নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নীরবে নির্জনে যন্ত্র-অরণ্যে

আপাতত রেস্টে আছি! :)

স্নিগ

আমি একদিন মারা যাব, এই সত্যটা নিয়ে আমার খুব বেশি আক্ষেপ নেই। তবে, আমার মৃত্যুর পর আরও অসংখ্য অসাধারণ সব বই লেখা হবে, গান সৃষ্ট হবে, চলচিত্র নির্মিত হবে।কিন্তু আমি সে সব পড়তে, শুনতে কিংবা দেখতে পারবো না।এই সত্যটা আমাকে খুব যন্ত্রণা দেয়।

স্নিগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভালোবাসা আজকাল : ভিন্ন কিছু

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:৫৮

এবারের ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত তিনটি ছবির মাঝে, সবচে বেশি রঙ আর সৌরভের আকর্ষণ ছিল ভালোবাসা আজকালের মাঝে। পি. এ. কাজল পরিচালিত এই রোম্যান্টিক কমেডিটি সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এর নতুনত্ব নিয়ে। দর্শকদের এ আগ্রহ বিফলে যায়নি। ভালোবাসা আজকাল পুরোটা সময় জুড়ে দ্যুতি ছড়িয়েছে।

ভালোবাসা আজকালের গল্প আসলে রানা আর ডানার (শাকিব খান আর মাহিয়া মাহী) ভালোবাসার গল্প। শাকিব খানের মামা কাবিলা একজন কন আর্টিস্ট। বিভিন্নভাবে লোক ঠকিয়ে তার দিন যায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও শাকিবকে মামার এসব কুকর্মের সঙ্গী হতে হয়। এই মামা-ভাগ্নে মিলে সুমি নামের এক ধনী মেয়ের সম্পত্তি হাতাবার করে। মেয়েটির সম্পর্কে অন্য সব তথ্য জানলেও, দুজনের কেউই সুমির চেহারা চেনে না। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মাহী। সুমি সেজে শাকিবের বাড়িতে এসে ওঠে। মাহী প্রায়ই স্বপ্নে বান্দরবনের এক জমিদার বাড়ি দেখতো। সে ইংল্যান্ড থেকে লুকিয়ে বাংলাদেশে এসেছে এই জমিদার বাড়িটা খুঁজতে। মাহীকে খুঁজতে তার বাবা আলীরাজও দেশে আসে। পত্রিকায় মাহীর সন্ধান চেয়ে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। মামা-ভাগ্নে মাহির আসল পরিচয় জেনে যায়। তারা ঠিক করে কিছুদিনের জন্য মাহীকে লুকিয়ে রাখবে, যাতে পুরস্কারের অঙ্কটা আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় মায়ের মৃত্যু হলে, শাকিব সিদ্ধান্ত নেয় মাহীকে তার স্বপ্নের কাছে পৌঁছে দিতে। তাদের পিছু নেয় আলীরাজের দল। শুরু হয় মাহী আর শাকিবের স্বপ্নের পথে যাত্রা।

ভালোবাসা আজকাল পরিচালনা করেছেন পি এ কাজল। চিত্রনাট্যও তারই করা। “জাজ” এর গল্পে সংলাপ লিখেছেন আব্দুল্লাহ জহির বাবু। ক্যামেরায় ছিলেন শফিকুল ইসলাম শাহীন। পরিচালক হিসেবে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন পি এ কাজল। পুরো মুভিতে কোথাও অগোছালো বা তাড়াহুড়াভাব ছিল না। ছবিটা যে সময় নিয়ে যত্ন করে নির্মাণে তার স্পষ্ট ছাপ ছিল। ঝকঝকে প্রিন্ট সবাইকেই মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল। প্রতিটি দৃশ্যই, বিশেষ করে বান্দরবনের অংশটুকু চোখের জন্য বড্ড আরামদায়ক ছিল। পাহাড়ী এলাকায় ওয়াইড অ্যাঙ্গেল আর গানের দৃশ্যে ক্রেনের ব্যবহার প্রশংসনীয়। অ্যাকশন দৃশ্য ও চেজ সিকোয়েন্সের এক্সিকিওশন ভালো ছিল। তবে, বেশ কিছু ক্লোজ শট ও মিড ক্লোজ শট অনাবশ্যক লেগেছে। এই শটগুলোর জন্য অনেক সময় ক্যারেক্টারগুলো সামান্য নড়লেই, ফ্রেমে কাটা পড়ে যাচ্ছিল। প্রেক্ষাগৃহে এটা খুব চোখে লাগে।

