নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি আজাড় মানুষ। নিজেকে আবিষ্কারের নেশায় নেশাগ্রস্থ।

জিসান অাহমেদ

একজন কসমিক ট্র্যাভেলার, মহাজাগতিক মুসাফির।

জিসান অাহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মানুষ হত্যাকান্ডের দৃশ্য ভিডিও করার সংস্কৃতি

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১০:০৪



১.
হেমন্তের পড়ন্ত বিকাল।অারিফা চাঁদপুর বড়স্টেশনের রক্তধারার পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় দশ মিনিট ধরে বিবাগী হয়ে পায়চারি করছে।সূর্য পশ্চিম অাকাশে হেলে পড়ে নীল অাকাশের ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে ঘুমিয়ে যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছে।সিঁদুর রাঙা মেঘ জমেছে দিগন্তের গায়।এই মায়াময় আলোর বিকালে দূরদিগন্তে নীল আকাশ নুয়ে এসে মিশে গেছে মেঘনার বুকে।নদীর ঢেউগুলো অলসভাবে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তীরের ছোটবড় বৃক্ষরাজিকে।পানিতে সাদা বক অার পানকৌড়িরা স্নান করছে অাপন মনে।নদীর অথৈ জলরাশির কলকলধ্বনি অার হাওয়া বয়ে যাওয়ার সোঁসোঁ শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই।এখন অারিফার মৌনভঙ্গ করে হাজারো কথার ফুলঝুরি ফুটাতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু পঁচিশ মিনিট হয়ে গেল অয়ন এখনও অাসছে না।অারিফার অার তর সইছে না।দীর্ঘ তিন বছর পর অাজ অয়নকে দেখতে পাবে ভেবে গতকাল রাতে সে ঠিকমত ঘুমাতেই পারি নি।সে রাতভর অয়নকে নিয়ে ভেবেছে।অয়ন নিশ্চয়ই অাগের চেয়ে অনেক বেশি রোগা হয়ে গেছে -এ রকম হাজারো বিমর্ষ কথা তাঁর ভাবনার অবনিতে উঁকি দিচ্ছিল প্রতিনিয়ত।অয়নের অাসতে বিলম্ব দেখে সে রেগে অনেক ক্রোধ নিয়ে নদীর তরঙ্গায়িত জলরাশিতে ছোট ছোট পাথরের টুকরা ছুঁড়ে মারছে।দক্ষিণা সমীরণের শিরশির স্পর্শ তাঁর ত্বকে আদুল এক অনুভূতির সৃষ্টি করছে অার তাঁর হালকা সোনালি-কৃষ্ণ বর্ণের কেশগুচ্ছ মৃদু দুলছে।সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে অাজ অয়নের সাথে অাড়ি, তাঁর সাথে কোনো কথাই বলবে না।

২.
অয়ন, রায়হান ও নেহালকে প্রস্তুতি নিতে দেরী করার কারণে বকা দিচ্ছে।অয়নের ভাল বন্ধু ওরা দু'জন।অয়ন ওদের কথা দিয়েছিল অারিফা ঢাকা থেকে গ্রামে এলে ওর সাথে নিশ্চয়ই পরিচয় করিয়ে দিবে।এ থেকেই ওদের অাজ সঙ্গে নিয়ে যাওয়া।অবশেষে ওরা প্রস্তুতি শেষ করে একটি সিএনজি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।অার সাথে করে তিনজনই ওদের দামী মোবাইল ফোন নিয়ে নিয়েছে ছবি উঠানোর জন্য।অয়ন ভাবছে অারিফা নিশ্চয়ই অনেক রেগে অাছে।তাই সে সাথে করে ওর পছন্দের এক গুচ্ছ শিউলি ফুল নিয়ে নিয়েছে।সে জানে ও শিউলি ফুল দেখে নিশ্চয়ই রেগে থাকতে পারবে না।বিশ মিনিটের মধ্যে সিএনজি রক্তধারায় গিয়ে থামল।অয়ন দেখতে পেল অারিফা নদীর দিকে বিষন্ন মনে তাকিয়ে অাছে।ওর চোখে মুখেও রাগের ছাপ স্পষ্ট।সে কিছু নাই বলেই অারিফার সামনে ফুলগুলো এগিয়ে দিল।অারিফা অনেক ক্রোধ নিয়ে ফুলগুলো গ্রহণ করে বলতে থাকে,

