নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভোরের শরীরে এখনও লেগে আছে রাত্রির দগদগে ক্ষত

শ. ম. দীদার

কার্ণিশ ভাঙ্গা জানালার ফাঁক দিয়ে রাতের আকাশের যেটুকু অংশ দেখা যায়, অইটাই আমার পৃথিবী।

শ. ম. দীদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

দ্য তোরাব আলী সিকদার’ রোজনামচাঃ আমাদের বাল্যশিক্ষা

২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:০৯

বড় হয়ে আমি যাঁর মত হতে চেয়েছিলাম, তিনি বলেছিলেন, না, আমার মত কেন, তোমার কারো মতনই হবার দরকার নেই। শুধুই নিজের মত হও। ছোট বেলায় আমি কারো মতন হতে চায়নি, কারণ আমার আশেপাশে কারো মতন হওয়া যায় এমন কাউকে পাইনি। শেষ পর্যন্ত আমি কারো মতনই হতে পারিনি। এটা নিয়ে অবশ্য আমার কোন আফসোস নেই, অহঙ্কার ও নেই।
আমি যখন নিজের মত হতে গেলাম, তখন আমি অন্য কারো মত হতে চাইলাম। আমি যেদিন অন্য কারো মত হতে চেয়েছিলাম, যাঁর মত, তিনি আমার এক শিক্ষক। আজিজুর রহমান। তো আমি যখন তাঁর মত হতে চেষ্টা করলাম, আমার সারা জীবন মনে হল, এটা রীতিমতন দুঃসাহস দেখানো। যেদিন আমি প্রফেট পড়তে শুরু করি, আমার মনে হচ্ছিল, আরে এতো আমার সেই স্যার! যখন মাকারচুদ্রা পড়ি, আরে এতো আমার সেই স্যার। আমার বুদ্ধ।

আজিজুর রহমান। আমার স্কুল শিক্ষক। আমার প্রফেট।

তখন রাত রাত্রির দিকে ধাবমান। তোরাব আলী সিকদার ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে আগুন গুঁজে দিয়ে আবারো বলতে শুরু করল। আর দশজনের মত, পড়াশোনা অবহেলিত বোর্ডিং কিছিমের কৃষি পরিবারে অর্থাভাবে প্রাইভেট পড়া আমার জন্য খুব দুরূহ ছিল। আমি অঙ্কে ভয়ানক দূর্বল ছিলাম। এখনও। তিনি আমাকে ইংরেজি তো পড়াতেনই, স্যার অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু আমার জন্য রাত জেগে তিনি অঙ্ক কষে রাখতেন। হয় পড়াব না কিন্তু ভুল পড়াব না এই ছিল তাঁর মূর‍্যালিটি। রাতে অনুশীলন করা সেই অঙ্ক সকালে আমাকে শেখাতেন। বিনিময় নেননি কোনদিন। স্যার আমার অর্থকষ্টের কথা জানতেন। আমার মতন আরো আরো কত কতজনকে যে এরকম বিনে পয়সায় পড়িয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।

স্যারের মোটের উপর দুইজোড়া জামা কাপড় ছিল। একটা ভাঙ্গা স্যুটকেস। একজোড়া প্লাস্টিকের জুতা। একজোড়া বার্মিজ মাঙ্কি স্যান্ডেল। এই ছিল তাঁর সর্বসাকুল্যে সম্পত্তি। স্কুলের একটা রুমে তেল চিটচিটে বালিশ আর একটা চকির উপর চাঁটায় ছিল স্যারের শোবার বন্দোবস্ত। স্যারের মধ্যে এ নিয়ে কোনদিন কোন আফসোস দেখিনি।
একটা লতানো আঁকা-বাঁকা কিছিমের কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল স্কুলের বারান্দার এক কর্ণারে। স্যার ফযরের নামাজ শেষ করেই সেই কৃষ্ণচূড়াটার শেকড়ে বসে থাকতেন অনেকক্ষণ। তার মুখটা সেই সময় হা হয়ে থাকত। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। খুব ভোরে উঠতেন। সেই সময় তাঁর চোখজোড়া ক্যামন শীতল, স্বচ্ছ আর গভীর মনে হত। মুখাবয়ব ক্যামন পেলব, আরো কোমল। কী যে ভাবতেন। আমার তখন বুদ্ধের কথা মনে পড়ত। স্যারকে আমার বুদ্ধ মনে হত।
স্যার যখন অবসরে যান, তখনো স্কুলের কাছে দশ বছরের বেতন পাওনা ছিল। আমার মনে আছে, স্যার ভাঙ্গা একটা স্যুটকেস আর প্লাস্টিকের জুতা পড়ে সেই চকরিয়া থেকে বেশ কয়েকবার পাওনা টাকাটা চাইতে এসেছিলেন। ম্যানেজিং কমিটির চোর বাটপাররা শেষ পর্যন্ত কিছু টাকা হয়তো দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন আফসোস তাঁর ছিল না।
একদিন মনে আছে, স্যার ছুটি নিয়ে এক সপ্তাহ মতন ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। যেদিন ফিরে আসেন, সেদিন দুপুরে পৌঁছেছিলেন। এসেই হাত মুখ ধোয়ে সোজা ক্লাসে চলে এলেন। আমরা তো ক্লাসে কেউ কেউ কেঁদেই ফেলেছিলাম, স্যারকে এতোদিন পর দ্যাখে। স্যার শিখিয়ে দেননি কোনদিন। আমাদের বাসা থেকেও কোনদিন শেখানো হয়নি। আমরা সেদিন এক এক করে স্যারকে পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলাম। স্যার বলেছিলেন; কর কী, কর কী তোমরা! আয়! তোরা বুকে আয়। আমরা সেদিন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম।

