| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ফাঁকে দুজনের পরিচয়টা একটু সেরে নেওয়া যাক।
আসিফ আর আশিকের বাবা সাধারণ একজন চাকুরে ছিল। ভাগ্যক্রমে তার বিয়ে হয় বেশ অবস্থাপন্ন একটি পরিবারে। বংশপরম্পরায় সেই পরিবারে যেমন ছিল অঢেল সম্পদ, তেমনি ছিল চোখ ধাঁধাঁনো রূপ। একবার অফিসের একটা কাজের জন্য সেই পরিবারের সঙ্গে আসিফের বাবার একটা যোগাযোগ ঘটে। তার সহজ সরল চালচলন, কথাবার্তা আর পরিপাটি বেশভূষায় সেই পরিবারের মেয়েটি তার প্রেমে পড়ে যায়। সেই প্রেম এতটাই গভীর যে মেয়েটি তাকে পরিবারের অমতে বিয়েও করে ফেলে।
আসিফের নানা কিন্তু কিছুতেই মেয়ের এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলেন না। তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি থেকে মেয়েকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করলেন।
ওদিকে আসিফদের একমাত্র মামা বাপের বিপুল সম্পত্তি নিয়ে রাজার হালে জীবন কাটাতে থাকে। বোনের আর্থিক দুরবস্থার কথা তার অজানা ছিল না। কিন্তু কঞ্জুস ভাইয়ের হাত গলে একটা পয়সাও কখনো বের হয়নি। এই ব্যাপারে তার মন একেবারে সাফ। বাপ নিজেই তার মেয়েকে বঞ্চিত করেছে। তার তো কিছু করার নাই। আর সবাইকেই নিজের কর্মফল ভোগ করতে হয়! পরিবারের অমতে বিয়ে করার ফল তো বোনকে ভোগ করতেই হবে!
হয়ত তার বোনের জীবনটাও অল্পের মধ্যে পরিপাটিই হতে পারত, কিন্তু আসিফের বাবা শেষ বয়সে এসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তার চিকিৎসার পেছনে পানির মতো টাকাপয়সা খরচ হয়ে যায়। পরিবারটি একরকম পানিতেই পড়ে যায়। কোনোরকমে মায়ের জীবদ্দশা অব্দি দুই ভাই একসাথে থাকলেও মা-বাবার মৃত্যুর পরে আসিফ আর আশিক নিজের নিজের রাস্তা খুঁজে নেয়।
আশিকের কথার রেশ টেনে আসিফ বলে, ‘মামার কথা কী যেন বলছিলে? কী হয়েছে মামার?’
‘হবে আবার কী? বয়স কি কম হয়েছে? সাতাশি আটাশির কম হবে না। নানারকম অসুখ বিসুখ ছিল। বয়সের সাথে সাথে সেগুলো আরো মজবুত হয়েছে। মামীও তো তার কাছাকাছি বয়সের। দুই বুড়ো বুড়ি কেউই খুব একটা সুস্থ না! মাঝে মাঝেই খবর পাই, এখন তখন অবস্থা!’
আসিফের কেমন একটু সন্দেহ হলো মনে। বলেই ফেলল, ‘খবর পাও, নাকি খবর সংগ্রহ করো?’
‘তার মানে?’ আশিক চোখ ঘুরিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল।
‘ওহ কাম অন ভাইয়া! তুমি যেন কিছুই বোঝো না? কচি খোকা একেবারে! মামার খবর নেওয়ার হঠাৎ এত কীসের গরজ পড়ল তোমার?’
‘এটা কেমন কথা? নিজের মামা মরমর অবস্থা! একটা খবর নেওয়ার মধ্যে তুই কী এমন রহস্য খুঁজে পেলি?
ইতোমধ্যে চা আর স্যান্ডউইচ চলে এসেছে। দুজনেই স্যাণ্ডউইচে কামড় বসিয়েছে। আসিফ আর ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সোজাসাপ্টাই বলল, ‘যে মামা আমাদের এত দুর্দিনে একবার উঁকি মেরে পর্যন্ত দেখল না, তুমি সেই মামার মৃত্যুশয্যায় তার খবর নিচ্ছ এটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। ঝেড়ে কাশো তো ভাইয়া! মামার ছেলেপুলে নাই। তার মৃত্যুর পরে মামার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির আমরাই একমাত্র উত্তরাধিকারী। ইচ্ছা না থাকলেও বেচারা আমাদেরকে না দিয়ে আর কী করবে?’