-অারিফাঃ এখন কয়টা বাজে ?
-অয়নঃ স্যরি, অাসলে হয়েছি কি.....
অয়নের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে অারিফা বলতে থাকে,
-অারিফাঃ থাক, অনেক হয়েছে।এতে ভয় পাওয়ার কী অাছে ? ঐ বাঁদরগুলো কে ?

অয়ন অারিফার এ কথা শুনেই খিলখিল করে হাসতে থাকে।অয়নের এই রোদ্দুর হাসি অারিফা সবসময়ই বেশ উপভোগ করে।বাদলা দিনে তাঁর ভেজা মনকে ওর রোদ্দুর হাসি রোদে ঝলমলে করে দেয়।অারিফার যতই মন খারাপ থাকুক না কেন ওর হাসি শুনলে মন ভাল হয়ে যায়।বাতায়ন খুলে হাত বাড়িয়ে দেয় বাইরের বাতাবরণে।একটু একটু ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে ও তাঁর হাত ছুঁয়ে যায়।সে দু'চোখ বন্ধ করে জগৎ -এর সব ভুলে গিয়ে ওর ছোঁয়া অনুভব করে।অয়ন হাসি থামিয়ে অারিফার সাথে রায়হান ও নেহালকে পরিচয় করিয়ে দেয়।তারপর রায়হান ও নেহাল বিকালের রঙিন অাভায় ছবি তুলা নিয়ে মেতে উঠে।অার এদিকে অয়ন ও অারিফা তাঁদের দীর্ঘ দিনের অব্যক্ত কথা একের পর এক বলতে থাকে।

৩.
অয়ন এক পর্যায়ে অারিফাকে অাকাশ দেখিয়ে বলে,
-অয়নঃ তুমি একফালি আকাশ, অার অামি এই অাকাশে ভুল করে ঢুকে পড়া একটি শঙ্খচিল।
-অারিফাঃ মানে কী ?
-অয়নঃ তোমাকে নীলাম্বরীর মত দেখাচ্ছে।যার মধ্যে কিছু শুভ্র মেঘ আনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।আর আমি হচ্ছি এই মেঘের ভিতর অযাচিতভাবে ঢুকে পরা একটি চিল।
-অারিফাঃ তুমি আমাকে এত ভালোবাস কেন ? অামাকে কখনো ছেড়ে যাবে নাতো ?
-অয়নঃ না, কখনো না।দরকার হয় তোমাকে নিয়ে কোনো এক নির্জন দ্বীপে, কোনো এক গহীন অরণ্যে যেখানে ঝর্ণার ধারে বসে জঙ্গলের পাতায় পাতায় সূর্যের আলো বিলীন হওয়া দেখবো কিংবা কোনো এক অামলকির বনে ঝরা পাতায় শুয়ে গাছদের গোপন কথায় আড়ি পাতবো।সবুজ ঘাসে চিৎ হয়ে শুয়ে উপরের নীলাম্বরী দেখবো।শুভ্র মেঘ দেখবো।সেখানে
আমাদের মতো অামরা বাঁচবো।কেউ অামাদের বলতেও পারবে না, তোমরা কে ?

