নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তৌফিক জোয়ার্দার

তৌফিক জোয়ার্দার

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট শেষ করে দেশে ফিরেছি ২০১৫ সালের শেষ দিকে। যারা ফলো করতো, তাদের কাছে বারবারই বলেছি দেশে ফিরবো। সামুতে লিখেওছিলাম এ নিয়ে। অনেকেই সাধুবাদ দিয়েছিলেন, আবার অনেকে প্রকাশ করেছিলেন সন্দেহ ও অনাস্থা। এ ক’টা বছর কেটে গেল ফিরে আসার ধাক্কাটা সামলাতে। অনেক দিন পর আবার এলাম সামুতে। আবারো লেখালেখির দুর্মর আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে। আবার ঘন ঘন দেখা হবে বন্ধুরা।

তৌফিক জোয়ার্দার › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন পিয়াস করিমের মৃত্যু ও আমাদের মূল্যবোধ কম্প্রোমাইজ করা কদর্যতার স্ফূরণ

১৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১:৪১


সোশাল মিডিয়ার সাথে আমার সম্পৃক্ততা সেই হাইফাইভের যুগ থেকে; যখন দিনাজপুরের দুর্লভ কোন সাইবার ক্যাফেতে বসে একেকটা পেইজ লোড হবার জন্য আধ ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত। গোটা মেডিকেলে হাতে গোনা দু'জন কি তিন জন তখন ইন্টারনেট ব্যবহার করত; আর এই সংখ্যালঘুদের সাইবার ক্যাফে গমন তখন সংখ্যাগরীষ্ঠ ছাত্র ছাত্রীদের একে অপরকে চোখ টিপ দিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ মুচকি হাসির উপলক্ষ্য ছিল। পর্ন সাইট ভিজিট করা ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারের আর কোন হেতু থাকতে পারে সেটা তখনো বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রীর জ্ঞানের অনভিগম্য।

ফেসবুকের ব্যাপারে সিরিয়াস হয়েছিলাম ঢাকায় আসার পর- ২০০৭ সালের দিকে। সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্টতার সুবাদে শনৈ শনৈ বেড়ে চলছিল বন্ধুর সংখ্যা। চেনা, অর্ধ চেনা, এমনকি অচেনা মানুষদেরকে বাছ বিচার ছাড়াই এ্যাড করতাম প্রথম প্রথম। এর পেছনে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং কাজ করেছিল নিজের ভেতর: সোশাল মিডিয়ার অপরিসীম শক্তিকে সাম্প্রতিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাগুলোর বহু আগে থেকেই আমি আঁচ করতে পেরেছিলাম। আমার মনে হত, একটি খবরের কাগজে লেখা ছাপা হলেও আমার পরিচিত বড়জোর কয়েকশ মানুষ হয়ত সেটা পড়বে। পক্ষান্তরে নিজের আইডিয়াগুলো স্রেফ স্ট্যাটাস আপডেট আকারে ফেসবুকে ছেড়ে দিলে বন্ধু তালিকার কয়েক হাজার মানুষের টাইমলাইন সেটা ক্রস করে যাবে।

তখন আমি পাবলিক হেলথে পড়া মাত্র শুরু করেছি, তাই আমার পেশাগত ক্ষেত্রেই মূলত: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সম্ভাব্য উপযোগীতা আমাকে দারুন ভাবে আলোড়িত করেছিল, উৎসাহিত করেছিল চেনা অচেনা নানা মানুষজনকে নিজের নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে। এটি ছিল একটি ডেলিবারেট স্ট্র্যাটেজি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বলতে গেলে কাউকেই কখনো জ্ঞানত: আনফ্রেন্ড করিনি (দক্ষিণ ভারতীয় নায়ীকাদের প্রোপিক ওয়ালা কিছু ফেইক আইডি ব্যতীত); কারণ এটি আমার ফেসবুক সংক্রান্ত মৌলিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং এবং স্ট্র্যাটেজির পরিপন্থী। আনটিল রিসেন্টলি।

