নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রবাহূত

রবাহূত › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার শৈশব এবং যাদুর শহর (১৬)

১৩ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১১:৫৭




মনে হয় বুঝি আমি, একদিনই দেখছিলাম সে আকাশ ।
যেবার রংপুর বেড়াতে গেলাম, সেবারই ওখান থেকে, এক কি দু রাতের জন্য গিয়েছিলাম লালমনিরহাট, ক্যান্টমেন্টে। রাত্রে যে অফিসার এর বাসায় ছিলাম উনি আমাদের নিয়ে গেলেন রানওয়েতে। বিশাল ফাঁকা জায়গা। রান ওয়ে জুড়ে পরে আছে শুধু, কেউ নেই শুন্যতা। চেয়ার পেতে বড়রা সব বসেছেন, আর আমি হাঁটতে হাঁটতে একটু তফাতে গিয়ে বসি, এক সময় রানওয়েতে শুয়ে পরি, দুহাত মাথার পিছনে দিয়ে, উপরে আকাশ, কৃষ্ণ পক্ষ বুঝি ছিল কিংবা তখনো হয়ত চাঁদ উঠেনি, কিংবা গিয়েছে ডুবে। তারা গুলিকে ঢেকে দেবার মত কেউ নেই, আহ্লাদি প্রেমিকার মত জগতের সব মনযোগ টেনে নিবে এমন আর কিচ্ছু নেই আকাশে। তারাদের তখন খুব বেশী চিনি না, কিন্তু কি যে খুশির ঝিকিমিকি, আমাকে পেয়ে, গোটা আকাশ জুড়ে। এমন বিশাল আকাশ! কি যে এক গভীর দাগ কেটে গেছে মনে। দেজাভু (Déjà vu) হয়েছে আমার অনেক বার সে আকাশ কে নিয়ে। সে অন্তহীন গভীর গম্ভীর অন্তরীক্ষ, সে অগণন নক্ষত্ররাজি, নিযুত আলোকবর্ষ দূরের রহস্য, কি যে নিগুঢ় এক ব্যাথার, এক অবাক আনন্দের, এক গোপন উত্তেজনার সঞ্চার করেছিল সে বালক মনে, সে শধু সেই জানে। একটু দূরের আত্মীয় পরিজনদের চপল সাংসারিক আলাপ শিশুর অর্থহীন বাক্য হেন মাঝে মাঝে শ্রুত হচ্ছিল, এছাড়া এ বিশাল শূন্যতার নৈশব্দ কান পেতে শুনছিল সে বালক মন। রান ওয়ে জুড়ে পরে আছে শুধু, কেউ নেই শুন্যতা!

সে আকাশ তো চুরি হয়ে গেছে কবে।
উঁচু সব দালানের সারি ভিড় করে আছে। সে নৈশব্দ কানে বাজে না আর। লোকেদের কোলাহল, গাড়ি ঘোড়ার যান্ত্রিক কলরব, জমাট বেঁধে আছে।এ শহর আর ঘুমোয় না!দিন মান সবাই ছুটে চলে। পাড়ায় সন্ধ্যা নামলেই কেমন যেন একটু ঝিম মারত আশপাশ। পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা বসে যেত বই খুলে। বই এর ফাঁকে যে গল্পের বই থাকত না তা কিন্তু নয়। বিটিভির আটটার খবরের পর থেকেই মনটা উস খুস করতে থাকতো প্রিয় কোন টিভি শো এর জন্য।

