নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানস চোখ

\"আক্ষি মুদিয়া দেখ মনরে...... আক্ষি মুদিয়া...!!\"

মানস চোখ

ধ্যান ও ধান্ধা একই সঙ্গে চালানোতে চেষ্টারত...... কিন্তু ধ্যানে মনোযোগী কম......আর ধান্ধায় পারদর্শী নই...

মানস চোখ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অলীক-দর্শনঃ একটি আধা-ভৌতিক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

১১ ই মার্চ, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৪



এক

আমি আর লিয়াকত চাচা সকাল দশটার মধ্যে বেড়িয়ে পরতে প্রস্তুত হয়ে যাই। মেজবান বাড়ীর কর্তা আমাদের কে বার বার বারণ করে এই পথে যেতে, তিনি আমাদেরকে জেলা শহর হয়ে যাওয়ার কথা বলে। এই রাস্তা সম্পর্কে আমরা নিজেরা কিছুটা জানতাম তারপরেও পুরাপুরি স্বচ্ছ ধারণা ছিল না কারণ আমরা কখনো ওই রাস্তায় যাই নাই, শুধু জানতাম ডাকাতির ভয় ছাড়াও আরও কি যেন ভয়-ভীতি ঐ রাস্তায় হয়ত আছে শুধু এইটুকুই জানতাম। কিন্তু জেলা শহর হয়ে যাওয়া মানে আবার বাড়ীতে যাওয়া আর বাড়ীতে গেলে বাবা নাও যেতে দিতে পারে, এই ঝুঁকি এড়াতে আমরা এই ঝামেলাযুক্ত পথেই যেতে আগ্রহী হয়েছি।



লিয়াকত চাচা আমার আব্বার চাচাতো ভাই, উনি আমাদের সাথে শহরের বাড়ীতে থেকে কলেজে পড়ে। এই ঘটনার সময়-কাল আশির দশকের শুরুতে, তখন গ্রামের দিকে তেমন কলেজ ছিলনা বলে আব্বা লিয়াকত চাচাকে শহরে এনে ভর্তি করেছে। আমি তখন মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ি। চাচাকে খুব পছন্দ করি। উনার একটা ছোট রেডিও ছিল, আব্বা যেন দেখতে না পায় এই জন্য উনি প্রায় সময়ে রেডিওটা লুকিয়ে রাখত, আমাদের ভাই বোনদের ব্যাপক আগ্রহ ছিল ওই রেডিওর প্রতি। এ ছাড়াও তাকে পছন্দ করার আরো কারণ হল উনি মাঝে মাঝে কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখত আর দেখে আসা সিনেমার গল্প গুলো বলত।

দুই দিন হল আমরা লিয়াকত চাচার নানার বাড়ীতে (তার মামার শশুর বাড়ী) বেড়াতে এসেছি আর এখান থেকেই আমাদের গ্রামের বাড়ীতে যাওয়ার পরিকল্পনা, যদিও জেলা শহর হয়ে যাওয়াই সহজ, দূরত্ব বেশী হলেও আমরা না হেঁটে বাস ও বেবী টেক্সিতে যেতে পারতাম, কিন্তু আমাদের পরিকল্পিত রাস্তায় দূরত্ব কম হলেও একটা বড় অংশই আমাদের হেঁটে যেতে হবে, তার পরেও আমরা এই রাস্তাতেই যেতে আগ্রহী, কারণ পরদিন আমাদের গ্রামে মেলা, এই উপলক্ষে ব্যাপক মজা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে তা থেকে নিজেদের একটুও বঞ্চিত করা যাবে না।



