![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অজানা আতঙ্কে কেঁপে ওঠা ছাড়া আমরা আজ ‘ভাইরাল’ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারছিনা! শোষক কাঁটাসমেত কিছু অদৃশ্য, অনাবৃত জীবন্ত বিন্দু আমাদের ফুসফুসের সাথে নিজেদের আটকে দেয়ার অপেক্ষায় ঝাঁক বেঁধে রয়েছে - এমন ভয়ংকর কল্পনা ছাড়া খুব সাধারণ একটি দরজার হাতল, কার্ডবোর্ডের বাক্স কিংবা একটি সবজি ব্যাগের দিকে আমরা তাকাতে পারছি না!
লাফিয়ে বাসে ওঠা বা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো- চরম আতঙ্কিত না হয়ে কে ভাবতে পারছি এসব? স্বাভাবিক আনন্দের কথা স্বাভাবিকভাবে ভাবতে পারছি কেউ? আমাদের মধ্যে কে আসলে হাতুড়ে মহামারীবিদ, ভাইরাসবিদ, পরিসংখ্যানবিদ বা ভবিষ্যতবক্তা হয়ে উঠিনি? কোন বিজ্ঞানী বা ডাক্তার গোপনে কোনো অলৌকিক ঘটনার জন্যে প্রার্থনা করছেন না? কোন পুরোহিত গোপনে হলেও বিজ্ঞানের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি?
আবার ভাইরাসের এমন অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার আর বংশবৃদ্ধির মধ্যেও শহরগুলোতে অসংখ্য পাখির গান, ট্রাফিক ক্রসিংয়ে ময়ূরের নাচ আর আকাশের এমন নীরবতায় কেউ কি রোমাঞ্চিত না হয়ে থাকতে পারছি?
এই সপ্তাহে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই মারা গেছেন ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। এই সংখ্যা কয়েক শত হাজার ছাড়িয়ে যাবে, সম্ভবত আরো বেশি ছাড়াবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে। একদিকে সাথে করে নিয়ে আসা ভয়াবহ অসুস্থতা দিয়ে এই ভাইরাস মানুষকে আটকে রেখেছে স্ব-স্ব দেশে, শহরে, বাড়িতে; অন্যদিকে নিজে বৈশ্বিক পুঁজি এবং বাণিজ্যের পথে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু পুঁজিপ্রবাহের মতো মুনাফালাভ নয় বরং ভাইরাসটির লক্ষ্য নিজের বিস্তারলাভ এবং আমাদের অসাবধানতায় এর গতিবিধি পুঁজিপ্রবাহের দিককে কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে। অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ, বায়োমেট্রিকস, ডিজিটাল নজরদারি এবং সকল ধরণের তথ্য বিশ্লেষণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, পুঁজিবাদের ইঞ্জিনকে সশব্দে থামিয়ে দিয়েছে; কঠিনতম আঘাত করেছে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী, সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোকেও। হতে পারে এই থমকে যাওয়া সাময়িক, কিন্তু এর বিভিন্ন দিকগুলো মূল্যায়ন করে আমরা কি পুঁজিবাদের ইঞ্জিন মেরামতে এগোবো, নাকি এর চেয়ে কার্যকর কোনো ইঞ্জিনের খোঁজ করব সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আমাদের পক্ষে এটা যথেষ্ট সময়।
মান্দারিনেরা যুদ্ধের কথা বলতে পছন্দ করেন। রূপক হিসেবে নয়, আক্ষরিক অর্থেই এরা মহামারীর বদলে যুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করছেন। কিন্তু এটা যদি সত্যিই যুদ্ধ হতো, তাহলে আমেরিকার চেয়ে ভালো প্রস্তুতি আর কার ছিলো? এই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম সারির সৈন্যদের মাস্ক এবং গøাভস প্রয়োজন না হয়ে যদি বন্দুক, আধুনিক বোমা, বাঙ্কার বুস্টার, সাবমেরিন, যুদ্ধবিমান এবং নিউক্লিয়ার বোমার প্রয়োজন হতো, তাহলে কি এসবের কোনো ঘাটতি থাকতো?
রাতের পর রাত, সারা বিশ্বজুড়ে আমাদের কেউ কেউ এমন বিমুগ্ধ হয়ে নিউইয়র্ক গভর্নরের প্রেস ব্রিফিং শুনি যা ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমরা তাদের পরিসংখ্যান দেখি; আমেরিকার হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়া রোগীদের সেবা দিতে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে পুরোনো রেইনকোট বা আবর্জনার ব্যাগ থেকে মাস্ক তৈরি করছেন, নগণ্য মজুরিতে অমানুষিক পরিশ্রম করা এমন নার্সদের গল্প শুনি। ভেন্টিলেটরের জন্য রাজ্যগুলোর নিজেদের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দিতায় লিপ্ত হতে বাধ্য হওয়া কিংবা কোন রোগীটি ভেন্টিলেটর পাবেন আর কোন রোগীকে নিয়তির হাতে মৃত্যুর জন্য ছেড়ে রাখা হবে, আমরা ডাক্তারদের সেই দ্বিধাগ্রস্ততার গল্প শুনি আর ভাবি, হে ঈশ্বর! এই হলো আমেরিকা!
