নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

৩২ পৃষ্ঠায় খড়, ৩৩ পৃষ্ঠায় অাগুন

টোকন ঠাকুর

কবিতা গল্প লিখি, ছবি আঁকি-বানাই, একাএকা গান গাই...

টোকন ঠাকুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

হক-স্মৃতি

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:৪৩

অাজ যেমন করে গাইছে অাকাশ
টেকন ঠাকুর

অনেক সময়ই এমন হয় যে, অামরা হারিয়ে ফেলার পর একধরনের বুঝতে পারি, হারানোর অাগে ঠিক টেরই পাই না। হারানোর পর বুঝতে পারি, অার তো পাব না। খুঁজেও পাব না। শত কামনাতেও পাব না যখন, তখনই বোধোদয় হয়, কাঞ্চন-সোনাঝুরি দিন অামরা হারিয়ে ফেলেছি। সেই দিন ফিরে পাব না। বুঝতে পারি, বিকেলের নদী বয়ে গেছে নিজের মতোই, অামরা দেখিনি। অামার শিক্ষক ছিলেন কবি-গল্পকার অধ্যাপক শহীদুর রহমান। অামার কলেজে পড়া দিনে অামি তাকে পেয়েছিলাম। কত কিছু যে জেনেছি-শিখেছি শহীদ স্যারের কাছে, কোনোদিন কোথাও তা লিখিনি তেমন করে। পরে, ঢাকায় এসে খুব মিশেছিলাম লেখক-চিন্তুক অাহমদ ছফার সঙ্গে। ছফার কাছে শিখেছি বাংলাদেশ। ছফা ভাইকেও খুব অকালে হারিয়েছি অামরা। অাহমদ ছফার প্রয়াণের পর খুব কেঁদেছিলাম। খুব মনখারাপ হয়েছিল অামার। ছফার মৃত্যু অামাকে প্রিয়জন হারিয়ে ফেলবার বেদনা দিয়েছে, এখনো দেয়। অাস্তে অাস্তে হারানোর তালিকা দীর্ঘ হয়। হারাই সম্পর্ক, হারাই সময়। হারাই হারাই জীবন যায় অামাদের। একদিন কাইয়ূম চৌধুরী হঠাৎ চলে গেলেন। কষ্ট পেয়েছি।
শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী অামার শিক্ষক ছিলেন। চারুকলায় পড়েছি বলে দেশের প্রায় সব খ্যাতিমান শিল্পীই অামার শিক্ষক, এ অামার সৌভাগ্য। কাইয়ূম স্যার মারা গেলেন বছর দুই অাগের এক শীতে, ঢাকা সেনানিবাস স্টেডিয়ামে, বেঙ্গল মিউজিক ফেস্টিভালের মঞ্চে। মিউজিক নিয়ে কথা বলতে বলতেই তিনি ঢলে পড়লেন মঞ্চে। কাইয়ূম চৌধুরী চিত্রশিল্পী। শিল্পীর এমন বর্ণাঢ্য প্রস্থান অাগে দেখিনি অামরা। কাইয়ূম স্যারের বন্ধু হক ভাই। সৈয়দ শামসুল হক। বাংলা ভাষার সব্যসাচী লেখক। কয়েকদিন পর হক ভাইয়ের সঙ্গে অামার অাড্ডা। বললেন, 'কা্ইয়ূমের চলে যাবার খবর ফোনে দেওয়া হয়েছে অামাকে, ঢাকা থেকে।'
বললাম, 'ছিলেন কোথায়?'
'ত্রিপুরায়। একটা অনুষ্ঠানে ছিলাম। তোমার ভাবি অার অামি ত্রিপুরাতে গেলাম। কাইয়ূমের চলে যাওয়াটা কষ্ট দিচ্ছিল।'

'অন্য বন্ধুদের সঙ্গে কি ঠিকঠাক যোগাযোগ অাছে অাপনার?' অামার এই প্রশ্নটা ছিল এমনিই, এখানে লিখব এমন কোনো ধারণা ছিল না সেদিন। হক ভাইয়ের সঙ্গে অামার ক্যাজুয়াল অাড্ডার একটা সম্পর্ক কীভাবে যে হয়ে গেল, সেটাও জানিনে। এমন কি কিছুদিন বাসায় যাওয়া না হলেই হয়তো একদিন ফোন করে লেখক-ডাক্তার এবং হকের স্ত্রী, যাকে অামি অানোয়ারা অাপা বলেও ডাকি, ভাবিও বলি, তিনি বলেন, 'বাবু শোনো, তোমার হক ভাইয়ের শরীরটা দুদিন ভালো যাচ্ছে না। তুমি কি একটু অাসবে?'