দুই

মেজবান বাড়ীর লোকজনের শত বারণ ও বিভিন্ন ভয় ভীতি সত্যেও আমরা তারাতারি বেড়িয়ে পড়লাম আর তাদেরকে আশ্বস্ত করে গেলাম যে আমরা যে সময়ে রওনা দিচ্ছি তাতে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বাড়ীতে পৌঁছাতে পারব। আমাদের যাত্রা পথ বগুড়া-নগরবাড়ি মহাসড়ক ধরে এক ঘন্টার বাস যোগে পাশের উপজেলা তার পরে প্রায় ২ ঘণ্টার নৌকা যোগে নদী পারাপার হয়ে ৭/৮ মাইল হাঁটা পথ। আমরা যে সময়ে রওনা দিলাম তাতে সহজেই সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ীতে পৌঁছান যেত কিন্তু বাস থেকে নেমেই এইদিক দিয়ে আসার জন্য চাচার আরও আগ্রহের কারণ টের পেলাম :)। আমাকে বলল চল আমরা সিনেমা দেখে যাই এখানে সিনেমা হলে ‘ওয়াসিম আর অঞ্জু ঘোষ’ অভিনিত হিট ছবি চলছে। তখন হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সুযোগ পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া :) তাই এই সুযোগ সদ্ব্যবহার করতে সামনে পেছেনে কোন কিছু চিন্তা না করে আমরা সিনেমা হলে ঢুকে গেলাম। ইত্যিমধ্যে সিনেমা মনে হয় মিনিট তিরিশেক চলে গেছে, কিন্তু তাতে কি আসে যায়, বিরতির সময়ে আশে-পাশের লোকজনের কাছে শুনে নিলেই চলবে :)। আসলে সিনেমা হলে ঢুকে আমরা যে কি ভূল করলাম তা আগে জানলে কক্ষনই সিনেমা হলে ঢুকতাম না।



সিনেমা শেষ করে যখন হল থেকে বের হলাম তখন মোটামুটি বেলা তিনটার মত বেজে গেছে। হালকা কিছু খেয়েই তারাতারি নৌকা ঘাটের দিকে ছুটলাম। কিন্তু বিধি বাম, খেয়া নৌকা পেতে আমাদের প্রায় ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করতে হল।শীত কাল শুরুর দিকে তাই বিকেলের দৈর্ঘ্য বেশ কম, আমরা ভয় পেলাম যে এখনি ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে যাবে। কি আর করা, অবশেষে যখন আমরা নদী পাড় হয়ে শিবরামপুর হাটে এসে নামলাম ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।



তিন

ঐদিন হাটবার ছিল না, তাই হাটে তেমন কোন লোকজন নাই। নৌকাতেও তেমন লোক-জন ছিল না, আমরা সহ ৪/৫ জন ছিল তারা হাটের দিকে না গিয়ে হাটের সামনের রাস্তা দিয়ে হাট সংলগ্ন শিবরামপুর গ্রামের দিকে চলে গেল। আমরা হাটের দিকে এগোলাম, হাটের মাঝখান দিয়ে রাস্তা ধরে আমাদের সোজা চলে যেতে হবে। হাটে ঢোকার মুখেই কাচারী অফিস(ভূমি/তহশিল অফিস), দুই/তিন জন লোক অফিসের বারান্দায় হুক্কা খেতে খেতে গল্প করছিল। ঐ খান থেকে সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা পড়া এক লোক আমাদের ডাকল, আমরা বারান্দায় উঠলে আমাদের কে পরিচয়, কোথায় যাব ইত্যাদি ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করল। আমরা আমাদের পরিচয় আর আমাদের গ্রামের নাম বললাম। তারা সবাই বেশ অবাক হল এই সময় আমাদেরকে ঐ দিকে রওনা হওয়ার কথা শুনে। ভদ্রলোক আমাদের কে আজকে না গিয়ে, শিবরামপুরে কারো বাড়ীতে গিয়ে থাকতে বলল। আমরা বললাম আমাদের সাথে তেমন কিছুই নাই, চোর-ডাকাত আর কি নিবে। উনি তখন বললেন শুধু ডাকাত তো আর সমস্যা না এই রাস্তায় আরও সমস্যা আছে। কাশীপুরের দোষ লাগা পাকুড় গাছ আর নোকালির শ্মশান ঘাট পার হয়ে যেতে হবে ঐ জায়গাগুলো ভালো না। কয়েকদিন আগেই কিছু ঘটেছে, একজন এই ঘটনা বলতে গেলে ভদ্রলোক না করল, আমরা ভয় পাব বলে মনে হয় ভদ্রলোক আর বলল না। তারা যখন বুঝলো যে আমরা যাবই তখন একজন বলল যে এক লোক ঐ রাস্তায় যাবে কিন্তু এক যেতে সাহস করছে না বলে হাটের শেষ মাথায় চায়ের দোকানে বসে অন্য কোন সহ যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে, তাকে সাথে করে একসাথে যেতে।



