নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নীরবে নির্জনে যন্ত্র-অরণ্যে

আপাতত রেস্টে আছি! :)

স্নিগ

আমি একদিন মারা যাব, এই সত্যটা নিয়ে আমার খুব বেশি আক্ষেপ নেই। তবে, আমার মৃত্যুর পর আরও অসংখ্য অসাধারণ সব বই লেখা হবে, গান সৃষ্ট হবে, চলচিত্র নির্মিত হবে।কিন্তু আমি সে সব পড়তে, শুনতে কিংবা দেখতে পারবো না।এই সত্যটা আমাকে খুব যন্ত্রণা দেয়।

স্নিগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ অন্তরমহলে রাখিব, যেতে দেবো না

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:৪৫

ঋতুপর্ণ ঘোষ- বাংলা চলচ্চিত্রের এক দিকপালের নাম। অকালপ্রয়াণে যা পরিণত হলো কিংবদন্তীতে। সত্যজিৎ পরবর্তী দিশেহারা চলচ্চিত্র জগতটাকে যিনি একাই নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে গিয়েছেন সামনের দিকে। তারই বানানো পথ অনুসরণ করে হাঁটতে সাহস করেছেন আরো অনেকে। কিন্তু তারা সবাই যেন ঋতুপর্ণের ছায়াকেই বেশি অনুসরণ করেছেন। ঋতুপর্ণ অবশ্য বৃত্তে আটকে থাকেননি। বৈচিত্র্যময় সব গল্প নিয়ে একের পর এক ছবি বানিয়েছেন। ২১ বছরের পরিচালক জীবনে তার নির্মিত ছবির সংখ্যা ১৯, যার ১২টিই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। এই প্রবাদ পুরুষকে নিয়ে লিখেছেন স্নিগ্ধ রহমান।



ঋতুপর্ণ ঘোষের বাবা সুনীল ঘোষ ছিলেন তথ্যচিত্র নির্মাতা। তাই ছোটবেলা থেকেই সেলুলয়েডের ফিতার সাথে তার পরিচয় ছিলো। সত্যজিৎ রায়ের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন ঋতুপর্ণ। তাকে গুরু মানতেন। শিষ্যর শুরুটাও হয়েছিলো কতকটা সত্যজিতের মতো করেই। সত্যজিৎ অর্থনীতিতে স্নাতক করে প্রথম জীবনে বিজ্ঞাপনের কপি রাইটার হিসেবে কাজ করতেন। ঋতুপর্ণও অর্থনীতিতে স্নাতক করে কপি রাইটারের করেন। প্রথম কিছুদিন অবশ্য চলচ্চিত্র সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। কপি রাইটার হিসেবে অসংখ্য বিখ্যাত ক্যাচ লাইনের জন্ম দিয়েছেন ঋতুপর্ণ। কপি ও বেইজলাইন লেখার জন্য পেয়েছিলেন ১০টি জাতীয় পুরস্কার। প্রচুর বই পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। আর ভালোবাসতেন লিখতে।

১৯৯২ সালে নির্মাণ করেন তার প্রথম ছবি হীরের আংটি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত শিশুতোষ চলচ্চিত্রটিতে ছিলেন সুচিত্রা সেনের কন্যা মুনমুন সেন আর প্রবীণ শক্তিশালী অভিনেতা বসন্ত চৌধুরী। শিশুদের জন্য তৈরী করা হলেও এই রহস্য গল্পটিতে বড়রাও মজে যান।



কপি রাইটার হিসেবে কাজ করার ফাকে ফাকে ঋতুপর্ণের লেখা দুটো গল্প প্রকাশিত হয় পত্রিকায়।যার একটি ছিলো বাৎসরিক। গল্পটি তার আরেক গুরু ইঙ্গমার বারিম্যান (Ingmar Bergman) এর Autumn Sonata চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে লেখা । ১৯৯৫ সালে সেই গল্প থেকে বানান উনিশে এপ্রিল। এক নৃত্যশিল্পী মা আর তার মেয়ের সম্পর্ক, ক্যারিয়ারের কারণে সাংসারিক জীবনে জন্ম নেওয়া টানাপোড়েন উঠে আসে তার এই ছবিতে। সিনেমা হলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা মধ্যবিত্ত দর্শক আবারো হলে ফিরে এই ছবিটির জন্য। মা-মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অপর্ণা সেন আর দেবশ্রী রায়। আর দেবশ্রীর স্বামীর চরিত্রে ছিলেন তার তখনকার স্বামী প্রসেনজিৎ। ছবিটির জন্য ঋতুপর্ণ প্রথমবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। দেবশ্রী পান তার জীবনের একমাত্র জাতীয় পুরস্কার।



