নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

ফাহমিদা বারী

আমার ব্লগ মানে গল্প। গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানাই :)

ফাহমিদা বারী › বিস্তারিত পোস্টঃ

লোভ

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৩:০৫



এক
জানালার পাশে রোদে শুকোতে দেওয়া বরইয়ের মিষ্টি আচার গুলো দেখে প্রাণটা একেবারে আঁইঢাঁই করে উঠলো। আহা! কী মিষ্টিই না দেখাচ্ছে! এক্ষুনি টপাটপ কয়েকটা মুখে পুরতে না পারলে প্রাণটাই বুঝি বেরিয়ে যাবে।
এদিক ওদিকে তাকিয়ে হাতটা আচারের বয়ামের দিকে বাড়াতেই কোথা থেকে যেন গিন্নি উড়ে এসে ছোঁ মেরে বয়ামগুলোকে সরিয়ে নিয়ে গেল। করলার তিতা গলায় মিশিয়ে বললো,
‘এমন ছোঁক ছোঁক স্বভাবের মানুষ জীবনে দেখিনি বাপু! মিষ্টি কিছু দেখলেই লোভে জিভ লকলক করে। ডায়াবেটিস কি আমার নাকি তোমার? লোভ সামলানো কাকে বলে সেটাও জীবনে শিখতে হয়, বুঝেছো?’
এমনি কিছু জ্বালাময় বাক্যবাণ ঝেড়ে গিন্নি সেই জায়গা ত্যাগ করলো। সাথে আচারের বয়ামগুলোকেও নিয়ে গেল। মনে মনে গিন্নির চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করলাম। খেতেই যদি না দেবে তাহলে এত নানা রঙের আচার বানানো কীসের জন্যে? আর সেগুলোকেও এত সাজিয়ে গুছিয়ে চোখের সামনে শুকোতে দেওয়ার উদ্দেশ্যটাই বা কী?
ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে গত বছর। কত আগে বাঁধিয়েছি তা জানি না। অবশ্য বয়সও কিছু কম হয়নি। চল্লিশের কোঠা ছুঁয়ে ফেলেছি ভালোভাবেই। এই বয়সে শুধু ডায়াবেটিস কেন, হার্ট কিডনী লিভার কোনোকিছুর অসুখই আজকাল বাদ যায় না।
যেদিন ডায়াবেটিস ধরা পড়লো, পাংশু মুখে ভাবতে বসলাম...জীবনের মিষ্টি স্বাদটা আজ থেকে চিরতরে বিদায় নিল। এমনিতেই ধাক্কা খাওয়া জীবনে ওটুকুই যা মিষ্টি অবশিষ্ট ছিল। বাকী সবই তো তিতাই তিতা!
রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম, অফিসের বসের রক্তচক্ষু, বাজারে অগ্নিমূল্য, সহকর্মীদের ল্যাংমারা, আত্মীয় স্বজনের টিপ্পনী...এবং সেই সাথে গিন্নীর খ্যাঁচখ্যাঁচানি। জীবনে মিষ্টি বলতেই ছিল চমচম, সন্দেশ, পানতোয়া...আহা!
আর কী! এখন থেকে সেটাও নাই হয়ে গেল।
ডাক্তার আমার পাংশুটে মুখ দেখে ফিক করে হেসে ফেললেন,
‘আরে মশাই, তাও তো যৌবনকালটা মণ্ডা মিঠাই প্রাণভরে চেখে দেখতে পেরেছেন। আজকাল বিশ-বাইশ বছরেও এই রোগ ধরে বসে, জানেন?’
আমি যেন কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পেলাম। যাক, আমি একাই এই ইহজগতে একমাত্র ভূক্তভোগী নই তাহলে! খুশি চেপে রেখে দুঃখ দুঃখ মুখ করে বললাম,
‘সত্যি নাকি? কী বলছেন ডাক্তার সাহেব!’
‘জি হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। বরং আমি তো বলবো একটা বয়সের পরে ডায়াবেটিস আশীর্বাদের মতো। কন্ট্রোল করার জন্য আর কাউকে ঠেলতে হবে না। এটাই আপনাকে ঠেলবে।’
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম। মনে মনে বললাম, ‘তাই যেন হয়!’
কিন্তু কী হতে গিয়ে কী হলো!
