নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) ৭।শহরনামা (উপন্যাস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), ৮। মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ, ২০২৩), ৯। নির্বাচিত দেবদূত(গল্পগ্রন্থ, ২০২৪), ১০। দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন/ফরটি রুলস অফ লাভ (অনুবাদ, ঐতিহ্য, ২০২৪)
(ব্লগের নির্বাচিত পাতা পর্যন্ত যাইতে অক্ষম লেখাটি জনকণ্ঠ তাদের সাহিত্য পাতায় ছাপায়া দিছে। জীবন বিচিত্র ।
জনকণ্ঠের লিঙ্ক - Click This Link)
এক।
সাহিত্যচর্চার নানা রূপ। সাহিত্যচর্চা হতে পারে একনিষ্ঠ সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে, সাহিত্য সমালোচনার মাধ্যমে অথবা সাহিত্যকর্ম সৃষ্টির মাধ্যমে। সাহিত্যপাঠে বিশেষ কোন দায়বধ্যতা নেই। কেউ আজীবন নিছক শখে, অথবা মানসিক উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যে নিমগ্ন সাহিত্যপাঠে লিপ্ত থাকতে পারেন। অপরদিকে সাহিত্য সমালোচনা হতে পারে পেশাগত, হতে পারে কোন বিশেষ আদর্শিক অবস্থান থেকে অথবা নিখাদ স্বতঃপ্রণোদিত।
কিন্তু যখন সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারটা আসে, তখন লেখকের মাথায় সচেতনে বা অবচেতনে কাজ করতে থাকে একসাথে অনেকগুলো বিষয়। কি লিখবো, কেন লিখব, শুধু নিজের জন্যে লিখবো নাকি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লিখবো, পাঠকের কথা বিবেচনায় রাখতে হলে সে পাঠকবলয়ে কে কে আছেন, কোন আদর্শিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে হবে কি না, থাকলে লেখায় তা উঠে আসবে কি না, চিন্তাভাবনা কতটুকু মৌলিক হচ্ছে, কোন প্রথাসিদ্ধ লেখকের স্টাইল অনুসরণ করবো কি না, করলে কতটুকু, কোন ফরমেটে লিখবো- গদ্য না কবিতা, গদ্য হলে কি প্রবন্ধ ধরণের, না উপন্যাস বা গল্প- এ রকম নানাধরণের প্রশ্ন এসে নিত্ত ভিড় জমায় লেখকের মস্তিষ্কে।
তবে যে বিষয়টি নিয়ে প্রতিটি সৃষ্টিশীল লেখকের সচেতনভাবে চিন্তাশক্তি ব্যায় করতে হয় তা হচ্ছে- তার সাহিত্যিক মানস তৈরিতে সে কার সাহায্য নেবে? সাহিত্যকর্ম তৈরির পিছনে উপাদান তথা রসদগুলো সে জোগাড় করবে কোথা থেকে? সাহিত্যকর্ম তো কোন বুদবুদ নয় যা বাতাসে উবে যায়, অথবা প্রচণ্ড গরমে বয়ে যাওয়া একঝলক দমকা হাওয়া নয় যা হুট করে এসে হুট করে চলে যায়। কিসের প্রভাবে তবে একটা গল্প, কবিতা বা উপন্যাস টিকে থাকে বছরের পর বছর? আর কালের বিচারে উতরে যাওয়া এইসকল সাহিত্যিকের চিন্তার জগতটাই বা তৈরি হয় কিভাবে?
এ প্রশ্নগুলির উত্তর নিয়ে খুব করে ভেবেছেন বিংশ শতাব্দীর বিদগ্ধ কবি এবং সাহিত্য সমালোচক- টি এস এলিয়ট। তার “ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট” প্রবন্ধটিতে একজন সাহিত্যিকের ব্যাক্তিসত্ত্বা বিকাশে তার জাতিগত ঐতিহ্যসহ আর কি কি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে তিনি করেছেন গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত।
দুই।
বলছিলাম, এলিয়ট কথা বলেছেন কবিদের ঐতিহ্য সচেতনতা নিয়ে। ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য সচেতনতা স্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করে সমসাময়িক দু’জন কবির লেখায়। পৃথিবীর প্রতিটি জাতির সৃষ্টিশীলতার আলাদা ঐতিহ্য থাকে। নূতন কিছু সৃষ্টি করার পন্থা, শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গী স্থান-কাল-পাত্রভেদে আলাদা হয় কিন্তু প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর মহৎ শিল্পীরা নিজ নিজ ট্র্যাডিশন দ্বারা সচেতন বা অবচেতনে প্রভাবিত। যেমন, ফরাসি শিল্পী-সাহিত্যিকদের বৈশিষ্ট্য হল তুলনামূলকভাবে তারা পৃথিবীর অন্যান্য যেকোন দেশের শিল্পীদের তুলনায় নিজস্ব শিল্পকর্মের প্রতি অনেক ক্রিটিক্যাল বা খুঁতখুঁতে দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করেন। এটাই তাদের ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য।