বিকেল হলেই দেখতাম পাড়ার বড় ভাইরা সব পাল তোলা প্যান্ট সার্ট পরে, হাই অ্যাঙ্কেল সাদা কেডস পরে একবার এদিকে তাকায়, একবার ওদিকে তাকায় এভাবে হেঁটে যেয়ে মোড়ের ভিডিও এর দোকানের সামনে টুলটায় যেয়ে বসতেন। লিনেনের প্রিন্ট শার্ট আর সাদা পাতলুন, একে ঠিক প্যান্ট বলে যায় না, পাতলুনই মানায়, অসংখ্য প্লেইট দেয়া সে পাতলুন কুচি কুচি হয়ে থাকতো ফ্রিল দেয়া জামার ঘেরের মত। তারাই মহল্লার মা বাবা। মানুষের আপদ বিপদেও আছে, মারামারি, ধরাধরিতেও আছে। আমাদের পাশের বাসার রাজু ভাই, ঘাড় ছোঁয়া বাবরী চুল, পরে কমিশনার হয়ে ছিলেন, নেই আর; “নাই” হয়ে গেছেন প্রতিপক্ষের হাত সাফাইতে। হ্যান্ডসাম শিপু ভাই, দেখেছি ঢাকা ইউনিভার্সিটির কনসার্টে একাই এক গাদা ছেলে পুলেকে পিটিয়ে বের হয়ে এসছেন, তিনিও নেই, সেই হাত সাফাই! খুব ভালো গান গাইতেন। তেরাস্তার মোড়ে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আশিকির গান গাইতেন, ‘ধীরে ধীরে সে ম্যারে জিন্দেগি ম্যা আনা...”। কার উদ্দেশ্যে কে জানে। সহজ উদার গলা, কোন জড়তা নেই। “বাকের ভাই” আসলে, কম বেশী ইনাদেরই একটা সংস্করণ।

পাড়ায় আমার প্রথম যে বন্ধুটি হয় তার নামটি বড় ছিল খাসা, “গজু”। স্কুল থেকে ফিরে গজুদের সাথে লেগে যেতাম রাস্তা জোড়া ক্রিকেট ম্যাচে, মাঝে মাঝে। আসলে স্কুল পালিয়ে এত খেলতাম, বাসায় ফিরে আর খেলার শক্তিটুকু থাকত না। স্কুলে কি খেলাই না খেলতাম। ব্যাগটা রেখেই লেগে যেতাম টেনিস বলের ফুটবলে, হয় মাল্টি পারপাস হলে নয় লবিতে, সে কি খেলা! ফার্স্ট পিরিয়ডের ঘনটা না বাজা অবধি চলত সে খেলা। ক্লাসে থাকলে অবশ্য সুবোধ ছেলে হয়েই থাকতাম, তবে ডেস্কে কিন্তু গল্পের বই পড়া ঠিকই চলত। “সেবা বই প্রিয় বই অবসরের সঙ্গী”। নাহ মোটেই নয় সারাখনের সঙ্গী। যদি ক্ষমতা থাকত কাজী আনোয়ার হোসেন কে একুশে নয়ত স্বাধীনতা পদক দিতাম। বাংলাদেশে এক বিশাল পাঠক সমাজ উনি তৈরি করেছেন, এত এত ক্লাসিকের সাথে জানা শোনা হয়েছে শুধু তাঁর জন্য। হুমায়ূন আহমেদ নিঃসন্দেহে পাঠক প্রিয় কিন্তু উনি শুধু হুমায়ূনেরই পাঠক তৈরি করেছেন, অনেককে চিনি তারা সগর্ভে বলে আমি হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া কিছু পড়ি না! আফসোস!শুধু তাই নয় প্রাক হুমায়ূন যুগে সবার লিখাই হুমায়ূন গন্ধী, ব্যাতিক্রম খুব কম। সেই সেবা বই এর জন্য কি না করেছি। রিকশা ভাড়া বাঁচিয়ে, ইউসুফের বন চপ কি ঠান্ডা কোক আর হট পেটিসের লোভ জয় করে পনেরো কুড়ি টাকা জমলেই এক খানা বই, যেন ঝলমলে আলো, যেন খোলা জানালা, কত কি দেখা যায়। কিশোর ক্লাসিক, অনুবাদ, ওয়েস্টার্ন আর তিন গোয়েন্দায় বুদ হয়ে থাকতাম, ততদিনে কুয়াসা শেষ, সব পড়া হয়ে গেছে, আমরা ওয়েস্টার্ন এত পড়তাম এত ঢুকে যেতাম গল্পে, সেই এরফান জেসাফ কি সাবডিয়ার মত ডান হাতে চা কফি পর্যন্ত খেতাম না, কখন আবার ড্র করা লাগে। সে সময় বন্ধুদের মাঝে কাউ বয় আঁকায় আমার বেশ খ্যাতি হয়েছিল। দুঃখ একটাই একটা বই ছিল “কাঁটা তারের বেড়া”, কভারে অ্যাডাল্ট কনটেন্ট থাকায় সে সময় আর কেনা হয়নি পড়াও হয়নি, এই অবধি আর পড়তেই পারলাম না সেই “কাঁটা তারের বেড়া”। ভুল করে না থাকলে লেখক ছিলেন আলিমুজ্জামান। এখনো বহু দিন পর সেবার বই পড়লে মনে হয় যেন, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম। আর মনে মনে এখনো যে নিজেকে কিশোর পাশাই ভাবি, এটা বললে কিন্তু খুব ভুল হবে না। আর কিশোর পাশাকে আমার মনে হত ভয়েজারস এর ছোট ছেলেটির মত, লাল সাদা স্ট্রাইপ টিশার্ট পরা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল।


