নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভোরের শরীরে এখনও লেগে আছে রাত্রির দগদগে ক্ষত

শ. ম. দীদার

কার্ণিশ ভাঙ্গা জানালার ফাঁক দিয়ে রাতের আকাশের যেটুকু অংশ দেখা যায়, অইটাই আমার পৃথিবী।

শ. ম. দীদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদর’২০১৭: ম্যানি হ্যাপি রিটার্ন্স অব দ্যা ডে

১৮ ই জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৪:২১


তোরাব আলী সিকদারের বুকটা ক্যামন ধড়ফড় করে উঠল।

এমন উজ্জ্বল ভোর, তোরাব আলী সিকদার ইতোপুর্বে দেখেছেন, এমনটা সে কিছুতেই ঠাহর করতে পারলেন না। এ এমন রৌদ্রকরোজ্জ্বল, এমন ঝলমলে, দেখে, তোরাব আলী সিকদার জন্মের পর প্রথম যে কাঁদন কেঁদেছিলেন, ঠিক সেইভাবে ওঁয়াও ওঁয়াও করে কেঁদে উঠলেন। প্রকাণ্ড জানালায় সেঁটে থাকা মখমলের লম্বা লম্বা পর্দা ঠিকরে বহু বছরের জমাট বাঁধা আলোর ফোয়ারা ঘর ভর্তি থৈ থৈ করছে, মুহুর্তেই। সে কেমন কোমল, কেমন পেলব।

ডান পাশের দেয়ালে সাঁটানো নীট্‌শে মোটা গোঁফে তা দিচ্ছেন। সিকদার সাহেব চোখ রগড়ালেন।

না। আর বিছানায় থাকতে পারলেন না। নগ্ন হয়ে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে গেলেন। নিয়ম করে প্রত্যহ শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে যে মন্ত্রটা আওড়ান, সেটা আজও ভুল না করেই পাঠ করলেন। ‘শরীর পবিত্র হয় জলে, আর মন পবিত্র হয় প্রার্থনায়’। আজ একবার নয়, তিন তিনবার। সজোরে।
রবীন্দ্রনাথ গেয়ে উঠলেন- ‘ডাকিছ শুনি জাগিনু প্রভু আসিনু তব পাশে’।

তোরাব আলী সিকদার দিনের কার্যতালিকা লিখতে শুরু করলেন-
১। সবাইকে হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদর ম্যাসেজ দিতে হবে
২। গুলশানে অফিস কলিগের হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদর পার্টিতে এ্যাটেন্ড করতে হবে
৩। হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদর উপলক্ষে সরকারি অনুষ্ঠান আর পিজ্জা হাটের পিজ্জা ব্যুফে পার্টিতে জয়েন করতে না পারার স্যরি ম্যাসেজ দিতে হবে
৪। বিকেলে শাহবাগে সার্বজীন হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদর সভায় অংশ গ্রহণ করতে হবে
৫। হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদর এর উপর একটা চমৎকার ফেইসবুক স্ট্যাটাস দিতে হবে
৬। অফিসের গ্রাফিক্স ডিজাইনারকে দিয়ে হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদর এর একটা ফেবু কভার ডিজাইন করতে হবে
৭। ‘হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদরঃ নারীর ক্ষমতায়নে জাগতে হবে নারীকে এখনই’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে যেতে হবে মহিলা ক্লাবে

মোটামুটি আজকের দিনের জরুরী কাজের তালিকাটা লিখেই হ্যাজেসে আগুন লাগালো সিকদার সাহেব। প্রস্তুতি নিতে নিতেই দুপুর শেষ। এর মধ্যে দুইটা কুরিয়ার আসল। পার্সেল।

হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদর প্রস্তুতি পর্ব। এক সপ্তাহ’র প্রস্তুতি। আজকে শেষ মুহুর্তের কেনাকাটা। বিকেলে বের হয়ে আর্চিস থেকে গোটা পঞ্চাশেক হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদর ডিজাইন কিনলেন। সফট কপি। আড়ং থেকে একটা পাঞ্জাবী আগেই অনলাইনে অর্ডার দিয়ে রেখেছিলেন। বড়পা’র জন্য একটা শাড়ি। মোমবাতি, আগরবাতি, ধূপ আর কর্পুর। সব আড়ং থেকেই। হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদরের দশ পাউন্ডের কেক, বেলুন আর ক্যাপ কিনলেন। বাসায় অনেক লোকজন আসবে। সার্বজনীন শ্রেণির বন্ধুরা আসবে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সোনালী শিশিরে চুমুক দেন না। তাদের জন্য দু কেস বিয়ারের অর্ডার দিয়ে রেখেছেন। জালি কাবাব, সোতা কাবাব আর কাঁকড়ার ঝাল ফ্রাই হচ্ছে মেইন ডিশ। জাপানি বন্ধুদের জন্য টাইগার শার্কের বার বি কিউ করতে হবে। সব কিছু কেনা হয়েছে একদম ফর্দ মাফিক। বুয়াকে গোণে গোণে সতেরদিন আগে থেকেই বলা আছে। বুয়া শুধু বলেছিলেন, ভাইজান, গঞ্জে গেলে আমার জন্য একটা লাল চিরুণী আর এক শিশি নাইরকল তেল আর একটা ফেইস ওয়াশ আইনেন।

