| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলার ডাক-হরকরা
রাতের পর রাত ক্লান্তিহীন মানুষের সুখ দুঃখের খবরের বোঝা বয়ে সে পৌছে দেয় দোরে দোরে কিন্তু তার খবর কে রাখে?
সুকান্তের রানার সবেগে হরিণের মতো যায়। কেমন সে রানার?
“হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন, জোনাকিরা দেয় আলো
মাভৈঃ রানার! এখনো রাতের কালো।
এমনি করেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে’।
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।
অনেক দুঃখে, বহু বেদনায় অভিমানে, অনুরাগে
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।”
সুকান্ত দেখে যেতে পারেননি চিঠির বোঝা নিয়ে এখন আর রানারকে ছুটতে হয় না। বোঝা টানার দিন শেষ হয়ে গেছে। আসলে চিঠি লিখার দিনই তো শেষ হওয়ার পথে। একটা সময় আসবে মানুষের লুপ্ত সংস্কৃতি নিয়ে আগামী দিনের গবেষক লিখবেন, সে আমলের মানুষ চিঠি লিখত, রানার মেইল ট্রেন থেকে চিঠির বোঝা নিয়ে ছুটত পোস্ট অফিসে, ডাক হরকরা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিত প্রিয়জনের চিঠি।
ঐতিহাসিক হেলেনিকাস জানাচ্ছেন তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীন হাতের লেখা চিঠির মধ্যে প্রাচীনতমটি লিখিত হয়েছে খ্রিস্টজন্মের ৫০০ বছর আগে। সাইরাস কন্যা পারস্যের রানী আতোসা সে চিঠি লিখেছেন। প্যাপিরাসে লিখা চিঠি জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে।
মেঘদূত বিরহী যক্ষ্মের চিঠি বহন করেছে।
কবুতর বহন করেছে গুরুত্বপূর্ণ পত্রাবলী।
এসেছে পদব্রজ ডাক হরকরা।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমটি স্মরণীয় গল্প ‘ডাক-হরকরা’। দীনু ডাক-হরকরার মাথার মাথালী দড়ি দিয়ে চিবুকের সঙ্গে বাঁধা, শক্ত হাতে ধরা বল্লম, অন্য হাতে হারিকেনের কম্পমান শিখার ধোঁয়ার চিমনি কালো রঙ ধরেছে, ডাক-হরকরা তার অভ্যস্ত নির্দিষ্ট গতিতে ছুটে চলছে। তারাশঙ্কর লিখছেন :
ডাক-হরকরা মৃত্যুতালে ছুটিতে ছুটিতে চলিয়াছে। এই গতি তাহাকে
বার বার সমানভাবে বজায় রাখিয়া চলিতে হইবে। পথে এক দণ্ড
বিশ্রাম করিবার উপায় নাই, গতি শিথিল করিবার উপায় নাই,
সামন্য বিলম্ব ঘটিলে কি হইবে দীনু কল্পনা করিতে
পারে না, কিন্তু তাহার ভয় হয়। তাহার ওপর পথে কোথাও
ওবারসিয়ার হয়তো লুকাইয়া আছে, কোনো জঙ্গলের মধ্যে
কিংবা কোনো গাছের ডালে বসিয়া ডাক-হরকরার গতিবিধি
লক্ষ্য করিতেছে।
এই দীনুকে প্রলোভন স্পর্শ করেনি, মিথ্যা অন্যায় ঠাঁই পায়নি তার কাছে। পিঠের বোঝা ডাকাতি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগত ডাকাতের আঘাতে অর্ধমৃত এই মানুষ বলতে দ্বিধা করেনি যে তার পুত্র নিতাই-ই সে ডাকাত।
সুকান্তের রানার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে নতুন মাত্রায় পা ফেলতে শুরু করেছে। জন্ময় মিত্রের চিঠি কার না অন্তর ছুঁয়ে যায়নি। সেই গানের বাণী।
