নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নীরবে নির্জনে যন্ত্র-অরণ্যে

আপাতত রেস্টে আছি! :)

স্নিগ

আমি একদিন মারা যাব, এই সত্যটা নিয়ে আমার খুব বেশি আক্ষেপ নেই। তবে, আমার মৃত্যুর পর আরও অসংখ্য অসাধারণ সব বই লেখা হবে, গান সৃষ্ট হবে, চলচিত্র নির্মিত হবে।কিন্তু আমি সে সব পড়তে, শুনতে কিংবা দেখতে পারবো না।এই সত্যটা আমাকে খুব যন্ত্রণা দেয়।

স্নিগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

হুমায়ূনের পরশমণি

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:৫১

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ছবি হয়েছে। কিন্তু সে সব ছবির মাঝে সবচেয়ে আলাদা নামটি হলো “আগুনের পরশমণি”। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের ধারাই বদলে দিয়েছে যে ছবিটি। আগুনের পরশমণিতে ছিলো জ্যোৎস্না, ছিলো বৃষ্টি আর ছিলো প্রেম। হুমায়ূন আহমেদের চোখ দিয়ে আমরা আবিষ্কার করি এক টুকরো দেশকে- একাত্তরের বাংলাদেশকে।

আগুনের পরশমণির গল্পের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা শরের এক বাড়ি। মতিনউদ্দিন সাহেব তার স্ত্রী সুরমা, দুই মেয়ে রাত্রি আর অপালা, গৃহকর্মী বিন্তিকে নিয়ে থাকেন সেই বাড়িতে। তাদের বাসায় সাময়িক সময়ের জন্য লুকিয়ে থাকতে আসে মুক্তিযোদ্ধা বদি। প্রথম প্রথম বদিকে অপছন্দ করলেও, একসময় বদিকে ভালোবেসে ফেলে রাত্রি। ধীরে ধীরে মতিন সাহেবের পরিবারের সদস্যে পরিণত হয় বদি। কিন্তু পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে এক বন্দুক যুদ্ধে আহত হয় বদি। আশ্রয় নেয় মতিন সাহেবের বাসায়। কারফিউ থাকার কারণে বদিকে কোনো চিকিৎসকের কাছেও নেওয়া সম্ভব হয় না। ভোর হলে, তবেই তারা ডাক্তার আনতে পারবে। শুরু হয়, অপেক্ষায়ময় দীর্ঘ এক রজনীর…।

‘আগুনের পরশমণি’ হুমায়ূন আহমেদের প্রথম চলচ্চিত্র হলেও, তার লেখা প্রথম চিত্রনাট্য হলো “শঙ্খনীল কারাগার”। সে ছবির জন্য তিনি ১৯৯২ সালে শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের পুরষ্কার পেলেও, বদনামও হয়েছিলো। সমালোচকরা বলেছিলেন, পুরো ছবির মাঝেই নাকি একটা “নাটক-নাটক” ভাব ছিলো। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও সে ছবির মান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। এজন্য আগুনের পরশমণির স্ক্রীপ্ট করেছেন সময় নিয়ে। পরিচালনার দায়িত্বও তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। মনে হতে পারে, পরিচালনার সিদ্ধান্তটি বুঝি হঠাৎ করেই নেওয়া। সেটা সত্যি নয়। অনুঘটক হিসেবে আরো কিছু ঘটনা ভূমিকা রেখেছে। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রমোশন পেয়ে ফুল প্রফেসর হওয়ার পরে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। হুমায়ূন আহমেদের মনে হতো শুধুমাত্র কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়ানোর জন্য তার জন্ম হয়নি, তার নিয়তি ভিন্ন। এছাড়া, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভালো কোনো চলচ্চিত্রের অভাব বরাবরই তাকে পীড়া দিতো। হুমায়ূন আহমেদ তার “১৯৭১” উপন্যাসটির স্ক্রীপ্ট চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মাণের জন্য দিতে চাইলেও, তৎকালীন সরকার রাজি হয়নি (ছবিটির অর্থায়ন করছিলো তথ্য মন্ত্রণালয়)। সেজন্য তিনি নিজেই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি বানাতে চান। আরেকটি বড় কারণ হলো তার বন্ধু আনিস। হুমায়ূনের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু আনিস সাবেতের স্বপ্ন ছিলো পরিচালক হবার। ক্যান্সারে আনিস সাবেতের মৃত্যু হুমায়ূনকে খুবই প্রভাবিত করে। তিনি নতুন করে চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন। তার লেখাগুলোতেও আনিস নামের চরিত্র অসংখ্যবার এসেছে। এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন নিজেই বলেন : “যখনই কোনো অসাধারণ চরিত্র আঁকতে চেয়েছি, আমি নাম দিয়েছি আনিস।”