এর পরে থেকে আমি আর কী কন্ট্রোল করবো, গিন্নি ছেলেপুলে সবাই এখন আমাকে কণ্ট্রোল করছে। যেটাতেই হাত বাড়াতে যাই, সাথে সাথেই আমার ডায়াবেটিসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নিজেরা দেদারসে আমারই চোখের সামনে সমানে চব্য চোষ্য খেয়ে যাচ্ছে। আবার সেগুলোর জোগানদারও হলাম আমি। এমনই আমার পোড়া কপাল!
মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম, নিজে খেতে পারবো না তো কাউকে খেতেও দিব না। দেখি, আমার চোখের সামনে দিয়ে কীভাবে আচার শুকোতে দেওয়া হয়।
ছুটির দিন বলে বেশ একটা ভাতঘুম দিয়ে উঠলাম। সপ্তাহের বাকী পাঁচদিন তো এই জিনিসের সাথে মোলাকাতই হয় না! বিকেলে চা খেয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসবো বলে বের হতে যাচ্ছি, এমন সময়ে গিন্নি এসে এক ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিলো। হাতে নিয়ে দেখি বেশ লম্বা ফর্দ। চালকুমড়া, চিনি, সরিষা তেল, বরই, তেঁতুল, জলপাই, কাঁচা আম...বাব্বাহ! এ যে একেবারে জিভে জল ধরানো সব জিনিসপত্র। গোমড়া মুখে বললাম,
‘সেদিনই না একগুচ্ছ এসব জিনিসপত্র এনে দিলাম! আজকে আবার কেন?’
গিন্নি ঠোঁট উল্টিয়ে আহলাদের সুরে বললো,
‘বাঃ! আচার, মোরব্বা বানালে কি একা একা খাবো? আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশীকে না দিয়ে খাওয়া যায় নাকি?’
‘বাবাহ! আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশীও ভাগ পাচ্ছে? কেবল নিজের পতিদেবতাকেই চোখে দেখতে পাচ্ছো না, তাই না?’
‘দেখ, এত বেশি লোভ ভালো না বুঝেছো? একটু আত্ম নিয়ন্ত্রণ করাও শিখতে হয়।’
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছি, এমন সময় দরজার কলিং বেল বেজে উঠলো।
পাশের বাসার ছোট মেয়েটা এসেছে। তার বাবা দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। চকলেট, খেলনা...ইত্যাদি বিস্তর জিনিসপাতি এনেছেন। কিছু জিনিস আমাদের ছেলেটার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন।
সেগুলো হাতে নিয়েই গিন্নির ফর্সা মুখ কালো হয়ে গেল। আমাকে ঠেস দিয়ে বললো,
‘এসব আর কিছু না, দেখানো...বুঝেছো? আমরা দিই আমের আচার, আর তারা দেয় বিদেশী চকোলেট। দেখাবে না তো কী! থাকলে দেখাবে নাই বা কেন? তোমার মতো তো আর খালি কলম পিষে না। তাদের অনেকদিকে আমদানী আছে!’
আমি হাওয়া বদলের পূর্বাভাষ টের পেলাম। পাশের বাসার ভদ্রলোক বিশিষ্ট সরকারী আমলা। সচিবালয়ে বসেন। প্রায়ই কীসের যেন ট্রেনিং ফ্রেনিং করতে বিদেশ ভ্রমণ করেন। তিনি তো বিদেশী চকোলেট আনতেই পারেন!
সেকথা গিন্নীকে অনেক বুঝিয়েছি। লাভ হয়নি। তার এক কথা,
‘বেশ তো! সে না হয় অফিস থেকে ট্রেনিংএ যাচ্ছে। আমরা নিজেদের টাকায় বিদেশ যাবো। তুমি তোমার আয় বাড়াতে পারো না, সেকথা বল!’
আবার যাতে প্রসঙ্গ সেদিকে না যায় তাই আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম,
‘কী যেন আনতে হবে বলছিলে...দেখি এগুলো বুঝিয়ে দাও! কতটুকু করে আনতে হবে?’
গিন্নি ঝাঁঝিয়ে উঠলো,
‘কিচ্ছু আনতে হবে না। যাও... তুমি যে রাজকার্য করতে যাচ্ছিলে, সে কাজেই যাও!’

