নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কখনও আমি অথবা আমার মন অথবা আমরা দুজন মিলে অনুসন্ধান করে বেড়াই সত্য ও সুন্দরের; যা শুধু গুটিকয় মানুষের স্বার্থের জন্য নয়, বরঞ্চ এই সমগ্র মানবতার জন্য।

আবীরের ঘোড়া

আবীরের ঘোড়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিক্ষক কাকে বলে?

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৭ ভোর ৪:৫৩

শিক্ষকের তত্ত্বীয় সংজ্ঞাঃ
১। যিনি ছাত্রদের ভেতরের শক্তিকে অনুধাবন করতে পারেন। সেই শক্তিকে এমনভাবে বিকশিত করার চেষ্টা করেন যা তার সমস্ত জড়তাকে ভেঙ্গে স্বপ্নযাত্রার সূচনা ঘটায়।
২। যিনি পথে হাঁটতে শেখান, গন্তব্য দেখানো যার কর্ম নয়।
৩। তিনি সিদ্ধান্ত দেন না বরঞ্চ শেখান কত কত ভিন্ন উপায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
৪। যিনি সীমাবদ্ধতাকে নয়, সম্ভাবনাকে প্রাধান্য দেন।
৫। বই নয় যিনি বাস্তবতাকে মুখোমুখি করবার সাহস দেখান।

তত্ত্ব ছেড়ে গল্পেঃ আমাদের এবারের জীবনগল্পের নাম- ওদের শিক্ষক

পর্বঃ শক্তি অনুধাবন
রানা, শিপু আর শফিক মিলে কিছু একটা খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছে মাঠের এক পাশে। রাশেদ স্যার দূর থেকে বিষয়টি টের পেয়ে যেই কাছে আসতে শুরু করলেন তখন তাকে দেখতে পেয়েই তিনজন দিল ছুট। স্যার সামনে এসে দেখলেন তারা এক ফুট চওড়া ও দৈর্ঘ্যের ছোট্ট একটি গর্তে পানি দিয়ে ভর্তি করছিল। বিষয়টা উনি বুঝতে পারলেন না, এইটা কি কোন খেলা তারা খেলছিল, নাকি কিছু একটা বানাতে চেষ্টা করছে! উনি চলে গেলেন।

পরদিন চতুর্থ শ্রেণীর ক্লাশে এসে প্রথমেই ঐ তিনজনকে দাঁড় করিয়ে বললেন, তোমরা ক্লাশ শেষে আমার সাথে দেখা করবে। তিনজনের মনেই বেশ একটা আতঙ্ক কাজ করছে , একবার ভাবছে ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে বাড়িতে চলে যাবে।

শিপু -ধরা তো খেয়ে গেছি, এখন পালালে আরও বিপদ।
শফিক- না পালানো যাবে না, কেননা রাশেদ স্যার রাগলে নাকি বেত ভেঙ্গে ফেলেন।

অগত্যা তারা খুব ভয়ে ভয়ে উনার রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালো। স্যার ওদেরকে ভেতরে আসতে বললেন।

রাশেদ স্যার- তোমরা কাল কি করছিলে মাঠের ঐপাশে?
রানা- স্যার, আমি কিছু করি নাই, শুধু পানি এনেছি।
রাশেদ স্যার- কেন পানি এনেছ?
শিপু- স্যার, আমরা একটা পুকুর বানানোর চেষ্টা করছিলাম।

রাশেদ স্যারের হাসি পেলো উনি হাসলেন না।

রাশেদ স্যার-পুকুর বানিয়ে কি করবে?
শফিক- বাসায় মাঝে মাঝে জ্যান্ত চিংড়ি আনে, ওগুলা এনে এখানে ছাড়বো ।
রাশেদ স্যার- পুকুর কি হলো?
তিনজন একসাথে বলে উঠলো, না স্যার।
শিপু- পানি শেষ হয়ে যাচ্ছিল বারবার।
রাশেদ স্যার- পানি কেন শেষ হচ্ছিল কিছু বুঝতে পারলে?
রানা- না স্যার সেইটাই তো আমরা ধরতে পারছি না।