বলেছিলে তাই চিঠি লিখে যাই কথা আর সুরে সুরে
মন বলে তুমি রয়েছ যে কাছে আঁখি বলে কত দূরে।
চিঠিতে বেদনার সর্বব্যাপী বিস্তার :
আমার ভুবনে সকলি যে আছে
তুমি নাই শুধু তুমি নাই কাছে
মোর গান হারা স্মৃতির পাপিয়া একা একা মরে ঘুরে।
সোনার মেয়ে গো
তুমিও কি আজ বসি বাতায়ন পাশে
প্রহর গনিছ ছলছল চোখে
আমারি চিঠির আশে।
এই রচনাটিতে মূলত শিল্পী সাহিত্যিকদেরই ক’টি চিঠি কিছু বিবরণীসহ পত্রস্থ।
রানারের বোঝা বয়ে বেড়ানোর দিন শেষ। সম্ভবত চিঠির দিনও শেষ হয়ে আসছে।
হাসপাতাল থেকে সুকান্তের চিঠি
১৯৪৭। ভারত ও বাংলা ভাগের আয়োজন চলছে। কলকাতায় চলছে দাঙ্গা। সুকান্ত ভট্টাচার্য যাদবপুর টিবি হাসপাতালে। যক্ষ্মা তাকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রিয় বন্ধু কবি অরুণাচল বসুকে চিঠি লিখলেন ৮ এপ্রিল ১৯৪৭ :
অরুণ!
সাত দিন হয়ে গেল এখানে এসেছি। বড় একা-একা ঠেকছে এখানে। সারা দিন চুপচাপ কাটাতে হয়। বিকেলে কেউ এলে আনন্দে অধীর হয়ে পড়ি। মেজদা নিয়মিত আসে, কিন্তু সুভাষ নিয়মিত আসে না। কাল মেজবৌদি-মাসিমাকে নিয়ে মেজদা এসেছিল। চলে যাবার পর মন বড় খারাপ হয়ে গেল। বাস্তবিক শ্যামবাজারের ওই পরিবেশ ছেড়ে এসে রীতিমতো কষ্ট পাচ্ছি।
তুই কি এখনও দাঙ্গার অবরোধের মধ্যে আছিস? না কলকাতায় যাতায়াত করতে পারছিস? যাই হোক সুযোগ পেলে আমার সঙ্গে দেখা করবি। দেখা করার সময় বিকাল চারটে থেকে ছ’টা। শিয়ালদা দিয়ে ট্রেনে করে আসতে পারিস কিংবা ৮-এ বাসে। এখানে ‘লেডি মেরি হার্বার্ট ব্লক’ এক নম্বর বেডে আছি। আশা করি আমার চিঠি পাবি। দেখা করতে দেরি হলে চিঠি দিস।
৮/৪/১৯৪৭ সুকান্তা ভট্টাচার্য
কবিবন্ধু অরুণকে লিখা এটাই সুকান্তের শেষ চিঠি।
রাণুর প্রথম চিঠি
রাণুর বয়স তখন এগারো বছর। বয়সে তার চেয়ে পঁয়তাল্লিশ বছরের বড় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, রাণু লিখলেন :
প্রিয় রবিবাবু,
আমি আপনার গল্পগুচ্ছের সব গল্প পড়েছি আর
বুঝতে পেরেছি। কেবল ক্ষুধিত পাষাণটা বুঝতে পারিনি/... আচ্ছা
জয়পরাজয় গল্পটার শেষে শেখরের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে হল।
না। কিন্তু আমার দিদিরা বলে শেখর মরে গেল। আপনি লিখে
দেবেন যে, শেখর বেঁচে গেল আর রাজকন্যার সঙ্গে তার বিয়ে
হল। কেমন? সত্যিই যদি শেখর মরে গিয়ে থাকে, তবে
আমার বড় দুঃখ হবে। আমার সব গল্পগুলোর মধ্যে
মাস্টারমশায় গল্পটা ভালো লাগে। আমি আপনার গোরা,
নৌকাডুবি, জীবনস্মৃতি, ছিন্নপত্র, রাজর্ষি, বৌঠাকুরাণীর হাট, গল্পসপ্তক সব পড়েছি। কোনও কোনও জায়গায় বুঝতে পারিনি কিন্তু
খুব ভালো লাগে। আপনার কথা ও ছুটির পড়া থেকে আমি
আর আমার ছোট বোন কবিতা মুখস্থ করি। চতুরঙ্গ, ফাল্গ––নী ও
শান্তিনিকেতন শুরু করেছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম না। ডাকা ঘর
