজ লভ্য ছিল না।


ক্লাস সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে আমি আমার বড় ভাইয়ের বাসায় উঠে আসি, ওঁর বাসা ছিল, মোহাম্মদপুর টাউন হলের পিছনে, জমজমাট এলাকা। এখানেই ঠিক সন্ধ্যা বেলায় সেই বাদাম ওয়ালা হেঁকে যেত। রাত নামছে আলগোছে, ঠিক এই সময় সেই বাদাম ওয়ালা ডাকবেই “অ্যায়ই বাদাম”। পরাবাস্তব এক সন্ধ্যা ধীরে ধীরে পাখা মেলে অন্ধকার মথের মত, ঘরে তখনো আলো জ্বালিনি। ঘোর গ্রস্ত শুয়ে থাকি চুপ। পশ্চিমের জানালায় আকাশ দেখা যায়। ফিকে হলদে বাতিরা জ্বলে উঠছে একে একে এ শহরে, কাছে-দূরে, আরও দূরে। অমলের “দই-ওয়ালা” যেন, আমার এই বাদাম ওয়ালা। অমলের পাহাড়ের ঢালে শ্যামলী নদীর তীরের সেই গাঁয়ের হাত ছানি এখানে নেই, কেমন এক পরাবাস্তব ঘোর লাগা এক শহরের অমোঘ আহবান থাকে সে ডাকে, ছায়া ছায়া শহর এক, চারকোলে মোটা মোটা দাগে আঁকা এক শহর, কার্টিজ পেপারের অমসৃণ জমিনে। সে বাদাম ওয়ালাকে কখন আমি দেখিনি, কিন্তু সে শব্দরা রয়ে গেছে এখন, তার সন্ধ্যার সেই ডাক যেন মনে করিয়ে দেয়, দিন শেষ সন্ধ্যা হল। “সন্ধ্যা হল, হাঁস মুরগী ঘরে তোল, আবুর কুকুর বাঘা...” এমন নয় “প্রভু দিন যে গেল সন্ধ্যা হল পার কর আমারে” পথের পাঁচালীর ইন্দিরা ঠাকরুন দন্তহীন টোলপড়া মুখের গানের মত, কি যেন এক অজানা আশঙ্কার আভাস থাকত, মাঝে মাঝে এও ভাবি সে বাদাম ওয়ালা কি সত্যি ছিল? না আমার অবচেতনে তৈরি সে, ঘুম ভাঙ্গানোর কোন কায়দা, সজাগ করবার কায়দা। এখনো মাঝে মাঝে হঠাৎ কচিৎ কেউ ডেকে উঠে ““অ্যায়ই বাদাম” আমি জেগে উঠি!


জায়েদ আলী সাহেবের চারতলায় আমরা থাকতাম, মোহাম্মদপুরে গায়ে গায়ে লাগা সব বাসা, এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে যাওয়া যায় অনায়েসে এমন। সকাল হলেই পাড়ার বড় ভাইদের পবিত্র কাজ ছিল ডেক সেটে জোড়ে হিন্দি গান বাজাতে শুরু করা, “ অ্যায় মেরে হাম সাফার ইক জারা ইন্তেজার, তুম সদায়ি বেরাহি হ্যা মাঞ্জিল প্যায়ার কি”... ...।
শুরু হত দিন! ভাবি একটা স্কুলে পড়ান, সকাল সকাল বের হয়ে যেতে হয়, শামীম ভাই এর অফিস মতিঝিল ওঁর ও সকাল সকাল বের হতে হয়, ওদের মিষ্টি মজার ছেলে সামির কে ভাবী সাথে করে নিয়ে যায় আর আমার স্কুল এগারটা থেকে তাই কিছুটা সময় একা, খুব যে প্রতিদিন পড়তাম তা না, দেয়ালের সাথে টেবিল টেনিস খেলতাম। তখন ধ্যান জ্ঞান স্বপ্ন সব টেবিল টেনিস।সাতাশি টাকা দিয়ে একটা ব্যাট কিনেছিলাম, আর রন পল্যাঙ্ক এর পকেট ডায়েরী তে লিখে ছিলাম একটা স্বপ্ন পূরণ হল। এভাবেই দেয়ালে মেরে মেরে দারুন একটা সার্ভিস বের করে ফেললাম, তা দিয়ে বেশ একটা সময় বন্ধু মহলে রাজ করেছিলাম। একটু পরে আসতো বন্ধু খোকা ওরা একটা গলি পরেই থাকত, তারপর দুই বন্ধু টেবিল টেনিস ব্যাটে বলটা ঠুকতে ঠুকতে স্কুলে চলে যেতাম।