যদিও হুমায়ূন আহমেদ প্রথমে ১৯৭১ উপন্যাসটিকে চলচিত্ররূপ দিতে চেয়েছিলেন, পরবর্তীতে আগুনের পরশমণিকে বেছে নেন। কারণ, অনেক কম বাজেটে ছবিটি নির্মাণ করা সম্ভব হতো। পুরো ছবিতে একটি মাত্র সেট ব্যবহার করে হয়েছে। এছাড়া, হুমায়ূন আহমেদের মনে হয়েছিলো “১৯৭১”-এর মতো বড় ক্যানভাসের গল্পকে সামলানোর জন্য তিনি কিছুটা অনভিজ্ঞ। বাজেট নিয়ে এত মাথা ঘামিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। সরকারী অনুদানের ২৫ লক্ষ টাকা শেষ হবার পর, নিজের ব্যক্তিগত সঞ্চয় ও অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের কাছ থেকে ধার নিয়ে ছবির শেষ ভাগের শ্যুটিং সম্পন্ন করেন হুমায়ূন।

চলচ্চিত্রের স্ক্রীপ্ট সাধারণত তিন অঙ্ক (Three Act) বিশিষ্ট হয়। তবে, আগুনের পরশমণিতে ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্টের দিকেই পরিচালকের বেশি সময় দিয়েছেন। তার এই বাড়তি মনোযোগের কারণটা আমরা আবিষ্কার করি ছবির শেষ ভাগে গিয়ে (তৃতীয় অঙ্কে)। এই অংশটুকু বড্ড বেদনাবিধুর। নীরিহ মানুষদের প্রাণহানি দেখি, বদির মামা রেজাউল করিম, বদির বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা তুহিন আর বিন্তির মতো পরিচিত চরিত্রগুলোর বিদায় দেখি (এখানে একটি কথা বলে রাখি, হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ক্রীপ্টে বিন্তি চরিত্রটি মারা যায় না। সে ডাক্তার খুঁজতে বাইরে গিয়ে, আবার ফিরে আসে)। পরিচালক ইচ্ছা করে প্রতিটি চরিত্রের সাথে এতটা নৈকট্য তৈরী করে দেন, যাতে তাদের বিদায়টা দর্শকদের অনেক বেশি করে স্পর্শ করে। এ যেন পরিচালকের টর্চার করার নিজস্ব ভঙ্গি। আর তিনি ছবির সমাপ্তি টানেন প্রতীকী এক দৃশ্যের মাধ্যমে। এক রাশ পাখি আকাশে উড়ে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ছবির শেষ দৃশ্যটির শ্যুটিং করা হয়েছে সবার আগে। হুমায়ূন আহমেদ অবশ্য একটি অল্টারনেটিভ এন্ডিং রেখেছিলেন: একদল শিশু ধবধবে শাদা পোশাক পড়ে, স্বাধীন দেশের পতাকা হাতে দৌড়ে আসছে। ধারণ করা হলেও, পরবর্তীতে দৃশ্যটা আর ব্যবহার করা হয়নি।