অচলায়তন, রাজা শারদোৎসব এসবও পড়েছি। আমার আপনাকে
দেখতে খু-উ-উ-উ-উ-উ-উব ইচ্ছে করে।
রাণু অধিকারীর বাস শিলংয়ে; বাবা ফণিভূষণ অধিকারী দিল্লির হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ। রবীন্দ্রনাথ প্রথম শিলংয়ে এলেন ১১ অক্টোবর ১৯১৯। তখন রাণুর বয়স তেরো। রাণুকে পাশে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ শিলংয়ের পাহাড়ি পথে হেঁটে বেড়িয়েছেন; তাদের সম্পর্কটি তখন দু’বছরের পুরনো। ‘আপনি আমার আদর জানবেন। আর চুমু।’- এভাবে শেষ হয়েছে রাণুর অনেক চিঠি। ‘চুমো’ শব্দটি সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই রাণুই লেডি রাণু মুখার্জি।
[সূত্র : অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের ‘রবীন্দ্রনাথ রাণু ও শেষের কবিতা’]
অবন ঠাকুরের চিঠি
অসিতকুমার হালদার অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্ট স্কুলের ছাত্র এবং ভাগ্নে। তিনি এক সময় আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হন।
২৩ অক্টোবর (১৯৩০? চিঠিতে বছরের উল্লেখ নেই) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ৫ দ্বারকানাথ ঠাকুরের লেন, কলকাতা থেকে অসিতকুমারকে লিখছেন :
প্রিয় অসীত,
তোমার চিঠি পেয়ে অবাক হয়ে গেলুম। তোমার ছড়া তুমি বিনা পায়সায় শিশুভারতীকে দিতে পারো, কিন্তু আমার ছবি খবরদার দিও না। বিনামূল্যে আমার ছবি কোথাও ছাপতে দেব না, যদি ওরা ছাপতে চায় আমার সঙ্গে কথা কইতে বোলো। কেননা এই দুঃসময়ে ছবির কপিরাইট ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে অসাধ্য। তুমি পত্রপাঠ শিশুভারতীর কর্তৃপক্ষকে আমার ইচ্ছা জানিয়ে দিও এবং ছাপা বন্ধ কোরো। আশীর্বাদ নাও।
তোমারি
শ্রী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তারিখবিহীন, তবে পোস্ট অফিসের ছাপ ২৯ জানুয়ারি ১৯৩২। অবন ঠাকুরের যন্ত্রণার একটি চিঠি :
প্রিয় অসীত,
ছবি কেনবার লোক নেই, কেনবার নামও করে না কেউ, কেবল ছবি দেখে সমালোচনা ও মরুব্বিয়ানা করে দেখছি সবাই। দেখে নিয়ে খালাস ছবি। এ যেন আমাদের কন্যাদায় উপস্থিত হয়েছে। ঘাড়ে করে নিয়ে ছবি দেখিয়ে এসো বাড়ি বাড়ি, পাকা দেখার নামটি করে না কেউ। বাজার দরে নির্ভর করলে বাজারের ছবিই আঁকতে হবে। সেই রকম একখানা ছবি এবার এঁকেছি, সেইটেই পাঠাবো তোমার কাছে, পারো তো বেচে দিও।
যে ছবি বেচবার ইচ্ছে নেই তা কেউ যদি দেখতে চায়’ত বলবা আমার এখানে এসে দেখতে। তাতে গুরু-শিষ্য দু’জনেরই আনন্দ দর্শক প্রদর্শক দু’জনের আত্মীয়তা বাড়ে বই কমে না। ক’বছর তো দেখছি ছবি দেখিয়ে আর কোনও লাভ নেই, ভালো আছি। আশা করি তোমরা ভালো আছ।
তোমারি
শ্রী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জীবনানন্দের চিঠি