দুই
অফিসে জুন মাসের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে।
নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই। আমার টেবিলের ওপরে ফাইলের লম্বা চূড়া। দেখে শেষ করতে পারছি না। ভালোমত চেক না করে কোনো ফাইল ছাড়তেও পারছি না।
এই ভয়ানক ব্যস্ত সময়ের মধ্যেই পিয়ন এসে খবর দিল, বড় সাহেব সালাম দিয়েছেন। এই সময়ে কাজ বন্ধ রেখে উঠে যাওয়াও মুশকিল। ফিরে এসে আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হয়। আমি মুখ ভর্তি বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলাম,
‘এখনই যেতে হবে?’
‘জি স্যার, এই মূহুর্তেই!’
আর কী বলার আছে! ফাইলের স্তুপ সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, বসের সাথে সাক্ষাত করে আসার জন্য।
আমার বসের চেহারা বেশ তেল চুকচুকে। বয়সে আমার চেয়ে ছ’সাত বছরের বড়। কিন্তু বেশ নধরকান্তি শরীর, আঁটোসাটো মুখ। আমার মতো চিমসে ধরা মুখ নয়। আর তা হবেই বা না কেন? খাওয়া দাওয়াতে তো আর কার্ফু জারী করা নেই, যে চেহারা চিমসে যাবে!
গিয়ে দেখি, বসের রুমে আরো গোটা তিনেক লোক আগে থেকেই বসা। টিকাদার শ্রেণীর কেউ হবে বলে মনে হলো। প্রত্যেকের সামনে একটা করে প্লেটে রসগোল্লা, সমুচা। আমি যেতেই বস সাদরে সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন,
‘এই যে, আসুন আসুন নিয়াজ সাহেব। আপনার কথাই হচ্ছিলো। কী ব্যাপার আপনাকে এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? খাওয়া দাওয়া করেন না নাকি?’
আমি বেশ অবাক হলাম। বসের মুখের এমন আদর আমার কপালে তেমন একটা জোটেই না বলতে গেলে। ইনি এখানে আসার পরে থেকেই সুযোগ খুঁজছেন, কীভাবে আমাকে সরিয়ে দেওয়া যায়। আমিও মাটি কামড়ে পড়ে আছি। চাকরির পরে থেকে এই ডিভিশনেই আছি বেশ অনেক বছর। কেমন যেন বাপদাদার ভিটে বলে মনে হয়। চাইলেই কেউ ‘হঠ যা’ বলে হঠিয়ে দেবে এটা মানতে মন চায় না।
আমি চেয়ারে বসতে বসতে বললাম,
‘এই তো স্যার, খাওয়া দাওয়া কন্ট্রোল করতে হয় তো, তাই আর কী!’
‘আহ হা! কেন কন্ট্রোল করবেন এই বয়সে? বসুন, মিষ্টি খান।’ বস পিয়নকে ডাকার জন্য বেল টিপতে যেতেই বললাম,
‘স্যার, মিষ্টি খাব না...আমার ডায়াবেটিস।’
বস যেন ভীষণ দুঃখিত হলেন এমন গলায় বললেন,
‘এঃ হে! ডায়াবেটিস বাঁধিয়ে বসেছেন! নিশ্চয়ই খুব বেশি অনিয়ন্ত্রিত খাওয়া দাওয়া করেছেন আগে, সেজন্যই এই দশা। আমার দেখুন না, আলহামদুলিল্লাহ এই বয়সেও ওসব বাঁধে টাধেনি। একটু লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই হলো, বুঝলেন না?’
আমি বুঝলাম। এই জ্ঞান এখন আমাকে সবাই দেয়। ফ্রি সার্ভিসিং এর মতো। আমি কাউকে বোঝাতে পারি না যে, বাপ-মা’র ছিল তাই আমারও আছে। সবাই নিজের মতো করে জ্ঞান দিতে থাকে। আমিও নিতে থাকি।
বস এবারে গা ঝাঁকানি দিয়ে বললেন,
‘আচ্ছা, সে যাক...আপনার সাথে কি এনাদের আলাপ হয়েছে?’
আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম, সবক’টাই পুরনো পাপী। ইতিপূর্বে বহুবার আমার রুমে এসে জ্বালা যন্ত্রণা দিয়ে গেছে। সেসব কিছু ভেঙ্গে না বলে বললাম,
‘জি, স্যার আলাপ হয়েছে।’
বস সম্পূর্ণ ভিন্ন আলাপে চলে গেলেন এরপরে। আমি ধারণা করছিলাম, এরপরে কী বলতে পারেন। কিন্তু আমার সেইসব চিন্তাভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে তিনি বললেন,
‘আপনার কি বিদেশে টিদেশে যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি নিয়াজ সাহেব? পাসপোর্ট করা আছে? আজকাল পাসপোর্ট করা কি ঝক্কির কাজ সেটা জানেন? সারাদিন পার্সপোর্ট অফিসে গিয়ে বসে থাকতে হয়। তবুও বেশিরভাগ দিন কাজ হয় না। এই যে, আলম সাহেবকে দেখছেন...উনার এক ভাই আছেন পাসপোর্ট অফিসে। সেখানে গিয়ে শুধু উনার নাম বলবেন। সেকেণ্ডেই কাজ করে দেবে।’