আমরা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঐ চায়ের দোকানের সামনে এলাম, হাটটি বেশ বড় হলেও হাটবার না হওয়াতে আমরা ছাড়া আর কোন লোক নাই। চায়ের দোকান মোটামুটি বন্ধ করে ফেলেছে আর অন্যকোন লোক ঐ রাস্তায় না যাওয়ার কারনে সেই অপেক্ষামান ভদ্রলোক আজ রাতে শিবরামপুরে ঐ চায়ের দোকানদারের বাড়ীতে থাকবে বলে ঠিক করেছে। আমরা আসাতে অই ভদ্রলোক যেন হালে পানি পেল সে তার থাকার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে এক সাথে রওনা দিতে মনঃস্থির করল। দোকানদার আমাদের আর দেরী না করে রওনা দিতে বলল আর কোন বিপদ হলে কি দোয়া পরতে হবে তাও বলে দিল। আমরা দোয়া-কালাম পড়তে পড়তে রওনা দিলাম। অপেক্ষামান ভদ্রলোকের সাথে সাইকেল ছিল, সে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে আমাদের সাথে হাটতে লাগল।



চার

অগ্রহায়ন মাসের শেষের দিকে হালকা হালকা শীত পড়েছে আর সেই সাথে পাতলা কুয়াশা তাই অন্ধকার বেশ গাঢ়। কয়েকদিন আগেই হয়ত খেতের ধান কেটেছে বলে পাশের মাঠে মনে হয় কোন ফসল নাই যদিও অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। আমরা যে রাস্তায় যাচ্ছি সামনের ৬/৭ মাইলের মধ্যে রাস্তার পাশে কোন গ্রাম বা লোকালয় নাই আর সেই সময়ে ঐ অঞ্চলে বিদ্যুতের বালাই ছিলনা। সঙ্গের ভদ্রলোক বলছিল আসলে এই রাস্তাটাই নতুন হয়েছে আগে এদিকের যোগাযোগ বর্ষা কালে নৌকাতে হত আর শীত কালে হালট দিয়ে যাতায়াত করত আর এই উঁচু রাস্তা হওয়াতে এখন মোটামুটি সারা বছরই হেঁটে অথবা গরুর গাড়ীতে যাতায়াত করা যায়। এই ফাঁকা রাস্তা শেষ করে প্রথম গ্রাম ‘নোকালি’, ওইখানে আমাদের আত্মীয় থাকায় আমরা দুই একবার ঐ গ্রাম পর্যন্ত এসেছিলাম, রাতে বেশি হওয়ার কারণে আমরা আজকে ‘নোকালি’ পর্যন্তই যাব বলে ঠিক করলাম। সঙ্গের ভদ্রলোক তার পাশের গ্রাম ‘চারিগ্রাম’ পর্যন্ত যাবেন, সেখানে তার শ্বশুরবাড়ী।



প্রকৃতপক্ষে রাস্তাতে কি ভয় ছিল বা আছে ওইটা আমার মাথায় কাজ করছিল না, আসলে পারিপার্শ্বিক পরিবেশই এমনিতেই ভুতুরে ছিল, কেমন যেন গা ছম-ছমে ভাব, এখনো পর্যন্ত রাস্তায় অন্য কোন লোকজনের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি, অবিরত ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আর কিছুক্ষন পর পর দূর থেকে শেয়ালদের ডাকে এমনিতেই এক ধরণের ভীতি কাজ করছিল। আমার কিছুক্ষন পর পরই গলা শুকিয়ে আসছিল আর মনে হচ্ছিল যে আজকে হয়তো কপালে খারাপি আছে আর আদৌ বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব কি না এই নিয়েও সন্দেহ ছিল। আমি দুই জনের মাঝে হাঁটছিলাম, এক কদম পিছনে পড়লেই দৌড়ে আবার সমান্তরাল হচ্ছিলাম। আমাদের হাঁটার গতিও অনেক কম, চারদিকে বেশ গাঢ় অন্ধকার আর রাস্তায় খানা-খন্দ বাঁচিয়ে আমরা হাঁটছিলাম।