কবি সম্মানী জীবদ্দশায় জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) তেমন পাননি। তবুও ২ নভেম্বর ১৯৫১ ১৮৩ ল্যান্স ডাউন রোড, কলকাতা ২৬ থেকে সুরজিৎ দাসগুপ্তকে লেখা তার অনুচ্ছেদের একটি চিঠির শেষ অনুচ্ছেদে তিনি লিখলেন :
একটি কবিতার জন্যে সম্মানমূল্য আমি সাধারণত ২৫-৩০ থেকে ৫০ পর্যন্ত পাই। তোমরা ২০, দাও না, আমি সময় করে ভালোভাবে নতুন কবিতা লিখে পাঠাই। লেখার জন্য সময় ও সাধনার দরকার, গদ্যের চেয়ে কবিতার বেশি। আশা করি ভালো আছ। প্রীতি ও শুভাকাক্সক্ষা জানাচ্ছি।
ইতি,
জীবনানন্দ দাশ
নিজের কবিতার আলোচনা নিয়ে উদ্বিগ্ন জীবনানন্দ ২ মে ১৯৫৩ একই ঠিকানা থেকে সুরজিৎ দাসগুপ্তকে চার অনুচ্ছেদের যে চিঠি লিখেন তার দুটি :
‘সীমান্ত’ আমি দেখিনি। কি লিখেছে জানি না। কিন্তু এ সম্বন্ধে প্রতিবাদ করে কি লাভ? শুদ্ধসত্ত্ব বাবুর নিজের আলোচনায়ও তো ঢের ভুল। মনীন্দ্র রায়েরও কোনো ধারণা নেই। আমার মনে হয় সঞ্জয় বাবু কিছু লিখলে ভালো হয়। ডক্টর বোস তো খুব ভালো সমালোচক। কিন্তু তিনি কি এখন লিখবেন? তুমি নিজে কীভাবে লিখতে চাও? তোমার লেখাটা আমাকে দেখিও তো।
আমার কবিতা সম্বন্ধে চারদিকে এত বেশি অস্পষ্ট ধারণা যে আমি নিজে এ বিষয়ে একটি বড় প্রবন্ধ লিখব ভাবছিলাম। কিন্তু শরীর বড় অসুস্থ; কোনো কাজই করতে পারছি না। কোথাও চেঞ্জে যাওয়া দরকার। আশা করি ভালো আছ। শুভাকাক্সক্ষা জানাচ্ছি।
ইতি
জীবনানন্দ দাশ
(সীমান্ত-সাহিত্য সাময়িকী, মনীন্দ্র রায় সম্পাদিত, শুদ্ধসত্ত্ব বসু, একক সাময়িকীর সম্পাদক, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ড. অমলেন্দু বসু।)
একই ঠিকানা থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০ অম্লান দত্তকে লেখা
একটি পুর্ণাঙ্গ চিঠি :
প্রিয় বরেষু,
অম্লান বাবু, আপনাদের নির্দেশ মতো আশ্বিনের ‘দ্বন্দ্বে’র জন্য ‘আধুনিক কবিতা’ লেখাটি তৈরি করে একই সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম।
এই লেখাটি আপনি আশ্বিনের সংখ্যায় সম্পাদকীয় হিসেবে ব্যবহার করবার কথা বলেছিলেন, কিন্তু প্রথম প্রবন্ধ হিসেবে ব্যবহার করলে কি-না হবে হয়তো।
Final proof আমি একবার অবশ্যই দেখে দিতে চাই। আসছে বিবশ-এ আমি কলকাতায় আসব ঠিক বলতে পারছি না। কিন্তু তার পরে এলেও proof দেখবার সুযোগ পাব আশা করি।
জীবনানন্দ দাস
শ্রীযুক্ত অম্লান দত্ত সমীপেষু
দ্বন্দ্ব মাসিক পত্র
কলকাতা।
কবি নরেশ গুহকে লিখা ১১ মে ১৯৫১ তারিখের পত্রের একটি অংশ :
আর একটা কথা : আমার এখানে একটা বড় রুম ও খানিকটা isolated বারান্দা (রান্না ইত্যাদি করা যেতে পারে)- যা আপনি অনেক আগে একবার দেখেছিলেন- খালি আছে। sublet করতে চাই। আপনার জানাশোনা কোনো লোক- একজন হলেই ভালো, কিংবা বড় জোর দু’জন- থাকলে অবিলম্বে পাঠিয়ে দিলে খুশি হবো।
[প্রভাত কুমার দাশ সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ দাশের অপ্রকাশিত পত্রগুচ্ছ’ আজকাল, শারদীয়া ১৪০৪ থেকে উদ্ধৃত।]
সত্যজিৎ রায়ের চিঠি