কথা হল যে, পদ্ধতি আলাদা হলেও ঐতিহ্যপ্রবণতা সক্রিয়ভাবে কাজ করে সবার মধ্যেই। ধরা যাক, আমরা একজন কবির দুর্দান্ত একটি কবিতা পড়লাম- শব্দচয়নে, বাক্যবিন্যাসে, আলঙ্কারিক প্রয়োগে যে কবিতাটি পাঠককে বুঁদ করে রাখে। প্রাথমিক মুগ্ধতার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পরপরই সচেতন পাঠক কবিতাটির ব্যাবচ্ছেদের চেষ্টা করেন, খুঁজে দেখেন যে কবিতার কতটুকু মৌলিক এবং কতটুকু অনুপ্রাণিত তার প্রাক্তন কবিদের লেখা দ্বারা। প্রাক্তন কবিদের লেখা, তা সে একযুগ আগের হোক অথবা এক শতাব্দী, অথবা এক সহস্রাব্দ – সবকিছুই একটি নির্দিষ্ট ঐতিহ্যের স্রোতে বহমান। তো, সেই কবির লেখা কবিতা যদি তার সমসাময়িক বা ঠিক তার পূর্ববর্তী প্রজন্মের কবির কবিতা থেকে ভিন্নতর হয় তবে তার প্রশংসায় আমরা মুখর হয়ে উঠি। এটা আর বিচার করা হয়ে ওঠে না যে তার কবিতাটি হয়তো দশ বছর নয়, শত বছর বা তারও বেশী আগের এমন এক কবির কবিতা দ্বারা প্রভাবিত, যার হাড় কবরের মধ্যে শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। এবং এই যে প্রভাবিত হবার ব্যাপারটা, তা কেবল তরুণ কবিদের কাঁচা হাতে লেখা কবিতার ক্ষেত্রেই ঘটে তা নয়, কবিশক্তির মধ্যগগনে আছেন এমন কবির কবিতায়ও তার প্রাকপুরাতন কবিদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
তাই লেখায় ট্র্যাডিশনের প্রভাব গায়ের জোরে বা গলাবাজি করে উড়িয়ে দেয়া বা দুম করে অস্বীকার করার মত সহজ ব্যাপার না। একই জিনিস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনুকরণ করার চেয়ে নূতন কিছু চেষ্টা করা ভালো, অথবা একদম অনুকরণ না করাই শ্রেয়তর- ঢালাওভাবে এমন কথা বলেই পূর্বতন কবিদের প্রভাবকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। কারণ, এলিয়ট বলেন, ট্র্যাডিশনের প্রভাববলয় কাজ করে আরও অনেক গভীরে। হয়তো একজন কবি একদম অসচেতন ভাবেই অনুকরণ করে চলেছেন কাউকে, যার সম্পর্কে সে নিজেই ওয়াকেফহাল নয়। ট্র্যাডিশনের যথার্থ অনুকরণে একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যচর্চায় সোনা ফলতে পারে তবে সেজন্যে তাকে কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা নিজ সাহিত্যিক ঐতিহ্যের জড়ে বা গোঁড়ায় পৌঁছুতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন প্রত্নতাত্ত্বিকের মত নিষ্ঠা নিয়ে ক্রমাগত মাটি খুঁড়ে নিজের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যের মুখোমুখি হবার প্রবল বাসনা। অতীতকে শুধুমাত্র অতীততের পটভূমিতে না দেখা বর্তমান সময়ের সাযুজ্যে কিভাবে তাকে বিচার করা যায়- সে চিন্তাটুকুও করে নিতে হবে একই সাথে। উদাহরণস্বরূপ এলিয়ট বলেন একজন ঐতিহ্যসচেতন ইংরেজ সাহিত্যিক যখন কলম ধরেন তখন তার মাথায় শুধু তার নিজের সমসাময়িক কবিদের কবিতা ঘোরে না, বরং হোমারের ইলিয়ডের সময় থেকে নিয়ে সমসাময়িক সমগ্র ইউরোপের সাহিত্যকর্মই তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। নিজের জাতিগত ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ব্যাপারে এই সচেতন দৃষ্টিভঙ্গীকেই এলিয়ট যেকোনো সাহিত্যিকের জন্যে কাম্য বলে উল্লেখ করেন।
এলিয়ট খুবই শক্তভাবে বলেন- কোন কবি বা সাহিত্যিকের বিচ্ছিন্ন কোন একক অস্তিত্ব বা পরিচয় নেই। যে কোন সাহিত্যিকের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠালাভ করে অতীতের সার্থক সাহিত্যিকদের মহৎ সাহিত্যকর্মের সাথে তুলনার দ্বারা। এ পরিমাপের পর বলা চলে যে সমসাময়িক কোন লেখকের লেখায় সোনা কতটুকু আর খাত কতটুকু। আর এই তুলনায় প্রাপ্তি বা লাভ মোটেও একমুখী নয়। মানে ব্যাপারটা এই না যে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত লেখকদের লেখার সাথে তুলনার দ্বারা শুধুমাত্র নবীন লেখকের সাহিত্যিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, বরং অতীতের সাহিত্য কর্মগুলিরো পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে এ তুলনায়। এলিয়ট বলেন অতীতের সাহিত্যকর্মের সাথে তুলনা মোটেও অতীতকে শিরোধার্য ধরে হবে না, বরং তুলনা হবে দ্বিমুখী, একের দ্বারা অপরের। নবসৃষ্টি কোন সাহিত্যকর্ম যদি অতীতের হুবহু অনুকরন হয় তবে তাকে কোন শিল্পকর্মের কাতারে ফেলাই যাবে না। শুধুমাত্র “ফিট ইন” – করা, অর্থাৎ টিকে যাওয়া বা গণমানুষ দলেদলে গ্রহণ করেছে বলেই যে কোন কিছুকে আর্ট আখ্যা দিতে হবে ব্যাপারটা এমন না মোটেই।