গিয়ে দেখি, হক ভাই হয়তো তার বাড়ির দোতলা দিয়ে নিচের ড্রইংরুমে অাসছেন, অামি বসে অাছি, হক ভাই এসে বসলেন। হয়তো হালকা কাঁশি দিচ্ছেন। কাঁশিটা বাড়ছে, কমছে। কিন্তু কাঁশি তাকে কাবু করতে পারার কথা্ নয়। অামাদের অাড্ডা শুরু হয়ে যায়। কত না কথা হয়। কথা দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছুটে যায়। কথার সঙ্গে ছুটি অামরাও। একটু থামি। চা পান করি। লুচি অার অালুর দম অাসে। অামরা খেতে খেতে কথা বলি। বাংলাভাষার সব্যসাচী কবির সঙ্গে কথা জমে ওঠে। ধীরে ধীরে কথার মধ্যে কবিতা ঢুকে পড়ে। ছোটগল্প ঢুকে কথার পড়ে। অালাপের অালপথ ভেঙে যায়। সিনেমা ঢুকে অালাপের পড়ে। হাওয়া হই হই করে ঢুকে পড়ে 'মঞ্জুবাড়ি'তে। গুলশানে সৈয়দ হকের বাড়ি, বাড়ির নাম 'মঞ্জুবাড়ি'। হাওয়া ঢুকে পড়ে জানলা দিয়ে। সেই সময় উপমহাদেশ-দেশভাগের ইতিহাস ঢুকে পড়ে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে। ১৯৪৯ সালের ছিমছাম শহর ঢাকা ঢুকে পড়ে হকের কথার মধ্যে। কথার মধ্যে ঢুকে পড়ে সৈয়দ হকের বাল্যবেলা, কুড়িগ্রাম, তেতাল্লিশের মন্বঃন্তর। মানুষের কঙ্কালসার লাশ ঢুকে পড়ে অালাপের মধ্যে। দেশভাগ পরিসর বাড়িয়ে দিয়ে যায় অামাদের অালোচনার। মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য অধ্যায় হয়ে ঢুকে পড়ে কথায়, অালোচনায়, অাড্ডায়। অালাপের মধ্যে অটোমেটিক প্রবেশ করেন সৈয়দ হক যাদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন, সেই মহান বাঙালিগণ_ কবি জসীমউদ্দীন, শিল্পাচার্য্য জয়নুল অাবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান বা হকের বন্ধু চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান, নির্মাতা অালমগীর কবির। তিনি তার প্রয়াত কবি বন্ধু লেখক-সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান, কবি শামসুর রাহমানের কথা বলেন। শামসুর রাহমানের মৃত্যুতে তিনি কাতর হয়ে পড়েন। বন্ধুর মৃত্যু তাকে ব্যথা দিয়ে যায়। কবিবন্ধু অাবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কথা বলেন। অার বলেন, 'ফোনে শহীদ কাদরীর সঙ্গে কথা হয় মাঝেমধ্যে। শহীদ কাদরী তখনো অামেরিকায় থাকতেন এবং কাদরীও প্রয়াত হলেন গত মাসেই। সেই সময়টায় হক ছিলেন লন্ডনে, কর্কট রোগ দূরীকরণ চিকিৎসায়। ঢাকায় অামরা ছিলাম উৎকণ্ঠায়। লক্ষ বাঙালি পাঠক তার। দুঃশ্চিন্তা বেশি পাঠকের। দুঃশ্চিন্তা কম নয় স্বজনের। কবির স্বজন! অাসলে কবির স্বজন কারা? তার পরিবার-পারিপার্শ্বিক মানুষ, নাকি কবিকে বা লেখককে যারা পাঠ করে তাকে চিনে নিয়েছেন, কবির ভেতরে ঢুকে পড়েছেন, তারা? এই প্রশ্ন শুধু প্রশ্ন হয়েই থেকে যায়। এই প্রশ্নের সদুত্তর দেয় না কেউ। সৈয়দ হককেই এই প্রশ্ন করা যেত, অামি করতাম, 'অাচ্ছা হক ভাই, শ্রষ্ঠার স্বজন কারা?

গত মাসে, গত অাগষ্টের শেষে দীর্ঘ প্রবাস জীবনের ইতি ঘটিয়ে শহীদ কাদরী অামেরিকায় প্রয়াত হলেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় কবির শবদেহ ঢাকায় পৌঁছুল, অাগে থেকেই টিকিট-শিডিউল থাকায় সেদিন অামি কোলকাতায় ছিলাম। মনটা ব্যাকুল ছিল শহীদ কাদরীর জন্যে, যে কবিকে অামাদের প্রজন্ম ঢাকায় দ্যাখেনি কখনো। কারণ, তিন দশকেরও অধিক সময় শহীদ কাদরী প্রবাসে থেকেই মারা গেলেন। কাদরী ছিলেন সৈয়দ হকের অারেক বন্ধু, সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশক থেকে, যৌবনের সূচনাকাল থেকেই, পুরোনো ঢাকার বালাবাজারের ঐতিহাসিক 'বিউটি বোর্ডিং'এর দিনগুলো থেকেই। অার কানাডা থেকে মাঝেমধ্যে ফোন করেন কবি-অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হকের অারেক বন্ধু। প্রশ্ন করি, 'অামি কি অাপনার বন্ধু?'
'বন্ধু তো বটেই। নইলে অাড্ডা হয় নাকি?'
হকের বাড়ি 'মঞ্জু বাড়ি'। গুলশান ১ এর ৬ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়িটা। বিশাল জায়গা নিয়ে বাড়ি। এদেশে কোনো কবির এইরকম রাজকীয় বসবাস অার দেখিনি। রাজা তিনি, রবীন্দ্রনাথ তিনি। অাবার তিনিই হচ্ছেন বাউল। হকের দাদার ফকিরি জীবনই কি গোপন জিনের দাবিতে সাহিত্য-সমগ্র প্রকাশে ঠেলে দিয়েছিল সৈয়দ শামসুল হককে? সে প্রশ্ন করা হয়নি অামার। বুঝিনি তো, তিনি এইভাবে হঠাৎ চিরদিনের মতো চলে যাবেন?