মারাঠি দিনকর রামরাও কৌশিক শান্তিনিকেতনে এসে কলাভবনে ভর্তি হলেন ১৯৪০ সালে, নন্দলাল বসু তখন অধ্যক্ষ। সত্যজিৎ রায় দিনকরের মতোই একজন শিক্ষার্থী। ছাত্রাবাসের কুঠিরে যে কক্ষে সত্যজিৎ থাকতেন পাশেরটিই দিনকরের। সখ্য এতদূর গড়াল দিনকর হয়ে গেলেন দিনু; আর প্রিয়জনের কাছে সত্যজিৎ তো মানিকই।
১১ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সত্যজিৎ দিনুকে লিখছেন :
প্রিয় দিনু,
কিঙ্করদার (চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর রামকিঙ্কর বেজ) লিথোগ্রাফটি সমেত তোমার চিঠির জন্য অনেক ধন্যবাদ। কিছুদিন ধরেই তোমাকে চিঠি লিখব ভাবছিলাম- পার্থ বসুর (আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক) কাছে তোমার অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে আর তার জন্য নিজেকে কিছুটা দোষী মনে করে- কিন্তু হয়ে আর উঠছিল না নতুন ফিল্মের (সোনার কেল্লা) ব্যস্ততায়। জেনে খুশি হলাম ‘অশনি সংকেত’ তোমার ভালো লেগেছে। তুমি আবার চলাফেরা করতে পারছ জেনে আরও খুশি হলাম।
কেবল রাজস্থানের মরুভূমির উদ্দেশে রওনা দিচ্ছি লোকেশন দেখতে। এবারও কিন্তু কমেডি অ্যাডভেঞ্চার। সুতরাং দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার থেকে স্বাদবদল।
সবাইকে ভালোবাসা
মানিক
[অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের ‘সত্যজিৎ রায়ের অপ্রকাশিত পত্র’ শারদীয় দেশ ১৪১৭] সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২)
শ্যালিকার কাছে জয়নুলের চিঠি :
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তখন পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বল্পকালীন চাকরিতে করাচিতে। শ্যালিকা রওশন আরা আমিন বাচ্চুকে করাচি থেকে লিখছেন ২৪ জুন ১৯৪৮। শিল্পী রওশন আরা জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠিত আর্ট স্কুলের প্রথম দিককার ছাত্রী। জয়নুলের চিঠির সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি জীবনের স্কেচও রয়েছে।
স্নেহের বাচ্চু দি,
আমার দোয়া জানিবা। তোমার চিঠি পাইয়াছি। করাচি কি রকম জায়গা অন্যান্যের চিঠিতে হয়তো শুনিয়া থাকিবে। আসিলে বিস্তারিত মুখে শুনিতে পাইবা। টুটুল (ছেলে) দুষ্টমি করে। আমি এই সময় কাছে নাই বলিয়া দুঃখ হইতেছে। দেখিও, ও কিন্তু যে কোনো সময় চৌকি হইতে পড়িয়া যাইতে পারে। জানুর (স্ত্রী) চিঠিতে শুনিতে পাইলাম যে ওর স্বাস্থ্য নাকি খুব ভালো হইয়াছে। আমি আরো নানা জায়গা হইতে আমার ওইরূপ ফটো তোলাইয়া রাখিতেছি।
তুমি জিজ্ঞাসা করিয়াছ যে পাঞ্জাবি মেয়ে বিয়ের কী হইল? আমি যে তোমাকে কথা দিয়া আসিয়াছি মীনার সঙ্গেও পাকা কথাই হইয়া রহিয়াছে। সুতরাং আগেই পাঞ্জাবির কী দরকার? জানুর সাহায্যের জন্যই তো আমার আর একটা বিয়ের দরকার! সে তো তুমি আর সীমাই রহিয়াছ। আর করিয়া কাজ কী!