আগুনের পরশমণির প্রতিটি চরিত্রে সবাই অসাধারণ অভিনয় করেছেন। তবে, হুমায়ূন নাকি আবুল হায়াত আর ডলি জহুরের অভিনয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তার মনে হয়েছে, পরিচালক হিসেবে তিনি সঠিক অভিনয়টা বের করতে পারেননি। দিলারা জামান, মোজাম্মেল হোসেন, তুহিন, সালেহ আহমেদের চরিত্রের ব্যপ্তি কম হলেও মুগ্ধ করেছেন। আলাদা করে বলতে হয়, বিন্তি চরিত্রে পুতুল আর কর্নলের চরিত্রে অভিনয় করা ওয়ালিউল ইসলামের কথা। নবাগত হিসেবে তাক লাগানো অভিনয় করেছেন তারা। বদি চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূরের অভিনয় দারুণ ছিলো। তার সরল হাসি দেখলে যেমন তাকে গোবেচারা ভালোমানুষ মনে হয়, আবার অ্যাকশনের সময় তার মুখের কাঠিন্য দেখে মনে হয়েছে এ যেন অন্য কোনো বদি। রাত্রি চরিত্রে অভিনয় করে বিপাশা হায়াত জাতীয় পুরস্কার পেলেও দৃশ্যভেদে তাকে অতি অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে। অপালা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ূনকন্যা শীলা আহমেদ। মূল উপন্যাসের অপালা অনেক গম্ভীর, অন্তর্মুখী। ছবির অপালা তার ঠিক বিপরীত। এই ছবিটি দেখলে সবাই বলতে বাধ্য হবেন, শীলার অভিনয় ছেড়ে দেওয়াটা বাংলাদেশের অভিনয়জগতের জন্য অনেক বড় একটা ক্ষতি।

আগুনের পরশমণির সঙ্গীত পরিচালক প্রয়াত সত্য সাহা। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম পছন্দ ছিলেন খন্দকার নুরুল আলম। সত্য সাহা নিজে হুমায়ূন আহমেদকে ফোন করে সঙ্গীত পরিচালক হবার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি কখনো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাননি। তার ধারণা ছিলো হুমায়ূন আহমেদের ছবিতে কাজ করলে তিনি পুরস্কারটি পাবেন। কারণ এখানে তার স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ থাকবে। তার অনুরোধে রাজি হয়ে যান হুমায়ূন। অসাধারণ আবহ সঙ্গীত করেছিলেন সত্য সাহা। সে বছর সত্যিই তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ছবিতে গান ছিলো পাঁচটি। তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত, একটি হাসন রাজার গান। নিজে দুটি গান লিখেও, একটি শেষ পর্যন্ত আর ব্যবহার করেননি হুমায়ূন আহমেদ। তবে শীর্ষ সঙ্গীতটি রেখেছিলেন। আমাদের দেশের সূর্যসন্তানদের এত অল্পকথায় এত নিখুঁত বিবরণ খুব কম মানুষই দিতে পেরেছে।লাইনগুলো এরকম:

হাতে তাদের মারণাস্ত্র চোখে অঙ্গীকার,

সূর্যকে তারা করবে বন্দী এমন অহংকার,

দৃপ্ত চরণে যায়,

মৃত্যুর কোলে মাথা রেখে তারা জীবনের গান গায়।

আগুনের পরশমণিতে হুমায়ূন বেশ কিছু মোটিফ ব্যবহার করেছেন। পুরো ছবিতেই প্রতীকের ব্যবহার লক্ষণীয়। সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর একজন করে প্রতিনিধি পেয়েছি আমরা ছবিটিতে। চরিত্রগুলো তাদের ভিন্ন পেশা, শিক্ষা, জ্ঞান, অর্থনৈতিক অবস্থা, বয়সের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। আগুনের পরশমণিতে প্রতিটি Age Group-এর একটি করে ক্যারেক্টার আছে। এখানেই আগুনের পরশমণি ব্যতিক্রম। একজন সুরমার মাঝে আমরা নিজের মায়ের ছায়াই খুঁজে পাই। মতিন সাহেব একদিকে যেমন মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিচ্ছেন, আবার ঘরে জিন্নাহর ছবিও টাঙাচ্ছেন। এক মধ্যবিত্ত পিতার চিরায়ত এই ভীতসন্ত্রস্ত অসহায়ত্বের রূপটিও আমাদের চেনা। আমরা খুঁজে পাই অভিমানী এক তরুণী রাত্রিকে। মুক্তি পাবার তীব্র বাসনা যার মনে, একই সাথে যুদ্ধে যাবার আকুতিও তার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে। আছে অপালা, বিন্তি। যুদ্ধ নিয়ে যারা খুব একটা চিন্তিত নয়। সব শেষে আসে বদি। যে স্পষ্টতই তরুণ সমাজের প্রতীক।