তো কলকাতায় রবীন্দ্র সদনে চলছিল ১০ দিন ব্যাপী 'বাংলাদেশ বইমেলা'। মঞ্চ করা হয়েছে বইয়ের স্টলগুলোর পাশে। মঞ্চের সামনে শ' দেড়েক দর্শক। দর্শক বলতে কোলকাতার বইপ্রমী অার স্মৃতিতে বাংলাদেশ বহন করা বাঙালিরা। যারা একদিন বাংলাদেশের নাগরিক ছিল এবং বর্তমানে ভারতীয়। সবই দেশ বিভাগের কুফল। দেশ বিভাগের সময়কার ইতর রাজনীতিবিদদের ইতরামির ফল। সেই ইতরামি জীবন দিয়ে খেসারত দিতে হচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাঙালিকে। রাজনীতিবিদদের নষ্টামি কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটাতে পারে, চোখের সামনে তার একটি বড় দৃষ্টান্ত ১৯৪৭ সাল। ভারতীয় উপমহাদেশ ভেঙে টুকরো করে ফেলল! ভাঙনের সেই ক্ষত পোষায়নি অার। ক্ষত কেবল বেড়েছেই।

তো দূর থেকে দেখলাম, কলকাতা বইমেলার অনুষ্ঠান মঞ্চে বসে অাছেন কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়, রবিউল হুসাইন, তারিক সুজাত এবং অারো দুইজনঅামার অচেনা মানুষ। তারাও হয়তো কবি, পশ্চিমবঙ্গের হতে পারেন। অনুষ্টান অ্যাংকরিঙ করছে অামাদের কবি পিয়াস মজিদ। কিন্তু মঞ্চে ছিলেন অারেকজন কবি, যার সঙ্গে অামার ঢাকায় কখনো সামনাসামনি দেখা হয়নি। যদিও ফেসবুকের মাধ্যমে অামরা বন্ধু, পরষ্পররের লেখা পড়েছি, স্ট্যাটাস পড়ে থাকি। ফটো দেখে থাকি। সুদর্শন তিনি। ফেসবুকে ফটো দেখার অভিজ্ঞতা থেকেই অনেকটা দূর থেকে অামি দেখলাম, বসে অাছেন কবি মাহবুবুল হক শাকিল। তিনিও অামাকে দেখলেন এবং অামাদের মধ্যে দূর থেকেই ইশারা ভাষায় ভাব বিনিময় হলো। এরপর তিনি পিয়াসকে কাছে ডেকে কী যেন বললেন এবং পিয়াস ফের ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে মাইকে অামার নাম ধরে দুইবার ডাকল। অামি রবীন্দ্র সদন চত্বরে দাঁড়িয়ে মাটির ভাড়ে চা গিলে যখন একটা বিড়ি ধরিয়েছি, অাবার পিয়াস মাইকে অামার নাম ডাকল, মঞ্চে উঠলাম। কবি মাহবুবল হক শাকিলের পাশের চেয়ারে বসলাম। দর্শকসারির প্রথম লাইনে তখন অধ্যাপক অানিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, বাংলাদেশের প্রকাশক সাহিদুল ইসলাম বিজু, মাজহার ভাইসহ অনেকেই। অামি একটি ছো্ট্ট কবিতা পড়েছি, ওটাই একমাত্র কবিতা অামার, যেটা মুখস্থ থাকে। কবিতার নাম, 'ভূগোলমাষ্টার'।
'এই অাকাশ অামার পিতা/
মাটি অামার মা/
অামি তাদের সন্তান, ওই দিগন্ত।/
কিন্তু ভূগোলমাষ্টার বলছেন_/
দিগন্ত একটি ধারণামাত্র।'