ড: পিয়াস করিম ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুবাদে আমার কলিগ না হলে তার সাথে গুটি কয়েকবার লিফটে দেখা হয়ে যাওয়া ছাড়া তার নাম মনে রাখার কোন কারণ ছিলনা। ক'দিন আগে যখন ভদ্রলোক মারা গেলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল মেইলে রেজিস্ট্রারের ইমেইল থেকে তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রথম জানতে পারি, এবং লিফটে দেখা হওয়ার তাৎপর্যহীন কিছু স্মৃতিকে খুব সহজেই পাশ কাটিয়ে আবার নিজের কাজে মন দেই। তার জানাজা কোথায় কখন হবে সেটি দেখার মত ধৈর্য্য বা প্রয়োজনও বোধ করিনি- কারণ একমাত্র একসময়ের ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে এবং বাবা মা'র মন্ত্রণায় জনাব হুমায়ূন আহমেদের জানাজা ছাড়া আর কোন অনাত্মীয়ের জানাজায় আমার যাওয়া পড়েনি (কয়েকজন অকাল প্রয়াত বন্ধু বান্ধবী আর তাদের বাবা মা ব্যতীত)। কিন্তু বাসায় ফিরে ফেসবুক খুলে যা দেখলাম তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। একজন সদ্য প্রয়াত মানুষের নাম বিকৃত করে, তার সম্পর্কে অশ্লীলতম কথামালার উদগ্র মহড়া চালাচ্ছে আমারি বন্ধু তালিকার কিছু মানুষ। এদের মধ্যে এমন ক'জনও আছেন যাঁদেরকে বিতার্কিক হিসেবে শ্রদ্ধা করেছি, মুক্ত চিন্তা আর ভব্যতার দীক্ষাগুরু হিসেবে যাদের কয়েকজনকে মাথায় তুলে রেখেছি আকৈশোর।

আমি জানিনা পিয়াস করিম কোন টক শো তে কি বলেছিলেন। ঘটনাচক্রে পিয়াস করিমের সাথে সংশ্লিষ্ট চারজন মানুষের সাথে তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী ৪৮ ঘন্টায় কথা হয়- যাঁরা কিনা গণজাগরণ মঞ্চের একনীষ্ঠ কর্মী এবং সমর্থক। একজন সুদূর কানাডা থেকে ফোন করে তার নিদারুন বিরাগের কথা জানাল, একজন পিয়াস করিমের ছাত্র, একজন আমার শিক্ষিকা ও বর্তমানে সহকর্মী (ইনি জীবনের দীর্ঘদিন বাম রাজনীতির সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন), আরেকজন স্বনামধন্য একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্বের কন্যা। আবারো বলছি- এঁরা প্রত্যেকেই মঞ্চের সূচনালগ্ন থেকেই এর প্রতি আন্তরিক, আবার ড. করিমকেও খুব কাছ থেকে দেখেছেন (মিডিয়া ব্যক্তিত্বের কন্যা ব্যতীত)। এরা প্রত্যেকেই সার্টিফাই করলেন ড. করিম কখনোই একাত্তরের ঘাতকদেরকে সমর্থন করেননি, কখনোই স্বাধীনতার বিপক্ষেও অবস্থান নেননি। তবে এরা প্রত্যেকেই এটাও বলেছেন- ড. করিমের রাজনৈতিক যে এ্যালাইনমেন্ট শেষের দিকে গড়ে উঠছিল সেটিকেও তারা সমর্থন করেন না। তথাপি একজন মৃত মানুষের প্রতি অশীষ্ট আচরণের যে কদর্য বহি:প্রকাশ তারা দেখছেন সেটিকে তারা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।

আমি রাজনীতি বুঝি কম,আমি টেকনোক্র্যাট হিসেবেই নিজেকে তৈরি করছি। কিন্তু একজন বাঙ্গালি ঘরের ছেলে হিসেবে এইটুকু বুঝি আমাদের একটি মূল্যবোধ আছে। আমরা যারা দেশকে ভালবাসি, দেশের মানুষকে ভালবাসি- তারা এই মূল্যবোধগুলোকেও অন্তরে এবং অভ্যাসে ধারণ করি। এই মূল্যবোধ কখনোই একজন সদ্য প্রয়াত মানুষের প্রতি কদর্য ভাষা প্রয়োগ এবং উল্লাস প্রকাশকে সমর্থন করেনা। অথচ এই বাঙ্গালি মূল্যবোধের পরিপন্থী আচরণগুলোর পরাকাষ্ঠা তারাই বেশি দেখাল (অন্তত আমার টাইমলাইনে) যারা কিনা দেশপ্রেমের প্রদর্শনীতে সবাইকে কেবল পেছনেই ফেলেননি, পদতলে পীষ্টও করে এসেছেন। তাই আমার দীর্ঘদিনের প্রেসিডান্ট ব্রেক করে নিজের ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে কিছু কুলাঙ্গারকে বিতাড়িত করলাম।