ছবির চরিত্রগুলো, বিশেষ করে নারী চরিত্রগুলো ঘরে বন্দী। তাদের এই বন্দী দশাকে পরিচালক প্রকাশ করেছেন জানালার শিককে জেলের গরাদের মতো করে দেখিয়ে। দুই নারী চরিত্র সুরমা আর অপালার প্রথম দৃশ্যটিই এমন। পরবর্তীতে রাত্রি যখন তার বাবার কাছে ছাদে যাবার অনুমতি চায়, সে তখন জানালার ওপাশ থেকে সত্যিকারের কয়েদীদের মতো করেই লোহার শিক ধরে রেখেছিলো। চরিত্রের সাথে জেলের সিম্বোলজির এমন ব্যবহারের সবচে বিখ্যাত উদাহরণ হলো বিলি ওয়াইল্ডারের “Double Indemnity”। সেখানে চরিত্রের বন্দীত্ব বোঝাতে ভেনেশিয়ান ব্লাইন্ডসের ছায়া জেলের শিকের মতো করে পড়ে।

রাতের দৃশ্যগুলোতে হুমায়ূন চরিত্রগুলোর ছায়া বড় করে দেখাতে চেয়েছিলেন। এগুলো হলো তাদের মনের ভয়ের প্রতীক। তার এই পরিকল্পনা পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করতে পারেননি। হুমায়ূন নিজেই স্বীকার করেছেন, সবাই তার অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়েছে। বেশ কয়েকটি দৃশ্যে দেখা যায়, পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্য করে থুথু নিক্ষেপ করা হচ্ছে। দোকানদার আর ভিক্ষুকের থুথু নিক্ষেপ গোপন হলেও, তুহিনেরটা সরাসরি পাকিস্তানী অফিসারের মুখে গিয়ে পড়ে (ঠিক এমন একটি দৃশ্য হুমায়ূনের বহুব্রীহি নাটকেও ছিলো)। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, দুইজন বাংলাদেশীকে উলঙ্গ অবস্থায় কান ধরে উঠবস করাচ্ছে। আরেকটি দৃশ্য দেখা যায়, একটি মৃত কুকুরের পাশে দুটো মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে। বাঙালী জাতিকে পাকিস্তানীরা শুধু উলঙ্গ করেই ছাড়েনি, কুকুরের মতো গুলি করে মেরেছে। আরও কয়েকটি লক্ষণীয় প্রতীক হলো: লাল-সবুজ রঙের টিয়া পাখির খাঁচায় বন্দী অবস্থার ক্লোজ শট, জিন্নাহর ছবির উপরে মতিন সাহেব (বাংলাদেশীর) রক্তের দাগ লেগে যাওয়া, মুক্তিযোদ্ধা বদির শরীর থেকে ঝরে পড়া রক্ত চেটে খাচ্ছে একটি কুকুর। ছবিতে শান্তি কমিটির প্রধান হিসেবে এক ব্যক্তিকে দেখানো হয়। সেই ব্যক্তির অ্যাপীয়ারেন্সের সাথে বাংলাদেশের চিহ্নিত এক যুদ্ধাপরাধীর মিলটা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত।

আগুনের পরশমণি রেকর্ড ৮টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলো।

সেরা চলচ্চিত্র (যৌথভাবে) – আগুনের পরশমণি ও দেশপ্রেমিক

সেরা অভিনেত্রী – বিপাশা হায়াত (আগুনের পরশমণি)

সেরা সঙ্গীত পরিচালক – সত্য সাহা (আগুনের পরশমণি)

সেরা শিশুশিল্পী – শীলা আহমেদ (আগুনের পরশমণি)

শিশুশিল্পী (বিশেষ) – হোসনে আরা পুতুল (আগুনের পরশমণি)

সেরা কাহিনীকার – হুমায়ূন আহমেদ (আগুনের পরশমণি)

সেরা সংলাপ রচয়িতা – হুমায়ূন আহমেদ (আগুনের পরশমণি)

সেরা শব্দগ্রাহক – মফিজুল হক (আগুনের পরশমণি)