অতীতের সাহিত্যিকদের দ্বারা তরুণ একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম প্রভাবিত হওয়া এবং ইত্যবসরে তার সাহিত্যমানস গঠন করবার ব্যাপারে এলিয়ট বলেন- অতীতের কাজকে বোঝা বানিয়ে সর্বক্ষণ পীঠে নিয়ে নিয়ে ঘুরতে হবে ব্যাপারটা এমন না। পছন্দের একজন বা দুজন সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মকে বাতিঘর ধরে তাদের অন্ধ অনুকরণ করার প্রচেষ্টা যেমন ভুল, তেমনি একটি নির্দিষ্ট সাহিত্য পরিসর বা সময়কে নিজের আদর্শ ধরে নেয়াটাও সমীচীন নয়। একটি যুগের সাহিত্যকর্মকে ঢালাও ভাবে আরেকটি যুগের সাহিত্যকর্মের ওপর যেমন প্রাধান্য দেয়া সম্ভব নয়, যেমন আমাদের বঙ্গদেশীয় সাহিত্যকর্মের প্রেক্ষিতে বলতে গেলে- রবীন্দ্রত্তর যুগের কল্লোল সাহিত্যগোষ্ঠী বাংলা সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখেন। একজন রবীন্দ্রভক্তের জন্যে কল্লোলগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি না দেয়াটা যেমনি ভুল হবে, একইভাবে কল্লোলসাহিত্যের অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার প্রবণতাও মূর্খতা। কেননা সাহিত্যসৃষ্টির উপাদানগুলো যুগভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয় এবং একজন কবির ব্যাক্তিমানসের তুলনায় সমগ্র জাতির সামষ্টিক চিন্তাজগত অনেক বৃহৎ এবং গুরুত্বের দাবীদার।
একজন সাহিত্যিক তার সাহিত্যে তৈরির রসদ জোগাড় করবেন কোথা থেকে, তারও কোন ধরাবাঁধা ছক বা গণ্ডি নেই। সাহিত্য তৈরির সকল উপাদান বাস্তব অভিজ্ঞতার জগত থেকে আহরণ করতেই হবে এমন কোন নিয়ম নেই, যদিও একটা সময় ছিল যখন ইউরোপিয়ান কবি সাহিত্যিকেরা জীবনের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ পার করতেন ইউরোপ ঘুরে দেখে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করে। অপরপক্ষে শেক্সপিয়ারেরও উদাহরণ দেয়া যায়, যিনি কিনা কেবল প্লুটার্কের (প্রধানতম প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসবেত্তা) বই পড়েই ইউরোপের ইতিহাস সম্বন্ধে যে জ্ঞান অর্জন করেছেন, ইংরেজরা বছরের পর বছর ধরে ব্রিটিশ মিউজিয়াম ঘুরে দেখেও সে জ্ঞান অর্জন করতে পারে নি। তাই, এলিয়ট বলেন যে ঐতিহ্য সচেতনতা তৈরির পন্থা ধরাবাঁধা নয়। ক্রমাগত আত্মত্যাগ, ব্যাক্তিসত্ত্বাকে উহ্য রাখার দ্বারা এ প্রচেষ্টা পরিপূর্ণতা লাভ করে। নিজের খণ্ড খণ্ড চিন্তাচেতনা, যা সামষ্টিক, কালিক ও স্থানিক চেতনার সাথে সংঘর্ষ তৈরি করে, তা ছাঁটাই করা, বাদ দেয়ার মাধ্যমে নিজ কৃষ্টি-সংস্কৃতির সাথে সাযুজ্য তৈরি হয়।
তিন।
বড় কবি – ছোট কবি পার্থক্য করি কি দিয়ে? এলিয়ট বলেন বড় কবি বা পরিণত কবি তিনি নন যার কবিতার ভাব- বিচিত্র, বা যার কবিতা অন্যান্য কবিদের কবিতা থেকে সবসময় দু লাইন গভীরে গিয়ে কথা বলে। একজন পরিণত ও একজন অপরিণত কবির পার্থক্য তাদের মস্তিষ্কে, তাদের চিন্তা প্রক্রিয়ায়। এলিয়ট কবি মস্তিস্কের ব্যাবচ্ছেদ করে বোঝান যে কেমনটা হলে আমরা তাকে যথার্থই অনুকরণীয় কবি মস্তিষ্কের খেতাব দিতে পারি। এলিয়ট বলেন, কবির মস্তিষ্ক অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। একজন কবি যাকিছু পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করবেন তা তার মস্তিষ্কে অনুরণন তৈরি করবে। ঘটনার সাথে অনুভূতির সংমিশ্রনে জন্ম হবে কবিতার এবং কবি মস্তিষ্কের ভূমিকা হবে সেই বিক্রিয়া সংঘটনের প্রভাবকের। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন হাইড্রোজেন আর সালফারের বিক্রিয়ায় সালফিউরিক অ্যাসিড প্রস্তুত হবার রাসায়নিক বিক্রিয়াটি, যেখানে প্লাটিনাম অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। কবিমানসের ভূমিকা প্রভাবক প্লাটিনামের মত।
মহৎ একটি কবিতার জন্ম হয় আবেগ এবং অনুভূতির মিশেলে। হতে পারে সেটা নির্দিষ্ট একটি আবেগ, অথবা একাধিক আবেগের সংমিশ্রণ, অথবা আবেগকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কেবল অনুভূতির স্থল হতে লেখা। তবে কবির মস্তিষ্ককে প্রস্তুত থাকতে হবে বৈচিত্রময় আবেগ-অনুভূতি, দৃশ্যকল্প এবং উপমা ধারণ করে রাখার জন্যে- যাতে করে এ সবকিছু একত্র করে কবিতা বিনির্মাণ করা যায়, তৎক্ষণাৎ না হলেও পরে, একটু সময় নিয়ে।
বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু আঁটানোর ক্ষমতা, অথবা একটা অনুভূতির পীঠে ভর করে আরও বৃহৎ ক্যানভাসে ছবি আঁকার বা একটি অনুভূতির সূত্র ধরে আরও বিস্তৃত অনুভূতির জগতে ছড়িয়ে যাওয়ার সক্ষমতা অর্জন কবির মহত্ত্ব নির্দেশক। উদাহরণস্বরূপ জন কিটসের ওড টু দা নাইটিংগেল কবিতার কথা স্মরণ করা যায়, যেখানে কিটস নাইটিংগেল পাখির সূত্র ধরে অনুভূতির বিচিত্র সংমিশ্রণ দেখিয়েছেন, যার প্রায় কিছুই উক্ত পাখি সংশ্লিষ্ট নয়।
এলিয়ট বলতে চান, কবিতা কবির একান্ত ব্যাক্তিগত অনুভূতি ব্যাক্ত করার স্থল নয়। কথাটা খুবই দ্বন্দ্ব সৃষ্টিকারী বা ভ্রমের উদ্দীপক, কেননা আমাদের মধ্যে যারা একটুআধটু কবিতা লেখেন, তাদের অধিকাংশই জীবনে প্রথম কবিতা লেখার জন্যে কাগজ কলম নিয়ে বসেছেন নিজের মনের অব্যাক্ত কথাগুলি লিপিবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে। তাই এলিয়টের যুক্তিটি মনোযোগ দিয়ে বোঝা দরকার। এলিয়টের মতে, প্রকৃত কবি হচ্ছেন একটি “মিডিয়াম” বা মাধ্যম, যার মধ্যে নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং চেতনার সমন্বয়ে সৃষ্ট অনুভূতি এসে জমা হয়। তখন কবির দায়িত্ব হয় তার “ব্যাক্তিসত্ত্বা”-কে যথাসম্ভব দূরে রেখে সেই অনুভূতিগুলোকে পাঠকের জন্যে উপস্থাপন করা। যখন ব্যাক্তিসত্ত্বা লেখনীতে প্রায় ঊহ্য থাকবে, তখন তা সার্বজনীন হবে, সবাইকে স্পর্শ করবে। ব্যাক্তি অনুভূতিতে ভারাক্রান্ত কবিতা বেশীরভাগ সময় কবিতাই হয়ে ওঠে না।
হতে পারে যে কবি এমন একটি বিষয় তিনি তার কবিতায় উপস্থাপন করছেন যা খুবই সময়োপযোগী এবং তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু ব্যাক্তিগতভাবে কবিকে সেই বিষয়টা একদমই আকর্ষণ করে না। উদাহরণস্বরূপ একজন কবি যার কবিতায় মূলত মানব-মানবীর প্রেম তুলে আনতে পছন্দ করেন, তিনি তার দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে একটি রাজনৈতিক কবিতা লিখতেই পারেন। তার সৃষ্টি সেই কবিতাটিও একটি মহৎ কবিতা হয়ে উঠতে পারে , কিন্তু এটা বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে না যে তাকে ব্যাক্তি অনুভূতির জায়গা থেকে অনুভব করেই লিখতে হবে কবিতাটি। এমন ক্ষেত্রে কবি নিজের সত্ত্বাকে ছাপিয়ে হয়ে ওঠেন সমাজের বা সময়ের কণ্ঠস্বর।
ঠিক তেমনিভাবে একজন কবি বা লেখককে নূতন- চমকপ্রদ সব অনুভূতিসম্পন্ন কেচ্ছাকাহিনী মাটি খুঁড়ে বা আকাশ ফুঁড়ে আবিষ্কার করতে হবে- এমনও নয়। খুব সাধারণ একটি বিষয় নিয়েও যথাযথ আবেগের স্ফুরণে কালজয়ী একটি কবিতা লেখা যায়।
এলিয়টের আগে যে রোম্যান্টিক কবিতার মুভমেন্ট, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন কবিতা হচ্ছে “প্রকৃতির নিসর্গ হতে আহরিত শান্ত আবেগের প্রস্ফুরণ” (ইমোশনস রিকালেক্টেড ইন ট্রাঙ্কুয়ালিটি)। এলিয়ট শক্তভাবে দাবী করেন এটা কবিতার সবেচেয়ে অপরিপক্ক ফর্মুলা। কারণ কবিতা মোটেও হঠাৎ চলে আসা অপরিপক্ক আবেগের ভুরভুরে বহিঃপ্রকাশ হতে পারে না, বরং আবেগকে “কনসানট্রেট” করে, তথা চাপিয়ে, কমিয়ে, ছাঁটাই করে একদম মেদহীন ঝরঝরে আকৃতিতে এনে কবিতায় প্রয়োগ করতে হয়।
পরিশেষে এসে এলিয়টের সাথেই কণ্ঠ মিলিয়ে বলা চলে, কবিতা ব্যাক্তিসত্ত্বার প্রকাশের স্থল নয়, বরং ব্যাক্তিসত্ত্বাকে আড়াল করবার মাধ্যম। কিন্তু এই কাজটি সবার দ্বারা সম্ভব হয় না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আনাড়ি কবির অপটু হাতের লেখায় কবিতা একটি আর্ট ফর্ম হয়ে ওঠার বদলে ব্যাক্তিতান্ত্রিক স্লোগানে পরিণত হয়। দক্ষ কবি এবং প্রকৃত কবিসত্ত্বার ধারক-বাহক যিনি, তিনিই এই ক্ষুদ্রতার পরিসীমা অতিক্রম করে যেতে পারেন। এই শ্রেণীর মহৎ কবির কবিতাই আমরা যুগে যুগে, কালে কালে পাঠ, প্রশংসা ও পর্যালোচনা করি।
এক।
সাহিত্যচর্চার নানা রূপ। সাহিত্যচর্চা হতে পারে একনিষ্ঠ সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে, সাহিত্য সমালোচনার মাধ্যমে অথবা সাহিত্যকর্ম সৃষ্টির মাধ্যমে। সাহিত্যপাঠে বিশেষ কোন দায়বধ্যতা নেই। কেউ আজীবন নিছক শখে, অথবা মানসিক উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যে নিমগ্ন সাহিত্যপাঠে লিপ্ত থাকতে পারেন। অপরদিকে সাহিত্য সমালোচনা হতে পারে পেশাগত, হতে পারে কোন বিশেষ আদর্শিক অবস্থান থেকে অথবা নিখাদ স্বতঃপ্রণোদিত।