একদিন বিছানায় আধশোয়া হয়ে বিজ্ঞান বই এর আড়ালে কোন একটা সেবার বই পড়ছিলাম, যথারীতি পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলাম, আর বিশ্বাস ঘাতক বই, সুন্দর বিজ্ঞান বই এর আড়াল থেকে বের হয়ে গেল। আমার বড় ভাই, শামীম ভাই এসে ডাক দিল, উঠো, আমি তো খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম নিশ্চয়ই কিছু বলবে, কিন্তু কিচ্ছু বলল না, শুধু বলল “খেয়ে ঘুমাও”, এই ছিল ওর স্টাইল! এমন কষ্ট লাগলো, আহারে এই ভাবে শামীম ভাইকে ফাঁকি দিলাম। সাইকোলজির ছাত্র ছিল তো খুব বুঝত কিভাবে কাকে ডিল করতে হয়। অপরাধ বোধে দেখা যেত আরও বেশী বেশী পড়ছি। আমার এই ভাইটি ছিল একদম অন্যরকম এক মানুষ। আমাদের ছোটদের কাছে সেই শেষ কথা, শামীম ভাই একটা কথা বললে আমরা আর কিচ্ছু বলতে পারতাম না। মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, সম্মান আর সুন্দর ব্যবহার সবার কাছে তাঁকে প্রিয় করে তুলেছিল। কিছু দিন আগে একটা কাজে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম, সেখানে শামীম ভাই এর পরিচিত একজনের সাথে দেখা, সে লোক সেখানেই কথা বলতে বলতে কেঁদেই দিল, আমাকেও কাঁদালো। আমার বড় ছেলেটি যে বছর হল, সে বছরই চলে গেলেন, পঞ্চাশ সবে হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমরা সবাই মিলে গ্রামে গিয়েছিলাম, রাতে খুব জোছনা হয়েছিল, সে কি ফিনিক ফোঁটা জোছনা, আমরা অনেক দূর হেঁটে একটা পুলের ধারে গিয়েছিলাম। দুজন কত গল্প হয়েছিল সে গাঁয়ের সাঁকোতে হেলান দিয়ে।আমার অনেক বড় ভাই কিন্তু আড্ডা দিতাম যেন বন্ধুর মতই।