হাঁটতে হাঁটতেই সংগের ভদ্রলোকের সাথে বিভিন্ন কথা হচ্ছিল, কথা প্রসঙ্গে রাস্তা নিয়ে আলাপ শুরু হল, আমরা যদিও খুব ভয় পাচ্ছিলাম তারপরেও রাস্তার ব্যাপারটা খুব জানতে ইচ্ছা করছিল। ভদ্রলোক বার বার বলছিল ভাই এগুলো শুনলে আপনারা ভয় পাবেন তাই শুনতে চাইবেন না। আমারা যদিও ভয় পাচ্ছিলাম তারপরও সাহসী ভাব নিয়ে শোনার জন্য জোড়া-জুড়ি শুরু করলাম তবে না শুলেই মনে হয় ভাল হত। আমাদের জোড়াজুড়িতে ভদ্রলোক বলতে শুরু করল, আমি তার জবানীতেই এখানে লিখলাম...

“গত বছর আশ্বিন মাসের শেষের দিকে আমি আমার শ্বশুর অসুস্থ থাকায় অসময়ে রওনা দেই। এই রকম সন্ধ্যার পরে এই রাস্তাতেই একা যাচ্ছিলাম। তখনও পর্যন্ত আমার ভয়-ডর একটু কম ছিল। এই রকম রাত-বিরাতে অনেক চলা-ফেরা করতাম, তবে কখনো কোন সমস্যা হয় নাই। সেদিন রাতে হালকা জ্যোৎস্না ছিল আর সেই সাথে টিপ-টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। রাস্তায় বেশ কাদা তাই সাবধানে হাঁটছিলাম। কাশীপুরের পাকুড় গাছের কাছাকাছি গিয়েছি, হালকা জ্যোৎস্নায় দূর থেকে পাকুড় গাছ দেখা জাচ্ছিল। ঐ পাকুড় গাছ নাকি দোষ লাগা বেশ কয়েকজন ওখানে অপঘাতে মারা গেছে তাই ভর দুপুর বা সন্ধ্যায় ওখান দিয়ে যেই যায় না কেন বেশ সাবধানে যায় আর রাতে তো কথাই নেই। এইটা-সেইটা ভাবছিলাম বলে একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, যখন আমি পাকুড় গাছের একবারে কাছা-কাছি তখন হঠাৎ দেখলাম একটা খাটিয়া্র মত আর তার মধ্যে সাদা কাপড়ে জড়ানো কিছু আর তার পেছেনে সাদা কাপড় পড়া পাঁচ/ছয় জন দাঁড়িয়ে, এই কিছুক্ষন আগেও এইরকম কিছু দেখলাম না। ঠিক যেন জানাজার নামাজ পড়তে দাড়িয়েছে, আমি কি করব বুঝতে পাড়ছিলাম না, কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলাম তার পরে ভাবলাম যেহেতু তারা মনে হয় জানাজা পড়ছে তাই আমিও দাড়াবো, এই চিন্তা করে আমি রাস্তার পাশের খালে অজু করার জন্য বসলাম। খুবই ভয় পেলাম, দোয়া পরতে পরতে আর চোখে গাছের দিকে তাকিয়ে দেখি কিছুই নাই...... আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। পরে জোরে জোরে দোয়া পড়তে পড়তে মোটামুটি দৌড় দিয়ে ঐ গাছ পার হলাম। যখন দৌড়াচ্ছিলাম পেছন মনে হয় কয়েকজন দৌড়াচ্ছিল বেশ কাদা থাকায় ছপ ছপ শব্দ পাচ্ছিলাম। এর পরে কি ভাবে আর কতক্ষণে আমি বাড়ীতে গিয়াছি তার খুব একটা জ্ঞান ছিল না। ঐ রাত থেকে প্রায় ১০/১৫ দিন জ্বরে ভুগি।”

