নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যতই আসুক, দুঃখ আঘাত,অন্ধ দু\'চোখ যতই বাধার সামনে দাড়াকবন্ধু তোমার স্বপ্ন দেখার, মনটা ধরে রেখো।

টি এম মাজাহর

Bangladesh

টি এম মাজাহর › বিস্তারিত পোস্টঃ

মোবাইল ভেঙে শিক্ষা প্রদান!!!!

২১ শে মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৯

সেদিন একটি বিদ্যালয়ের একজন বয়স্ক ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের সাথে কথা হচ্ছিলো। কথা প্রসঙ্গে বেশ আফসোসের সঙ্গে জানালেন শ্রেনীকক্ষে বেত দিয়ে পেটানো নিষিদ্ধ করায় কি বড় বিপদেই (!) না আছেন তারা! বেত ছাড়া কি পোলাপানদের শিক্ষা দেয়া যায়?
আমার নিজেরও মনে পড়ে গেলো নিজের ছাত্র বেলার কথা। বেত দিয়ে পেটানোর জন্য বিখ্যাত ছিলো স্কুলের আরবী শিক্ষক মাহবুব স্যার। আরবী শব্দের অনুবাদ ক্লাস। প্রথম জনকে জিজ্ঞাসা করা হলো একটি শব্দ, সে পারলোনা, সাথে সাথে বেতের বাড়ি। দ্বিতীয় জনকে জিজ্ঞাসা করা হলো একটি শব্দ, সে অর্থটা বলে দিলো, খুশি হওয়ার বদলে স্যার একটু মন খারাপ করলেন, সাথে সাথে দ্বিতীয় শব্দ জিজ্ঞাসা করলেন। ছেলেটি এবার পারলো না, ওর বেলায় শাস্তি হলো দ্বিগুন, একটা পেরেছিলো যে! এমনি করে ক্লাসের একজন কে পাওয়া গেলো, যে চার পাচটি শব্দতেও আটকালো না, স্যারের মুখে এখান স্পষ্টতই ক্ষুব্ধ ভাব। এক এক করে ধরে আট দশটা শব্দের পর যখন একটি শব্দে সে আটকে গেলো, শুরু হলো মার! পুরো ক্লাসের সবচে বড় অপরাধী সে! মনে আছে, ছেলেটা সেই সপ্তাহে অসুস্থ হয়ে স্কুলেই আসতে পারলো না।
বাংলাদেশে অভিভাবক মহলেও মোটামুটি প্রচলিত আছে, যেই মাস্টার সবচেয়ে বেশী বেতাতে পারবে, সেই সবচেয়ে ভালো শিক্ষক। সেই ফাকে অসংখ্য অযোগ্য শিক্ষক হয়ে যান অভিভাবকের চোখে হিরো!