ডাক্তার যখন হাসি হাসি মুখে আমাকে বলল, আপনি বাবা হতে চলেছেন, এ খবরটি প্রথম আমি দেই আমার এই ভাই কে। সোনার মানুষ ছিলেন। আর দেখেছি কি পরিমাণ শক্ত মনের মানুষ সে। তাঁর মৃত্যুর পর তাই আমি কাঁদিনি, ভেবেছি এখানে ওঁ থাকলে কি করত, আমি নিরবে সব করে গিয়েছি, আমি নিজের হাতে আমার এ ভাইকে গোসল দিয়েছি, তারপর সব শেষে যখন তাঁকে কবরে শুইয়ে মুখটা কেবলা মুখী করে উপরে উঠে এলাম, তারপর কেঁদেছি। যেন দ্বিতীয় বার পিতৃ হারা হলাম। সে ছিল একটা ছায়ার মত, একটা কোমল মায়ার মত। তাঁর ফোন নাম্বার , ফোন বদলের আগ পর্যন্ত মুছিনি, যদি আবার কখন বেজে উঠে, একটা কোমল কন্ঠ যদি আবার বলে উঠত, “কিরে তোর কোন খবর নাই ক্যান?”। এই তো অনেক ছিল, কে হায় আর এমন বলে আজ? কি সুন্দর কবিতা লিখত, আর ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকত, জল রঙ্গে অনেক গুলো আঁকা ছবি ছিল ওর। ওর একটা নাটক বাংলা একাদেমিতে নিবন্ধন হয়েছিল সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়া অবস্থাতেই, নাট্যচক্রের সাথে জড়িয়ে ছিল, টিভিতে দুবার মাইমের প্রোগ্রামও করেছিল। আর ও যখন ছোট ছিল মার জন্মদিনে একটি গান লিখে সুর করে গেয়েছিল,”গুন গুণ অলি শোন...” বোনেদের কাছে শুনেছি। আর রস বোধ, একালের যে কোন স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানদের চেয়ে কম না। সিরিয়াস মুখে মজার কথা বলেই যেত, আর সবাই হাসতে হাসতে খুন। আর ছিল তাঁর বই পড়া, আমাদের বাসায় কোন বই আসলেই কাড়াকাড়ি করে শেষ করতাম আমরা, তবে শামীম ভাই ধরলে আমরা ওকেই আগে পড়তে দিতাম।

এমন মানুষরা বুঝি খুব সহসা হারিয়ে যেতেই আসে পৃথিবীতে, হারিয়ে গিয়ে সবাই কে বুঝি সব হারাদের দলে ফেলে দেয়। বুঝবার আগেই গেলেন মা, বাবাকেও হারালাম একদম হুট। তারপরও শূন্য যতটুক হয়েছিলো বুক, ভরিয়ে রেখেছিল সবকটি ভাই বোন। একা হয়নি মনে খুব। হাসি খুশি দুঃখ অভিমান সব মিলে মিশে ছিলাম। তারপর যেন হারাধনের ছেলেদের মত হারাতে লাগলাম, ভালবাসার একেকটি মুখ, সুখে থাকার , বেঁচে থাকার, একেকটি মুখ। ভাইকে হারানোর দু’বছরের মাঝে হারালাম বোনকে, সব চেয়ে যে ছিল ছোট সেই গেল বুঝি আগে, আমার বড় হলেও ওকে ছোটই ভাবতাম, ভালবাসার, স্নেহের, বন্ধুতার, সুতোয় বাঁধা ছিলাম। সে যে ভালোবাসা সে যে কি মায়া, আজ তারা মাত্র দুজন নেই এখনো আমরা ছ’টি ভাই বোন রয়েছি, কিন্তু মনে হয়, এ বিশ্বচরাচর যেন শূন্য, কোথাও কেউ বুঝি নেই, মাত্র দুটি শূন্যতা সব, সব দিয়েছে শূন্য করে। ভাইএর চশমা, সতীনাথের গান, হেমন্তের মেঘ কালো আকাশ কালোর সুরে আমি ছুঁয়ে থাকি তাঁকে, কঠিন সময় এলে ভেবে নেই তাঁকে। আর সে বোনটি আমার সবেতেই রয়ে গেছে।