ভদ্রলোক এইভাবে তার সেই ঘটনার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিল সেই সংগে বলল এই ঘটনা যখনই তার মনে হয় তার গায়ে কাঁটা দেয়। এই দেখেন বলে আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল তা দেখতে আমি আর চাচা এই অন্ধকারে তেমন কিছু না দেখলেও হাত দিয়ে দেখলাম সত্যি তার হাতের লোমগুলো খাড়া হয়ে আছে। আমরা এই ঘটনা শুনে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম, বিশেষ করে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ আমি লিয়াকত চাচার জামা ধরে হাটতে লাগলাম।



পাঁচ

এই ভাবে কতক্ষণ হাটলাম জানি না। দুই ঘণ্টাও হতে পাড়ে আবার চার ঘণ্টাও হতে পারে, কারো কাছে ঘড়ি নাই। ইতিমধ্যে আকাশে হালকা চাঁদ দেখা দিল, হালকা কুয়াশা আর হালকা চাঁদের আলোতে আরো ভৌতিক আলোর সৃষ্টি হল! এতক্ষন অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না এইটাই বরঞ্চ ভালো ছিল। এখন এই হালকা জ্যোৎস্নায় একধরণের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছিল। তীব্র ভয় নিয়ে আমরা আগাচ্ছি, যথারীতি একসময় কাশীপুরের পাকুড় গাছের কাছাকাছি চলে এলাম। বেশ দুরে একটা বিল বা জলা আর জলার ওপারে ২/৩ মাইল দূরে কাশিপুর গ্রামের একটা অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। একটা বা দুইটা আলো মনে হল তারার মিট মিট করছে। যদিও তখনও ঐ অঞ্চলে বিদ্যুৎ ছিল না, তাই ঐ আলো কিসের আলো আমরা বুঝতে পারছিলাম না।



হঠাৎ আমার মনে হল রাস্তার যেদিকে গ্রাম সেদিক থেকে কিছু দেখা যাচ্ছে, আমি চাচার জামা ধরে জোড়ে টান দিলাম, এতো ভয় পাচ্ছিলাম যে মুখে কথা বলতে পারছিলাম না। আমরা তিন জনই মোটামুটি দাঁড়িয়ে পড়লাম আর ঐ দিকে তাকিয়ে বোঝার চেস্টা করছি। কাক জ্যোৎস্নায় হালকা হালকা দেখা যাচ্ছিল কয়েকজন লোক খেতের আল দিয়ে হেটে রাস্তার দিকে আসছে। সংখায় পাঁচ/ছয় জন লম্বা সাদা পাঞ্জাবী বা আলখেল্লার মত কিছু পরনে একটু দূর আর হালকা আলোর কারনে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। আমাদের কথাবর্তা বন্ধ হয়ে গেছে, আমরা তাকিয়ে আছি ঐ দিকে। তারা হেঁটে হেঁটে রাস্তার উপরে উঠে আড়াআড়ি রাস্তা পার হয়ে আবার উল্টো দিকের মাঠে নেমে গেল, একটু দূরে যে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি আমাদের দিকে তারা একবার ও তাকালো না। মনে হল নিবিষ্ট মনে মাটির দিকে তাকিয়ে হাটছে, অনেক দূর থেকে আমরা কয়েকটা কুকুরের ডাক শুনলাম, কুকুর যখন ভয় পায় অথবা হঠাৎ কোন কিছু দেখতে পায় এই রকম। আমাদের সঙ্গের লোকের কথায় আমরা সম্বিত ফিরে পেলাম। উনি বলল ভাই আপনারা দোয়া পড়েন, আয়াতুল কুসরী পরেন। আমরা তিন জনই একসাথে দোয়া পড়তে লাগলাম। আমি কোনমত শুকনো গলায় চাচা কে বললাম চলেন আমরা ফেরত যাই। সঙ্গের ভদ্রলোক বললেন, না না এই সব সময়ে কখনো উলটা যেতে হয় না। চলেন চলেন জোড়ে হাটেন আর জোরে জোরে দোয়া-কালাম পড়েন। আমরা জোরে জোরে দোয়া-কালাম পড়তে পড়তে সামনে আগালাম, ভদ্রলোক তার সাইকেলের বেল বাজাতে লাগলেন, আমরা মোটামুটি দৌড় দিয়ে ঐ পাকুড় গাছ পাড় হলাম। নাজানি আবার কি দেখি এই ভয়ে একবারের জন্যেও পেছনে কেও পেছনে তাকালাম না। তবে আমারও মনে হল আমরা যখন পাকুড় গাছটা পাড় হচ্ছিলাম আমাদের পেছন পেছন মনে হয় কেউ আসছে। তবে একজন না বেশ কয়েকজন দৌড়ালে যেমন আওয়াজ পাওয়া যাই এই রকম পেলাম। বুকের মধ্যে দুরুম দুরুম করছে, ঘামে সারা শরীর জবজবে আর পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ। বেশ খানিকটা আসার পরে আমরা হাটার গতি একটু ধীর করলাম এবং পেছনে তাকালাম, কিন্তু তেমন কিছুই চোখে পড়লো না শুধু আধো অন্ধকারে ছায়া ছায়া পাকুড় গাছই দেখা যাচ্ছে।