অন্যকে বেত দিয়ে পেটানো একটা বড় ধরণের মানসিক রোগ। শিশুদের বেত দিয়ে পেটানো শুধু মানসিক রোগই নয়, বরং ফৌজদারী অপরাধও বটে। কিন্তু, কোন এক রহস্যজনক কারণে সেই মানসিক রোগিদের আমরা কেউ কেউ অযথাই মর্যাদার আসনে বসিয়ে দেই। এদেশে শিক্ষার আধুনিকায়ন করার সময় এই বিশাল ত্রুটিটি নীতি নির্ধারকদের চোখে পড়ে, এবং শিশুদের শাস্তি ও অত্যাচার করবার মতো জঘন্য এই অপরাধটিকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়।
এখন সমস্যা হলো তাদের, যারা নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে বেতিয়ে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ে তুলে ফেলেছে। নিজেদের শিক্ষা আপডেট করতে পারুক বা না পারুক, বেতানোটা তো তারা রপ্ত করে ফেলেছিলো! তাই হাত নিশপিশ করে কিছু করবার জন্যে, যার কিছু কিছু মাঝে মাঝেই মিডিয়ায় আসে। আর একটা নমুনা দেখা গেলো , যখন একটি স্কুলে এসেম্বলির সামনে মোবাইল ভাঙার ছবিতে কিছু লোকদের সমর্থন চোখে পড়লো। একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের জিনিস জোর করে বা কৌশলে নিয়ে যাওয়া (চুরি করা) এবং শিক্ষার্থীর জিনিস ভেঙে ফেলা যে একটা কু-রুচিকর কাজ, সেটা বোঝার মতো বোধ অনেক শিক্ষকেরই নেই। এটা আমাদের জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। যদি ছবিটির সাথে বর্ণনা সত্যি হয়, তাহলে বলতে হবে, এই শিক্ষকদের জাতিকে ও শিশুদের শিক্ষা দেয়ার কোনও যোগ্যতা ও ক্ষমতা আর অবশিষ্ট নাই। শিক্ষকতা পেশার সম্মানে তাদের নিজেদেরই শিক্ষকতা থেকে সরে যাওয়া উচিৎ। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর মতো যোগ্যতা না থাকলেই কেবল বেত দিয়ে পিটানো, মোবাইল ভাঙা আর গালিগালাজ করেই নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে হয়। নব্বইএর দশকে এদেরই একদল শিক্ষক নামের প্রজাতি ছিলো যারা "আউট বই" উদ্ধার করার নামে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ব্যাগ চেক করে প্রকাশ্যে গল্পের বই জব্দ (চুরি) করতেন। এ রকম একজন শিক্ষক হারুন স্যারের কবলে পড়ে আমার যেই বইগুলো জব্দ করা হয়েছিলো সেগুলো হলো- জুলভার্ণের আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ, হাকালবেরী ফিন এবং আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী। তবে নব্বই এর শেষ প্রান্তে এসে এর বিরুদ্ধে সারাদেশে বিপ্লব ঘোষণা করেন আমাদের দেশেরই একজন সম্মানিত শিক্ষক "আবদুল্লাহ আবু সায়িদ"। পড়ার বইয়ের বাইরের বইগুলো পড়তে তিনি শুধু উৎসাহ ই দেন নি, বরং আনুষ্ঠানিকভাবে বই পড়ার জন্য পুরস্কার ঘোষনা করেন। আজকের মোবাইল ভাঙার ঘটনায় খুশি হওয়া লোকগুলো সেদিন নিশ্চয়ই আবদুল্লাহ আবু সায়িদ স্যারকে সামনে পেলে আক্রমণই করে বসতেন!