আশিক চায়ের কাপে শুধু শুধু চামচটাকে নাড়াতে থাকে।
ছোট ভাইয়ের কাছে ধরা পড়ে গেছে সে। এখন আর লুকিয়ে লাভ নাই। মনে মনে সাজিয়ে নেয় কথাগুলো। তারপর গুছিয়ে বলার চেষ্টা করে, ‘দ্যাখ ভাই, আমাদের যা অবস্থা… তাতে মামার প্রতি রাগ ক্ষোভ পুষে রাখলে আমাদেরই ক্ষতি। মামা হয়ত মায়ের শেষ সময়ে পাশে দাঁড়ায়নি, কিন্তু মাঝে মাঝে ঠিকই খোঁজ খবর নিয়েছে। নানা বেঁচে থাকতে তো সেটুকুও করেনি!
এখন এটাকে সৌভাগ্যই বল বা যাই বল, মামার কোনো সন্তানাদি নাই। আমরাই তার তিনকূলে একমাত্র আপনজন। মামার যদি ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে তো…’
‘হুম এই তো আসল কথা এতক্ষণে বললে! তার মানে, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল দিয়ে বসে আছ তুমি। মামার যে মতিগতি শেষ মুহূর্তে মনে হতেই পারে সব সম্পত্তি কোনো চ্যারিটিতে দিয়ে যাবে! সারাজীবনে কোনো ভালো কাজ করেছে কী না সন্দেহ, মরার পরে এই সম্পত্তির উছিলায় যদি কিছু সওয়াব জোটে কপালে!’
‘সেজন্যই তো বলছিলাম... ইয়ে মানে... তুই আর আমি গিয়ে যদি মামাকে একটু দেখে আসি? কেমন হয়? অসুস্থতার খবর পেয়ে দেখতে এসেছি... এটা শুনলে কি মামার মন গলবে না? আর পুরনো জংধরা সম্পর্কটাও আবার নতুন করে ঘষেমেজে তকতকে করে ফেলা যাবে! কী বলিস?’
এটা শুনে আসিফ একটু চিন্তা করে। এই আইডিয়াটা একেবারে মন্দ নয়। অসুস্থ মামাকে তো তারা দেখতে যেতেই পারে! তাদের উদ্দেশ্য মামার কাছে ধরা না পড়লেই হলো! আর তাছাড়া ওদের মামী মানুষটা খারাপ না। মনে যাই থাকুক, সামনাসামনি ওদের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আসিফ বলল, ‘হ্যাঁ তা যাওয়া যায়। মামাকে দেখতে গেলে মামার অখুশি হওয়ার কোনোই কারণ নাই!’
আশিক উৎসাহিত হয়ে বলে ওঠে, ‘তাহলে আয় একটা ডেট ঠিক করে ফেলি! জলদি জলদি গেলেই ভালো হয়। অবস্থা নাকি খুব একটা ভালো না!’
‘বেশ চলো কাল বিকেলে যাই। তুমি অফিস থেকে সোজা আমার পত্রিকা অফিসে চলে এসো। ওখান থেকেই রওয়ানা দেওয়া যাবে!’
কথাবার্তা পাকাপোক্ত করে দুই ভাই যার যার পথ ধরল। আশিক মনে মনে নানান স্বপ্ন বুনে চলল। অভাব আর অনটনে জীবনটা একদম শুকনো মরুভূমি হয়ে গেছে! এই শুকনো মরুভূমিতে একটুখানি জলসিঞ্চন হলে কত যে ভালো হতো!
এত কাড়ি কাড়ি সম্পত্তির মালিক তাদের মামা! সেখান থেকে অল্পস্বল্প কিছু দিলেই তো তাদের দুই ভাইয়ের জীবনটা সেট হয়ে যায়।
প্ল্যানমাফিক পরদিন একটু আগেভাগেই অফিস থেকে বের হলো আশিক। যথাসময়ে আসিফের পত্রিকা অফিসেও পৌঁছে গেল। গিয়ে দেখল, আসিফ বেশ মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। ভাইকে দেখে চোখ নাচিয়ে বলে, ‘বাহ একেবারে ফিটফাট হয়ে হাজির হয়ে গেছ দেখছি!’