ছবির কি ছু অংশে যদিও উত্তম-সুচিত্রার ক্ল্যাসিক “চাওয়া-পাওয়া” এর ছায়া পাওয়া গিয়েছে (চাওয়া-পাওয়া আবার অ্যামেরিকান মাস্টারপীস “It Happened One Night” থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিল)। তবে, সেই ছায়া কখনো গাঢ় হয়নি। গল্প নিয়ে কাজ করার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। গল্পটা যথেষ্ট মজবুত ছিল না, উপকরণেরও ঘাটতি ছিল। পরিচালক অবশ্য সেটা রানিং গ্যাগ দিয়ে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ভালোবাসা আজকাল যেহেতু রোম্যান্টিক কমেডি, মজাদার দৃশ্যের প্রাধান্য থাকা স্বাভাবিক, আর সে প্রাধান্য ছিলও বটে। অনেকদিন পর দর্শকরা ছবি দেখতে এসে এমন প্রাণ খুলে হেসেছে। তবে, কমেডি দৃশ্যগুলোর মাঝে বিরতির প্রয়োজন ছিল। নইলে দর্শক পূর্ণাঙ্গ স্বাদটা উপভোগ করতে পারে না। আরেকটি ব্যাপার, জামিল ও কাবিলার অংশটুকু ছিল সাবপ্লট। শুরুর ২০ মিনিট সময়ই সাবপ্লটে দিয়ে, মূল গল্পে প্রবেশ করতে কালক্ষেপণ করাটা বিরক্তি উৎপাদন করেছে। কাবিলার দর্শক গ্রহণযোগ্যতাকেও অপব্যবহার করা হয়েছে। ছবির প্রায় ৬০ শতাংশ সময় জুড়ে কাবিলা ছিলেন। ছবির এক পর্যায়ে শাকিব খান কাবিলাকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখলে, পুরো হলজুড়ে তালির আওয়াজ পাওয়া যায়। এ করতালি যতটা না দুষ্টের দমন দেখে, তার চেয়ে বেশি কাবিলার হাত থেকে সাময়িক মুক্তির আনন্দে। দর্শকরা টিকিট কেটে ছবি দেখতে আসেন নায়ক আর নায়িকাদের দেখার জন্য। তাই চিত্রনাট্যে পার্শ্ব চরিত্রের স্ক্রীন প্রেজেন্সও তদনুযায়ী রাখতে হবে। ছবির এক পর্যায়ে দেখা যায়, কাবিলা সকালে নাস্তা করার জন্য কলা খুঁজতে যায়। কারণ ঐ পাহাড়ী এলাকায় একটা ডিমভাজি পাওয়াও দুষ্কর। তার ঠিক আগের রাতের দৃশ্যে, শাকিব খান মাহিকে হোটেল থেকে কিনে আনা বিরিয়ানি খাওয়াতে যায়। এই বিরিয়ানি শাকিব কোথা থেকে পেলেন, বোঝা গেল না।

ছবির সংলাপগুলো সুন্দর ও সাবলীল ছিল। কমেডি মুভিতে পাঞ্চ লাইন শক্তিশালী না হলে, পুরো দৃশ্যটা অর্থহীন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আবদুল্লাহ জহির বাবুকে ফুল মার্ক্স দেওয়া চলে। ছবির আরেকটি প্লাস-পয়েন্ট হল এর কস্টিউম। ছবির শুরুতে দরিদ্র শাকিবের অতি আধুনিক পোশাকটা বাদ দিলে, বাকি ছবিতে সবার কস্টিউম পার্ফেক্ট ছিল। মাহির প্রতিটি ড্রেসই রুচিশীল, ক্ষেত্রবিশেষে নায়িকাসুলভ আবেদনময়ী ছিল। শুধুমাত্র দর্শকদের আনন্দ দেবার জন্য অপ্রয়োজনীয় খোলামেলা পোশাক দেখতে হয়নি।