কিছুক্ষণ অামরা পাশাপাশি বসেছিলাম। জানি, তিনি রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রের লোক। অামার এও জানা অাছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে থাকাকালীন চিকিৎসাধীন কবি সৈয়দ শামসুল হককে দেখতে গেছেন, সময় দিয়েছেন শুশ্রুষার মায়ায়, ভালোবাসায়। তাই, সেই মুহূর্তে কবি মাহবুবুল হক শাকিল, কবিদের নিজস্ব বংশে তিনি অামার ভাই, হক ভাই যেমন ভাই, শক্তি-বিনয় যেমন ভাই, সুনীল-শরৎ যেমন ভাই, রণজিৎ দা, মৃদুল দা যেমন ভাই, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ যেমন ভাই, নেরুদা-বোদলেয়র যেমন ভাই। মালার্মে যেমন ভাই। পাজ যেমন ভাই। লালন যেমন ভাই। সখা সখা ভাই। সেটা একটা অনুভূতির অংশ। সেই অংশ থেকেই মঞ্চে বসা সেই ক্ষণমুহূর্তের সুযোগে অামি জানতে চাইলাম, 'অামি তো লন্ডনে যোগাযোগ করতে পারছি না, হক ভাই কেমন অাছেন?'
প্রধানমন্ত্রীর দফতরের লোক মাহবুবুল হক শাকিল বলেন, 'লন্ডনের ডাক্তার কেমো দিয়েছেন, সব কিছুই এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক চলছে।'
'ঠিকাছে। কোলকাতায় অাপনার সঙ্গে প্রথম দেখা হলো। ঢাকায় গিয়ে একদিন অায়েশ করে অাড্ডা দিতে চাই।' মাহবুবল হক শাকিলের সঙ্গে হক ভাইকে নিয়ে এই ছোট্ট একটি তথ্য অামাকে কেমন নিশ্চিতি দিল, সে মুহূর্তে। কারণ, হক ভাইয়ের সুস্থ্য হয়ে ফেরা দরকার, এটা মনে মনে খুব চাচ্ছিলাম। চাবই তো। কবি তিনি। কবি বংশের অহঙ্কার তিনি।

এর একটু পর, পাশেই, 'জীবননান্দ সভাঘর'এ অারেক অনুষ্টানে অামি কবিতা পড়বার ছিলাম। কবিতা পড়তে হবে। নিজের কবিতা মুখস্থ থাকে না বলে অামার বন্ধু কবি বিভাস রায়চৌধুরী অামার কয়েকটা কবিতা ফেসবুক থেকে দেখে হাতে অনুলীখন করে এনে দিল। ফলে, নিজের কবিতা দেখে পড়বার একটি ব্যবস্থা অামার হলো। সে ছিল অশোকনগর থেকে প্রকাশিত 'অহর্নিশ' ছোটকাগজের কুড়িবছর পূর্তি এবং লেখক বেনজীন খান এর পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে মধ্যমণি কবি শঙ্খ ঘোষ। পাশাপাশি বসে অাছি শঙ্খ ঘোষের। এই প্রথম। এক অন্য ধরনের অনুভূতি। এই সেই কবি, শঙ্খ ঘোষ, অামি যার কত বই পড়েছি। 'ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম' পড়েছি। 'গান্ধর্ব বিবাহগুচ্ছ' 'পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ' 'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে' 'জর্নাল'_কত কী পড়েছি। শঙ্খ ঘোষকে তা বললামও অপার মুগ্ধতায়। তিনি ফোন নম্বর দিলেন। অাড্ডা হবে শঙ্খ ঘোষের বাসায়, কথা হলো। সেই ফাঁকেই অামি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে শেয়ার করতে চাইলাম, 'সৈয়দ শামসুল হক তো লন্ডনে। জানেন, হক ভাইয়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে।'
শঙ্খ ঘোষের মুখটা মলিন হলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ' হ্যা, ফোনে কথা হয়েছে অামাদের।'

হোটেল ছেড়ে কলকাতায় কয়েকদিন ছিলাম কলেজের তরুণ শিক্ষক, লেখক, পাতাউজ্জামানের বাসায়। পাতা হচ্ছে রাজীব অাহমেদ। ওর বাসা সন্তোষপুরে। সারাদিন কলকাতায় হটি হটি করে ঘুরে রাজীবের বাসায় গেলেই একটা শান্তি। নিজের বাড়িতে থাকার অনুভূতি পেলাম পাতার বাসায়। এত বই-পত্রিকা পাতার ঘরের চতুষ্কোণে! শুধু বই অার বই। বাংলা-ইংরেজি বই। ফিকশন, নন-ফিকশন। যদিও রাজীবের হাতে কবিতা দিয়েই সূচনা, এখন ছোটগল্পে মনোযোগী। খুব ভালো পার্সেপশন রাজীবের। ওকে অামার ভালো লেগেছে। রাজীবকে ভাই হিসেবে পেয়েছি। ওই যে, কবি বংশের ভাই। অার একটা গৃহতথ্য জানাই? রাজীবের রান্নাও খুব চমৎকার। রাজীবের বাসায় থাকলে একটা জিনিস হয়ঃ ঘুরে-ফিরে কথাবার্তায় পড়ে অার্ট-কালচার-চিন্তা-ভারত-বাংলাদেশ-পদ্মা-ইলিশ-ফারাক্কা, ডুয়ার্সের জঙ্গল, ইলিয়াস-শহীদুল জহির-ভৈকম মুহম্মদ বশীর-পশ্চিমবঙ্গ-নন্দন-কফি হাউস-কলেজ স্ট্রিট-যাদবপুর ইউনিভার্সিটি-মমতা-বামফ্রণ্ট-সুমনের গান কিম্বা অাড্ডা দিতে দিতে ভোরের পাখির অাজান_সবই চলে অাসে। এলেন সৈয়দ হকও। রাজীবের খুব ইচ্ছে, অামি যেন সৈয়দ হকের একটা বইতে লেখকের অটোগ্রাফ নিয়ে রাখি ওর জন্যে। ইচ্চৈ অপূর্ণ রইল রাজীব, সৈয়দ হক চলে গেলেন, দেখা পাইনি তার। অার পাবও না। একদিন অামি হাসপাতালে গিয়েওছিলাম। হকের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। হকের শরীর সেদিনই চূড়ান্ত ফল করল।