এই এপিক ট্র্যাজেডি আমাদের চোখের সামনেই ঘটমান। কিন্তু এটা কিছু নতুন নয়। এটা বছরের পর বছর রেললাইনে কাত হয়ে পড়ে থাকা একটি ট্রেনের ধ্বংসাবশেষ। হাসপাতালের গাউন পরিহিত অর্ধউলঙ্গ রোগীদের গোপনে রাস্তার কোনায় ফেলে দেয়া ‘পেশেন্ট ডাম্পিং’ ভিডিওগুলির কথা কার মনে নেই? আমেরিকার অপেক্ষাকৃত কম ভাগ্যবান নাগরিকদের জন্য হাসপাতালের দরজা প্রায়শই বন্ধ হয়ে যায়। রোগীরা কতোটা অসুস্থ ছিলেন বা কি পরিমাণ ভুক্তভোগী তা মুখ্য বিষয় নয়; এমনকি এখন পর্যন্ত নয়- কারণ এই ভাইরাসের যুগে একজন দরিদ্র মানুষের অসুস্থতা ধনী সমাজের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি এখনো সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স হোয়াইট হাউজের চোখে ছিটগ্রস্ত বলে বিবেচিত, খোদ তার নিজের দলের কাছেও।
আর সামন্তবাদ এবং ধর্মীয় মৌলবাদ, বর্ণ এবং পুঁজিবাদের মধ্যিখানে ঝুলে যাওয়া কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী একইসাথে সমৃদ্ধ এবং দরিদ্র আমার দেশ ভারত?
ডিসেম্বর মাসে যখন গোটা চীন উহানে ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে লড়ছে, তখন ভারত সরকার সংসদে সদ্য পাশ হওয়া নির্লজ্জভাবে বৈষম্যমূলক মুসলিম বিরোধী নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা কয়েকশত সহ¯্র নাগরিকের গণ-অভ্যুথানের মোকাবেলা করছে।
৩০ জানুয়ারি, আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবস প্যারেডের সম্মানিত প্রধান অতিথি, মহাবন আমাজন-খেকো এবং কোভিড- প্রত্যাখ্যানকারী জাইর বলসোনারোর দিল্লি ত্যাগের দিনকয়েক পরেই ভারতে কোভিড ১৯ আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তি সনাক্ত হওয়ার ঘোষণা আসে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের কর্মসূচীতে ফেব্রæয়ারিতে ভাইরাস ভাবনার চেয়ে অনেক জরুরি কাজ ছিল। মাসের শেষ সপ্তাহ ছিল রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিক সফরের জন্য নির্ধারিত সময়। গুজরাট রাজ্যের একটি স্পোর্টস স্টেডিয়ামে ১০ লক্ষ দর্শকশ্রোতা জমায়েতের লোভ দেখিয়ে তাকে ডেকে আনা হয়েছে; যাতে একইসাথে ব্যয় হয়েছে প্রচুর অর্থ এবং সময়।
তারপর এলো দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন। ভারতীয় জনতা পার্টি জানতো নিকৃষ্ট খেলা না চালালে তাদের পরাজয় অবধারিত। ‘গাদ্দারদের’দের গুলি করে মারার শ্লোগান এবং শারীরিক আক্রমনের হুমকিতে সাজানো একটি লাগামহীন-অবাধ কদর্য হিন্দু-রাষ্ট্রবাদী প্রচারনা তারা চালিয়েও ছিল।
এত কিছুর পরেও তারা হেরেছে।
ফলস্বরূপ, এই হারের প্রতিশোধ নিতে দোষী সাব্যস্ত করা হলো দিল্লির মুসলমানদের । পুলিশ সমর্থিত হিন্দু সশস্ত্র জনতা উত্তর-পূর্ব দিল্লির শ্রমজীবী মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বাড়িঘর, দোকানপাট, মসজিদ এবং স্কুল। আক্রমণ হবার আন্দাজ করতে পারা মুসলিমেরাও এর বিরুদ্ধে লড়বার চেষ্টা করেছে। এই দাঙ্গায় নিহত হয় মুসলমান এবং কিছু হিন্দু মিলে ৫০ জনেরও বেশি মানুষ।
হাজার হাজার উদ্বাস্তু মানুষ স্থানীয় কবরস্থানে আশ্রয় নিয়েছে। কোভিড ১৯ নিয়ে যখন সরকারি কর্মকর্তারা প্রথম সভায় মিলিত হন, তখনও নোংরা দূর্গন্ধযুক্ত ড্রেন থেকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহগুলো টেনে বের করা হচ্ছিলো এবং অধিকাংশ ভারতীয় জীবনে প্রথমবারের মতোন হ্যান্ড স্যানিটাইজারের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে শুরু করেছেন।
মার্চ মাসও কেটেছে ব্যস্ততায়। ভারতের মধ্য প্রদেশে কংগ্রেস সরকারের পতন এবং তার জায়গায় বিজেপি সরকার স্থলাভিষিক্ত করতে কেটে গেছে মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহ। ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড ১৯ কে মহামারী ঘোষণা করে। তার দুইদিন পর মার্চের ১৩ তারিখ ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানান কোভিড ১৯ কোনো ‘হেলদ ইমার্জেন্সি নয়’।