পর্বঃ সম্ভাবনার বিকাশ
রাশেদ স্যার তাদের তিনজনকে সাথে করে স্কুল শেষে ধানের মিলে নিয়ে গেলেন। সেইখানে একটা চৌবাচ্চা দেখিয়ে বললেন, ´এইখানে পানি আছে? তোমরা যেখানে গর্ত করেছো সেইখানকার বেলে মাটির মধ্য দিয়ে খুব সহজেই পানি নিচের দিকে চলে যায়। মাটিতে যদি এই চৌবাচ্চার মতন পানি শুষে নিতে দেয় না এমন কোন উপাদান থাকে তবে আর পানি বের হতো না। ওইধরনের মাটিকে দোআঁশ মাটি বলে। ও আরেকটা কথা পানি কিন্তু বাষ্প হয়েও বায়ুর সাথে মিশে যায়, তাই পরিমান অল্প হলে খুব দ্রুত পানি শেষ হয়ে যাবে।´

পর্বঃ হাটতে শেখা
রানা, শিপু আর শফিক খুব খুশি। স্যার তাদেরকে তো বকলেন ই না বরঞ্চ সাথে করে বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে পুকুর বানাতে হয়। আজ ওদের মাথায় নতুন একটা বুদ্ধি এসেছে। ওরা নৌকা বানাতে চায়। নৌকা করে এইবার তারা বর্ষায় ঘুরবে। কিন্তু স্যারের কাছে বিষয়টা আগে শিখে নেয়া যাক। তারা ক্লাশ শেষে স্যারকে বলল, ´স্যার আমরা একটা নৌকা বানাতে চাই।´ রাশেদ স্যার বললেন, ´এইটা তো খুবই ভালো কথা কিন্তু তোমরা কি সাঁতার জানো? সবাই একসাথে বলে উঠলো, না স্যার।
রাশেদ স্যার- তাহলে আগে সাঁতারটা শিখে নাও, তারপর না হয় এসো আমার কাছে আমি শিখিয়ে দিবো কীভাবে নৌকা বানাতে হয়।

পর্বঃ সিদ্ধান্ত
তিনমাস পরে এসে তিনজন বলল, ´স্যার আমরা সাঁতার শিখে ফেলেছি। এইবার আপনি বলেন আমরা কীভাবে নৌকা বানাবো।´ স্যার ওদের সাঁতার শেখার ঘটনায় বেশ অবাক হলেন। তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাদেরকে নৌকা বানানোর কারখানায় নিয়ে যাবার পথে জিজ্ঞেস করলেন, ´নৌকা বানাতে তো তোমাদের অনেক কিছু কিনতে হবে টাকা আছে?´ সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতাকি করলো, নিরুত্তোর হয়ে মাথা নিচু করে হাটতে থাকল। একবার মনে হলো তারা আর যাবে না স্যারের সঙ্গে। শিপু তো লজ্জায় বলেই উঠলো, ´তাহলে আমরা সবাই টাকা জমিয়ে এরপর যাই?´ স্যার তখন বললেন, ´পুরো প্রক্রিয়াটাকে তোমাদের দেখা উচিৎ। এরপর সিদ্ধান্ত নিও।´

পর্বঃ বাস্তবতা
সে যাত্রায় এতো জটিলতা দেখে নৌকা বানানোর উদ্যোগ তারা বাদ দেয়। তারপরের দিন থেকেই তিনজন মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা টাকা জমানো শুরু করবে নৌকা কিনতে। স্কুলের টিফিনের টাকা তারা জমাতে শুরু করলো। গ্রীষ্মের ছুটির আগে তারা তাদের জমানো টাকা নিয়ে এসে গুনতে শুরু করে দেখল মোট ১৮০০ টাকা হয়েছে। লাগবে কমপক্ষে ৫০০০ টাকা। কিন্তু তিনজনে গ্রীষ্মের ছুটিতে কোথাও না গিয়ে সেই টাকাটা চেয়ে নেয় তাদের পরিবারের কাছ থেকে। পরিবার শর্ত দেয়, এক শর্তেই তারা কেবল টাকাটা নগদ দিবে যদি এর বিনিময়ে তারা গণিত বইটা শেষ করে ফেলতে হবে গ্রীষ্মের ছুটিতে। অনেক কষ্টে খেলা মাটি করে তারা গণিত বইটা শেষ করেছিলো। বন্যার পানি আসার কয়েকদিন আগে রানার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাটা কিনে ফেলে ওরা। কিন্তু রাশেদ স্যারকে জানায় না। ভাবে স্যারকে একটা সারপ্রাইজ দিবে।