সরকার ও বিরোধীদল পরস্পর পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দিয়েছেন হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদর উপলক্ষে। টিভি চ্যানেল, বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন আলোচনাসভা আর দোয়া মাহফিলের আয়োজন করলেন। এই দোয়া মাহফিলে শুধু মুসলিম জাহানের কল্যাণ কামনা করে দোয়া করার জন্য হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদর এর সার্বজনীন মাহাত্ম ও বিশেষ তাৎপর্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে সে বিষয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ বিবৃতি দিয়েছেন। এতে ধর্ম নিরপেক্ষ সংগঠনগুলো সংহতি প্রকাশ করেছেন। মাহফিলে বিশ্বশান্তির জন্য বিশেষ প্রার্থনার প্রস্তাব রেখে বর্ধিত আলোচনাসভার আয়োজন করা হল।

রাত দশটার পর থেকে মাঝরাত অবধি পার্টি চলল। পাড়ার মসজিদের ইমামটা একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেলের 'হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদরঃ বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় সবিশেষ তাৎপর্য' শীর্ষক বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ায়, বিশেষ দোয়ার আয়োজনটা প্রায়ই ভেস্তে যেতে বসেছিল, যদি না সেই ক্ষণে রবার্ট মারান্ডি সবিশেষ প্রার্থনার কাজে এগিয়ে না আসতেন।

সবাই যার যার ঘরে চলে গেলো।
পার্কিংয়ের জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ার অপমানটা কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে, ব্যালকনিতে চিন্তা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে দোল খাচ্ছিলেন তোরাব আলী সিকদার। পার্সেল দুইটার কথা আচমকা মনে পড়তেই আলমারির তাক এ হাত বাড়ালেন। তখন কে বা কারা পাঠিয়েছেন তা জানার প্রয়োজন মনে করেনি। এরকম তো হরহামেশা কেউ না কেউ পাঠায়ই। একটা পার্সেল খুলে দেখল কালো জমিনে গ্রে কালারে ক্যালিগ্রাফি ‘হ্যাপি পবিত্র শব-ই-ক্বদরঃ ক্ষমার রাত। ফিরে এসো গতদিনের সব বেদনা ভুলে, প্রতারণার ক্ষত মুছে’। খামের উপর প্রেরকের শুধু নামটা আর খুব চেনা একটা মোবাইল নাম্বার যেটি এখন বন্ধ, তাও বছর দেড়েক আগে থেকেই। তোরাব আলী সিকদারের চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। একদিন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ক্যাম্পাস মাত করার স্মৃতি, অধুনালুপ্ত উত্তরা টু আজিমপুর এসি বাসের জার্নি, কনকনে শীতের রাতে বাসের অপেক্ষায় ফুড ভিলেজে অপেক্ষার মুহুর্তগুলোর কথা অবিকল মনে পড়ল। হঠাৎ মনে হল একটা বাতাসের ঝটকা এলো। সিকদার সাহেব হত বিহ্বল হয়ে গেলেন। দোল খাইতে গিয়ে যে সামনের দিকে ঝুঁকেছিলেন, সেখানেই স্টাক হয়ে গেলেন। ‘হ্যারে তুই এতো কিছু করলি, আমার কথা ভুইলায়ই গেলি মাত্র ক’বছরে? গফুর মিয়া রে দিয়া কবর জিয়ারত করাইলি। তুই নিজে আসলি না?’ মা, আপনি রাগ করলেন?

বাইরে ফকফইক্কা চান্দের আলো। এমনই এক করালগ্রাসী জোৎস্না রাতে গৌতম বুদ্ধ গৃহত্যাগ করেছিলেন। তোরাব আলি সিকদার আর ঘরে থাকতে পারলেন না। তাঁর চোখের পাতা ভীষণ ভারী। ঠোঁট বিড় বিড় করছিল। পা ঠিক সঠিক স্থানে পড়ছে কী না বুঝতে পারছে না। তোরাব আলী সিকদার চীৎকার দিয়ে উঠলেন।

ভোরে কাজের বুয়া এসে দ্যাখে তোরাব আলী সিকদার সিঁড়িতে পড়ে আছেন। তাঁর উশকো খুশকো চুল আর ফ্যাকাশে মুখের মধ্যে কোমল পেলব ভয়ঙ্কর রৌদ্রকরোজ্জ্বল সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.