কিন্তু যখন সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারটা আসে, তখন লেখকের মাথায় সচেতনে বা অবচেতনে কাজ করতে থাকে একসাথে অনেকগুলো বিষয়। কি লিখবো, কেন লিখব, শুধু নিজের জন্যে লিখবো নাকি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লিখবো, পাঠকের কথা বিবেচনায় রাখতে হলে সে পাঠকবলয়ে কে কে আছেন, কোন আদর্শিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে হবে কি না, থাকলে লেখায় তা উঠে আসবে কি না, চিন্তাভাবনা কতটুকু মৌলিক হচ্ছে, কোন প্রথাসিদ্ধ লেখকের স্টাইল অনুসরণ করবো কি না, করলে কতটুকু, কোন ফরমেটে লিখবো- গদ্য না কবিতা, গদ্য হলে কি প্রবন্ধ ধরণের, না উপন্যাস বা গল্প- এ রকম নানাধরণের প্রশ্ন এসে নিত্ত ভিড় জমায় লেখকের মস্তিষ্কে।
তবে যে বিষয়টি নিয়ে প্রতিটি সৃষ্টিশীল লেখকের সচেতনভাবে চিন্তাশক্তি ব্যায় করতে হয় তা হচ্ছে- তার সাহিত্যিক মানস তৈরিতে সে কার সাহায্য নেবে? সাহিত্যকর্ম তৈরির পিছনে উপাদান তথা রসদগুলো সে জোগাড় করবে কোথা থেকে? সাহিত্যকর্ম তো কোন বুদবুদ নয় যা বাতাসে উবে যায়, অথবা প্রচণ্ড গরমে বয়ে যাওয়া একঝলক দমকা হাওয়া নয় যা হুট করে এসে হুট করে চলে যায়। কিসের প্রভাবে তবে একটা গল্প, কবিতা বা উপন্যাস টিকে থাকে বছরের পর বছর? আর কালের বিচারে উতরে যাওয়া এইসকল সাহিত্যিকের চিন্তার জগতটাই বা তৈরি হয় কিভাবে?
এ প্রশ্নগুলির উত্তর নিয়ে খুব করে ভেবেছেন বিংশ শতাব্দীর বিদগ্ধ কবি এবং সাহিত্য সমালোচক- টি এস এলিয়ট। তার “ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট” প্রবন্ধটিতে একজন সাহিত্যিকের ব্যাক্তিসত্ত্বা বিকাশে তার জাতিগত ঐতিহ্যসহ আর কি কি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে তিনি করেছেন গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত।
দুই।
বলছিলাম, এলিয়ট কথা বলেছেন কবিদের ঐতিহ্য সচেতনতা নিয়ে। ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য সচেতনতা স্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করে সমসাময়িক দু’জন কবির লেখায়। পৃথিবীর প্রতিটি জাতির সৃষ্টিশীলতার আলাদা ঐতিহ্য থাকে। নূতন কিছু সৃষ্টি করার পন্থা, শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গী স্থান-কাল-পাত্রভেদে আলাদা হয় কিন্তু প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর মহৎ শিল্পীরা নিজ নিজ ট্র্যাডিশন দ্বারা সচেতন বা অবচেতনে প্রভাবিত। যেমন, ফরাসি শিল্পী-সাহিত্যিকদের বৈশিষ্ট্য হল তুলনামূলকভাবে তারা পৃথিবীর অন্যান্য যেকোন দেশের শিল্পীদের তুলনায় নিজস্ব শিল্পকর্মের প্রতি অনেক ক্রিটিক্যাল বা খুঁতখুঁতে দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করেন। এটাই তাদের ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য।
কথা হল যে, পদ্ধতি আলাদা হলেও ঐতিহ্যপ্রবণতা সক্রিয়ভাবে কাজ করে সবার মধ্যেই। ধরা যাক, আমরা একজন কবির দুর্দান্ত একটি কবিতা পড়লাম- শব্দচয়নে, বাক্যবিন্যাসে, আলঙ্কারিক প্রয়োগে যে কবিতাটি পাঠককে বুঁদ করে রাখে। প্রাথমিক মুগ্ধতার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পরপরই সচেতন পাঠক কবিতাটির ব্যাবচ্ছেদের চেষ্টা করেন, খুঁজে দেখেন যে কবিতার কতটুকু মৌলিক এবং কতটুকু অনুপ্রাণিত তার প্রাক্তন কবিদের লেখা দ্বারা। প্রাক্তন কবিদের লেখা, তা সে একযুগ আগের হোক অথবা এক শতাব্দী, অথবা এক সহস্রাব্দ – সবকিছুই একটি নির্দিষ্ট ঐতিহ্যের স্রোতে বহমান। তো, সেই কবির লেখা কবিতা যদি তার সমসাময়িক বা ঠিক তার পূর্ববর্তী প্রজন্মের কবির কবিতা থেকে ভিন্নতর হয় তবে তার প্রশংসায় আমরা মুখর হয়ে উঠি। এটা আর বিচার করা হয়ে ওঠে না যে তার কবিতাটি হয়তো দশ বছর নয়, শত বছর বা তারও বেশী আগের এমন এক কবির কবিতা দ্বারা প্রভাবিত, যার হাড় কবরের মধ্যে শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। এবং এই যে প্রভাবিত হবার ব্যাপারটা, তা কেবল তরুণ কবিদের কাঁচা হাতে লেখা কবিতার ক্ষেত্রেই ঘটে তা নয়, কবিশক্তির মধ্যগগনে আছেন এমন কবির কবিতায়ও তার প্রাকপুরাতন কবিদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