অবশেষে ১৯ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি ফ্রান্স এবং ইতালি থেকে ধার করে আনা ‘সামাজিক দূরত্ব’ (বর্ণবাদের চর্চায় তীব্রভাবে নিমজ্জিত একটা সমাজের জন্য খুব সহজেই বোধগম্য) মেনে চলার প্রয়োজনীয়তার ভাঙা রেকর্ড বাজান এবং ২২ মার্চ দিনটিতে স্বেচ্ছাসেবামূলক ‘জনতা কার্ফিউ’ পালনের ডাক দেন। এই সংকটে সরকারের পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি কিছু না জানালেও, স্বাস্থ্যকর্মীদের স্যালুট জানাতে জনগনকে তিনি বারান্দায় বেরিয়ে এসে কাঁসর ঘণ্টা বাজানোর আহবান জানান। অন্যদিকে, সেই ভারতীয় স্বাস্থ্যকর্মী এবং হাসপাতালগুলোর জন্য প্রতিরক্ষামূলক গিয়ার এবং রেস্পিরেটরি সরঞ্জাম রাখবার পরিবর্তে তখনও সেগুলো রপ্তানি করা হচ্ছিলো, তিনি একথা কোথাও উল্লেখ করেননি।
নরেন্দ্র মোদীর অনুরোধ অত্যন্ত উৎসাহের সাথে পালন করা হয়েছে। ঘণ্টা-থালা বাজানোর মার্চ হয়েছে, পাড়ায় পাড়ায় নাচ হয়েছে, মিছিল হয়েছে। সামাজিক দূরত্বই বরং ততোটা পালন করা হয়নি। তারপরের দিনগুলোতে কিছু মানুষ পবিত্র গোবরের পিপায় ঝাঁপ দিয়েছে, বিজেপি সমর্থকরা গোমূত্র পানের আসর বসিয়েছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে মুসলিম সংগঠনগুলোও ঘোষণা দিয়েছে যে ভাইরাসের একমাত্র নিরাময় সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ এবং এই ঘোষনার সাথে ছিল মুসলিমদের বিপুল সংখ্যায় মসজিদে জড়ো হবার আহবান।
২৪ মার্চ রাত ৮টায় মোদী আবারো টেলিভিশনে উপস্থিত হয়ে জাতির উদ্দেশ্যে জানান যে মধ্যরাত থেকে সমস্ত ভারত লকডাউনের আওতায় আনা হবে। বাজার, দোকানপাট বন্ধ হবে এবং সরকারি বেসরকারি সকল গণপরিবহন এবং প্রাইভেট পরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকবে।
তিনি বলেছিলেন কেবল প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নয় বরং আমাদের পরিবারের প্রবীণ হিসেবে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এই আকস্মিক লক ডাউনের বিপর্যয় মোকাবেলা যাদের করতে হবে, সেই রাজ্যের সরকারদের সাথে পরামর্শ না করেই ১৩৮ কোটি মানুষ কেবল চার ঘণ্টার নোটিশে কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই লকড-ডাউন থাকবে এই সিদ্ধান্ত একা তিনি ছাড়া আর কে নিতে পারেন? তার কর্মকান্ড সুনির্দিষ্ট ভাবে এই ধারণা দেয় যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নাগরিকদেরকে শত্রæ হিসাবে দেখেন। যাদের আচমকা অতর্কিতে আক্রমণ করা যায়, কিন্তু কখনও বিশ্বাস করা যায় না।
আমরা লকড-ডাউন ছিলাম। অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং মহামারী বিশ্লেষক এই পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। সম্ভবত তারা তাত্তি¡কভাবে সঠিক। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই লক ডাউনের ফলাফল হয়েছে একেবারেই বিপরীত। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতির অভাবে সৃষ্ট এই বিপর্যয়কে তাদের কেউই সমর্থন দিতে পারেন না।
যে মানুষটি নিজের জাঁকজমক জাহির করতে ভালোবাসেন, নিজের উদ্ভট সিদ্ধান্তের ফলে সেই মানুষটিই সবার কাছে হাস্যকর বস্তুতে পরিণত হলেন আর অন্যদেরও উদ্ভট সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ করে দিলেন।
বিশ্ব হতভম্ভ হয়ে দেখলো, নিষ্ঠুর, কাঠামোগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য, জনদূর্ভোগের প্রতি উদাসীনতা নিয়ে কেমন নির্লজ্জের মতো ভারত নিজেকে নগ্নতায় প্রকাশ করছে।
কিছু রাসায়নিক পরীক্ষা যেমন হঠাৎ অনেক গোপন জিনিসকে উন্মুক্ত করে দেয়, এই লকডাউনটি তেমনই একটি গবেষণার মতোন কাজ করেছে। দোকান, রেঁস্তোরা, কারখানা, নির্মান শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ হওয়া এবং ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীরা বদ্ধদ্বার কলোনীগুলোতে নিজেদেরকে আবদ্ধ করে ফেলার সাথে সাথে আমাদের শহর এবং মেগাসিটিগুলো তাদের শ্রমজীবী নাগরিকদের, অভিবাসী শ্রমিকদের অবাঞ্ছিতের মতো তাড়িয়ে দিতে শুরু করলো।