পাতার সঙ্গে ফেসবুকে অালাপ। অালাপের অনুঘটক অামাদের কবি রাহেল রাজীব। রাহেলও সেই কবি বংশের ভাই। জগন্নাথে পড়ায়। রাহেলের সঙ্গে গতকালও, ২৮ সেপ্টেম্বর, রাহেল রাজীবের বাসায় হক ভাইয়ের প্রয়াণের একদিন পর, যখন কুড়িগ্রামে তার দাফন সম্পন্ন করে হেলিকপ্টার ফিরল ঢাকায়, সন্ধ্যায়, এইসব নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথা বলতে বলতেই অানোয়ারা সৈয়দ হককে ফোন দিলাম। ফ্যামিলির সবই তখন খাচ্ছিলেন। ভাবি ফোনেই কেঁদে ফেললেন, 'বাবু শোনো, তোমাদের হক ভাই তো অনেক বড় লেখক। অামি মনে হয় তার ঠিকমতো যত্ন নিতে পারিনি, সেইজন্যে চলে গেল অামাকে রেখে।'
'না, অাপনি তার পাশে ছিলেন, সাথে ছিলেন, সবাই জানে। অামিও জানি।'
মনোবিজ্ঞানের ডাক্তার ও লেখক অধ্যাপক অানোয়ারা সৈযধ হক, অামি যাকে অাপা বলেও ডাকলেও মাতৃত্বের পরিধির মধ্যে দেখি। অানোয়ারা অাপা যশোরের মানুষ, অামিও যশুরে, অামাদের সম্পর্ক কত বন্ধনের। এই মানুষটাকে, অানোয়ারা অাপাকে অামি কি বলে সান্ত্বনা দেব? সেই ক্ষমতা অামি অর্জন করেছি?

সৈয়দ হক প্রসঙ্গে অামি একটু অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কথাও বলব। অামি তো অার দশজনের মতোই জানি, কবীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্বনামী অধ্যাপক। ইংরেজি থেকে প্রচুর বিদেশী লিটারেচার বাংলায় অনুবাদ করেছেন। সরকার তাকে সম্মানসূচক পদ জাতীয় অধ্যাপকও করেছেন। এবং ২০১১ কি ১২ সালে ঢাকা ক্লাবের মধ্যের খোলা মাঠে রবীন্দ্র-সার্ধশত পালনের অংশ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ১৫১ জন লেখক একটি করে অর্থাৎ ১৫১ টি রবীন্দ্র বিষয়ে নতুন গ্রন্থ প্রকাশনার এক মহা অায়োজন ছিল। সেই ১৫১ জন লেখককে নিয়েই অায়োজন। এই মহা পরিকল্পনার পরিকল্পক-সমন্বয়ক কবি-অনুবাদক মনজুরে মওলা। অামাদের প্রিয় মওলা ভাই। কবি বংশের জাতক। তো সেই অনুষ্টানে হক তো থাকবেনই। রবীন্দ্রনাথ বলে কথা। তাছাড়া মওলা ভাই-হক ভাই সমবয়েসি এবং তাদের বন্ধুত্বের বয়সও প্রায় ছয়দশকের বেশিকাল জুড়ে গড়ে উঠছে। 'মূর্ধণ্য' প্রকাশনার অায়োজন সেটি। ঢাকা ক্লাবের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদাত সেলিমও প্রকল্পে জড়িত। দেখলাম, গাড়ি থেকে নামলেন কবীর চৌধুরী। নব্বুয়ের কাছাকাছি তিনি। একা হাঁটতে পারছিলেন না, তাকে ধরতে ছুটে গেলেন ৭৮/৭৯ এর দুই তরুণ। একজন হক ভাই, অন্যজন মওলা ভাই। কবীর চৌধুরীকে একটি টেবিলের পাশের চেয়ারে বসানো হলো। সৈয়দ হক উঠে এলেন, অামি যে টেবিলে বসেছিলাম, সেখানে। অামার কাছেই চলে এলেন। বললেন, 'এসো।'

সৈয়দ হক অামাকে নিয়ে গেলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কাছে। বললেন, 'কবীর ভাই, এই যে টোকন, টোকন ঠাকুর।'
'তাই?' কবীর চৌধুরী বিগলিত শিশুর মতো প্রায় দাঁত না থাকা গাল খুলে হাসলেন, 'ধন্যবাদ সৈয়দ। তুমি ওকে কোথায় পেলে?'