আলম সাহেব বসের কথার প্রমাণস্বরূপ ঘাড় নাড়িয়ে বললেন,
‘জি, স্যার। এসব তো কোন বিষয়ই নয়। আর বিদেশে যাওয়ার চ্যানেল ট্যাণেলের সন্ধান চাইলেও দেওয়া যাবে স্যার। এই তো, স্যারকেই আগামী মাসে একটা সুযোগ করে দিলাম।’
আমি বসের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার মুখে মুচকি মুচকি হাসি। বলে কী? এই লোকের হাতে বিদেশে যাওয়ার চ্যানেল আছে? আমি বিষয়টা খোলাসা করে জানার জন্যই বললাম,
‘আপনি কীভাবে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবেন? ঠিক বুঝতে পারলাম না!’
‘হেহ হে...সেসব ভেতরের কথা। সব কি খুলে বলা যায়? আমি তো আর ব্যবস্থা করবো না, শুধু জায়গামত একটু নাড়া দিব...ইয়ে মানে বুঝতে পারলেন না? যাক, সেসব। শুধু কিছু দরকার থাকলে অবশ্যই বলবেন।’
এবারে আমার বস বললেন,
‘আরে আমাদের চাকরিতে মজাটা কোথায় বলুন? মাঝে মাঝে একটু দেশের বাইরে ট্যুর ফ্যুর না করতে পারলে এসব চাকরি করতে কি আর ভালো লাগে?
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আমলারাই তো সব সরকারী ট্যুরগুলো নিয়ে নিচ্ছে। আমরাও চাইলে আমাদের ডিপার্টমেণ্টে কিছু বিদেশী ট্রেনিং এর ব্যবস্থা রাখতে পারি। আর এসবের জন্য আমাদের শুধুমাত্র একটু সঠিক জায়গাতে নক করতে হবে, বুঝলেন তো!’
আমি তেমন বেশি কিছু বুঝলাম না। তবু ঘাড় নেড়ে বললাম,
‘জি, স্যার বুঝেছি। তবে আপাতত স্যার আমার বিদেশ যাওয়ার তেমন কোনো চিন্তাভাবনা নেই। তাই এই মূহুর্তে পাসপোর্ট না করালেও চলবে। এবারে উঠি স্যার? মানে... অনেক ফাইল জমে আছে!’
‘আরে, করবেন ফাইলের কাজ! কাজ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না! বসুন বসুন! এই যে আলম সাহেবের পাশে যাকে দেখতে পাচ্ছেন, তিনি হলেন মহিউদ্দিন সাহেব। আপনার ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তির কাজ শেষ? যদি শেষ না হয়ে থাকে, তাহলে ইনি আপনাকে হেল্প করতে পারেন।’
কথাটা শুনেই গিন্নির সেদিনের ফোঁসফোঁসানি মনে পড়ে গেল... ‘এই সরকারী চাকরির জোর খাটিয়ে কতজনে কত ভালো ভালো স্কুলে ছেলেমেয়েকে ভর্তি করে। তুমি হচ্ছো একটা ঢোঁড়া সাপ। কিছুই করতে পারলে না জীবনে!’
আমার মুখের ভাব দেখে বস কিছু বুঝলেন কী না কে জানে, দ্বিগুণ উদ্যমে বললেন,
‘এই যে মহিউদ্দীন সাহেব... নিজাম সাহেবকে আপনার লিংকগুলো দিয়ে দেবেন আজই। আপনারা থাকতে আমরা কেন বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করতে এত ঝামেলা পোহাতে যাব, বলুন!’
মহিউদ্দীন সাহেব তার মুখের কথা কেড়ে নিয়েই বললেন,
‘জি স্যার। নিশ্চয়ই...নিশ্চয়ই!’
বস এক এক করে সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। সাথে প্রত্যেকের অনন্য একেকটা ক্ষমতার সাথেও পরিচিত হলাম। শেষমেষ একটু জোর করেই উঠে পড়লাম। নির্দিষ্ট সময়ে ফাইলগুলো ছাড়তে না পারলে বসই একসময় আমাকে চিনতে পারবেন না।
‘এবার উঠি স্যার। অনেক গুলো ফাইল পড়ে আছে, কাজ একেবারে এলোমেলো...বড় সাহেব যেকোন সময় তাড়া দিবেন...।’
‘উঠবেন? আচ্ছা উঠুন। ইয়ে...নিজাম সাহেব...আপনার কাছে আজ তিনটি ফাইল গিয়েছে মনে হয়। আমি মার্ক করে দিয়েছি। দেখলেই বুঝতে পারবেন। ফাইলগুলো ছেড়ে দিয়েন। বেশিক্ষণ আটকে রাখবেন না। বুঝেছেন?’
এতক্ষণে বুঝলাম। এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। মালিক তো চাইলেই যেখান থেকে খুশি সেখান থেকেই ঘাস কাটতে পারেন। কিন্তু ঘোড়া যদি জেদ ধরে বসে থাকে, তাহলে তাকে তো একটু ভুলিয়ে ভালিয়ে সরিয়ে দিতে হয়...নাহলে আরাম করে ঘাসটা কাটবে কীভাবে?
আমি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার রুমে ফিরে এলাম।