দরিদ্র, নিঃস্ব, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, বৃদ্ধ, যুবা, নারী, পুরুষ, শিশু, অসুস্থ, অন্ধ, বিকলাঙ্গ- এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছেন, বাড়িওয়ালদের দ্বারা বিতাড়িত হয়েছেন। যাওয়ার জায়গা নেই, দৃষ্টিসীমায় কোনো গণপরিবহন নেই। বাদাউন, আগ্রা, আজমগড়, আলীগড়, লখনৌ, গোরাকপুর- নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতে শত শত মাইল হেঁটেছেন। কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন পথেই।
তারা জানতেন বাড়ি পৌঁছুতে পারলে ক্ষুধার সম্ভাব্য যন্ত্রণাটা হয়তো কিছুটা দেরিতে পোহাতে হবে। সাথে করে নিয়ে যাওয়া ভাইরাস বাড়িতে থাকা পরিবার, বাবা মাকে সংক্রামিত করতে পারে, সম্ভবত এটাও জানতেন। ভালোবাসা না হোক, খাবারের সাথে সাথে তাদের একটু পরিচিত পরিবেশের প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল মর্যাদার সাথে একটু আশ্রয়ের। কারফিউর কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পুলিশ এদের অনেককে নির্মমভাবে মারধোর করেছে, লাঞ্ছিত করেছে। রাজপথে কিছু যুবককে চার-হাতে-পায়ে ব্যাঙ লাফ দিতে বাধ্য করেছে। বেরেলি শহরের বাইরে একদল মানুষকে অপমানজকনকভাবে জড়ো করে হোসপাইপ দিয়ে রাসায়নিক স্প্রে ছিটানো হয়েছে তাদের শরীরে।
তার কিছুদিন পরেই, গ্রামে ‘পালিয়ে যাওয়া’ এই জনগোষ্ঠী থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশংকায় সরকার রাজ্যগুলোর সীমানা বন্ধ করে দিলো, এমনকি পথচারীদের জন্যেও। বাড়ি ফেরার জন্যে যারা দিনের পর দিন হেঁটে চলেছে, জোরপূর্বক বিতাড়িত হওয়া শহরের ক্যাম্পগুলোতেই তাদেরকে আবারো ফিরে যেতে বাধ্য করা হলো।
এই ঘটনাটি প্রবীণ ব্যক্তিদের ১৯৪৭ এর ভারত ভাগ ও পাকিস্তান জন্মের পর গণস্থানান্তরের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। শুধু পার্থক্য এই যে, ১৯৪৭ এর গণস্থানান্তর ছিলো ধর্মচালিত, আর এবারকার প্রস্থান শ্রেণীবিভাজন চালিত। এমনকি এরা ভারতের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীও নয়। তারা শহরে কাজ করত এবং বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিল। কর্মহীন, গৃহহীন এবং হতাশ এই মানুষগুলোকে পুর্বের সেই শহরেই থাকতে হচ্ছে; এই ট্র্যাজেডি ঘটে যাবার বহু আগে থেকেই সেখানে গভীর সংকট ঘনীভূত হচ্ছিলো। আর এই ভয়াবহ দিনগুলিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জনচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন।
দিল্লি থেকে যখন মানুষ বাড়ি ফেরা শুরু করলো, আমি প্রায়শই লিখি এমন একটি ম্যাগাজিনের প্রেস পাস ব্যবহার করে দিল্লি এবং উত্তর প্রদেশের সীমান্তে অবস্থিত গাজীপুরে আমার গাড়ি প্রবেশ করে।
সে এক বাইবেলিক দৃশ্য! বা সম্ভবত না! বাইবেলেরও এই সংখ্যা জানা নেই! সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণে ঘোষিত এই লক ডাউনের ফলাফল সম্পূর্ণ বিপরীত - অকল্পনীয় মাত্রায় অসংখ্য মানুষ সেখানে ঠাসাঠাসি করে জড়ো হয়ে আছে। এমনকি এই দৃশ্য ভারতের শহরগুলোতেও একই রকম। হয়তো প্রধান সড়কগুলো ফাঁকা ঠিকই, কিন্তু বস্তি আর খুপড়িঘরে মানুষ গাদাগাদি অবস্থায় অবরুদ্ধ।
এই হেঁটে চলা মানুষগুলোর যতজনের সাথে কথা বলেছি, তাদের প্রত্যেকেই ভাইরাস নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু বেকারত্ব, অনাহার আর পুলিশের সহিংসতার তুলনায় তাদের জীবনে এই ভাইরাসের বাস্তবতা আর উপস্থিতি খুব সামান্য। মাত্র এক সপ্তাহ আগে মুসলিম বিরোধী আক্রমনে বেঁচে যাওয়া একদল মুসলিম দর্জির মধ্যে রামজিৎ নামের একজনের মন্তব্য আমাকে বিশেষভাবে চিন্তিত করেছে। তিনি পেশায় মিস্ত্রি, নেপাল সীমান্তের কাছে অবস্থিত গোরাকপুরের পথ পুরোটাই হেঁটে যাবার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি বললেন-
‘মোদীজী যখন এই সিদ্ধান্ত নেন, হয়তো তখন কেউই তাকে আমাদের সম্পর্কে বলেনি। হয়তো তিনি আমাদের সম্পর্কে কিছুই জানেন না’।
এই ‘আমরা’ মানে অন্তত ৪৬ কোটি মানুষ!