বিভিন্ন কারণে এই চলচ্চিত্রটি ঋতুপর্ণের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র। কারণ উনিশে এপ্রিলের অনেকগুলো উপকরণ ঋতুপর্ণের পরবর্তী কাজগুলোতে বারবার ফিরে এসেছে। নারী প্রধান চরিত্র, মা-মেয়ের সম্পর্কের উপাখ্যান এই বিষয়গুলোকে আলাদা করে গুরুত্ব দিয়ে বেশ কয়েকবার কাজ করেছেন তিনি। ঋতুপর্ণের সিনেম্যাটিক স্টাইলকে আকৃতি দান করে এই ছবি। কলকাতার মূলধারার শিল্পীদের দিয়ে ভিন্নধারার ছবি বনাতে শুরু করেন তিনি। এই ছবিতেই প্রথমবারের মাধ্যমেই প্রসেনজিতের সাথে ঋতুপর্ণের বন্ধুত্বের শুরু। আমৃত্যু এই বন্ধুত্ব অটুট ছিলো।



১৯৯৭ সালে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের গল্প নিয়ে ঋতুপর্ণ নির্মাণ করেন দহন। এই ছবিতে একই সাথে এক নির্যাতিত নারী ও এক সাহসী নারীকে তুলে ধরেন ঋতুপর্ণ। সেই সাথে পঁচে যাওয়া লিগ্যাল সিস্টেম আর মরচে পড়া সমাজের একচোখা নীতিকেও একহাত দেখে নেন। সঙ্গীতকার দেবজ্যোতি মিশ্রের সাথে এ ছবিতেও প্রথম কাজ করেন ঋতুপর্ণ। দহন পরবর্তী ঋতুপর্ণের সব ছবির মিউজিক করেছেন দেবজ্যোতি। এই চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও ইন্দ্রানী হালদার দুজনেই জাতীয় পুরস্কার পান। ঋতুপর্ণের ঝুলিতে যায় শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার।



নিজের প্রকাশিত আরেকটি ছোটগল্প বাড়িওয়ালি নিয়ে ১৯৯৯ সালে ছবি বানান ঋতুপর্ণ। এই ছবির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বলিউডের প্রতিষ্ঠিত তারকাদের নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে তার সাথে কাজ করার অমোঘ আকর্ষণে বলিউডের প্রথম সারির তারকারা ছুটে আসতেন। মুম্বাই ছেড়ে কলকাতায় থেকে কাজ করতেন মাসের পর মাস। ছবিটির নাম ভূমিকায় অভিনয় করে কিরণ খের জিতে নেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ছবিটি প্রযোজনা করেন কিরণ খেরের স্বামী অনুপম খের। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার জেতে বাড়িওয়ালি। সেই একই বছর শ্রেষ্ঠ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় ঋতুপর্ণের আরেকটি ছবি অসুখ।

২০০০ সালে ঋতুপর্ণ নির্মাণ করেন উৎসব। দূর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে জড়ো হওয়া এক যৌথ পরিবারের মধ্যে দিয়ে ঋতুপর্ণ মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারের সনাতন প্রথা, সম্পর্ক ও সমস্যাকে তুলে ধরেন।শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার যায় ঋতুপর্ণের ঝুলিতে।



সত্যিকারের মা-মেয়ে অপর্ণা সেন আর কঙ্কনা সেন ও মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে ২০০২ সালে ঋতুপর্ণ পরিচালনা করেন তিতলি। ঋতুপর্ণ গান আর কবিতাকে শক্তিশালী মাধ্যমরূপে ব্যবহার শুরু করেন এই ছবির মাধ্যমে।

২০০৩ সাল ঋতুপর্ণের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই বছর মুক্তি পায় তার শুভ মহরৎ ছবিটি। আগাথা ক্রিস্টির “The Mirror Crack’d from Side to Side অবলম্বনে তিনি গোয়েন্দাধাঁচের এই ছবিটি নির্মাণ করেন। অভিনয় করেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর আর রাখী গুলজার। মিসেস মার্পলের বাঙালী সংস্করণ রাঙা পিসির ভূমিকায় অভিনয় করে রাখী জিতে নেন শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার।