রেডিওতে হঠাৎ একটা পুরনো গান, রোদ চশমা আর কতটা আড়াল আমার সজল চোখ। টিভিতে প্রিয় মুভি আমাদের, আমার ছেলে গুলো বুঝে গেছে, বাবা তাঁদের ফুপ্পির জন্য এমন হঠাৎ বলা কওয়া নেই ডুকরে উঠে। সে কি শুধু তাই? রোধ উঠলে আকাশে ঝকঝকে,ঝড় জলে ঠাণ্ডা হাওয়া দিলে, শীতের ভোরে অলস চায়ের কাপে, সবে তেই বুঝি তোর না থাকাই শুধু বেজে উঠে। আগে সুন্দর একটা জামা গায়ে দিলে আমি ঠিক ওর বাসায় যেতাম,”ইস আমার ভাইয়া মনি কে কি সুন্দর লাগেছে” এ কথাটি শুনবার জন্য। আমার লাইফের চার্ম ছিলিরে তুই! এখনো ভালো পোশাক টোশাক পড়লে খুব শুনতে মন চায় “ইস আমার ভাইয়া মনি কে কি সুন্দর লাগছে”। কত নামে যে ডেকেছে আমায়! চলে গেল এমন, যখন অনেক মানুষের জীবনই হয়ত শুরু হতে পারে। সে থেকে বুঝে নিয়েছি অকাল মৃত্যু বলে কিছু নেই। যিনি যান, তিনি আসলে বেঁচেই যান, মরে যাই আমরা।


এত সহসা বুঝি সব হয়ে গেল ভঙ্গ খেলা। খোলা কপাট, হাওয়ায় ঝাঁপটায় ডানা, জানালায় বিষণ্ণ হাহাকার, কড়ি কাঠে সময় বাঁধে সুতো শূন্যতার, ঘুলঘুলিতে স্মৃতির চড়াই আসে একা, আগাছারা সুরকি বাঁধানো পথ ছেয়ে ফেলে, ছেয়ে ফেলে হারানোর চারকোল কালোয়! এ বাড়িটিতে বুঝি আর কেউ থাকেনা! চুন সুরকির দেয়ালের সাথে কাটান সময় বুঝি হয়েছে আতীত, ঝড়ে যায় পড়ে যায়, স্মৃতির আখর যেন কমলা লালে ইট অজানা ব্যাথার মানচিত্র। নাই সময়ের, নাই পাত্রের ঘূর্ণি ছোট ছোট উঠে জেগে, আর দূরের ছায়া করা গাছটার মাথা মেঘ রোদ পার হয়ে আকাশের গায় দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ, দুচোখ নির্নিমেষ অনন্তে। কেউ বুঝি বা আর এ বড়িটিতে আসবে না, প্রশস্ত চৌকাঠ একা পরে থাকে রোদে জলে ঝঞ্জায়। আরও পাতা পরে, বিষণ্ণ শীতে শিশির পরে, আরও জমে উঠে, ভারি হয়ে থাকে মখমল যেন, ভিজে উঠে পত্র পল্লব চোখের। বুঝি অপেক্ষা, সেই অপুর দৌড় হয়রান, চিঠি চিঠি। কার চিঠি কখন যে আসে। ডাক গড়ির বুঝি কোন টাইম টেবিল নেই। হঠাৎ হুড়মুড় ঢুকে পরে প্ল্যাটফর্মে, বাজিয়ে অশুভ ঘনটা।


“জীবনটা কিছু নয় শুধু এক মুঠো ধুলো, চৈতি বাতাসে ওড়া শিমুলেরই তুলো”, এক সময় বাপি লাহিড়ীর হিট গান যদিও সুরটা বিখ্যাত সাউথ আফ্রিকান গায়িকা মিরিয়াম মাকেবার (মামা আফ্রিকা নামেও পরিচিত) “মালাইকা” গানটা থেকে নেয়া, এক অমোঘ সত্য চলে এসেছে এ গানে, কি সহজ অনায়াসে। তুলোর মত ভেসে ভেসে কে কোথায় চলে যাই। মাঝে মাঝে মানুষকে মনে হয় বই এর মত।
কিছু বই থাকে একবার পড়লেই ফুরিয়ে যায়। আর কিছু বই থাকে বার বার পড়বার। আবার এক সময় যে বই থাকে খুব প্রিয়, যত্নে থাকে সেলফের উঁচু তাকে, সে বই আবার কখন কখন পরে থাকে, পরেই থাকে, এক সময় মনে হয় কখনই এ বইটা আর পড়ব না। ভাবলেই কেমন একটা কষ্ট হয়। হুমায়ুনের কত্ত বই বার বার পড়েছি, ফেলুদার কত গপ্প, ইস্পাত প্রথম খন্ডটা পড়েছি না হলেও তিরিশ বার, সেই পাভেল করচাগিন, আরওতিওম, সেই সুন্দর ক্রুদ্ধ মুখ, তনিয়ার নত মুখে বই পড়া, আপেলের লাল গালে! আহ সময়! সময় এক দীর্ঘশ্বাস!! এক নিষ্ঠুর কুহক!