বলা বাহুল্য, আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হলো কিছু অদ্ভুত অলিখিত নীতি। কোন এক স্থানীয় ইলেকশনে সন্ত্রাসী আর মদখোর একজন লোকের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলা হয়েছিলো, যেহেতু সে নিজেই সন্ত্রাসী, সেহেতু সেই সবচেয়ে ভালো পারবে সন্ত্রাস দূর করতে! সেই রকম ভাবে, দেশের তুলনামূলক মেধাবীরা দেশের বিভিন্ন করণিক চাকুরীতে জীবিকা নির্বাহ করতে ঢুকে যায়। বাকীদের মধ্যে যারা কোন কাজ পায় না, বাধ্য হয়েই ঢুকে পড়ে শিক্ষকতায় (অবশ্যই সবার কথা বলছি না, কিন্তু যে তাদের সংখ্যা যে সিংহভাগ এতে সন্দেহ নাই)। ফলে শিক্ষকতা পেশায় যে সৃষ্টিশীলতা আছে তা অনুভব করবার শক্তি তাদের নেই। বেত দিয়ে পিটানো, ক্লাস বাদ দিয়ে প্রাইভেট পড়ানোর দিকে মনোযোগ, বই চুরি/মোবাইল ভাঙার ব্যাপারেই তাদের মনোযোগ।
এবার মোবাইল ভাঙার সাপোর্টে যারা কথা বলছেন তাদের জন্য কিছু বলিঃ তথ্য প্রযুক্তির সম্প্রসারণের এই যুগে মোবাইল শুধু যোগাযোগের মাধ্যম ই নয়, বরং জ্ঞান বিজ্ঞানের সবচেয়ে সহজলভ্য ডিভাইসও বটে। আপনার শিক্ষকতার মধ্যে যথাযথ পার্সোনালিটি গ্রো আপ করেন, আপনি নিজেকে অনুকরণীয় হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুলে ধরেন, আপনি ওদেরকে যা কিছু ভালো কাজ, করিয়ে নিতে পারবেন। আমার সাড়ে আট বছরেরও বেশী শিক্ষকতা জীবনে ক্লাসরুমে কোন মোবাইল বাজতে দেখিনি। যদিওবা ভুল করে কারও বেজেছিলো, সেটিই ছিলো তার শেষবার। নিজ দায়িত্বেই সে সুইচ অফ করে ফেলতো। কারও মোবাইল ভাঙার প্রয়োজন পড়েও নাই, ইনশাআল্লাহ পড়বেও না। বরং এই যুগে সব শিক্ষকের উচিৎ ছাত্রছাত্রীদের স্মার্ট ফোন ব্যাবহারে উৎসাহিত করা। সারা দেশকে আমরা একটি আইসিটি নির্ভর আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করবার প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছি, এই সময় প্রতিটি ছাত্রছাত্রীদের হাতে একটি স্মার্টফোন নিশ্চিত করা গেলে কত দ্রুত আমরা এগিয়ে যাবো, ভাবা যায় না। একটি ছয় কেজি ওজনের ডেস্কটপ বা দুই কেজি ওজনের দামী ল্যাপটপের বিকল্প হতে পারে একটি হালকা আইফোন। যারা নব্বইয়ের দশক বা এর পরের দশকে কম্পিউটার ব্যবহার শিখেছেন, তারা এটা সহজেই তুলনা করতে পারবেন- তখন "কম্পিউটার শেখা" কতটাই কঠিন ছিলো আর এখন কতটাই সহজ। একটি মাঝারী মানের স্মার্টফোন দিয়ে সাধারণ কাজে ব্যবহার করা হয় এমন বেশীরভাগ কাজই খুব সহজে করা যায় (যেমন, এমএস ওয়ার্ডে কাজ, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট, ভিডিও এডিটিং, অ্যাপস তৈরী, ছোটখাটো প্রোগ্রামিং, এস কিও এল.. ইত্যাদি)। সুতরাং ছাত্রদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিয়ে এই কাজগুলো ধরিয়ে দিতে হবে এবং আগ্রহ তৈরী করে দিতে হবে মাত্র। কিছুই শেখাতে হবে না, বরং ওরা আপনার চেয়ে দ্রুত ও কার্যকরভাবে শিখে নিতে পারবে।
এক্ষেত্রে অনেকেই চেচিয়ে উঠবেন, স্মার্ট মোবাইল হাতে পেলেই ছেলেমেয়েরা "প্রেম" করতে উঠে পড়ে উঠবে, "পর্ণগ্রাফি" তে মেতে উঠবে ইত্যাদি ইত্যাদি , যেমনটা পৃথিবীর সর্বক্ষেত্রেই নতুন প্রযুক্তি দেখলেই বলা হয়েছিলো।