তাই লেখায় ট্র্যাডিশনের প্রভাব গায়ের জোরে বা গলাবাজি করে উড়িয়ে দেয়া বা দুম করে অস্বীকার করার মত সহজ ব্যাপার না। একই জিনিস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনুকরণ করার চেয়ে নূতন কিছু চেষ্টা করা ভালো, অথবা একদম অনুকরণ না করাই শ্রেয়তর- ঢালাওভাবে এমন কথা বলেই পূর্বতন কবিদের প্রভাবকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। কারণ, এলিয়ট বলেন, ট্র্যাডিশনের প্রভাববলয় কাজ করে আরও অনেক গভীরে। হয়তো একজন কবি একদম অসচেতন ভাবেই অনুকরণ করে চলেছেন কাউকে, যার সম্পর্কে সে নিজেই ওয়াকেফহাল নয়। ট্র্যাডিশনের যথার্থ অনুকরণে একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যচর্চায় সোনা ফলতে পারে তবে সেজন্যে তাকে কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা নিজ সাহিত্যিক ঐতিহ্যের জড়ে বা গোঁড়ায় পৌঁছুতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন প্রত্নতাত্ত্বিকের মত নিষ্ঠা নিয়ে ক্রমাগত মাটি খুঁড়ে নিজের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যের মুখোমুখি হবার প্রবল বাসনা। অতীতকে শুধুমাত্র অতীততের পটভূমিতে না দেখা বর্তমান সময়ের সাযুজ্যে কিভাবে তাকে বিচার করা যায়- সে চিন্তাটুকুও করে নিতে হবে একই সাথে। উদাহরণস্বরূপ এলিয়ট বলেন একজন ঐতিহ্যসচেতন ইংরেজ সাহিত্যিক যখন কলম ধরেন তখন তার মাথায় শুধু তার নিজের সমসাময়িক কবিদের কবিতা ঘোরে না, বরং হোমারের ইলিয়ডের সময় থেকে নিয়ে সমসাময়িক সমগ্র ইউরোপের সাহিত্যকর্মই তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। নিজের জাতিগত ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ব্যাপারে এই সচেতন দৃষ্টিভঙ্গীকেই এলিয়ট যেকোনো সাহিত্যিকের জন্যে কাম্য বলে উল্লেখ করেন।
এলিয়ট খুবই শক্তভাবে বলেন- কোন কবি বা সাহিত্যিকের বিচ্ছিন্ন কোন একক অস্তিত্ব বা পরিচয় নেই। যে কোন সাহিত্যিকের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠালাভ করে অতীতের সার্থক সাহিত্যিকদের মহৎ সাহিত্যকর্মের সাথে তুলনার দ্বারা। এ পরিমাপের পর বলা চলে যে সমসাময়িক কোন লেখকের লেখায় সোনা কতটুকু আর খাত কতটুকু। আর এই তুলনায় প্রাপ্তি বা লাভ মোটেও একমুখী নয়। মানে ব্যাপারটা এই না যে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত লেখকদের লেখার সাথে তুলনার দ্বারা শুধুমাত্র নবীন লেখকের সাহিত্যিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, বরং অতীতের সাহিত্য কর্মগুলিরো পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে এ তুলনায়। এলিয়ট বলেন অতীতের সাহিত্যকর্মের সাথে তুলনা মোটেও অতীতকে শিরোধার্য ধরে হবে না, বরং তুলনা হবে দ্বিমুখী, একের দ্বারা অপরের। নবসৃষ্টি কোন সাহিত্যকর্ম যদি অতীতের হুবহু অনুকরন হয় তবে তাকে কোন শিল্পকর্মের কাতারে ফেলাই যাবে না। শুধুমাত্র “ফিট ইন” – করা, অর্থাৎ টিকে যাওয়া বা গণমানুষ দলেদলে গ্রহণ করেছে বলেই যে কোন কিছুকে আর্ট আখ্যা দিতে হবে ব্যাপারটা এমন না মোটেই।
অতীতের সাহিত্যিকদের দ্বারা তরুণ একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম প্রভাবিত হওয়া এবং ইত্যবসরে তার সাহিত্যমানস গঠন করবার ব্যাপারে এলিয়ট বলেন- অতীতের কাজকে বোঝা বানিয়ে সর্বক্ষণ পীঠে নিয়ে নিয়ে ঘুরতে হবে ব্যাপারটা এমন না। পছন্দের একজন বা দুজন সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মকে বাতিঘর ধরে তাদের অন্ধ অনুকরণ করার প্রচেষ্টা যেমন ভুল, তেমনি একটি নির্দিষ্ট সাহিত্য পরিসর বা সময়কে নিজের আদর্শ ধরে নেয়াটাও সমীচীন নয়। একটি যুগের সাহিত্যকর্মকে ঢালাও ভাবে আরেকটি যুগের সাহিত্যকর্মের ওপর যেমন প্রাধান্য দেয়া সম্ভব নয়, যেমন আমাদের বঙ্গদেশীয় সাহিত্যকর্মের প্রেক্ষিতে বলতে গেলে- রবীন্দ্রত্তর যুগের কল্লোল সাহিত্যগোষ্ঠী বাংলা সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখেন। একজন রবীন্দ্রভক্তের জন্যে কল্লোলগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি না দেয়াটা যেমনি ভুল হবে, একইভাবে কল্লোলসাহিত্যের অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার প্রবণতাও মূর্খতা। কেননা সাহিত্যসৃষ্টির উপাদানগুলো যুগভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয় এবং একজন কবির ব্যাক্তিমানসের তুলনায় সমগ্র জাতির সামষ্টিক চিন্তাজগত অনেক বৃহৎ এবং গুরুত্বের দাবীদার।