কবীর চৌধুরী যে হক ভাইকে সৈয়দ বলে ডাকেন, এটা অামার জানা ছিলা না। অামাকে কবীর চৌধুরী বসতে বললেন। অামি একটি চেয়ারে বসলাম। হক ভাই অন্যদিকে গেলেন। কবীর চৌধুরী অামাকে কি বলবেন, সেটা অামি জানি না। অামিই বললাম, 'স্যার, কেমন অাছেন?'
অধ্যাপক কবীর চৌধুরী স্বখেদে বললেন, 'এই বয়েসে অার থাকা। অামি অাসলে পত্রিকায় তোমার কবিতা পড়ি অনেকদিন ধরেই। ভালো লাগে। একদিন কথায় কথায় সৈয়দকে বললাম, এই টোকন ঠাকুরকে তুমি চেনো সৈয়দ? এর কবিতা অামার ভাল্লাগে। সৈয়দ বলল, চিনব না কেন? টোকনের কবিতা অামিও পছন্দ করি। অামরা অাড্ডা দিয়ে থাকি। ভালেই হলো। অাজ ও তোমাকে হাতে নাতে সপে দিয়ে গেল।'
অামার কিছু বলবার থাকার কথাও নয়, নেইও। কিছুক্ষণ কথা হলো কবীর স্যারের সঙ্গে। বললাম, অাপনার অনেক অনুবাদের পাঠক অামি। অামার কলেজ লাইফ থেকেই। অামার কবিতা নিয়ে কবীর চৌধুরী অামাকেই বলছেন, ব্যাপারটা কেমন অস্বস্তির না? অামি একটু পরে স্যারকে বলে উঠে গেলাম। স্যার মারা গেলেন কিছুদিন পরেই। মনে অনুশোচনা এলো, ওইদিন অারেকটু সময় কেন কবীর চৌধুরীর পাশে, তার ছায়ায় থাকলাম না? এমন তো না যে, অামি কবিতা নিয়ে অাড্ডা কম করি। ভাবতে কেমন যেন লাগে, অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে অামাকে অালাপ করিযে দিলেন সৈয়দ শামসুল হক। বাংলা ভাষা-সংষ্কৃতিতে তাদের যে দান, তা গ্রহণ করবার সম্পূর্ণ প্রস্তুতিও তো অামার নেই। নেই তো নেইই। কিছুই নেই। অামার একটি সাম্রাজ্য নেই। ব্যাপ্ত কাঠামোতে নির্মিত প্রাসাদ নেই। থাকলে, কবি বংশের কাউকে অার বাইরে থাকতে হতো না। বলতাম, অাপনারা সবাই এই প্রাসাদে থাকেন। ঘুমান। ঘুম ভাঙলে উঠে, ভাল্লাগলে কবিতা লিখবেন। সৈয়দ শামসুল হককে বলতাম, অাপনি লেখেন পরানের গহীন ভেতর। অামরা থাকব গহীন ভেতর। অামরা থাকব পরানের ভেতর। পরান থাকবে গহীনের ভেতর। ভেতর থাকবে পরানের গহীনে। সেইখানে থেকে যাচ্ছেন সৈয়দ শামসুল হক, কবি বংশের দারুণ অহঙ্কার। সেই অহঙ্কার দান করেন সব্যসাচী হক, বাংলার জনপদে, বাংলাভাষায়।

কদিন ধরে সবাই বলছে, সৈয়দ হক 'পরানের গহীন ভেতর' চলে গেছেন, ২৭ সেপ্টেম্বর, বিকালে। 'পরানের গহীন ভেতর' তো সৈয়দ হকের একটি কাব্যগ্রন্থ, যার কবিতাগুলো বাংলা ভাষার পাঠকের স্মৃতিতে ঢুকে পড়েছে। একটা একটু পড়াই যাক_
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,/
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,/
মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷/
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,/
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,/
নিজেই তাজ্জব তুমি – একদিকে যাইবার চাও/
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান/
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,/
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,/
ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,/
সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায় ৷/
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর ৷/


২৮ সেপ্টেম্বর বিকেল থেকে জন্মশহর কুড়িগ্রামের সরকারি কলেজের মাঠের কোণে সৈয়দ হক সমাহিত। ১৯৩৫ এর ২৭ ডিসেম্বর এক কনকনে শীতের ভোরে জন্মেছিলেন যে শিশু, তার বাবা ছিলেন হোমিও প‌্যাথের ডাক্তার। একদিন সকালে হকের মায়ের যখন প্রসব ব্যথা ওঠে, তখন তাকে দূরের হাসপাতালে নেয়া সম্ভব ছিল না। হকের বাবাই ছিলেন হকের ধাত্রী। বাচ্চা মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে অাসার পর প্রতিবেশিরা বলল, 'এ তো বাদশা।'
হক ভাই একদিন কথায় কথায় বললেন, 'জানো, অামার বাবা-মা, ছোটবেলার বন্ধুরা অামাকে বাদশা নামেই ডেকে থাকে!'

অামার বন্ধু মোহাম্মদ মোস্তফার সঙ্গে অাড্ডা দিচ্ছিলাম 'মধ্যমা' প্রকাশনীতে। গ্রন্থপ্রেমী সঞ্জয় গাইন ছিল, মধ্যমায় চাকরি করত তখন সঞ্জয়। কথায় কথায় মোস্তফা বলল, 'সিনেমা সিনেমা করো, হক ভাইয়ের খেলারাম খেলে যা নিয়ে সিনেমা বানাতে পারো না?'