ভারতের রাজ্য সরকারগুলো এই সংকটে সন্তোষজনক আন্তরিকতা ও সহানুভূতি দেখানোর চেষ্টা করেছেন। ট্রেড ইউনিয়ন, বেসরকারি নাগরিক সহ অন্যান্য গোষ্ঠী খাদ্য এবং জরুরি রেশন বিতরণ করছেন। অথচ পর্যাপ্ত তহবিলের জন্যে রাজ্য সরকারের মরিয়া আবেদনের বিপরীতে কেন্দ্রীয় সরকার সাড়া দিয়েছেন অত্যন্ত ধীরগতিতে। দেখা যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিলে কোনো নগদ টাকা নেই। এর পরিবর্তে রহস্যজনক নতুন পিএম-কেয়ার তহবিলে শুভাকাঙ্খীদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ জমা হচ্ছে। মোদীর চেহারা অংকিত প্রি-প্যাকেজড খাবার তারপরেই আসতে শুরু করলো।
এরই সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে তার যোগ-নিদ্রা ভিডিও শেয়ার করলেন। সেখানে অ্যানিমেটেড মোদীর “ড্রিম বডি’’ জনগণকে সেলফ আইসোলেশনের মানসিক চাপ মোকাবেলা করতে যোগব্যায়ামের আসন প্রদর্শন করছে।
এই নার্সিসিজম সত্যিকার অর্থেই উদ্ভট। একটি যোগ-আসনের মাধ্যমে তিনি সম্ভবত ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীকে ভয়ংকর রাফায়েল ফাইটার জেট চুক্তিটি পুনঃবিবেচনার অনুরোধ করছেন এবং চুক্তির সেই ৭০.৮ বিলিয়ন ইউরো আমাদের কয়েক মিলিয়ন (মোট জনসংখ্যার তুলনায় যা অত্যন্ত নগণ্য) ক্ষুধার্ত মানুষের সহায়তায় জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যবহারের অনুমতি চাচ্ছেন। নিশ্চয়ই ফরাসিরাই এটা ভালো বুঝতে পারবে।
লকডাউনের দ্বিতীয় সপ্তাহে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়লো, ওষুধ এবং নিত্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ কমে যেতে লাগলো। কয়েক হাজার অনাহারী অর্ধাহারী তৃষ্ণার্ত ট্রাক চালক তখন মহাসড়কে বিচ্ছিন্ন এবং অবরুদ্ধ অবস্থায়। ঘরে তোলার জন্য প্রস্তুত ফসলগুলো তখন মাঠেই ধীরে ধীরে পঁচে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক সংকট এরই মধ্যে হাজির হয়েছে। রাজনৈতিক সংকট চলমান। বিরাজমান এইসব সংকটের মধ্যেই মূলধারার গণমাধ্যম কোভিড ১৯ এর সংবাদকে বিষাক্ত মুসলিম বিরোধী প্রচারনায় ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত করেছে। লকডাউন ঘোষণার আগে দিল্লিতে সভার আয়োজন করা তাবলিগী জামাত নামে একটি সংগঠন ভাইরাসের ‘সুপার স্প্রেডার’ হিসেবে পরিণত হয়েছে; যা মুসলিম নাগরিকদের অপবাদ দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। সামগ্রিক বিষয়টি এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যেন মুসলিমরাই এই ভাইরাস আবিষ্কার করেছে এবং ইচ্ছেকৃতভাবে একে জিহাদ হিসেবে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
কোভিড ১৯ সংকটের আরো অনেকটাই এখনো আসবার বাকি। অথবা বাকি নেই। আমরা জানিনা। যদি সংকট আসে এবং যখন আসবে, প্রচলিত সকল ধর্মীয়, বর্ণ ও শ্রেনীর যাবতীয় কুসংস্কার স্ব-স্থানে বহাল রেখেই এর মোকাবেলা করা হবে বলে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি।
২ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতে ২০০০ জন কোভিড ১৯ পজিটিভ সনাক্ত হয়েছে এবং ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। অত্যন্ত স্বল্পসংখ্যক পরীক্ষার ভিত্তিতে প্রকাশিত এই সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই নির্ভরযোগ্য নয়। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ নিয়ে প্রচুর মত পার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ কয়েক মিলিয়ন আক্রান্ত হবে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ মনে করছেন আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার অনেক কম হবে। সংকটের আসল ভয়াবহতা আমরা হয়তো কখনোই জানতে পারব না। আমরা শুধু জানি যে হাসপাতালে সত্যিকারের ভিড় এখনও শুরু হয় নি।