স্কুলের যে স্যারকে তোরাব আলী সিকদার পছন্দ করতো না, অঙ্কের স্যার, বাবু উদয় শেখর দত্ত, তাঁর বেতন আদায়ের জন্যও একদিন প্রতিবাদের ভাষা হিশেবে তোরাব আলী সিকদারেরা স্কুলে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। বাসায় কী বকুনিটা সেদিন তোরাব আলী সিকদার খেয়েছিল। কিন্তু গায়ে লাগেনি। অথচ তোরাব আলী সিকদারের প্রিয় শিক্ষকের জন্য তোরাব আলী সিকদার কিছুই করতে পারেনি। এখন স্যার কোথায় আছে, কেমন আছে, আদৌ বেঁচে আছে কী না কিছুই জানে না তোরাব আলী সিকদার।

রাত আরো গভীর, যতটা প্রতীয়মাণ। ঠোঁটের ফাঁকে আগুন গুঁজে দিয়ে আবার শুরু করল তোরাব আলী সিকদার। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর, আমার চিন্তা ছিল বাব্বাহ! বিশ্ববিদ্যালয়! না জানি এখানকার স্যাররা কত্ত কত্ত বড়। এখানে সব বৈশ্বিক। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হবার দিনও আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের কল্পনার সাথে মেলাতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয় এতোটা সঙ্কীর্ণ হবে আমি ভাবতেই পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাররা এতোটা অপ্রশস্থ হবেন, আমি কোনদিন চিন্তাও করিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিনটি পর্যন্ত আমি আমার সেই আজিজুর রহমান স্যারের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। আমি অপেক্ষায় ছিলাম আমার সেই গোর্কি’র মাকারচুদ্রা গল্পের বুড়ো জিপসিটার জন্যে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম কাহ্‌লিল’র দ্য প্রেফেট’র আল মুস্তাফা’র জন্য। আমি আলমিত্রা। আমার সেই প্রফেট, সেই আজিজ স্যার। কিন্তু আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও আজিজ স্যারের সমান বা তাঁর মতন কাউকেই পাইনি। তারা কেউই আজিজ স্যারের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দামী গাড়ি-বাড়িসমেত, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি এবং তাদের সন্তান আর মিত্রদের সন্তানকে বিনা ভর্তি পরিক্ষা অথবা নামমাত্র ভর্তি পরিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে হবে এই অধিকার আদায়ে আন্দোলন করেন, আমার আমার আজিজ স্যারেরা ভাতার জন্য না, বেতন বৃদ্ধির জন্য না, বেতন পাবার জন্য আন্দোলন করেন। শেষে বেতন না পেলে বলেন, ছাত্র পড়িয়েছি, আবার বেতন লাগবে ক্যান? ওরা তো আমারই সন্তান। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলেন, শিক্ষার্থীরা তো আমাদেরই চ্যালা-চামুণ্ডা। এই হচ্ছে আজিজ স্যার আর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার।

রাত ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। তোরাব আলী সিকদার সোনালী শিশিরে শেষ চুমুকটা দিল। আর বাঁশিতে শেষ টানটা মেরেই; হঠাৎ ঝিম মেরে গেল। তার চোখ দুটো আরো গভীর। আরো কোমল হয়ে উঠল। আচমকা চীৎকার দিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠল। স্যার, আমার জীবনের সমস্ত অর্জন আপনার নামে সঁপে দিলেও আপনার ঋণ শোধ হবার নয়। আজকে আমার যে বিনির্মাণ, সেটা আপনার জন্যেই। এই বলে ঢুকরে কেঁদে উঠল তোরাব আলী সিকদার। স্যার হাঁটু গেঁড়ে আপনাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে স্যার। আপনি যা শিখিয়েছেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা তো শেখাতে পারেইনি, বরং কেড়ে নিয়েছে তার থেকে। তোরাব আলী সিকদার অনবরত কাঁদছে অন্ধকারে।
শেষ রাতের গভীর বুক চিরে সেই কান্নার সুর অনেক দূরে পৌঁছে গেলো। তখন হোসেইন আলীযাদেহ’র ‘তাসনিফ পারওয়ানেহ শো’ বেঁজে উঠল। আর উর্ধ্বাহু প্রসারিত তোরাব আলী সিকদার উন্মাদের মতন চীৎকার করে বলে উঠল; এই যে আপনারা যারা আমার জীবন থেকে ছয়টি মূল্যবান বছর কেড়ে নিয়েছেন, তাদের প্রতি আমার সমস্ত শৈশবের অভিশাপ দিলাম- আপনারা মানুষ হন, আপনাদের মূর্খতার মতন সত্যের শপথ; বিশ্বাস করুন; আপনারা এক একটা জলজ্যান্ত কঙ্কাল।

একটু একটু করে আলো ফুটতে শুরু করছে। দূরে। খুব দূরে খুব গভীর বিরহ নিয়ে মুয়াযযিন আযান দিচ্ছে। তোরাব আলী সিকদার হন্তদন্ত হয়ে উদ্ভ্রান্তের মতন বেরিয়ে পড়ল চকরিয়ার উদ্দেশ্যে।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১:২১

ইমরান পলাশ বলেছেন: অসাধারণ লেখছেন ভাই। আরো চাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.