অারিফা অয়নের এ ভালবাসা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না।তাঁর চোখ থেকে টলমল করে অশ্রুর ফোয়ারা ঝরে পড়ছে বৃষ্টি হয়ে।তাঁরপর সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে অয়নকে বলতে থাকে,

-অারিফাঃ আমি এখনও বাতায়ন খুলে তোমার পথ চেয়ে থাকি, বাতাসে কান পেতে থাকি, যদি
তোমার ডাক শুনি ! বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টিপূর্ব মায়াময় গন্ধে তোমাকে খুঁজি।ভেজা বাতাস, অামার ভেজা মন অস্থির হয়ে যায় তোমার কারণে ! বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব কিন্তু মোহনীয় জলসুরের ছন্দে ছন্দে ঝরে যাবার আগে আমার সাথে সাথে যেন তোমার অপেক্ষায় ক্ষণ গুনছে, সব নিশ্চুপ হয়ে যায়।জানালার পাশের গোলাপ ফুলগুলোও যেন সৌরভ ছড়ায় না, তুমি অাসবে বলে।কিন্তু আমি ধৈর্যচ্যুত হয়ে যাই তোমাকে না দেখে।অনেক বেশি বিবাগী হয়ে যাই তোমার রিক্ততায়।অনেক ভালবাসি তোমায়, অনেক বেশি।

৪.
এ কথা বলতেই অারিফার গলা ধরে অাসে।সে অার কিছু বলতে পারে না।অয়নও প্রায় বাকহীন।কিছুক্ষণ পর রায়হান ও নেহাল এসে তাঁদের নীরবতা ভাঙ্গায়।তখন পশ্চিম অাকাশে সূর্য হেলে পড়েছে প্রায়।অয়ন বলল সন্ধ্যা নেমে অাসবে কয়েকমিনিটের মধ্যেই, এবার অামাদের সবাইকে যেতে হবে।তারপর সবাই মিলে হাঁটতে হাঁটতে রক্তধারার সামনে চলে অাসে।ঠিক যখনই তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের স্তৃতিস্তম্ভ রক্তধারা অতিক্রম করবে, তখনই ধারালো চাপাতি হাতে এক যুবক তাঁদের পথ রুদ্ধ করে দেয়।যুবকটি অারিফার হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে।অয়ন ও তাঁর বন্ধুরা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলে যুবকটি হুমকি দেয়, যে সামনে অাসবে তাঁকেই শেষ করে দিবে।এই বলে যুবকটি অারিফার মাথায়, চোখে, মুখে ও গলায় নৃশংসভাবে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে।অারিফা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকে।কিন্তু অয়ন ও তাঁর বন্ধুরা ভয় পেয়ে যায়।অারিফাকে বাঁচাতে কেউই এগিয়ে যাচ্ছে না।রায়হান তাঁর মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে এই নৃশংস দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করতে থাকে।রায়হানকে দেখে দেখে অয়ন এবং নেহালও অারিফার মৃত্যুর দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করা শুরু করে।তাঁদের দেখে দেখে রক্তাধারায় ঘুরতে অাসা অন্যান্য লোকজনও অারিফার নৃশংস হত্যাকান্ডের করুণ দৃশ্য ভিডিও করতে থাকে।তাঁদের একেক জনকে মনে হয়েছে ফটোগ্রাফার, অার তাঁরা যেন কোনো সিনেমার শোটিং স্পটে ভিডিও করছে।কিন্তু অারিফাকে বাঁচাতে কেউই এগিয়ে যায় নি।কিছুক্ষণের মধ্যেই অারিফার জীবন্ত দেহ লাশ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।অার এভাবেই অয়ন অারিফার ভালবাসাকে মোবাইলে ধারণ করে পূর্ণতা দেয়।দীর্ঘদিনের প্রেম, কিছুক্ষণ অাগের অারিফার নীলাম্বরীতে শঙ্খচিল হওয়া ও গভীর অরণ্যে সূর্য বিলাস করা এ সবই সামান্য চাপাতির সামনে মাথা নত করে।অার মৃত্যু ঘটে প্রকৃত মনুষত্ববোধের।সেই সাথে মানবিকতাবোধ ও ভালবাসার পরিধি নির্ধারিত হয়ে যায় মোবাইলে ধারণকৃত কয়েকমিনিটের ভিডিওতে যেখানে হত্যাকারীর ছবি দেখা যায়।অয়ন ও ঘটনাস্থলে উপস্থিত মানুষের কাছে অারিফার জীবনের চেয়ে তাঁর হত্যাকারীকে বেশি মূল্যবান মনে হয়।অয়ন ও তাঁর বন্ধুদের কাছে ভালই লাগছে হত্যাকারীকে ভিডিও করতে পেরে।তাঁরা এই ভিডিও ফেসবুক, ইউটিউব ও বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় পাঠিয়ে জীবন রক্ষার তকমা পেয়ে যায়।সরকার, রাষ্ট্র, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও দেশের হলুদ মিডিয়ায় তাঁদের নিয়ে হৈচৈ শুরু করে দেয়।তাঁদেরকে দেশ সেরা সাহসী সন্তান হিসেবে অাখ্যা দেওয়া হয়।