আমি-ইতি
তোমার দুলাভাই
(মোহাম্মদ আসাদের ‘শিল্পাচার্যের অপ্রকাশিত চিঠি’ কালের কণ্ঠ ঈদ সংখ্যা ২০১০ থেকে পত্রটির একাংশ উদ্ধৃত।)
সেলিনা মেয়ে না ছেলে
৫০/১ প্রতাপাদিত্য রোড, কলকাতা ২৬ থেকে ১৩ মার্চ ১৯৭৯ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লিখছেন সেলিনা হোসেনকে :
স্নেহের সেলিনা
আমি সত্যিই জানতে চেয়েছিলাম- তুমি ছেলে না মেয়ে? এ জন্য আমার দোষ দিও না। আমাদের শৈশবে পূর্ববঙ্গ- এমনকি কৈশোরের শুরুতেও হিন্দু-মুসলমান পরিবার পাশাপাশি বাস করেছি। সেই প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থেকে আজ ৩২ বছর নির্বাসিত। এছাড়া আজকাল নানারকমের নাম গুলিয়ে দিচ্ছে। আমার অজ্ঞতার জন্য তবু আমি লজ্জিত। তুমি নিশ্চয় তন্বী-গৌরী এবং চোখে চশমা আছে।
তোমার গল্পটি পেয়েছি। কাল ছবি আঁকতে দেব। আমরা গল্পের জন্য একশো টাকা দিয়ে থাকি। বড় হলে দরকারে একটু বেশি দেবার চেষ্টা করি। তুমি একশো টাকা পেয়েছো তো?
ততদিনে সবারই চেনাজানা হয়ে গেছে। ১৮ বছর পর আর একটি চিঠি বুদ্ধদেব গুহের সেলিনা হোসেনকে লিখা :
৮/৪/৯৭ কলকাতা
সেলিনা
কল্যাণীয়াষু এবং শ্রদ্ধাভাজনীয়াষু
তোমার চিঠিটি আমি কলকাতাতে না থাকায় হারিয়ে গেছিল। আমার পরিচালনের গাফিলতিতে তোমার উপর খুব অভিমানও হয়েছিল। যাই হোক, তার নিরসন হল।
তোমার উৎসর্গীকৃত ‘জঙ্গল সম্ভার’ দেজ পাবলিশিংয়ের সুধাংশু দের স্মারকও পাঠিয়েছিলাম। পেলে কিনা পত্রপাঠ জানাবে। তোমার কাছ থেকে প্রাপ্তি সংবাদ না পেয়ে চিন্তিত আছি।
[উৎস : সেলিনা হোসেনকে লেখা চিঠি, কালের কণ্ঠ, ঈদ সংখ্যা ২০১২; চিঠি আংশিক উদ্ধৃত।]
অসুখ আমার অমৃতের একগুচ্ছ অহংকার
কবি আবুল হাসানের ২৮ বছরের জীবন। জন্ম ১৯৪৭-এর ৪ আগস্ট, অকাল মৃত্যু ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫। ঘাতক ব্যাধির চিকিৎসা করাতে বার্লিন গেলেন। চার মাস চিকিৎসাধীন থেকে ১৯৭৫-এর ফেব্র“য়ারিতে খানিকটা সুস্থ হয়েই ফিরে আসেন। দেশে আমার আগমনে বার্লিন চ্যারিটি হাসপাতাল থেকে আবুল হাসান শকওত ওসমানকে লিখলেন :
