![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়তাম। আমার এখনো সব স্পস্ট মনে আছে। সেদিন ছিলো রবিবার। রবিবারে আমাদের গ্রামের হাট বসে। সেদিন গ্রামের সবাই হাট থেকে পরিবারের জন্য নিত্যদিনের সব জিনিসপাতি কিনে নিয়ে আসতো। আমার বাবাও নিয়ে আসতো। আমার একটা বোন আছে। আমার থেকে বড়। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম। সে পড়তো সেভেনে। আমার থেকে দু'ক্লাস বড়। বয়সেও দুবছরের বড়। আপু আমাকে অনেক আদর করতো। আর আম্মুর সাথে সাথে বাড়ির অনেক কাজ করতো। আমি কিছুই করতাম না। আমি শুধু খাওয়ার সময় খাইতাম আর অন্য সময় আম্মু বলতো পড়তে বসো। প্রতি রবিবারের হাট থেকে আব্বু আমার জন্য অনেক মজার মজার খাওয়া নিয়ে আসতো। কিন্তু আমার আপুর জন্য কিছুই আনতো না। আপু অনেক সময় আব্বুর সাথে রাগ করতো। কিন্তু কোনই লাভ হতো না। উল্টো আম্মুর দমক খেতে হতো। আমি আমার জন্য নিয়ে আসা খাওয়া খেতে আপুকে ডেকে একটু একটু দিতাম। আপুকে একটু দিলে আমার কাছে আরেকটু খেতে চাইতো। কিন্তু আমি দিতাম না। তখন আমি ভাবতাম মেয়েরা মনে হয় বাড়ির সব কাজ করবে। আর ছেলেরা বসে বসে খাবে। আর ছেলেদের থেকে মেয়েরা কম খায়। এটাই হচ্ছে নিয়ম। আর আমিও এটাই মেনে চলতাম। আপু স্কুলে পড়তো। কিন্তু কারো কাছে টিউশনি পড়তো না। আমি ২টা স্যারের কাছে টিউশনি পড়তাম। কিন্তু তারপরও আপু আমার থেকে ভালো রেজাল্ট করতো। কিন্তু তারপরও আমি যদি ৫০নাম্বারও পেতাম। তা নিয়ে আব্বু আম্মুর সে কি উল্লাস! কিন্তু আমার আপু পেতো ৭০-৮০ নাম্বার করে। কিন্তু তারপরও কোনো নজর ছিলো না তার প্রতি। হয়তো এটাই নিয়ম। আমি সে নিয়ম মেনেই চলতাম।
একদিন আমি স্কুলে যাওয়ার পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। আপু ছিলো ক্লাসে। সেদিন তার খুবই জরুরি একটা পরিক্ষা ছিলো। কিন্তু আমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছি শুনে আপু তাড়াতাড়ি উত্তরপত্র জমা দিয়ে চলে আসে আমাকে দেখার জন্য। তারপর আমার পকেট থেকে ১০টাকা নিয়ে আপু ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে আসে আমার জন্য। আপুর কাছে কোনো টাকা ছিলো না। আব্বু আম্মু কেউই আপুকে টাকা দিতো না। হয়তো মাঝে মাঝে অনেক বলার পরে ৫ বা ১০ টাকা দিতো। কিন্তু সে টাকাও আপু কিছুই করতো না। সে টাকা দিয়ে আপু আমার জন্য বিভিন্ন জিনিস নিয়ে যেতো। আপু হয়তো এমনি হয়৷ তখন এটাই ভাবতাম। এটা যে ভাই-বোনের ভালোবাসা সেটা তখন বুঝতাম না। তখন মনে করতাম এটাই নিয়ম। আপুরা হয়তো এমনি হতে হয়।
আমার আম্মু মুরগি পালতো। একদিন একটা মুরগি হঠাৎ ডিম পেড়েছে। আর সেটা পেয়েছিলো আমার আপু। আপু আম্মুকে বলেছিলো যে, এই ডিমটা আপু ভেজে খাবে। কিন্তু আম্মু বলেছিলো, এটা নাকি প্রথম ডিম। আর এই ডিম নাকি পুরুষ মানুষে খায়। তাহলে নাকি মুরগির বাচ্চারা বেশির ভাগ মোরগছানা হবে। মুরগিছানা থেকে মোরগছানার দাম হাটে বেশি। তাই মোরগছানাই চাইতো সবাই। আর তাই এই ডিমটা আপুর খাওয়া হলো না। আমিও আম্মুর কথাটাই নিয়ম ভেবে খেয়ে নিয়েছি। একটুও কষ্ট হয়নি আপুর জন্য। আমি খাওয়ার সময় আপু যখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। তখন আম্মু দমক দিয়ে আপুকে আমার সামনে থেকে চলে যেতে বললো। আপু মুখটা কালো করে চলে গেলো।
এভাবে, চলছে আমাদের দিনকাল। যখন আপুর এসএসসি পরিক্ষা চলছে তখন আপুকে আম্মু বেশি রাত জেগে পড়তে দিতো না। বলতো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তুই বসে থেকে কেরোসিন শেষ করতেছিস কেনো। যা পড়ার তা দিনের বেলায় পড়িস। এখন ঘুমাতে যা। আপু রাতে ঠিক মতো পড়তেও দিতো না। আমি এমনিতে ফাকিবাজ ছিলাম। তাই আমি রাতে বেশিক্ষণ পড়তাম না। দিনে স্কুল আর টিউশনি পড়তাম তো তাই। রাতে আমি যতক্ষণ পড়তাম আপু ততক্ষণ শান্তি মতো পড়তে পারতো। কেউই কিছু বলতো না তখন।
পরিক্ষার রেজাল্ট দিলো আপু পাস করেনি। আপুর সে কি কান্না! বলে বুঝানো যাবে না। আর আম্মু নানা কথা বলে খুঁচিয়ে যাচ্ছে আপুকে। অনেক বাজে বাজে কথাও বলেছে। ফেইল করার জন্য সব দোষটা আপুরই৷ তাই আম্মু বলেছে আর পড়তে হবে না আপুকে। কিন্তু আমি জানতাম আমার আপু আমার থেকেও খুবই ভালো ছিলো লেখাপড়ায়। সেখানেই আপুর লেখাপড়া শেষ হয়ে যায়। রাতে আমি যখন পড়তে বসি। আপু তখন আমাকে পড়ার সময় সাহায্য করতো। কিন্তু আম্মু বাজে কথা বলে আমার পাশে থেকে সরিয়ে দিতো আপুকে। আপু পাশে থাকলে নাকি আমিও ফেইল করবো। আপু কিছু পড়তে বললে তা পড়তে বারণ করে দিয়েছে আমাকে। আপু তখন একপাশে গিয়ে চোখ দুটো চোখের পানিতে ভিজিয়ে ফেলতো।
তার কিছুদিন পরেই আপুর বিয়ে দিয়ে দিলো। আপুর খুব ইচ্ছে ছিলো লেখাপড়া করার। অনেক কিছু করার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু তা কিছুই হলো না। আপু এখন তার স্বামীর বাড়িতে রান্না করতেছে। আর এটাই বুঝি আপুদের জীবনের নিয়ম।
অণুগল্প; এটাই কি নিয়ম!
লেখক; ইলিয়াছ শুভ্র (জুনিয়র শুভ্র)
©somewhere in net ltd.