বর্তমান সময়ের বিচারে আগুনের পরশমণির গুরুত্ব আরো বেড়ে গিয়েছে। সবাই এখন যেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোকে আর দশটা ছবির সাথে গুলিয়ে ফেলছেন। মুক্তিযুদ্ধ ছবির মাঝে শুরু হয়ে, ছবির মাঝেই শেষ হয়ে যাওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। মুক্তিযুদ্ধ রূঢ় বাস্তব। ছবিতে যেভাবে আমরা বাংলাদেশীদের মরতে দেখি, ৭১ সালে এমন পাইকারি গণহত্যাই চালিয়েছিলো পাকিস্তানিরা। নির্বিচারে সবাইকে মেরে ফেলেছিলো, অত্যাচার করেছিলো এদেশের মানুষদের। আর তাদের সহায়তা করেছিলো আমাদেরই দেশের কিছু নরকের কীট। আজ আমরা বাংলাদেশিরা তাদের ক্ষমা করে দিচ্ছি, তাদের সঠিক শাস্তির বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছি। কেউ তাদের পক্ষে সাফাই গাচ্ছে, অনেকে তো তাদের অপরাধে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই বলে পাকিস্তানি আর বাংলাদেশিরা নাকি ভাই! চরম হাস্যকর এই কথার সবচেয়ে ভালো জবাবটি দিয়েছেন তারেক মাসুদ, তার মাটির ময়না চলচ্চিত্রের শেষাংশে। আগুনে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাওয়া গ্রাম জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়কে দেখিয়ে রোকেয়া প্রাচী বলে, “তাকায় দেখো, তোমার ভাইরা ঘর-বাড়ি কেমনে জ্বালায় দিয়ে গেসে!”

সেন্সর বোর্ড প্রথমে ছবিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে বাদ দিতে বললেও, হুমায়ূন আহমেদ রাজি হননি। পরবর্তীতে ভাষণসহই সেন্সর সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।আগুনের পরশমণির নির্মাণ শেষ হবার পর হুমায়ূন আবিষ্কার করলেন ছবির কিছু কিছু অংশ কাঁপছে। এই দৃশ্যগুলো তিনি রিশ্যুট করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অর্থাভাবে করতে পারেননি। ছবির প্রেস শো-তে তিনি বলেন, ত্রুটিপূর্ণ এই দৃশ্যগুলি দেখলেই তার চোখে পানি চলে আসে।

শিক্ষক, লেখক, নাট্যকার, গীতিকার, পরিচালক যে পরিচয় বেছে নিয়েছেন, প্রতিবারই স্বীয় ক্ষেত্রে সোনা ফলিয়েছেন। মন হয় হয়, তার বুঝি গোপন কোনো স্পর্শমণি ছিলো। যার স্পর্শে নকলের ভীড়ে ঠিক বেরিয়ে পড়তো নিখাদ স্বর্ণ। এ মণির সন্ধান আর কেউ জানে না। এটা ছিলো তার নিজস্ব পরশমণি- হুমায়ূনের পরশমণি।



আগুনের পরশমনি

মুক্তির সাল: ১৯৯৪

কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনা : হুমায়ূন আহমেদ

প্রযোজনা ও পরিবেশনা : নুহাশ চলচ্চিত্র

গীতিকার: হাছন রাজা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সঙ্গীত: সত্য সাহা

চিত্রগ্রহণ: আখতার হোসেন

সম্পাদনা: আতিকুর রহমান মল্লিক

শব্দগ্রাহক: মফিজুল হক

অভিনয়ে: আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হয়াত, আবুল হায়াত, মোজাম্মেল হোসেন, ডলি জহুর, শিলা আহমেদ প্রমুখ

তথ্যসূত্র:

১. ছবি বানানোর গল্প : হুমায়ূন আহমেদ

২. আগুনের পরশমণি (উপন্যাস) : হুমায়ূন আহমেদ

৩. আগুনের পরশমণি (চিত্রনাট্য ) : হুমায়ূন আহমেদ

৪. আগুনের পরশমণি – এক চলচ্চিত্রকারের আবির্ভাব : শাকুর মজিদ

৫. হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার: সাজ্জাদ শরিফ ও ব্রাত্য রাইসু



মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.