সেদিন মনে হচ্ছিল রাস্তা আর শেষ হচ্ছে না, ঘামে ভেজা শরীর আর খড়খড়ে শুকনো গলা নিয়ে হেঁটেই চলছি। অবশেষে আমরা নোকালির কাছা কাছি আসলাম, যখন আমরা নোকালি শ্মশান ঘাটের কাছাকাছি এসেছি একটু দূর থেকে দেখলাম রাস্তা বন্ধ করে একদল কুকুর বসে আছি আমরা আবারও ভয় পেয়ে যাই, আমরা আবার দাঁড়িয়ে যাই চিন্তা করতে থাকি আর এগবো কি-না? হঠাৎ এগুলোর ভিতের থেকে শিয়ালের ডাক শুনতে পেলে আমাদের সম্বিৎ ফিরে আসে যে আসলে এগুলো শিয়াল। সঙ্গের ভদ্রলোক তার সাইকেলের বেল বাজাতে থাকে আমরা জোড়ে শব্দ করতে করতে আস্তে আস্তে আগাতে থাকি। শিয়ালের দল মনে হয় অনেক কষ্ট করে আমাদের যাওয়ার জায়গা করে দেয়। এক পালে ৮/১০ টা বিভিন্ন আকারের শিয়াল একগুলো আমাদের দেখে খুব একটা ভয় পায়না, শুধু রাস্তার এক সাইডে চলে যায়। আসলে পরিস্থিতি এমন ছিল যে আমরা মোটামুটি সব-কিছু দেখেই ভয় পাচ্ছিলাম। অল্পকিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা তেমন কোন ঘটনা ছাড়াই নোকালির শ্মশান পার হয়ে আসি। আমরা যেন হাপ ছেড়ে বাঁচি, আমার বুকের ঢিবঢিবানি কিছুটা কমে।



ছয়

শ্মশান পাড় হয়ে একটু আগালেই রাস্তা দুই ভাগ হয়ে গেছে, আমাদেরকে ডান দিকের রাস্তায় নোকালি গ্রামের দিকে যেতে হবে আর সোজা রাস্তায় আধা মাইলের মত গেলে চারিগ্রাম। রাস্তার মোড়ে এসে সঙ্গের ভদ্রলোক আমাদের কে জিজ্ঞাসা করল আমরা একা নোকালি যেতে পাড়ব কি-না? আমরা তাকে বললাম যে যেতে পারব। ভদ্রলোক আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন যাওয়ার আগে সাবধান করে দিলেন আর যেন রাতে এই রাস্তায় না আসি। আমরা নোকালির দিকে আগালাম, গ্রাম দেখা যাচ্ছে প্রথমেই পাল পাড়া, বেশ কয়েক ঘড় কুমারের বাস এর পরে একটু ফাঁকা জায়গা খালের পাড় দিয়ে হাটতে হয় এর পর মূল গ্রাম শুরু, খালটা গ্রামের পাশ দিয়ে এসে পাল পাড়ার পাশ দিয়ে শ্মশানের পেছেন দিয়ে গেছে। গত বছর আমরা যখন এসেছিলাম তখন এই খালে মাছ ধরেছিলাম।