শ্রদ্ধাষন্বেষু শওকত ভাই,
এখানে আমার যে উদ্দেশ্যে আসা, সে উদ্দেশ্য বাস্তবে পরিণত হলো না। বরং জেনে দুঃখিত হবেন, ডাক্তাররা আমাকে একমাত্র লেখা ও কথা বলার ক্লান্তি আহরণ ছাড়া আর কোনো রকমের ক্লান্তি, হাঁটা, দৌড়ানো, সিঁড়িভাঙা, রাত্রি জাগরণ ইত্যাদি ইত্যাদি সমস্ত যৌবনসুলভ আচরণ এবং কর্ম থেকে এখন থেকে বিরত থাকতে বলেছে। অর্থাৎ যখন আমার যৌবন তখন আমি আপনাদের চাইতেও বৃদ্ধ।... বলুন তো এর চাইতে দুর্নিয়তি একজন মানুষের জন্য আর কী থাকতে পারে?
যে মানুষ যৌবন চাইলো, সেই মানুষ পরিবর্তে বৃদ্ধত্বের দাস হলো, এর চাইতে কষ্টের আর কোনো অভিজ্ঞতা এবং বেদনাবোধ পৃথিবীতে আছে?...
আমি শারীরিক কর্মক্ষমতা না হারালে, আমার এই অসহায় অবস্থার কথা আপনাকে জানাতাম না। কিন্তু সাহসের সমস্ত শৌর্যের মালিক হয়েও আমি আপনাকে বলছি, আমার দেশ আমাকে বর্তমানে কাপুরুষ করে তুলেছে। জীবনে বাঁচতে হলে খাদ্যের দরকার। খাদ্যের জন্য টাকা, টাকার জন্য চাকরি। কিন্তু ‘গণকণ্ঠ’ তালাবদ্ধ। আমি দেশে ফিরে গিয়ে আপনার কাছে হাত পাতলে আপনি আমার জন্য কিছু করবেন, এই দুঃসময়ে এহেন সুসাময়িক অনুভূতি আমার, তা দেশে গিয়ে গলায় দড়ি দেবো না- অন্তত আপনার মুখের দিতে তাকিয়ে এ আমি আসা করছি।
ইতি
আবুল হাসান
অসুখই যে তার অমৃতের একগুচ্ছ অহংকার, অসুখ তাকে আর বেশি দিন বাঁচতে দেয়নি। পৃথক পালঙ্কের কবি যাবার আগে একটি চিরকালীন আশ্বাস দিয়ে গেছেন। যতদূর যাও ফের দেখা হবে। কেননা মানুষ যদিও বিরহকামী, মিলনই মৌলিক।
[উৎস : বিশ্বজিৎ ঘোষের ‘আবুল হাসান’, বাংলা একাডেমি, ১৯৯২, পত্রটি আংশিক উদ্ধৃত।]

২|
২৮ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:৩৮
দেবজ্যোতিকাজল বলেছেন: দারুণ লিখেছ
৩|
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:৫৫
বিজন রয় বলেছেন: মুগ্ধ পোস্ট।
বাংলা সাহিত্য চর্চা আপনার আছে এটা বলতে হবে।
লিখুন বেশি বেশি।
©somewhere in net ltd.
১|
১৮ ই নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:০৮
প্রামানিক বলেছেন: সুন্দর পোষ্ট। ধন্যবাদ