স্কুল! আহা সে স্কুল! কি এক সুন্দর সময় ছিল সে! স্কুল তো স্কুল নয় যেন সব পেয়েছির জগৎ! বন্ধুরা, টিচাররা এখনো বুঝি সবচেয়ে আপন। ক্লাস রুম, স্কুলের মাঠ, পিছনে সে পুরন ভাঙ্গা গাড়ি, সংসদ ভবন, জিয়া উদ্যান, ধান্মন্ডী লেক,এলিফ্যান্ট রোডের গলি, নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, শাহবাগ এ সবটাই আমাদের স্কুল ছিল। গোটা শহর জুড়েই আমরা আর আমাদের স্কুল। চারিদিকে শুধু বিস্ময় আর বিস্ফোরণ আনন্দের! আসলে সময়টাই ছিল এমন। একান্ত নিজের দুঃখ-ব্যাথা, পাওয়া-না পাওয়া কই ভেসে যায়। সে সময় হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে নিজেদের অনেক বড় বড় মনে হত। দিনে বরাদ্দ ছিল তিন টাকা, তাই অনেক কিছু ছিল বিশ পচিশ টাকা জমলেই জ্ঞানকোষ! কখনো কামালের “বন চপ”, সে সময় এর চেয়ে সুস্বাদু বুঝি দুনিয়াতে কিছু ছিল না আর। কেননা তখন রেস্টুরেন্টে ঢুকে আড্ডা দেয়া শিখিনী, তাই ঝোল দিয়ে পুরি খাবার স্বাদ পাইনি। সে আর কিছু দিন পরে হবে।


স্কুলে সবাই বন্ধু থাকে তারপরও ছোট ছোট একটা গ্রুপ ঠিকই তৈরি হয়, আমাদের ছিল তেমন সাত জনের একটা গ্রুপ। সুবন্ত, শান্ত, শাহিন, শিমুল, খোকা, পুলক আর আমি। একটা কোড নেইম ও ছিল। সব কিছুতেই আমরা একসাথে। স্কুল পালালে, খেলতে গেলে, সব কিছুতেই আর সবার রোল নম্বর ছিল আগে পরে কাছাকাছি। এর মাঝে শিমুল ফিলিপাইন থেকে এশ্ছিল তাই ওর বাংলাটা একটু বাংলিশ ছিল (এখনো অনেকটা তাই রয়ে গেছে), ওর তেমন বন্ধু কেউ হচ্ছিলো না , আমি হলাম বন্ধু, হঠাৎ একদিন ক্লাসে এসে বলে, আচ্ছা তুমি দাঁত থাকতে দাঁতের যত্ন নাও? আমি বুঝলাম না , কথা নেই বার্তা নেই কি বলছে? আচ্ছা দেখি বলে আমার ব্যাগ থেকে বই বের করলো, দেখল সব সেলাই আর মলাট করা, তারপর বলল হুম তুমি দাঁত থাকতে দাঁতের যত্ন নাও। পরে বুঝলাম আন্টি বোধহয় বই নষ্ট করার জন্য ওকে বকা দিয়ে একথা গুলি বলেছেন আর ও ওখান থেকে টুকে দিয়েছে। কিছু দিন পরে ও স্কুলে আসল ওর গেইম অ্যান্ড ওয়াচ নিয়ে ব্যাস আর বন্ধুর অভাব থাকল না ওর। ক্লাস টেনে এসে সেই শিমুল কিন্তু দলছুট হয়ে টেস্টে ফার্স্ট হয়ে গিয়েছিলো।