এরপর থেকেই সৈয়দ হকের সঙ্গে একধরনের ধারাবাহিক অাড্ডা অামার শুরু। বসলে, কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক-চিত্রকলা ঘুরে অালোচনা সিনেমায় এসে থামে। থামে কই? অাড্ডা অারো নতুন বাঁক নেয়। সেই বাঁকে দাঁড়িয়ে অাছেন জহির রায়হান, দাঁড়িয়ে অাছেন অালমগীর কবির। তো কথায় কথায় একদিন হক ভাইকে বললাম, 'এবার তো অাপনার সেভেনটি নাইন হতে যাচ্ছে।'
'হ্যাঁ।'
'উনোঅাশি!'
হক বলেন, 'ইংরেজিটাই তো ভালো শোনাল। সেভেনটি সেভেনটি মানে ধরো সত্তুরের সাউন্ডটা থাকে, উনো-অাশি বললে অাশি অাশি লাগে। বেশি বয়স মনে হয়।'
হক ভাই হাসলেন। অামারও হাসি এসে যায় ঠোঁটে। বললাম, 'বড় করে অাপনার জন্মদিনটা হওয়া উচিৎ।'
'কে করে অার!'

সৈয়দ হকের ৭৯ তম জন্মদিন পালন করেছিলাম অামরা। সাদ্দাম সিকদার, মোস্তফা মনন, পুজা সেনগুপ্ত, জয়িতা মহলনবীশ, গাজী রাকায়েত, শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালা বিভাগ ও মেইন অডিটোরিয়ামের স্টাফরা এবং সর্বোপরি ডিজি লিয়াকত অালী লাকী, সবার দুর্দান্ত সাপোর্টে অনুষ্ঠিত হলো সৈয়দ হকের ৭৯তম জন্মদিন। শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, নাট্য নির্দেশক অাতাউর রহমান, নির্দেশক-অভিনেতা মামুনুর রশীদ, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, রাজনীতিবিদ নূহ-উল অালম লেনিন, বাংলা একাডেমির ডিজি শামসুজ্জামান খান, অানোয়ারা সৈয়দ হক এবং সৈয়দ হক মঞ্চে ছিলেন। হক কবিতা পড়েছিলেন সেদিন প্রায় ৫০ মিনিট, দাঁড়িয়ে, হেঁটে হেঁটে, দুহাত নাড়িয়ে। অানন্দিত কিশোর সেদিন সৈয়দ হক। অামরা যদি সেই অনুষ্ঠানের ভিডিও করতে পারতাম! অাফসোস থেকেই যাচ্ছে, এই গরিবি-অর্থনৈতিক জীবনে! সেদিন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ডিজি লাকী ভাই হক-জন্মজয়ন্তি পালনে দিলেন প্রধান অডিটোরিয়াম। একটি প্রকাশনা করেছিলাম, 'সামান্য কিছু' 'অা লিটল বিট' 'সৈয়দ হক স্মারক সংখ্যা'--যাতে সাদ্দাম হোসেন ওরফে সিকদারেরই চৌদ্দঅানা কৃতিত্ব। হক ভা্য়ের কয়েকশত ফটোগ্রাফি করিয়েছিলাম। পুরো ব্যাপারটি হক ভাইকে খুব প্রাণবন্ত করেছিল। শিল্পকলার প্রধান অডিটোরিয়াম মঞ্চের ব্যাকড্রপে রেখেছিলাম ১৬ ফুট বাই ৬ ফুটের হ্যাঙ করা হকের পোর্ট্রেট, অার তার স্বাক্ষর। জন্মদিনে নিজের মুখোমুখি সৈয়দ শামসুল হক।
৭৫০ সিটের অডিটোরিয়াম। দর্শক পূর্ণ হয়েও অারো কিছু দাঁড়িয়ে অাছে। অাড়াই ঘণ্টার একটি জন্মদিন পালন অনুষ্টান। যেভাবে বলেছি, হক ভাই টাইমিং রক্ষা করে তা শেষ করলেন।
'অন্ধকার মঞ্চ। স্পট লাইট ডায়াসের ওপর পড়বে। উপস্থাপককে দেখা যাবে। কবি অাফরোজা সোমা উপস্থাপক। সোমার কিছু কথার পর মঞ্চ ফের অন্ধকার। বাজবে বাঁশি। মিনিট দেড়েকের বাঁশির পর মিডল স্টেজে অাস্তে অাস্তে লাইট আপ হবে এবং সেই লাইটে দেখা যাবে, সৈয়দ হক নিজেকে দেখছেন এবং লাইট পুরো মঞ্চ কভার পর হক ঘুরে তাকাবেন হলভর্তি দর্শকের দিকে, দর্শকের উদ্দেশ্যে ভালোবাসা ছুড়ে দেবেন ডান হাতের অাঙুল ঠোঁটে তুলে।'
হক ভালোবাসা জানালেন। হককেও ভালবাসি আমরা, তার বর্ণাঢ্য সৃষ্টিকর্মের নিরিখে। তিনি সফল চাষা, বাংলাভাষার।