যেখানে ভারতের সরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলো প্রতি বছর ডায়রিয়া, অপুষ্টি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতায় মারা যাওয়া ১০ লাখ শিশুর অসুস্থতার মোকাবেলা করতে সমর্থ নয়; লক্ষ লক্ষ য²ার রোগী (বিশ্বের এক চতুর্থাংশ), অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতায় ভোগা জনসংখ্যার একটা বড় অংশ যারা ছোটোখাটো অসুস্থতায়ও ঝুঁকিতে থাকেন; এই বিশাল অরক্ষিত জনগোষ্ঠী নিয়ে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার বর্তমান পরিস্থিতির মতোই ভারতও এই সংকটের মোকাবেলা করতে সক্ষম নয়।
ভাইরাস আক্রান্তদের সেবায় কর্মব্যস্ত সকল হাসপাতালগুলোতে অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কমবেশি স্থগিত রয়েছে। দিল্লির কিংবদন্তী অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস এর ট্রমা সেন্টার বন্ধ রয়েছে। সেই বিশাল হাসপাতালের সামনে রাস্তায় বসবাস করা ক্যান্সার রিফিউজি হিসেবে পরিচিত শতশত ক্যান্সার রোগীদের পশুপালের মতোন তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
মানুষ অসুস্থ হয়ে ঘরেই মারা যাবে। আমরা হয়তো কখনোই তাদের খবর জানতে পারবো না। তাদের মৃত্যু হয়তো পরিসংখ্যানেও যোগ হবে না। গবেষণা বলে, এই ভাইরাস শীতল আবহাওয়ায় বেশি ছড়ায়- আমরা শুধু এই তথ্যের সত্যতার আশায় থাকতে পারি (যদিও অনেক গবেষক এতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন)। ভারতের মানুষ অতীতে তীব্র উত্তপ্ত গ্রীষ্মের জন্য অযৌক্তিকভাবে আর কখনোই এমন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেনি।
আমাদের কী হয়ে গেল? হ্যাঁ, এটা একটা ভাইরাস। এই ভাইরাসের আসল চরিত্র আমাদের স্পষ্টত কিছু জানা নেই। কিন্তু অবশ্যই এটা একটা ভাইরাসের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে আমাদেরকে স্ব-জ্ঞানে ফিরিয়ে আনার জন্য এটা একটা ঐশ্বরিক পন্থা। অন্যেরা বলছে এটা বিশ্ব দখল করে নিতে চীনাদের ষড়যন্ত্র।
সে যা-ই হোক না কেন, করোনা ভাইরাস ক্ষমতাশীলদের হাঁটু গেঁড়ে বসিয়ে দিয়েছে; বিশ্বটাকে এমনভাবে থামিয়ে দিয়েছে যেভাবে অন্য কিছুই আমাদের থামাতে পারতোনা। আমাদের মন এখনো পুরোনো ‘স্বাভাবিকত্ব’ ফিরে পেতে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে; এই আকস্মিক বিচ্ছেদকে অস্বীকার করে আমাদের মন এখনো ভবিষ্যতকে অতীতের সাথে জুড়ে দিতে চাইছে। কিন্তু এই বিচ্ছেদ, এই বিচ্ছিন্নতা বর্তমান। কী সর্বনেশে ব্যবস্থা আমরা নিজেদের জন্য গড়ে তুলেছি, এই ভয়ঙ্কর নিরাশা আমাদেরকে তা পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ দেয়, বুঝিয়ে দেয় যে পুরোনো ‘স্বাভাবিকতা’ ফিরে পাবার মতো চরম ক্ষতিকর এখন আর কিছুই হতে পারে না।
ঐতিহাসিকভাবেই মহামারী মানবজাতিকে অতীত ছেড়ে বিশ্বকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে আসছে। এই মহামারীও তার চেয়ে আলাদা কিছু নয়। এই মহামারী একটি দ্বার, এ বিশ্ব থেকে পরবর্তী বিশ্বের মধ্যে একটি প্রবেশপথ।
সমস্ত পূর্বসংস্কার এবং বিদ্বেষ, আমাদের লালসা, তথ্য ভান্ডার এবং ভ্রান্ত ধারণার মৃতদেহ সাথে বয়ে নিয়ে, আমাদের মৃত নদী আর ধোঁয়াটে আকাশকে পেছনে ফেলে আমরা এই প্রবেশপথের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলাকে বেছে নিতে পারি। অথবা একটি হালকা ব্যাগ পিঠে এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্নে ধীর ধীরে হেঁটে চলতে পারি, এবং তার জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে পারি।
Source Article: ‘The pandemic is a portal’ by Arundhati Roy
Link: Click This Link
Image Source: Click This Link
২| ২৮ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:২৫
সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: কতদিন পর এলেন এরিস!