আমারা পাল পাড়া পার হয়ে খালের পার দিয়ে হাটছি আমরা যথারীতি দুজন নিজেদের কে দোষারপ করছিলাম দেরী করার জন্য আর সিনেমা হলে ঢোকার জন্য। ১৫/২০ মিনিট হাঁটার পরে আমাদের খেয়াল হল এত সময় কেন লাগছে তাকিয়ে দেখি আমরা শ্মশান আর পাল পাড়ার মাঝে খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। কি ভাবে এইটা হল আমরা ঠিক বুঝতে পারি না, আমাদের মাঝে আবার তীব্র আতংক ভর করে। আবার চোখে কি না দেখি এই ভয়ে আমরা আর কোন দিকে তাকাই না সোজা গ্রামের দিকে দৌড় শুরু করি।



পরিশেষঃ

পরে আমরা কি ভাবে আমাদের আত্মীয়ের বাড়িতে (চাচার খালার বাড়ী) পৌঁছেছিলাম আমি আজও মনে করতে পারি না, তবে আমার মনে আছে বাড়ীর সবাই অবিশ্বাসী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আগুন জ্বালিয়ে আমাদের হাত-পা ছেঁকতে হল, কি কি পানি পড়া খেতে হল। পরদিন তারা পাশের গ্রাম চারিগ্রামে খোঁজ করে রাতে গ্রামে সাইকেল সহ শিবরামপুর থেকে কোন অতিথি এসেছে কি না তা খোঁজ করে পেল না। তখন বাড়ীর লোকের বদ্ধ ধারণা হল যে আমরা গত রাতে বড় বাঁচা বেচে গেছি, ঐ লোকটার সাথেই কোন সমস্যা ছিল। এই ঘটনার পরে আমারা দুজনেই বেশ কিছুদিন জ্বরে ভুগি আর এই রকম হটকারী কাজ করার ফলে আব্বা শাস্তি স্বরূপ আমাদের কে অনেক দিন আর গ্রামের বাড়িতে যেতে দেয় নাই।

=========================================



পুনশ্চঃ আমার কাছে ঘটনাটাকে আজও রহস্যময় মনে হয়, তবে আমি নিজের মত করে এর ব্যখ্যা দাঁড় করিয়েছি। আসলে আমার এখনও সেই ভদ্রলোক কে ভদ্রমানুষ বলে মনে হয় যদিও ঐ লোককে খোঁজ করে পরে আর পাওয়া যায় নাই। সে রাত্রে আমাদের কে তিনি অনেক যত্ন সহকারে সঙ্গ দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, ঐ রকম একটা ফাঁকা যায়গায় আর অন্ধকার রাতে ঐ লোকের মুখে তার অভিজ্ঞতা শুনে আমরা যারপরনাই আতংকিত হয়েছিলাম আর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে প্রচন্ড ভয়ে আমরা হয়ত কাল্পনিক কিছু দেখেছি। তার পরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়, আমি না হয় ভয়ে এগুলো দেখলাম কিন্তু তিন জনই একই রকম দেখলাম কিভাবে?



(ব্যবহৃত ছবিটি ওয়েব থেকে সংগ্রহীত)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১০:৫৮

প্রামানিক বলেছেন: ভাই রাস্তা ভুলে আমিও একবার শ্মশান ঘাটে গিয়েছিলাম। সারারাত ইটা ক্ষেতে বসেছিলাম। সেই ভোগান্তির কথা মনে হলে এখনও গা শিউরে উঠে।

১১ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১১:৪০

মানস চোখ বলেছেন: এ রকম অভিজ্ঞতা মনে হয় সবারই কম-বেশী আছে!! :) :)
ধন্যবাদ ভাই 'প্রামানিক' আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য!!!!
ভালো থাকবেন ভাই!!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.