সেই একই বছর মুক্তি পায় ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালক জীবনের সবচে বিখ্যাত, আলোচিত-সমালোচিত চলচ্চিত্র চোখের বালি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ঐশ্বরিয়া রায়, প্রসেনজিৎ আর রাইমা সেন। এই ছবিতে ঋতুপর্ণ ইচ্ছা করেই সর্বাধিক পারিশ্রমিক দেন চিত্রগ্রাহক অভিক মুখার্জীকে। কারণ ঋতুপর্ণের মতে চোখের বালিতে তার ভূমিকা ছিলো সবচে গুরুত্বপূর্ণ।ছবির বিভিন্ন অংশে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চারুলতার প্রভাব আছে বলে স্বীকার করে নেন ঋতুপর্ণ। তার মতে, সকল বাঙালীর মাঝে রবীন্দ্রনাথকে সবচে ভালোভাবে বুঝেছিলেন এক সত্যজিৎ। সচেতন দর্শকমাত্রই স্বীকার করবেন, এর পরের নামটি হওয়া উচিৎ ঋতুপর্ণের। চোখের বালি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। এছাড়া লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনয়ন পায়। অনেকেই অবশ্য রবীন্দ্রনাথের গল্পকে নিয়ে এমনভাবে ছিনিমিনি খেলাটাকে মেনে নিতে পারেন না। সেইসাথে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সে বছরই ঋতুপর্ণ প্রথমবারের মতো ক্যামেরার সামনে আসেন Katha Deithilli Ma Ku (তোমায় কথা দিলাম মা) নামক এক ওড়িয়া ছবিতে অভিনয় করে।



ঐশ্বরিয়া রায় আর অজয় দেবগানকে নিয়ে পরের বছর ঋতুপর্ণ ঘোষ নির্মাণ করেন Raincoat। এটি তার প্রথম হিন্দি চলচ্চিত্র।অনেকদিন পর দেখা হওয়া দুই প্রেমিক-প্রেমিকার অতীত ও বর্তমান জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছে সংলাপনির্ভর ছবিটি। যার মূল অনুপ্রেরণা নিয়েছেন তিনি ও‘হেনরীর The Gift of the Magi ছোটগল্প থেকে। এ ছবিটি ২০০৪ সালের শ্রেষ্ঠ হিন্দি ছবির জাতীয় পুরস্কার জিতে নেয়।

পরিচালনার ফাকে ফাকে ছোটপর্দাতেও কাজ করেছেন ঋতুপর্ণ। “এবং ঋতুপর্ণ” ও “ঘোষ এন্ড কোং” নামে দুটি তারকালাপ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন তিনি। সেই সাথে সামলেছেন আনন্দলোক পত্রিকার সম্পাদনার ভার।



২০০৫ সালে ঋতুপর্ণের অন্তরমহল মুক্তি পায়। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের এক জমিদার ও তার দুই স্ত্রীকে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে ছবির গল্প। ছবির সাথে সাথে প্রকাশিত হয়েছে চরিত্রগুলোর মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা স্বপ্ন, লালসা, বিশ্বাস, কুসংস্কার, আর ভালোবাসা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিমা ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন জ্যাকি শ্রফ, সোহা আলি খান, অভিষেক বচ্চন, রূপা গাঙ্গুলি। এটি লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বেয়ারের জন্য মনোনীত হয়। অন্তরমহল সম্ভবত বাংলা ভাষার একমাত্র এরোটিক সাইকোলজিক্যাল ড্রামা।

ক্লাসিক যুগের প্রতি নিজের মমত্ব ও শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য ঋতুপর্ণ তার পরবর্তী ছবি দোসর শাদা-কালোয় নির্মাণ করেন। কান চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ পাওয়া ২০০৬ সালের এই ছবিটি প্রসেনজিতের ক্যারিয়ারে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। বাণিজ্যিক ধারা থেকে শিল্প ধারার চলচ্চিত্রে তার ট্রান্সফর্মেশন ঘটান ঋতুপর্ণ। প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জী পেয়ে যান সেরা অভিনেতার স্পেশাল জুরী অ্যাওয়ার্ড।



উৎপল দত্তের আজকের শাজাহান অবলম্বনে ২০০৭ সালে ঋতুপর্ণ তৈরী করেন The Last Lear । এই ছবিতে তিনি কাজ করেন বলিউডের প্রবাদ পুরুষ অমিতাভ বচ্চনের সাথে। ঋতুপর্ণ পরিচালিত একমাত্র ইংরেজী চলচ্চিত্রটিতে আরও অভিনয় করেন প্রীতি জিনতা ও অর্জুন রামপাল। The Last Lear সেই বছর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।ঋতুপর্ণের ইচ্ছা ছিলো বচ্চন পরিবারের চারজনকে একই ছবিতে অভিনয় করাবেন। সেটা আর হলো না।