৩| ২৮ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:৫৩
সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: অরুন্ধতী রয়ের লম্বা লেখা। পড়লাম পুরোটাই। আপনার অনুবাদ? দু'বার এসেছে লেখাটি, এডিট করে নেবেন।
অরুন্ধতী রয়ে ফিরে আসি। ওনার বুকার প্রাইজ বিজয়ী বইটি পড়ে ধারণা করা যায় - অপরিসীম দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে উনি লেখক হয়েছেন। 'স্মল থিংস' অথবা মূলক রাজ আনন্দের 'আনটাচেবল' / অচ্ছুৎদের প্রতি তার মায়া অনেক। তাই লৈঙ্গিক দিক থেকে যদিও নয়, তবে নাম ও পৈতৃক পরিচয়ে ভারতের একটি সুবিধাভোগী ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়েও তিনি কলম ধরেছেন সগোত্রের বিরুদ্ধে, বারবার। ওনার কোন এক সাক্ষাৎকারে একটা উক্তি আমার মনে দাগ কেটে আছে যা অনেকটা এরকম যে - লেখকের উচিৎ খ্যাতির আড়ালে থাকা। খ্যাতি পেয়ে গেলেই আর দরকারি কথাটি বলে উঠবার মত সৎসাহস লেখকের থাকে না। হুমায়ূন আহমেদকে সামনে রেখে লিখতে শুরু করা বাংলার অসংখ্য তরুণ যুবকের মত একজন, এই আমাকে, অরুন্ধতীর এই উক্তি সাহস জুগিয়ে চলেছে নিরন্তর দরকারি বাক্য উচ্চারণের নিমিত্তে লেখার।
বিশ্ব জুড়ে যুগে যুগে কোন একটা জাতি টার্গেটেড হয়ে নিষ্পেষিত হয়। প্রথম সহস্রাব্দের পর সে জাতি ছিল ইহুদী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে টার্গেট মুসলিমেরা।
ভারতের রাজনীতিতে এই মৌলবাদ তলায় তলায় প্রবাহিত হচ্ছিল দীর্ঘদিন, এখন একদম তা উলঙ্গ রূপ ধারন করেছে। কিন্তু আমার সবচে বেশী ভয় লাগে যখন আর্ট মিডিয়ামের মাধ্যমে একটা ব্লাস্ফেমিক হেজিমনি ছড়ানোর চেষ্টা চলে। কারণ কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে যদি বলা হয় - শ্লোগান দাও অমুক জাতি নিকৃষ্ট, তবে বন্দুকের ভয়ে হয়তো শ্লোগান দেবে ঠিকই, কিন্তু জানা থাকবে যে, কাজটা আমাকে দিয়ে জোর করিয়ে করে নেয়া হয়েছিল, ফলে বিপরীতমুখী চিন্তার সুযোগ থাকবে বরাবরই। কিন্তু ইন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়াকে দিয়ে যদি এই খেলাটা খেলা হয় তবে অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত, শিক্ষিত- অশিক্ষিত জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে সেই প্রোপ্যাগান্ডা এড়ানো মুশকিল।
খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, ইদানীং মারাঠাদের বীরত্ব নিয়ে, আর মোগল পাঠান তুর্কদের শত্রু চিহ্নিত করে ছবি বানানোর হিড়িক পড়েছে বলিউডে। পদ্মাবত মুভিতে আলাউদ্দিন খিলজির রোল প্লে করা রানভির সিং , তানহাজী মুভিতে সম্রাট আওরাংজেবের দেহরক্ষী উদয়ভান সিং রাঠোরের রোলে সাইফ আলি খান, বা পানিপথ মুভিতে আহমেদ শাহ আবদালির চরিত্রে সঞ্জয় দত্ত - এদের সবার প্রজেকশন অ্যানিমেলস্টিক বা জান্তব মনে হয়েছে আমার কাছে। এসমস্ত মুসলিম বাদশাহ যত না মানুষ, তার চে' বেশী পশু, এমনটা - এই জেনারেশনের ভারতবাসিদের কাছে প্রচার করাই এই সমস্ত প্রোপ্যাগান্ডা মুভির লক্ষ্য।
সেদিকে ভারতের লেখক শিবিরের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো মধ্যপন্থি, এটা স্বস্তি দেয়। শশী থারুরের লেখা ভালো লাগে। অরুন্ধতী রয়ের আরও একটা লেখা আপনার সূত্র ধরে পড়া হল।
পার্শ্ববর্তী দেশে সাম্প্রদায়িকতার এমন নগ্ন উত্থানের পর, এখন আমাদের বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে ন্যায়ের ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মনোভাব বজায় রেখে , আমাদের দেশের অন্যান্য ধর্ম্যালম্বীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, তারপর এই সমস্ত সাম্প্রদায়িক প্রোপ্যাগান্ডার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া জরুরী। গর্বের সাথে নিজের মুসলিম পরিচয়ের জানান দেয়াই তো এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ একটা 'সেকুলার' গোষ্ঠীর কাছে 'মধ্যযুগীয় বর্বর' বলে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার একটা উপক্রমণ। বাইরের বিশ্বে কি হচ্ছে, সে নিয়ে আর না ই কথা বলি।
শুভকামনা , ব্লগের পুরাতনতম বন্ধু!
১৫ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:০১
এরিস বলেছেন: পোস্ট করে রিপ্লাই দিতেই ভুলে গেছি আবির! আসলেই আসা হয় না এদিকে আর!