আমাদের স্কুলের মাঠটা অত বড় ছিল না, তাই সংসদ ভবনই ছিল আমাদের খেলার জায়গা, স্কুলে জনপ্রিয় ছিল টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলা, সে কি উত্তেজনা, টেবিল টেনিস, ফুটবল আর ক্রিকেটও ছিল, পরে শুরু হল ফ্রিসবি। ক্লাসরুমে ডেস্ক গুলো জোড়া দিয়ে বড় করে টেবিল বানাতাম আর বই কি হার্ড বাউন্ড খাতা সোজা করে রেখে নেট বানিয়ে খেলতাম টেবিল টেনিস, যদি টিফিনের পরেও স্কুলে থাকতাম। সংসদ ভবনে বড় করে ক্রিকেট খেললে, পিছের মাঠে খেলতাম, আর শিশুতোষ খেলার জন্য তো সামনের পুরো মাঠটাই থাকত আমাদের দখলে। একটা খেলা প্রায়ই খেলতাম ওয়াইল্ড ওয়েস্ট ধাঁচে, পুরো মাঠটাকে প্রেইরি ভাবতাম কেউ হতাম রেড ইন্ডিয়ান কেউবা এরফান জেসাফ কি সাবাডিয়া। গার্ডেন স্প্রিঙ্কলার গুলো হত আমাদের ওয়াটার হোল, খুঁজে খুঁজে বের করতাম। একদিন এমন কিছু খেলছি, পামট্রির ঝরে পরা পাতার পিছনের শক্ত অংশটা হাওয়ায় ভাসিয়ে মারছি একজন আরেকজন কে, আর পাস কাটিয়ে যাচ্ছি, তুমুল উত্তেজনা, এর মাঝে কারো ছোঁড়া শক্ত সে জিনিশটি শান্তর মাথায় লাগলো, শান্ত সাথে সাথে পরে গেল! ভয়ে আমাদের অবস্থা কাহিল, মরেই গেল নাকি?! কারো কাছে ফ্লাস্ক টাস্ক কিচ্ছু নেই, একটু জানি পানি ঢালবো, কি খাওয়াব! তখন টিভিতে ম্যাকগাইভার চলত, আসে পাশে যা কিছু আছে তা থেকেই আইডিয়া বের করতে হবে, এটাই তখন নিয়ম। দ্রুত সবার মোজা খুলে দৌড়ে লেকে গিয়ে ভিজিয়ে আনলাম, তাই চিপে মুখে পানি টানি ছিটিয়ে সজাগ করলাম, কে জানে দুই এক ঢোঁক সে পানি খেয়েছিলি কিনা, এত দিনে তো আর মনে নেই, ক্ষমা ঘেন্না করে দিস!


এমনই কত সময় আমাদের কাটত সংসদ ভবনে, খুব যদি গরম লাগতো, একদম মেইন গেটে আমরা একে একে পিঠ দিয়ে দাঁড়াতাম, দরজার ফাঁক গলে এসির বাতাস আসত, তাতেই গাঁ জুড়াতাম। ছিল পেয়ারা তলা আমাদের সবচেয়ে প্রিয় আড্ডা মারার জায়গা। আমাদের জোড়া বন্ধু রুপম, নিরুপমরা যখন ওখানে বাসা পেল, আমাদের আর কে পায়, থানা গেঁড়ে বসলাম একবারে, আমার গিটারের হাতে খড়ি সেই পেয়ারা তলাতেই। একদিন সংসদ ভবনের ওয়াটার বডিতে দেখি একটা নৌকো বাঁধা, আর কে পায় আমরা হই হই করে উঠে গেলাম, খুব চালাচ্ছি নৌকো, হঠাৎ দেখি পুলিশ বাঁশি ফুকে, হাতের ইশারায় সমানে ডাকছে, কাছাকাছি যেতেই শুনতে পেলাম বলছে, “ওই এদিকে আয়”! পুলিশের মুখে “তুই” শুনে আমরা তো রেগে আগুন, নেমে এমন ঝাড়লাম ওরাই পালাল। তখন সংসদ ভবন এমন জেইলখানার মত ছিলনা। পুলিসরাও আজকের মত সকল ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠেনি। আর বৃষ্টির দিন সংসদ ভবনের প্লাজা আর তার মর্মর পাথরে বাঁধা সিঁড়িতে বৃষ্টির যে খেলা, আর যে কল হাস্য না দেখলে বোঝাবার সাধ্য আমার নেই। কত সহজে একটি স্থাপনা যে আপন হতে পারে এর অপূর্ব উদাহরণ এ ভবন। আর কি যে আলো ছায়ার খেলা! জ্যামিতির সহজ প্রকাশ আর ছায়াদের নৈশব্দ, “Silence”! সে বিশাল ব্যাপ্তি কি আর শিশু মন ধারন করতে পারে? কিন্তু কি যেন এক অচেনা অনুভূতি, সে কংক্রিটের ঘন জ্যামিতি মনে তৈরি করত। বহুযুগ পরে যখন বার্লিনে ড্যানিয়েল লিবেস্কিন্দের Jewish Museum দেখি এমন এক শূন্যতার মুখোমুখি হই, যা ব্যাখ্যার অতীত।
কান (Luis I Kahn) বলতেন, “The sun never knew how great it was until it hit the side of a building”...কত সহজ করে বলে দিলেন আলো আর স্থাপত্যর সম্পর্ক। তিনি অনুভব করতেন জগতের সব, সব সব সব কিছুর প্রকাশ, উদ্ভাস আলোতেই, আর বস্তুই আলোকে ছড়ায় মানে স্থাপত্যই এ কাজটি করে, আর ছায়া সেই আলরেই সঙ্গী। সহজিয়া দর্শনের প্রকাশ স্থাপত্যের ভাষায়! তিনি ভাবতেন, “Even a brick wants to be something” সামান্য কাদা মাটির যে ইট তার মনেও কিছু হয়ে উঠার স্বপ্ন, তিনি দেখেছিলেন, আর আমাদের সৌভাগ্য আমরা আমদের এই জাতীও সংসদ ভবনে পেয়েছি, তাঁর লাল ইটের কমনীয়তা, কংক্রিটের দৃঢ়তা আর মর্মর পাথরের বিষণ্ণতা। এভবেই কবিতা হয়ে যায়, সংগীত হয়ে যায় জমাট স্থাপত্য, কথা কয়ে উঠে নৈশব্দের পংতি মালায়।