২০০৮ সালে মুক্তি পায় ঋতুপর্ণের তুলনামূলকভাবে দুর্বল একটি কাজ খেলা। এক পরিচালকের ছবি বানোনোর গল্প নয়ে এগিয়েছে খেলা। প্রসেনজিতের পাশাপাশি এই ছবিতে আরও ছিলেন মনীষা কৈরালা আর রাইমা সেন।



সে বছরই মুক্তি পায় ঋতুপর্ণের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত আরেকটি ছবি সব চরিত্র কাল্পনিক। এক কবির মৃত্যুর পর তার সাথে নিজের সংসার জীবনের খেরোখাতা নিয়ে হিসেব করতে তার স্ত্রী। ঋতুপর্ণ প্রায় পুরোটা ছবিই বয়ান করেছেন ফ্ল্যাশব্যাকে। প্রসেনজিতের সাথে এই ছবিতে আরো ছিলেন বিপাশা বসু। তাছাড়া একটি অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।



পরিচালনার পাশাপাশি গানও লিখেছেন ঋতুপর্ণ। “আবহমান” ও “মাছ, মিষ্টি অ্যান্ড মোর” ছবি দুটিতে তার লেখা গান আছে। এছাড়া “গানের ওপারে” নামের এক টিভি সিরিয়ালের স্ক্রীপ্ট লিখেন তিনি।

এক বছর বিরতি দিয়ে ২০১০ সালে এসে ঋতুপর্ণ ঘোষ উপহার দেন তার চলচ্চিত্র জীবনের অন্যতম সেরা দুটি কাজ- আবহমান আর নৌকাডুবি। ঋতুপর্ণের উপর বারিম্যানের যে প্রভাব সব চরিত্র কাল্পনিকে দেখা গিয়েছিলো সেটা আবহমানে এসে পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। গুজব উঠেছিলো আবহমানের গল্প সত্যজিৎ রায় আর মাধবী মুখার্জীর বাস্তব সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে বানানো। এক সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ নিজেই এ অভিযোগ নাকচ করে দেন। ঋতুপর্ণ প্রথমে নাসিরুদ্দীন শাহ, শাবানা আজমী ও বিদ্যা বালানকে নিয়ে হিন্দিতে “Kya Haseen Sitam” নামে ছবিটি বানাতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে বাংলায় ছবিটি শেষ করেন। ছোটপর্দায় সুবর্ণলতা সিরিয়াল করে বিখ্যাত বনে যাওয়া অনন্যা চ্যাটার্জী পান শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার। এছাড়াও আবহমানের শো-কেসে যোগ দেয় শ্রেষ্ঠ ছবি ও শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার।



এছাড়া এ বছরই তিনি Mumbai Cutting চলচ্চিত্রের জন্য Urge নামে একটি শর্টফিল্ম তৈরী করেন। মোট ১১টি শর্টফিল্ম ছিলো Mumbai Cutting ছবিটিতে। ঋতুপর্ণ ঘোষ ছাড়াও অনুরাগ কাশ্যপ, সুধীর মিশ্র এবং আরও আটজনের নির্মাতার কাজ স্থান পায় চলচ্চিত্রটিতে।

২০১১ সালের শুরুতে মুক্তি পায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি ঋতুপর্ণের আরেকটি শ্রদ্ধার্ঘ্য নৌকাডুবি। প্রখ্যাত বলিউডি পরিচালক সুভাষ ঘাই প্রযোজিত এই ছবিতে অভিনয় করেছেন প্রসেনজিত, যিশু সেনগুপ্ত আর দুই বোন রিয়া ও রাইমা সেন। গল্পের স্ক্রীপ্ট ও বর্ণনাভঙ্গি দর্শক সমালোচকের দারুণ প্রশংসা পায় ছবিটি।



২০১১ সালে হঠাৎ করেই অভিনয়ে মনোযোগী হয়ে পড়েন ঋতুপর্ণ। মেমোরিস ইন মার্চ আর আরেকটি প্রেমের গল্প নামে দুটো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।দুটো ছবিতেই সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি, সমকামিতার মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে। আরেকটি প্রেমের গল্প চলচ্চিত্রটির (প্রাথমিক নাম ছিলো ছায়া ছবি) জন্য ২৪ কেজি ওজন কমান ঋতুপর্ণ।