আপনি আপনার মতো এতো পড়াশোনা জানা মানুষ নই। আপনার অর্ধেক কথা আমার মাথার উপর দিয়ে হুউউউস করে চলে গেছে।
অরুন্ধতী রায়ের অনেক লেখা যে পড়েছি তাও নয়। আসলে এই লেখাটা আমি আমার দেশের কন্টেক্সট এ ভেবেছি, সেই ভাবনা থেকেই অনুবাদ করা। তবে শেষের কিছু কথা বাদে লেখাটি আমার নিজের কাছেই একপেশে অভিযোগ বলে মনে হয়েছে। কিন্তু একজন লেখক এর বাইরেও আর কিইবা বলতে বা লিখতে পারতেন। ওই শেষটুকুই নিয়েছি আমি। ব্যাগ হালকা করে ফেলেছি।
এই লেখার ধারাবাহিকতায় আরেকটি লেখা তিনি লিখেছেন বলে জেনেছি। এখনো পড়ে ওঠা হয়নি।
অনেক ধন্যবাদ আবির। আমার লেখার সুবাদে আপনার পড়া হলো জেনে অনুপ্রাণিত বোধ করছি।
৪| ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১২:১৩
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: অরুন্ধতী রায় ৩ এপ্রিলে এ আর্টিকেল লিখেছিলেন। তার লেখার মূল বিষয় কোভিডের সময় মোদী সরকারের নেয়া পদক্ষেপ সমূহ, বিশেষ করে লক-ডাউন সমালোচনা/পর্যালোচনা। আজ ২৮ এপ্রিল। ভারতের মৃত্যুসংখ্যা আজ পর্যন্ত ৯৩৭। লেখাটা পড়তে পড়তে ঐ প্যারাটা খুঁজছিলাম, যেখানে অরুন্ধতী রায় কিছু সুপারিশ সাবমিট করেছেন কোভিড মোকাবেলার জন্য মোদির পদক্ষেপ কী কী হতে পারতো, বা এখনো কী কী হতে পারে। সেগুলো দিতে তিনি অক্ষম বা ব্যর্থ হয়েছেন। আলটিমেটলি, শর্ট টাইমে নেয়া মোদির সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না। ওটা অনেক দেশের জন্য উদাহরণ হয়েছে। ৩ দিন সময় দেয়ার পর ঘোষণা দিলেও জন-ভোগান্তি কম হতো না, বরং বেশিই হতো, মানুষ এটাকে আরো সহজ/রিলাক্সড মোডে নিত বলে।
আমি অবাক হলাম, এই বড় লেখাটা এত ধৈর্য নিয়ে অনুবাদ করা দেখে। অনুবাদের জন্য বিরাট ধন্যবাদ আপনি প্রাপ্য, কিন্তু অরুন্ধতী রায় প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন নি। তার কিছু সুপারিশ ভারত ও উপমহাদেশ, এমনকি বিশ্ববাসীর জন্যও থাকতে পারতো। খালি সমালোচনা আর আবেগ দিয়া তো নামে মাত্র দায়িত্ব পালন হইয়া গেল- কোভিডের সময়ও আমি কলম ধরেছি।
শুভ কামনা এরিসের জন্য।
১৫ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:০২
এরিস বলেছেন: আবির ভাইয়ের মন্তব্যের উত্তরে সেটাই বলেছি। একপেশে লেখা, কেমন যেন দায় ছিল তাই লিখেছি, এই ধরণের।
আমি শুধু শেষের প্যারাটা মাথায় নিলাম। বাকিটায় নিজের দেশকে বসিয়েছি আর হেসেছি, সব মেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাইবোন, ভাবনা এক, তাদের সিদ্ধান্ত এক।
আপনিও অনেক শুভকামনা জানবেন!
৫| ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:১৭
রাজীব নুর বলেছেন: দিদন দিন বিজ্ঞানীদের উপর আমার রাগ বাড়ছে। এত দিন হয়ে গেল তারা আজও ওষধ আবিস্কার করতে পারলো না।
১৫ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:০৬
এরিস বলেছেন: কে জানে! ওষুধ হয়তো রেডিই আছে!
ডঃ ভাস্কর চক্রবর্তী নামে একজনের একটি লেখা পেয়েছি। অনুবাদ করতে পারি কিন্তু তা পাবলিশ করা নিজের জন্য ঝুকিপূর্ণ হয়ে যাবে বলে মনে করছি।
আই উইশ নির্ভয়ে শেয়ার করতে পারতাম!
৬| ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ২:০০
নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
ধন্যবাদ এরিস অরুন্ধতী রয়ের চমৎকার একটি্
আর্টিকেলের বঙ্গরূপ দেবার জন্য। অনেক কিছু
জ্ঞানগর্ভ কথা জানা হলো। তবে আমরা এখনো
ধারনা করতে পারছিনা যে করোনা বর্তমান্ ও
পরবর্তী সময়ে আমাদের কোন পর্যায়ে নিয়েৎ
যাবে। সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে ভাববার।
তাই প্রস্তুতি নয কাজে লেগে পড়তে হবে এখনি।
১৫ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:০৬
এরিস বলেছেন: ঠিক কী কী কাজ করা যেতে পারে নূর ভাই? আমি এখনো ভেবে উঠতে পারিনি!
৭| ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ৩:৪৮
নেওয়াজ আলি বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ প্রিয় লেখকের লেখা পড়তে দেওয়ায় । মাঝে মাঝে আরো দিবেন
৮| ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ ভোর ৫:৪৫
সোহানী বলেছেন: অরুন্ধতীর লিখা আমার ভালো লাগে। স্রোতের বিপরীতে সত্যিকারের একজন মানবিক মানুষ।
ধন্যবাদ লিখাটি জন্য।
©somewhere in net ltd.
১|
২৮ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:২৪
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: লেখাটা দু'বার এসেছে বলে অনেক বড়ো দেখাচ্ছে।
এরিসের পোস্ট দেখে পড়তে এসেছি। আসছি একটু পর।