পর্বঃ সাহস
সে´বার বন্যার পানিতে ভেসে গেলো বেড়িবাঁধের বাইরের গ্রামগুলা, স্কুল বন্ধ করে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়। আরও অনেক স্বেচ্ছাসেবী দরকার ছিল আশেপাশের এলাকাগুলো থেকে বৃদ্ধ মানুষগুলোকে নৌকা করে নিয়ে আসবার জন্য। রানা, শিপু আর শফিকসহ আরও ২০ জনের মতন রাশেদ স্যারের কাছে এলো স্বেচ্ছাসেবীর খাতায় নাম লিখাতে। কিন্তু শর্ত এলো, সাঁতার জানতে হবে, নতুবা এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে উনি কোন ছাত্রকেই যেতে দিবেন না হোক সে যতই মহৎ কাজ। তাই রানা, শিপু, শফিকসহ পঞ্চম শ্রেণীর আরও ২ জন সাঁতার জানা ছাত্রকে নিয়োগ দেয়া হয়। রাশেদ স্যার ৫ জনকে ডেকে বললেন, আমাদের এই কাজে অনেকগুলা নৌকা লাগবে কিন্তু আমাদের হাতে যে কয়টা নৌকা আছে তা যথেষ্ট নয়। তাই তোমরা যদি কারও কাছ থেকে একটা নৌকা ব্যবস্থা করতে পারতে তবে খুব ভালো হতো।

পর্বঃ স্বপ্নযাত্রা
পরদিন সকালে ওরা ৩জন নৌকা নিয়ে হাজির হয় স্কুলের মাঠে। রাশেদ স্যার নতুন নৌকা দেখে অবাক, ´কোথায় পেলে এই নৌকা। কারো জিনিস চুরি করা অন্যায়; কারো উপর অন্যায় আর অবিচার করে কখনও মহৎ কাজ করার চেষ্টা করো না। সেইটা কখনই মঙ্গল বয়ে আনে না।´ রানা আর ত্বরা সইতে না পেরে সব খুলে বলল। রাশেদ স্যার সেদিন ওদের নৌকা দেখে এতো খুশি হয়েছিলেন যে ওদেরকে ধরে কেঁদে দিয়েছিলেন। তারা সর্বসাকুল্যে ৫০ জন বৃদ্ধকে নৌকা যোগে নিয়ে এসেছিল আশ্রয়কেন্দ্রে, আর তাদের দেখাশুনা করেছে স্যারদের সাথে।

সেদিনের সাঁতারটা না জানলে এমন একটা ভালো কাজ তারা কখনই করতে পারতো না- তাই মনে মনে স্যারকে অনেক ধন্যবাদ দেয় ওরা। স্যার ভাবছিলেন সেদিন যদি ক্লাশে ওদের ধমক দিয়ে নিরুৎসাহিত করতেন তবে এতো বড় মহৎ কাজ ওরা কখনই করতে পারতো না। ভাগ্যিস রাগটা সে যাত্রায় নিয়ন্ত্রণে ছিল। এমন নানারকম ভাবনায় মিটিমিটি হাসতে হাসতে সাইকেল বের করলেন রাশেদ স্যার। এরপর প্যাডেল মেরে ছুটে চললেন সোজা রাস্তাটা ধরে সূর্য যেদিকে ডুবে ঠিক সেই দিকটায়।


মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.