একজন সাহিত্যিক তার সাহিত্যে তৈরির রসদ জোগাড় করবেন কোথা থেকে, তারও কোন ধরাবাঁধা ছক বা গণ্ডি নেই। সাহিত্য তৈরির সকল উপাদান বাস্তব অভিজ্ঞতার জগত থেকে আহরণ করতেই হবে এমন কোন নিয়ম নেই, যদিও একটা সময় ছিল যখন ইউরোপিয়ান কবি সাহিত্যিকেরা জীবনের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ পার করতেন ইউরোপ ঘুরে দেখে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করে। অপরপক্ষে শেক্সপিয়ারেরও উদাহরণ দেয়া যায়, যিনি কিনা কেবল প্লুটার্কের (প্রধানতম প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসবেত্তা) বই পড়েই ইউরোপের ইতিহাস সম্বন্ধে যে জ্ঞান অর্জন করেছেন, ইংরেজরা বছরের পর বছর ধরে ব্রিটিশ মিউজিয়াম ঘুরে দেখেও সে জ্ঞান অর্জন করতে পারে নি। তাই, এলিয়ট বলেন যে ঐতিহ্য সচেতনতা তৈরির পন্থা ধরাবাঁধা নয়। ক্রমাগত আত্মত্যাগ, ব্যাক্তিসত্ত্বাকে উহ্য রাখার দ্বারা এ প্রচেষ্টা পরিপূর্ণতা লাভ করে। নিজের খণ্ড খণ্ড চিন্তাচেতনা, যা সামষ্টিক, কালিক ও স্থানিক চেতনার সাথে সংঘর্ষ তৈরি করে, তা ছাঁটাই করা, বাদ দেয়ার মাধ্যমে নিজ কৃষ্টি-সংস্কৃতির সাথে সাযুজ্য তৈরি হয়।
তিন।
বড় কবি – ছোট কবি পার্থক্য করি কি দিয়ে? এলিয়ট বলেন বড় কবি বা পরিণত কবি তিনি নন যার কবিতার ভাব- বিচিত্র, বা যার কবিতা অন্যান্য কবিদের কবিতা থেকে সবসময় দু লাইন গভীরে গিয়ে কথা বলে। একজন পরিণত ও একজন অপরিণত কবির পার্থক্য তাদের মস্তিষ্কে, তাদের চিন্তা প্রক্রিয়ায়। এলিয়ট কবি মস্তিস্কের ব্যাবচ্ছেদ করে বোঝান যে কেমনটা হলে আমরা তাকে যথার্থই অনুকরণীয় কবি মস্তিষ্কের খেতাব দিতে পারি। এলিয়ট বলেন, কবির মস্তিষ্ক অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। একজন কবি যাকিছু পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করবেন তা তার মস্তিষ্কে অনুরণন তৈরি করবে। ঘটনার সাথে অনুভূতির সংমিশ্রনে জন্ম হবে কবিতার এবং কবি মস্তিষ্কের ভূমিকা হবে সেই বিক্রিয়া সংঘটনের প্রভাবকের। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন হাইড্রোজেন আর সালফারের বিক্রিয়ায় সালফিউরিক অ্যাসিড প্রস্তুত হবার রাসায়নিক বিক্রিয়াটি, যেখানে প্লাটিনাম অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। কবিমানসের ভূমিকা প্রভাবক প্লাটিনামের মত।
মহৎ একটি কবিতার জন্ম হয় আবেগ এবং অনুভূতির মিশেলে। হতে পারে সেটা নির্দিষ্ট একটি আবেগ, অথবা একাধিক আবেগের সংমিশ্রণ, অথবা আবেগকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কেবল অনুভূতির স্থল হতে লেখা। তবে কবির মস্তিষ্ককে প্রস্তুত থাকতে হবে বৈচিত্রময় আবেগ-অনুভূতি, দৃশ্যকল্প এবং উপমা ধারণ করে রাখার জন্যে- যাতে করে এ সবকিছু একত্র করে কবিতা বিনির্মাণ করা যায়, তৎক্ষণাৎ না হলেও পরে, একটু সময় নিয়ে।
বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু আঁটানোর ক্ষমতা, অথবা একটা অনুভূতির পীঠে ভর করে আরও বৃহৎ ক্যানভাসে ছবি আঁকার বা একটি অনুভূতির সূত্র ধরে আরও বিস্তৃত অনুভূতির জগতে ছড়িয়ে যাওয়ার সক্ষমতা অর্জন কবির মহত্ত্ব নির্দেশক। উদাহরণস্বরূপ জন কিটসের ওড টু দা নাইটিংগেল কবিতার কথা স্মরণ করা যায়, যেখানে কিটস নাইটিংগেল পাখির সূত্র ধরে অনুভূতির বিচিত্র সংমিশ্রণ দেখিয়েছেন, যার প্রায় কিছুই উক্ত পাখি সংশ্লিষ্ট নয়।
এলিয়ট বলতে চান, কবিতা কবির একান্ত ব্যাক্তিগত অনুভূতি ব্যাক্ত করার স্থল নয়। কথাটা খুবই দ্বন্দ্ব সৃষ্টিকারী বা ভ্রমের উদ্দীপক, কেননা আমাদের মধ্যে যারা একটুআধটু কবিতা লেখেন, তাদের অধিকাংশই জীবনে প্রথম কবিতা লেখার জন্যে কাগজ কলম নিয়ে বসেছেন নিজের মনের অব্যাক্ত কথাগুলি লিপিবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে। তাই এলিয়টের যুক্তিটি মনোযোগ দিয়ে বোঝা দরকার। এলিয়টের মতে, প্রকৃত কবি হচ্ছেন একটি “মিডিয়াম” বা মাধ্যম, যার মধ্যে নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং চেতনার সমন্বয়ে সৃষ্ট অনুভূতি এসে জমা হয়। তখন কবির দায়িত্ব হয় তার “ব্যাক্তিসত্ত্বা”-কে যথাসম্ভব দূরে রেখে সেই অনুভূতিগুলোকে পাঠকের জন্যে উপস্থাপন করা। যখন ব্যাক্তিসত্ত্বা লেখনীতে প্রায় ঊহ্য থাকবে, তখন তা সার্বজনীন হবে, সবাইকে স্পর্শ করবে। ব্যাক্তি অনুভূতিতে ভারাক্রান্ত কবিতা বেশীরভাগ সময় কবিতাই হয়ে ওঠে না।