পুনশ্চ ১: পিয়াস করিমের রাজনৈতিক এ্যালাইনমেন্ট নিয়ে সমালোচনা হতেই পারে, কিন্তু সেটি স্বাভাবিক ভব্যতার সীমা অতিক্রম করে নয় অবশ্যই। তাঁকে শহীদ মিনারে নেওয়ার আইডিয়া কার মাথা থেকে এসেছে জানিনা, তবে পত্রিকা মারফত জেনেছি উনার স্ত্রীই দরখাস্ত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে অনুমতিটুকু না দিলেই চলত, এবং সেখানেই বিতর্কে ইতি টানা উচিত ছিল মনে করি। অনেকেই চমৎকার যুক্তি দিয়ে বলেছেন কেন ড. করিমের (এমনকি অন্য কারও) শেষ শ্রদ্ধা শহীদ মীনারে হওয়াটা উচিত নয়। কেউ কেউ যথেষ্ট পরিশীলিত ও মার্জিত ভাষায় ড. করিমের রাজনৈতিক অবস্থানের ব্যাপারে অসমর্থন জানিয়েছেন এবং এও বলেছেন- যেহেতু ভদ্রলোক সবেমাত্র মারা গিয়েছেন সেহেতু তাকে অসমর্থনের হেতু গুলো এই মুহূর্তে সামনে আনাটাও সভ্যতার অপলাপ হবে। বলাই বাহুল্য এই মানুষগুলো আমার বন্ধু তালিকায় সসম্মানে বহাল আছেন।

পুনশ্চ ২: এই বিষয়টি নিয়ে অনেককেই রাজনৈতিক জেনারালাইজেশন করতে দেখেছি যে- মৃত পিয়াস করিমের অসম্মানকারীরা সবাই আওয়ামী লীগার; অথবা আওয়ামী লীগার মাত্রই এ কাজটি করেছেন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় নিশ্চিত জানি, এই জেনারালাইজেশনটি সঠিক নয়। এসব ঘটনাপ্রবাহে আমার একটি স্মৃতি মনে পড়ছিল। বঙ্গবন্ধুর খুনীদেরকে যখন ফাঁসি দেয়া হল, তখন টিভির পর্দায় দেখেছি সেই লাশবহণকারী এ্যাম্বুলেন্সের ওপর মানুষ জুতা ছুঁড়ে মারছে। পরদিন পত্রিকায় পড়লাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাঁর পিতা এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের শীকার, এবং যিনি স্বয়ং এই বিচারের মাস্টারমাইন্ড- তিনি নাকি সেই সময়টি কায়মনে প্রার্থনা করে নিভৃতে কাটিয়েছেন। ফুলস্টপ।

পুনশ্চ ৩: হ্যাঁ, একজন যুদ্ধাপরাধীর অপরাধ প্রমান সাপেক্ষে ফাঁসি হলেও আমি পাশবিক উল্লাসে মাতবো না। আমি বরং রিফ্লেক্ট করবো সেই সব স্বজাতী বাঙ্গালিদের জীবনের ওপর, যারা এই নৃশংস অপরাধীর নির্মমতায় প্রাণ হারিয়েছেন। শুকরিয়া করব একজন অপরাধীর শাস্তি হল বলে। একজন মৃত মানুষকে ঘৃণা জানিয়ে কিছুই হয়না- সেই ঘৃণা তার কাছে পৌঁছায়না, সেই ঘৃণা নিজের বেকুবি আর কদর্যতাকেই ডিনোট করে।

"Hate is a dead thing; who of you would be a tomb"- Kahlil Gibran.

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ২:৪৯

আমিনুর রহমান বলেছেন:




চমৎকার বলেছেন। বক্তব্যে সহমত।

১৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৯:০৩

তৌফিক জোয়ার্দার বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৪:৪০

দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: সত্যিই ----একজন মৃত মানুষকে ঘৃণা জানিয়ে কিছুই হয়না- সেই ঘৃণা তার কাছে পৌঁছায়না, সেই ঘৃণা নিজের বেকুবি আর কদর্যতাকেই ডিনোট করে।





আপনার লেখায় সহমত রইলো। ভাল থাকবেন নিরন্তর।

১৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৯:০৩

তৌফিক জোয়ার্দার বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.