তেমনি জীবনে থাকে কত মানুষ, কাউকে কাউকে ছাড়া বুঝি একটি দিনও ভাবা যেত না, ঘন ঘন যোগাযোগ, ফোন, চ্যাট, হ্যাং-আউট, আবার ক্যামন তারা হুট যায় হারিয়ে। আবার এমনও হয় ফিরে আসে, আবার হয়ত আসেও না। আবার কখন কোথাও কারুর সাথে হয় শেষ দেখা, সহসা মনে হয় এই মানুষটির সাথে বুঝি আর হবে না দেখা, অলস আড্ডা কিংবা কথকতা সব গেছে ফুরিয়ে। কি গভীর এ বেদনা! দূরের কোন বন্ধু জন কিংবা বর্ষীয়ান কোন স্বজন! হারিয়ে যাওয়া কি এক গভীর ব্যাধি! কিছু মানুষকে এ সবুজ লাজুক গ্রহের কোথাও আর পাবো না। একই পৃথিবীতে একই সময়ে আর হাঁটবো না! আর বলব না “তুমি হাঁট যে পথে,যে পথের ধুলো মারিয়ে তুমি চল,এ ধুলো যে মাটির, যে মাটি পৃথিবীর, আমি হাঁটি সেই পথে।“হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা ভালো থেকো খুব। আমরাও হারিয়ে যেতে আসছি, কাছে কিংবা দূর সময়ে! নিয়তি আমাদের বাঁধা, উর্ণনাভের সুক্ষ জাল পাতা, সময় এলে গুটিয়ে নেয় সে।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:২৪

শায়মা বলেছেন: তেমনি জীবনে থাকে কত মানুষ, কাউকে কাউকে ছাড়া বুঝি একটি দিনও ভাবা যেত না, ঘন ঘন যোগাযোগ, ফোন, চ্যাট, হ্যাং-আউট, আবার ক্যামন তারা হুট যায় হারিয়ে। আবার এমনও হয় ফিরে আসে, আবার হয়ত আসেও না। আবার কখন কোথাও কারুর সাথে হয় শেষ দেখা, সহসা মনে হয় এই মানুষটির সাথে বুঝি আর হবে না দেখা, অলস আড্ডা কিংবা কথকতা সব গেছে ফুরিয়ে। কি গভীর এ বেদনা! দূরের কোন বন্ধু জন কিংবা বর্ষীয়ান কোন স্বজন! হারিয়ে যাওয়া কি এক গভীর ব্যাধি! কিছু মানুষকে এ সবুজ লাজুক গ্রহের কোথাও আর পাবো না। একই পৃথিবীতে একই সময়ে আর হাঁটবো না! আর বলব না “তুমি হাঁট যে পথে,যে পথের ধুলো মারিয়ে তুমি চল,এ ধুলো যে মাটির, যে মাটি পৃথিবীর, আমি হাঁটি সেই পথে।“হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা ভালো থেকো খুব। আমরাও হারিয়ে যেতে আসছি, কাছে কিংবা দূর সময়ে! নিয়তি আমাদের বাঁধা, উর্ণনাভের সুক্ষ জাল পাতা, সময় এলে গুটিয়ে নেয় সে।


ভাইয়া এমন করে সবাই হয়তো ভাবে বা অনুভব করে কিন্তু লিখতে পারে শুধু কয়েকজন!~ :)

১৩ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৫

রবাহূত বলেছেন: অনেক দিন পর আপনার কমেন্ট দেখে খুব সুখী হলাম! অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা!

২| ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:০২

কলাবাগান১ বলেছেন: "এমন মানুষরা বুঝি খুব সহসা হারিয়ে যেতেই আসে পৃথিবীতে"

"ডান হাতে চা কফি পর্যন্ত খেতাম না, কখন আবার ড্র করা লাগে।"

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.