তিন
গিন্নির ক্যাচক্যাচানিতে ইদানীং বাসায় থাকতেই ইচ্ছে করে না। সারাক্ষণ কানের কাছে অভিযোগের ঘণ্টা বাজাতে থাকে,
‘দিনরাত অফিসে পড়ে থাকো। অথচ যে লাউ সেই কদু! নিজের কিছুই পাল্টাতে পারলে না! না স্বভাবটা... না অভাবটা!’
‘লোকজন অল্প বয়সেই এপার্টমেণ্ট কিনে ফেলে। এমনই আমার পোড়া কপাল, এপার্টমেন্ট তো দূর...একটা ইটও আজতক তুমি কিনতে পারলে না!’
‘দেশের বাইরে যাওয়া তো আর আমাদের ভাগ্যে নেই, বাড়ির কাছের কক্সবাজারে লোকে বছরে দুইতিন বার করে যায়। আর তুমি!
‘পাশের বাসার ভদ্রলোক যে চাকরি করেন তুমিও সেই একই রকম সরকারী চাকরিই করো। অথচ তার আছে ইয়া বড় গাড়ি আর তোমার আছে ইয়া বড় দড়ি!’
.......................................
অভিযোগ অভিযোগ আর অভিযোগ। শুনতে শুনতে মাথার মধ্যে কেমন যেন শর্ট সার্কিট হয়ে যায়।
স্বাভাবিক চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলি। অফিসে গিয়েই সব ফাইল ধুমধাম সই করে ফেলি। কোন বিল পেণ্ডিং রাখি না। সব আপডেটেড। ঠিকাদার যে আইটেমে যত টাকা ধরে দেয়, সব সই করে দিই। ঠিকমত চেকও করে দেখি না আর। কী হবে এত সাধু সেজে? গিন্নি যা চায়, তাই হোক!
স্যারের চিনিয়ে দেওয়া মহা কামিয়াব লোকদের সাথে তাল দিয়ে চলি। হাত কচলাতে কচলাতে একেকজন জিজ্ঞেস করে,
‘স্যার, কোন সেবা লাগবে কী না অধমকে একটু বলবেন।’
‘সেবা? আচ্ছা, বছরের এই সময়ে তো কক্সবাজারে হোটেল বুকিং পাওয়া যায় না...তাই না? ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’
‘কী বলেন স্যার? এইটা কোনো বিষয়? এক্ষুণি সব বন্দোবস্ত পাকা করে আপনাকে প্লেনে উঠিয়ে দিচ্ছি!’
যেমন বলা তেমন কাজ! আসলেই মহা মহা কামিয়াব লোক একেকজন। সোজা রাস্তায় যা মাথা কুটেও করতে পারা যায় না, এরা আঁকাবাঁকা পথে দু’মিনিটেই তা করে ফেলে।
প্রথমবার প্লেনে উঠে গিন্নি বিমোহিত। ছেলেমেয়েরাও পুলকিত! হোক না ডোমিস্টিক ফ্লাইট, তবু তো আসল প্লেন! এই প্লেনে চড়েই তো সাঁই করে বিদেশ যাওয়া যায়। এটুকু যখন হলো, ওটুকু আর হতে দেরি কোথায়?
বাসে চড়ে অফিসে যাওয়া খুব কষ্টকর। ভাবছি খুব তাড়াতাড়িই একটা গাড়ি কিনে ফেলবো। হুট করে সবকিছু করতে গেলে লোকজনের চোখ টাটাতে পারে। প্রথমে একটা সেকেণ্ডহ্যাণ্ড কিনে একটু আইওয়াশ করে নিতে হবে। কিছুদিন পরে ‘নষ্ট হয়ে গেছে’ বলে ফেলে দিয়ে নতুন একটা কিনে নিলেই হবে।
গিন্নির মেজাজ মর্জি ইদানীং খুব সহনীয় মাত্রায় থাকে। হাসি ছাড়া আর কথাই বলে না! গলার সুরে আহলাদ ঝরে ঝরে পড়ে।
ইতিমধ্যে এপার্টমেন্টেরও দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছে। আমিও আর বসে নেই। শুরু যখন করেইছি, আর দেরি করে কী হবে? একটা এপার্টমেণ্টও তাড়াতাড়ি বুকিং দিয়ে ফেলতে হবে। বুড়ো বয়সে কি ভাড়া বাড়িতে থাকবো নাকি?
আমি আজকাল বেশ স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠেছি। কারো বলতে হয় না, নিজে থেকেই সবকিছু কন্ট্রোল করে চলি। তেল চর্বি মিষ্টি একেবারে ধরিই না বলতে গেলে!
বেশিদিন না বাঁচতে পারলে এই আয়েশ ভোগ করবো কীভাবে? ভোগের জন্যই তো এতকিছু! মরে গেলে আর কী কাজে আসবে?
আমাকে কন্ট্রোল করে চলতে দেখে গিন্নি আমার মহাখুশী। ডগমগে গলায় বলে,
এই তো, এতদিনে তুমি আমার মনের মতো হয়েছো! আগে তো বুঝতেই চাইতে না। কী যে ছেলেমানুষি করতে!
এত লোভ করা ভালো নয়। সবসময় এভাবে লোভ সামলিয়ে চলতে হয়, বুঝেছো?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই।