আমার সৌভাগ্য তাঁর নকশায় করা বাড়ীতে ছিলাম আমার শৈশবের কয়েকটি বছর, এখনো যেন ছবির মত ভাসে শের ই বাংলা নগরের সেই লাল লাল ইটের বাড়িগুলো। কোন বাউন্ডারি ওয়াল ছিল না, পোর্টিকো তে নামলেই বিশাল দরজা, খুললেই ডবল হাইট স্পেইসে প্রশস্ত সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে, বামদিকে ড্রইংরুম আর ডানদিকে বিশাল ডাইনিং হল, সে দিক দিয়ে গারাজ আর সারভেন্ট কোয়াটারে যাওয়ার দরজা, এন্ট্রি থেকে সিঁড়ি তে না উঠে সোজা গেলে লন, সবুজ দূর্বা ঘাসে ছাওয়া, এক রত্তিও মাটি দেখা যেত না ! সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই গাড়ীবারান্দার দিকে মুখ করে ডানে বাবার ঘর, আমি রাত্তিরে সেখানেই ঘুমাতাম, বামে বড় একটা ঘর, বোনদের। সিঁড়ির পাশ দিয়ে প্যাসেজ গিয়ে একটা টানা বারান্দা, বারান্দা থেকে বাবার ঘরে ঢোকার আরেকটা দরজা, বাম পাশে আরও ঘর কি স্টোররুম কি কিছু ছিল আজ আর মনে নেই, বারান্দা থেকে লনটা দেখা যেত। ঘন সবুজ চ্যাপ্টা চওড়া ঘাসের!সে সবুজ গন্ধ আমি এখনো যেন পাই। মনেই হয় না এ আমার জীবনেরই অভিজ্ঞতা লব্ধ। মনে হয় বুঝি অন্য আমি, হাসি খুশি চারিদিক আর খুব খোলা খোলা হাওয়া, খুব ঝিকিয়ে উঠা রদ্দুরের যাওয়া আসা!


নিয়তি এক পাহাড়ি নদী কোত্থেকে কাকে কোথায় নিয়ে যাবে তার কোন ঠিক নেই। গড়াতে গড়াতে কোথায় চলে এলাম। সংসদ ভবন, তার সে বিশাল সবুজ মাঠ, প্রশস্ত প্লাজা আমাদের খুব কাছের, এখনো সে পথে চলতে গেলে যেন দেখতে পাই কিছু বালক বিস্ময় আর আনন্দের বিস্ফোরণে ভেসে যাচ্ছে, ফুলের রেনুর মত, শরতের মেঘেদের মত। ভরহীন ভারহীন ভেসে যাওয়া সে কৈশোর। বুকের কোথায় যেন একটু কেমন করে উঠে। সেই ঘাম তেলে চকচকে মুখ, পোশাকের ধুল-কাদা, হালকা গোঁফের কালো রেখার ক্ষীণ আভাস, কখনই জানি ফিরে আসবে না। সব আজ কত বড় বড় মানুষ। এ সবুজ নিলাভ গ্রহের এ মাথা থেকে ওমাথা ছড়িয়ে আছে।

আমি অবাক ভাবী “জীবন এত ছোট ক্যানে?”।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:২০

মলাসইলমুইনা বলেছেন: ভালো লাগলো আপনার লেখাটা খুব | ধন্যবাদ |

০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:৩৭

রবাহূত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ! আগের লিখা গুলো ও পড়েন! খুশি হব!! উৎসাহ পেলাম ভাই!!!

২| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১১:৫৩

মোহেবুল্লাহ অয়ন বলেছেন: বাহ! আপনি দেখি সামুর সমসাময়িক ব্লগার। অভিনন্দন এতদিন পার করার জন্য। লিখা চালিয়ে যান।

৩| ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ২:৫৪

সচেতনহ্যাপী বলেছেন: আমাদের কোড, আন্ডা, বেলচা,টম,বদনা ইত্যাদি।। আর শুধু যাদুই না প্রানের চেয়েও প্রিয় আমার ঢাকা।।

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ২:৫২

রবাহূত বলেছেন: সত্যি তাই! আর কত যে কোড নেইম ছিল!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.