২০১২ সালে ঋতুপর্ণ পশ্চিমবঙ্গ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে (পরিচালক শ্যাম বেনেগালের অনুপ্রেরণায়) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন।জীবন স্মৃতি” নামের ৭৬ মিনিটের ডকুমেন্টারিটি বানাতে গিয়ে রবি ঠাকুরের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঋতুপর্ণ আগ্রহী হয়ে পড়েন। ঠিক করেন, রাইমা সেন ও কোয়েল মল্লিককে নিয়ে ঠাকুরবাড়ির নারী চরিত্রগুলোকে আলোকপাত করে একটি চলচ্চিত্র বানাবেন। এখানে উল্লেখ্য যে কবিগুরুর শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায়ও “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর” নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছিলেন। সেখানে ধারাবর্ণনাও করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ।



এছাড়াও সে বছর তিনি আর.মাধবন, কঙ্কনা সেন, জয়া বচ্চন, নাসিরুদ্দীন শাহ ও রাইমা সেনকে নিয়ে তার একমাত্র কমেডি ছবি Sunglass নির্মাণ করেন। ১৯তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটার নাম পরিবর্তন করে Taak Jhaank নামে প্রদর্শিত হয়। সেখানে ছবিটি অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, কমল হাসান সহ উপস্থিত সকলের প্রশংসা অর্জন করে। ছবিটি ২০১৪ সালে মুক্তি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।

২০১২ সালে এসে ঋতুপর্ণ নির্মাণ করেন তার সবচে সাহসী চলচ্চিত্র চিত্রাঙ্গদা । প্রায় ১০ বছর ধরে এই ছবিটি বানানোর ইচ্ছা পুষে রেখেছিলেন তিনি। নিজের জেন্ডার আইডেন্টিটি খুঁজতে থাকা এক কোরিওগ্রাফার আর তার জীবনসঙ্গীকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে ছবিটি। ছবিটিকে দর্শকরা ফিরিয়ে দিলেও ৬০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে পেয়ে যায় স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড।



মৃত্যুর পূর্বে তিনি কাজ করছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রটি নিয়ে। চোরাবালি গল্প অবলম্বনে “সত্যান্বেষী” নামক চলচ্চিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন Kahaani ছবির পরিচালক সুজয় ঘোষ। অজিতের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের ভোকাল অনিন্দ্য চ্যাটার্জী। ছবিটির শুটিং শেষ হলেও পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ বাকি ছিলো। ছবিটি আগস্ট ২০১৩-তে মুক্তি পাবার কথা। নিয়তি যেন এক অদ্ভুত মজা করলো ঋতুপর্ণের সাথে। যার পরিচালক জীবনের শুরুটা হয়েছিলো রহস্য চলচ্চিত্র দিয়ে (কাকতালীয়ভাবে হীরের আংটি-ও বুক অ্যাডাপ্টেশন ছিলো), শেষটাও হলো রহস্য চলচ্চিত্র দিয়ে।



৩০শে মে, ২০১৩… পঞ্চাশ ছোঁয়ার তিন মাস আগেই কলকাতায় নিজ বাড়ি “তাসের ঘর“-এ ঘুমের মাঝে চিরনিদ্রার দেশে চলে গেলেন ঋতুপর্ণ। ক্যামেরার পেছনে, ক্যামেরার সামনে, স্টুডিওর বাইরে যার কর্মজীবন আর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সরব ছিলো সারা পৃথিবী, তার এমন নীরব প্রস্থান মেনে নিতে কষ্ট হয় বৈকি। কিংবদন্তী পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিকের বেশিরভাগ কাজই সমাদৃত হয়েছে তার মৃত্যুর পর। তিনি তার সময়ের চে এতটাই এগিয়ে ছিলেন যে, পৃথিবী তার চিন্তাধারার সমকক্ষ হতে অনেকটা সময় নিয়ে ফেলেছে। ঋতুপর্ণের সাথেও বুঝি এমনটাই হয়েছে। তার সৃষ্টি অনুভব করার জন্য পৃথিবী হয়তো এখনো যথেষ্ট প্রস্তুত হয়নি। কিন্তু তাই বলে তিনি হারিয়ে যাবেন না।দর্শকদের অন্তরে মননশীলতার দোসর হয়ে থাকবেন আবহমানকাল জুড়ে।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.