বুঝেছি বৈকি!




মন্তব্য ১৮ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ভোর ৪:৩২

ধুরন্ধর বলেছেন: স্বচ্ছন্দ লেখনী। বেশ আয়েস করে পড়ে ফেলা যায়। তবে অল্প কিছু বানানে ভুল রয়ে গেছে। একজন ভালো লেখকের বানানের প্রতি অনেকখানি মনোযোগ দেওয়া দরকার।

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৪৪

ফাহমিদা বারী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আমার লেখা পড়ার জন্য। বানানগুলো দয়া করে একটু ধরিয়ে দিলে উপকৃত হতাম। :)

২| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ৯:০৬

দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: অসাধারণ হয়েছে। তবে একটু ছোট করে লিখেতে হতো এতো বড় পড়ার সময় কোথায়।






ভালো থাকুন নিরন্তর। ধন্যবাদ।

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৪৬

ফাহমিদা বারী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। :)
ব্লগে হয়ত এত বড় লেখা কেঊ পড়ে না। ছোট ছোট করে পোস্ট করতে হতো মনে হয়।
তবে ছোট গল্পের আকৃতিগত দিক থেকে তো মনে হয় বেশি বড় হয়ে যায়নি।

৩| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:০০

জাহিদ অনিক বলেছেন: বরং আমি তো বলবো একটা বয়সের পরে ডায়াবেটিস আশীর্বাদের মতো। কন্ট্রোল করার জন্য আর কাউকে ঠেলতে হবে না। এটাই আপনাকে ঠেলবে।’ দারুণ উপলব্ধি।