হতে পারে যে কবি এমন একটি বিষয় তিনি তার কবিতায় উপস্থাপন করছেন যা খুবই সময়োপযোগী এবং তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু ব্যাক্তিগতভাবে কবিকে সেই বিষয়টা একদমই আকর্ষণ করে না। উদাহরণস্বরূপ একজন কবি যার কবিতায় মূলত মানব-মানবীর প্রেম তুলে আনতে পছন্দ করেন, তিনি তার দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে একটি রাজনৈতিক কবিতা লিখতেই পারেন। তার সৃষ্টি সেই কবিতাটিও একটি মহৎ কবিতা হয়ে উঠতে পারে , কিন্তু এটা বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে না যে তাকে ব্যাক্তি অনুভূতির জায়গা থেকে অনুভব করেই লিখতে হবে কবিতাটি। এমন ক্ষেত্রে কবি নিজের সত্ত্বাকে ছাপিয়ে হয়ে ওঠেন সমাজের বা সময়ের কণ্ঠস্বর।
ঠিক তেমনিভাবে একজন কবি বা লেখককে নূতন- চমকপ্রদ সব অনুভূতিসম্পন্ন কেচ্ছাকাহিনী মাটি খুঁড়ে বা আকাশ ফুঁড়ে আবিষ্কার করতে হবে- এমনও নয়। খুব সাধারণ একটি বিষয় নিয়েও যথাযথ আবেগের স্ফুরণে কালজয়ী একটি কবিতা লেখা যায়।
এলিয়টের আগে যে রোম্যান্টিক কবিতার মুভমেন্ট, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন কবিতা হচ্ছে “প্রকৃতির নিসর্গ হতে আহরিত শান্ত আবেগের প্রস্ফুরণ” (ইমোশনস রিকালেক্টেড ইন ট্রাঙ্কুয়ালিটি)। এলিয়ট শক্তভাবে দাবী করেন এটা কবিতার সবেচেয়ে অপরিপক্ক ফর্মুলা। কারণ কবিতা মোটেও হঠাৎ চলে আসা অপরিপক্ক আবেগের ভুরভুরে বহিঃপ্রকাশ হতে পারে না, বরং আবেগকে “কনসানট্রেট” করে, তথা চাপিয়ে, কমিয়ে, ছাঁটাই করে একদম মেদহীন ঝরঝরে আকৃতিতে এনে কবিতায় প্রয়োগ করতে হয়।
পরিশেষে এসে এলিয়টের সাথেই কণ্ঠ মিলিয়ে বলা চলে, কবিতা ব্যাক্তিসত্ত্বার প্রকাশের স্থল নয়, বরং ব্যাক্তিসত্ত্বাকে আড়াল করবার মাধ্যম। কিন্তু এই কাজটি সবার দ্বারা সম্ভব হয় না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আনাড়ি কবির অপটু হাতের লেখায় কবিতা একটি আর্ট ফর্ম হয়ে ওঠার বদলে ব্যাক্তিতান্ত্রিক স্লোগানে পরিণত হয়। দক্ষ কবি এবং প্রকৃত কবিসত্ত্বার ধারক-বাহক যিনি, তিনিই এই ক্ষুদ্রতার পরিসীমা অতিক্রম করে যেতে পারেন। এই শ্রেণীর মহৎ কবির কবিতাই আমরা যুগে যুগে, কালে কালে পাঠ, প্রশংসা ও পর্যালোচনা করি।
১৬ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৪৫
সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: প্রিয় মইনুল ভাই, প্রথমেই ধন্যবাদ দিই লেখাটি পড়ার জন্যে।
লেখাটি মূলত টি এস এলিয়টের ট্র্যাডিশন অ্যান্ড দা ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট - প্রবন্ধটির সারাংশ, উল্লেখ করেই দিয়েছি তা লেখার শুরুতেই । বাংলায় অনূদিত করার পর কিছুটা আমার মত করে সাজিয়ে নিয়েছি।
সামুতে প্রবন্ধ রচনায় সিদ্ধহস্ত অল্প সংখ্যক গুণী ব্লগারদের একজন আপনি। আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমার নিজেরও ভালো লাগছে খুব।
শুভকামনা রইল।
২| ১৬ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৫৭
মাঈনউদ্দিন মইনুল বলেছেন: //...একজন কবি যার কবিতার বিষয়বস্তু মূলত মানব প্রেম, তিনি যে দেশে বাস করেন, তার রাজনৈতিক অস্থিরতায় একটি রাজনৈতিক কবিতা লিখতেই পারেন, সেই সৃষ্টিকর্মটিও মহৎ হতেই পারে , কিন্তু এটা বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে না যে তাকে ব্যাক্তি অনুভূতির জায়গা থেকে অনুভব করেই লিখতে হবে কবিতাটি। এমন ক্ষেত্রে কবি নিজের সত্ত্বাকে ছাপিয়ে হয়ে ওঠেন সমাজের বা সময়ের কণ্ঠস্বর।//
চমৎকার। কথাগুলো আজও কত বাস্তব এবং কালোপযোগী!
জানিনা লেখাটি আমাদের মাননীয় সঞ্চালকের দৃষ্টিতে পড়বে কিনা। পড়ার কথা...
১৬ ই মে, ২০১৫ রাত ৯:৫২
সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: এলিয়টের লেখনী নিঃসন্দেহে কালোত্তীর্ণ, প্রিয় মইনুল ভাই।
সঞ্চালকের দৃষ্টিতে পড়ুক। সঞ্চালকের দৃষ্টি পড়লে ভালোই লাগে ! :প
পুনরায় শুভকামনা।
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৩২
মাঈনউদ্দিন মইনুল বলেছেন: টি এস ইলিয়টের ট্রাডিশন এন্ড ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’র কথা মনে করিয়ে দিলেন, বেশ জুতসই ভাবে। লেখাটি চমৎকার হয়েছে আবির। এরকম লেখা প্রায় অনুপস্থিত। অথচ ব্লগেই এরকম লেখার বেশি প্রয়োজন।