কদিন পরই, হক ভাই ফোনে বললেন, 'বারিধারায় একটি বাড়িতে অামার বার্থডে করবে তারা, অাসতে পারবে? সেদিন গেলাম বারিধারায়। এলিট এনায়েতুল্লাহ খানের বাড়ি। খান মূলত ব্যবসায়ী। চিত্রকলার উঁচুদরের কারবারি। তার বাড়িতেই হকের বার্থডে উৎসব। সোমা অার অামি গেছি উৎসবে। দেশের চিত্রকরদের একটা অংশ ছিল সে অনুষ্ঠানে। মদ্যপান ছিল। রাশান অ্যাম্বেসির প্রটোকল অফিসার এক জর্জীয় সুন্দরী, দক্ষিণ কোরিয়ান রাষ্ট্রদূত ছিলেন। কোরিয়ান রাষ্ট্রদূত হককে বললেন, 'ইউ অারো সেভেনটি নাইন? হাউ কাম? ইউ অার লুকিং ফিফটি নাইন অনলি!'
হকের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ থেকে কবিতা পড়ছিলেন সৈয়দ হক। একাধিক। হঠাৎ হক স্পিকারে ডাকলেন, 'হোয়ার ইজ অাওয়ার ইয়াং পোয়েট টোকন ঠাকুর?'
বাড়ির ইনডোরেই বানানো মঞ্চে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। সৈয়দ হকের ছবি দিয়ে ইংরেজিতে ব্যাকড্রপ প্রিন্ট করা। চারপাশে শুধু পেইনটিং। ড্রইং রুমে দেখলাম একটি কোর্তা। গ্লাস দিয়ে ঘেরা। ক্যাপশন পড়লাম, 'নবাব সিরাজউদৌলার কোর্তা।' এনায়েতউল্লাহ খান, অাগেই বললাম না, তিনি কালেক্টর, ব্যবসায়ী। হক অাবার ডাকলেন, ইংরেজিতেই। কারণ, ওখানে বিদেশী লোক ছিলেন ৫০ জনের মতো। দেশী ৬০ জন, যাদের বেশির ভাগই কনটেম্পোরারি অার্টিস্ট। যাদের সবাই অামার পরিচিত, কারণ, অামরা অামরা জয়নুল অাবেদিনের স্কুলের ছাত্র, চারুকলায় পড়েছি। তো, অামি গেলাম হক ভাইয়ের কাছে, যেখানে তিনি চেয়ারে বসে কবিতা পড়ছিলেন। কাছে যেতেই হক ভাই বললেন, 'একা কতক্ষণ কবিতা পড়ব? তুমি বসো। কিছুক্ষণ চালাও।'
বললাম, 'এখানে তো ইংরেজি কবিতা পড়তে হবে, অামার কবিতা তো ইংরেজি করা নেই। প্রস্তুতিও নেই অামার।'
হক ভাই অাদেশ দিলেন মনে হলো, 'বসো তো। কিছুক্ষণ মেমোরি থেকেই পড়ো।'
বলেই হক ভাই উঠে পড়লেন মানেই অামাকে সিটে বসতে হলো এবং অামি নিজের কবিতা নিয়ে কি বলব, হক ভাই সম্পর্কে অামার কিছু পার্সেপশন বলছিলাম।'

রাজশাহীতে, ইন্ডিয়ান অ্যাম্বেসির অনুষ্ঠান, বাংলা একাডেমি, বইমেলায় কত কতভাবে সৈয়দ হককে কতরকম ভাবে দেখেছি, পেয়েছি। অার অাড্ডা দিয়ে গেছি। মনে অাছে, একদিন বললাম, 'হক ভাই, অামি তো অাপনার সঙ্গে অাড্ডা দিই, সব্যসাচী হকের সঙ্গে। অাপনি কার সঙ্গে অাড্ডা দেন?'
'একজন কবির সঙ্গে। শিল্পীর সঙ্গে। বন্ধুর সঙ্গে।'
হকের কথায় লাজুক হয়ে পড়েছি। হকের সঙ্গে অাড্ডায় অাকাশ কাঁপিয়ে হেসে উঠেছি। হক ভাই হাসতে হাসতে কিশোর হয়ে পড়েছেন। তিনি চিরকালের চিরকিশোর। কী বর্ণাঢ্য তাঁর ব্যক্তিত্ব! তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে কেবল শেখারই ছিল াামার, যেমন তাঁর রচনায় রয়েছে শেখার অসীম উপাদান। শিখতে চেয়েছি, যতটা শিখতে তিনি সুযোগ দিয়েছেন, ততটা শিখতে পারিনি। তাঁকে ভালোবেসেছি, তাঁর সৃষ্টি, তাঁর লেখাকেও ভালোবাসি। এই ভালোবাসাতেও কিছু শিখতে পারি।

প্রিয় হক ভাই, অাপনার সঙ্গে অাড্ডাগুলো অার পাব না। এই অতৃপ্তি, এই শূন্যতা অামাকে মনখারাপ করে রেখেছে। কী করব?


৩০ সেপ্টেম্বর-১ অক্টোবর ঢাকা

মন্তব্য ০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.