আপনি ভাল লেখেন, ঝকঝকে। বোঝাই যায় বেশ সাবলীল।

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৪

ফাহমিদা বারী বলেছেন: গল্প পড়ে অনুপ্রাণিত করার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। :) শুভেচ্ছা রইলো।

৪| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৫২

ফয়সাল রকি বলেছেন: সব অধমের একই অবস্থা!
এই বিষয়ে আমারো একটা লেখা ছিল, সময় থাকলে দেখে আসতে পারেন... ছোট গল্প: নেকাব
লেখায় +++

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:১৬

ফাহমিদা বারী বলেছেন: ধন্যবাদ। পড়বো আশা রাখি। :)

৫| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১:৪৪

ভ্রমরের ডানা বলেছেন:





অবসরে পড়ব....

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ভোর ৫:০২

ফাহমিদা বারী বলেছেন: সেই ভালো!

৬| ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫১

খায়রুল আহসান বলেছেন: একটা বয়সের পরে ডায়াবেটিস আশীর্বাদের মতো। কন্ট্রোল করার জন্য আর কাউকে ঠেলতে হবে না। এটাই আপনাকে ঠেলবে -- বাহ। চমৎকার বলেছেন।
চাকরির পরে থেকে এই ডিভিশনেই আছি বেশ অনেক বছর। কেমন যেন বাপদাদার ভিটে বলে মনে হয়। চাইলেই কেউ ‘হঠ যা’ বলে হঠিয়ে দেবে এটা মানতে মন চায় না - এ কথাগুলোও ভাল লাগলো :)

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৩:২৮

ফাহমিদা বারী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। :) গল্প পড়ার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

৭| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:১৪

খায়রুল আহসান বলেছেন: গিন্নির ক্যাচক্যাচানিতে ইদানীং বাসায় থাকতেই ইচ্ছে করে না -- একটা সার্বজনীন অনুভূতির সহজ অভিব্যক্তি!
হুট করে সবকিছু করতে গেলে লোকজনের চোখ টাটাতে পারে। প্রথমে একটা সেকেণ্ডহ্যাণ্ড কিনে একটু আইওয়াশ করে নিতে হবে - :)
এত লোভ করা ভালো নয়। সবসময় এভাবে লোভ সামলিয়ে চলতে হয়, বুঝেছো?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই। বুঝেছি বৈকি!
- গল্পের সমাপ্তিতে এই সারকাজম ভাল লেগেছে।
অত্যন্ত সাবলীল লেখনি, সুখপাঠ্য। পোস্টে ভাল লাগা + +

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৪

ফাহমিদা বারী বলেছেন: আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানবেন। :)

৮| ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:১৩

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: এত লোভ করা ভালো নয়। সবসময় এভাবে লোভ সামলিয়ে চলতে হয়, বুঝেছো?

হা হা হা

দারুন। :)

অত্যন্ত সাবলীল লেখনি, সুখপাঠ্যতো বটেই। পোস্টে ভাল লাগা + + + +

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:২১

ফাহমিদা বারী বলেছেন: আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আচ্ছা আমি এই ব্লগে নতুন তো, কিছু জিনিস বুঝতে পারছি না। এই প্লাস দিয়ে কী বোঝানো হচ্ছে? অনেকেই দেখছি এটা দিচ্ছেন। লেখা ভাল লেগেছে বলে বিভিন্ন সংখ্যার প্লাস দিচ্ছেন। এটা কীসের জন্য?

৯| ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:২১

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: সামুতে আগে প্লাস বাটন ছিল। মাইনাস বাটন ছিল।

লেখা ভাল লাগেল প্লাস বাটন ক্লিক করা যেত। :) পছন্দ না হলে মাইনাস বাটন ;)
প্লাস মাইনাস বাটন নাই তবে এখন নাই চর্চাটা রয়ে গেছে :) শুধু প্লাসের..
ম্যানুয়ালী মাইনাস দিতে খুব একটা দেখি নাই

হুম ভাল লাগার প্রকাশই +++

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:০৯

ফাহমিদা বারী বলেছেন: ও আচ্ছা! ধন্যবাদ জানানোর জন্য। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.