ছবিতে শাকিব খান খুব ভালো অভিনয় করেছেন। “পাল্টে যাচ্ছেন শাকিব খান” অনেক দিন ধরে চলে আসা এই বাক্যটার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হল ভালোবাসা আজকাল। অতি অভিনয়, গলার চড়া স্বর, ড্যাম কেয়ার স্টাইল, অ্যাকশন হিরোসুলভ আমিত্বকে বর্জন করে নিজেকে ভিন্নভাবে প্রেজেন্ট করেছেন শাকিব। নতুন হেয়ার স্টাইল, ঝড়িয়ে ফেলা ওজন আর মার্জিত কণ্ঠস্বরে শাকিবকে একজন যথাযথ রোম্যান্টিক হিরো মনে হয়েছে। চতুর্থ ছবিতে এসেও মাহিয়া মাহীর এতটা অপরিপক্ব অভিনয় হতাশাব্যঞ্জক। আহ্লাদী মেয়ের অভিনয় করতে গিয়ে, ইমম্যাচিওরড মেয়ের অভিনয় করেছেন। তার ন্যাকামি বেশ কয়েকটি রোম্যান্টিক দৃশ্যের আবেশ নষ্ট করেছে। স্বপ্নের জমিদার বাড়ির বর্ণনা দেবার সময় মাহির অভিনয় দেখে মনে হয়েছে, নতুন কুঁড়ির কোনো শিশুশিল্পীকে দেখছি। মাহী, অনেকদিন তো নায়িকা থাকলেন, এবার না হয় অভিনেত্রী হবার চেষ্টা করুন। আলীরাজকে অনেকদিন পর ভালো অভিনয় করতে দেখলাম। মাঝের কয়েক ছবিতে তিনি শুধু সংলাপ আওড়ে যেতেন। কাবিলা তো আগে থেকেও ভালো অভিনয় করেন, তার সাথে জামিলের কমিক টাইমিংটা ভালো ছিল। তবে জামিল হোসেনের মুখে অভিব্যক্তির কমতি ছিল। মীরাক্কেলের পাঁচ মিনিটের পার্ফরম্যান্সগুলোতে তিনি এর চেয়ে বেশি এক্সপ্রেসিভ ছিলেন। আশা করছি, তার কাছ থেকে মজাদার কিছু কাজ পাব। বাংলা ছবিতে ভালো কমিক রিলিফের খুব অভাব। ছবির আরেকটি বিশেষ দিক হল মিশা সওদাগরের ভিন্ন ধরণের চরিত্র। চিরাচরিত অ্যাংলিসাইজড বাংলা উচ্চারণের খল চরিত্রের বদলে, নিষ্ঠুর কিন্তু সৎ পুলিশ অফিসারের চরিত্রে মিশাকে দারুণ মানিয়েছে। তার এমন কাজ আরও করা উচিৎ।

ছবিতে গান ছিল পাঁচটি। গানগুলো সুর দিয়েছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, ফুয়াদ আল মুক্তাদির, শফিক তুহিন। মামা-ভাইগ্না গানটার একটা শব্দও অতিরিক্ত সাউন্ড ইফেক্টের কারণে বোঝা যায়নি। গান নামক কানের প্রতি এই নিদারুণ যন্ত্রণাটাকে বাদ দিলে বাকি চারটি গান খুব শ্রুতিমধুর ছিল। ইমন সাহার আবহ সঙ্গীতও ভালো হয়েছে। গানগুলোর চিত্রায়নে ভিন্নতা ছিল। দেশের বিভিন্ন লোকেশনকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শীর্ষ সঙ্গীত ও স্বপ্ন দেখি গানের চিত্রায়ন বেশি ভালো হয়েছে। এছাড়া “একটি মুখ” গানটির নির্মাণে ক্রোমা টেকনোলজির ব্যবহার অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। দেশের অন্য মাধ্যমগুলোতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন না হলেও, চলচ্চিত্রে ক্রোমার ব্যবহার হাতে গোণা। পি এ কাজলের “গরীবের ভাই” ছবিতেই প্রথম মানসম্মত কিছু ক্রোমার কাজ দেখা গিয়েছিল। জাজ মাল্টিমিডিয়ার “ভালোবাসার রঙ” ছবির একটি গানে ক্রোমার কাজ অবশ্য সবার নিন্দা কুড়িয়েছিল। তবে এবার নিন্দা করবার জো নেই। ক্রোমার কাজ ও কালার কারেকশন দুটোই ভাল ছিল।

সব মিলিয়ে ঈদের ছবি বলতে যে ধরণের পারিবারিক বিনোদনকে বোঝানো হয়, ভালোবাসা আজকাল ঠিক তাই। প্রথম সপ্তাহের বক্স অফিস কালেকশন আর প্রেক্ষাগৃহে বিপুলসংখ্যাক মধ্যবিত্ত নারী দর্শকের উপস্থিতি সে কথারই প্রমাণ দিলো। ছবির শেষদিকে এসে আলীরাজ মাহিকে উদ্দেশ্য করে বলে, ভালোবাসা আজকাল হল কচুপাতার পানির মত। দেখতে সুন্দর, কিন্তু স্থায়িত্ব খুব কম। পি এ কাজলের “ভালোবাসা আজকাল” দেখতে মনোরম হলেও, এর জীবনকাল কিন্তু ক্ষণস্থায়ী নয়। ভালোবাসা আজকাল থাকতে এসেছে। এসেছে চলচ্চিত্র ইতিহাসে নিজের একটা আলাদা জায়গা করে নিতে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.