প্রথমেই "প্রেম" ঘটিত কথার উত্তর দিয়ে নেই। শিরিন ফরহাদ, লাইলী মজনুদের যুগে কোন মোবাইল প্রযুক্তি ছিলো? কিন্তু ওদের প্রেম দিয়ে মহাগাথাও তৈরী হয়েছে। আমার উদাহরণটি বলার উৎস হলো, "প্রেম" ঘটিত ঘটনাগুলোর জন্যে শুধু মোবাইলকে দায়ী করা হাস্যকর। যুগে যুগে নিম্মবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও "প্রেম" ইস্যু তৈরী হয়েছিলো এবং ভবিষ্যতেও হবে কোন সন্দেহ নাই। আশির দশকে ঢাকার "প্রেম" ইস্যুগুলোর জন্য ভিসিআর কে দায়ী করা হতো, নব্বইয়ের দশকে বাংলা নাটককে দায়ী করা হতো, আজকাল মোবাইল/ফেসবুক, আর ভবিষ্যতে অন্য কোন কিছুকে দায়ী করা হবে হয়তো। কিন্তু তরুণ তরুণীদের এই "প্রেম" ইস্যু কখনও বন্ধ হবে না। তাই অযথা "প্রেম" ইস্যুতে মোবাইলকে দায়ী না করে বাড়ীর সদস্যদের মোবাইলে ক্রিয়েটিভ কাজ করবার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন, নৈতিকতা শিক্ষা দেন- তাতে তার জীবনে প্রেম আসলেও অনৈতিকতার সাথে জড়িত হবে না এটা নিশ্চিত।
আর পর্ণোগ্রাফি! পৃথিবীর অন্যতম বিশালায়তন ব্যবসা। পৃথিবীতে কবে ছিলো না বলুন? মোবাইল প্রযুক্তির আগে ছিলো সিডির রমরমা ব্যবসা, তার আগে ভিডিও ক্যাসেট, তার আগে ছিলো বিভিন্ন ম্যাগাজিনের ব্যবসা, নব্বইয়ের দশকেও পত্রিকার দোকানে দেখতাম- অপরাধজগৎ নামের ম্যাগাজিন বইটি কেনার জন্য মুরুব্বীদের ভিড়। মোবাইল/ইন্টারনেট এ বসে থাকা কিশোরদের যদি সৃজনশীল কাজে মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তারা সেখানেই মুখ ডুবিয়ে রাখবে- পৃথিবীতে প্রচুর উদাহরণ আছে।
যদি বেত দিয়া না পিটায়ে শিক্ষা দিতে না পারে, শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করবার ক্ষমতা না থাকে এবং নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করবার সামর্থ না থাকে, তাহলে তার শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দেয়াই উচিৎ।
আমি জানি উপরের যুক্তিগুলোর কোনটিই তরুণ তরুণীদের পর্ণোগ্রাফি থেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পরবে না। কিন্তু এটাও সত্যি যে মোবাইল ভেঙে ফেললেও এগুলো নিয়ন্ত্রন সম্ভব না। শুধুমাত্র তরুণ/কিশোরদের নতুন প্রযুক্তির সাথে যথাযথভাবে ব্যাবহার-উপযোগি করে অনুপ্রাণিত করাটাই হবে তাদের বিভিন্ন নেগেটিভ কাজ থেকে নিয়ন্ত্রন করবার একমাত্র পথ। একই কথা প্রযোজ্য কিশোরদের জঙ্গীবাদ বা মাদকাসক্তের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্যেও। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার বিষয়গুলোর সাথে মোবাইল প্রযুক্তির সমম্বয় ঘটানোর মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, যেমনটা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বে।
মনে রাখতে হবে, যে কোন প্রযুক্তির সবচেয়ে দক্ষ ব্যবহার শিখতে পারে কমবয়সী মানুষেরা। পৃথিবীর আগামী দিনগুলো হয়ে উঠবে প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়া জাতির জন্য ভয়ঙ্কর কঠিন। আমরা বিভিন্ন অছিলায় ভবিষ্যত প্রজন্মকে আটকে রাখতে পারি না। বরং প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে এই শিশুদের ভবিষ্যত দক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ আমাদেরই নিতে হবে।
শিক্ষকদের বেত দিয়ে শিক্ষা প্রদান আমরা বন্ধ করতে পেরেছি। এবার শিক্ষক নামধারী লোকদের শিক্ষার্থীদের জিনিস ভাঙা , চুরি করা রোধ করবার সময়। আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি গড়ে তুলতে এখন শিক্ষক গড়ে তোলার ব্যপারে জোর দেয়াটাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.