৫.
ঠিক অারিফার এই হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শীদের মতো এ রকম হাজারো অারিফার জীবন না বাঁচিয়ে অামরাও অাজ ভিডিও তোলার সংস্কৃতিতে মরিয়া হয়ে উঠেছি।মানুষের মৃত্যুকে অামরা বেশ ভালভাবেই উপভোগ করছি।জীবন রক্ষার চেয়ে হত্যাকারীর ভিডিও ধারণ করাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।ঠিক অয়নের মত অামরাও অামাদের প্রিয়জনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছি।মানুষ হত্যার ভিডিও করার সংস্কৃতি চর্চা যে হারে বাড়ছে, অনতিবিলম্বে অামাদের নিজেদেরকেই বাবা, মা, ভাই, বোন ও প্রিয়জনের মৃত্যু দৃশ্য ভিডিও করতে হবে।যদি এমনটা নাও ঘটে, অন্তত অামাদের এটা নিশ্চিত থাকতে হবে যে অামাদের প্রিয়জনকে না বাঁচিয়ে তাঁদের মৃত্যু দৃশ্য অন্য কেউ ঠিকই ভিডিও করবে।তা না হলে অামরা খাদিজা বেগম, বিশ্বজিৎ ও রাজনের মৃত্যুর এবং টিএসসিতে বোনের শ্লীলতাহানির ভিডিও ধারণ না করে তাঁদের জীবন রক্ষায় ভূমিকা রাখতাম।তাই অামাদের এ অপসংস্কৃতি থেকে শীঘ্রই বেড়িয়ে অাসতে হবে।

[বি.দ্র. অারিফা হত্যার গল্পটি সম্পূর্ণ ফিকশনাল।]

[প্রথম প্রকাশঃ ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৬ খ্রিঃ, ফেসবুকে]

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৫:১০

বিলুনী বলেছেন: পুরা দৃশ্যটাকে অনেক সময় নিয়ে পরম মমতায় যারা ভিডিউ করছে তাদের মানসিকতা কোন পর্যায়ে পড়ে !!! নিশ্চয়ই তারা মহামানবকেও গিয়েছেন ছাড়িয়ে !!!!

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১:০৮

জিসান অাহমেদ বলেছেন: যেদিন নিজেরা এই পরিস্থিতির শিকার হবে সেদিন এরা নিশ্চয়ই টের পাবে সবকিছু।নিরন্তর শুভেচ্ছা রইল।অামি ব্লগে ও লিখালিখিতে একেবারেই নতুন।দোয়াপ্রার্থী।অাপনার মতো ব্লগারের মন্তব্য পেয়ে অামি সত্যিই বেশ পুলকিত।ধন্যবাদ।

২| ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৫:১৬

বিলুনী বলেছেন: লিখাটা শেষ করার আগেই অসর্তকতার কারনে মন্তব্য প্রকাশ বাটনে চাপ লেগে এটা চলে যায় সাবমিশনে । যাহোক, সচেতনমুলক এ পোস্ট লিখকের প্রতি রইল আভিনন্দন । লিখাটি পাঠে সকলের মাঝে সঠিক কর্মের অনুভুতিটা আসুক ফিরে এ কামনাই করি ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.