কথা ভুল না। আজ মামার বাসায় যাবে দেখে নিজের সবচেয়ে দামি ড্রেসটা পরেছে আশিক। সকালবেলাতেই সেলুনে গিয়ে চুল দাঁড়ি কেটেছেঁটে এসেছে। অফিসে বস তাকে দেখে বেশ কিছুক্ষণ ভ্রু তুলে তাকিয়ে ছিল। তারপর আচমকা জিজ্ঞেস করে বসে, ‘কী খবর আশিক সাহেব? এই বয়সে আবার নতুন করে বিয়েশাদীর কথা ভাবছেন নাকি? আপনার স্ত্রী আর বাচ্চাকাচ্চাগুলোর তাহলে কী হবে?’ বলেই নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে উঠেছে।
আশিক এসব গায়ে মাখেনি। লোকে কত কী বলে! সব কথা কি গায়ে মাখলে চলে? তার এরকম চরম দুর্দশায় লোকে কি তার বাসায় এসে ভালোমন্দ খোঁজখবর নিয়ে যায়? শুধু বাঁকাচোখা কথার সময় সবাই আছে!
আশিক ছোটভাইকে বলে, ‘জলদি কাজ শেষ কর! বেশি রাত হয়ে গেলে আবার মামা ঘুমিয়ে পড়তে পারে। দেখা না করে এলে আর কী লাভ হলো?’
আসিফ অবশ্য খুব একটা আশার আলো দেখছে না। যে মানুষ তার মায়ের পেটের বোনের আর্থিক অনটনে হাত বাড়ায়নি, সে ভাগ্নেদের সম্পত্তি লিখে দিবে এটা তার কাছে আকাশকুসুম স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে। তবে মামাকে একবার দেখে আসার মধ্যে ক্ষতি কিছু নাই। দেখা যাক ঘটনা কী দাঁড়ায়!
ঘটনা যা দাঁড়াল, তা বেশ অভাবনীয়। আশিক আসিফের মামা আশফাক হক দুই ভাগ্নেকে দেখে ভয়ানক রকমের আনন্দিত হলো। তার অসুস্থ শুকনো শরীরটাতে যেন নতুন প্রাণ গজালো। হাঁকাহাঁকি করে চাকরবাকরদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। একে ওকে ডেকে বলল, ‘আমার ভাগ্নেরা আমাকে দেখতে এসেছে, দেখেছিস? আমি ওদের কথা ভুলে থাকলে কী হবে, ওরা আমাকে ভোলেনি! ঠিক মনে রেখেছে!’
স্ত্রীকে বলল, ‘সামারা, ওদের কিছু খেতে দাও। দুজনেই অফিস থেকে এসেছে। কিছুদিন আগে যে পেস্ট্রিটা আনিয়েছিলে, ওটা আছে? খুব টেস্টি ছিল! থাকলে ওদেরকে দাও।’
আশিক আসিফের মামী মিসেস সামারা হক ছোটখাট চেহারার একজন অত্যন্ত সুন্দরী মহিলা। বয়সের নির্মম আঁচড় তার শরীরকে ভেঙে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সৌন্দর্যকে পুরোপুরি কেড়ে নিতে পারেনি। ভদ্রমহিলা খুব বড় ঘরের সন্তান ছিলেন। তার দাদা ছিল ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বাবা ছিল বাংলাদেশ আর্মির টপ র্যাঙ্কড অফিসার। তার মা ও ঘরকুনো গৃহিণী ছিল না। বাবার পাশাপাশি তার মাও নিয়মিত পার্টি প্রোগ্রামে এটেন্ড করত। ভালো টেবিলটেনিস খেলত। ব্যাডমিন্টনেও তুখোড় ছিল। সেই সময়ের একজন গ্রাজুয়েট ছিল তার মা।
আর মিসেস সামারা হক নিজে সাইকোলজিতে ইংল্যান্ড থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। দেশে এসে স্বামীর ব্যবসাবাণিজ্য দেখাশোনা করত। তবে চাকরিবাকরি করেনি। তার নাকি নয়টা পাঁচটা অফিস করতে ভালো লাগে না। এর চাইতে ব্যবসাতে বুদ্ধি ও মেধা খাটাতেই বেশি ভালোবাসতেন তিনি।
অত্যন্ত সফল এই ভদ্রমহিলার জীবনের একটাই কালো দাগ। তিনি মা হতে পারেননি। মা হওয়ার জন্য চেষ্টার কোনোরকম ত্রুটি করেনি তারা স্বামী স্ত্রী। কিন্তু কথায় আছে, ‘কপালে নাইকো ঘি, ঠকঠকাইলে হবে কী?’
তার স্বামী আশফাক হক পিতা ডাক শোনার জন্য আকুল হয়ে ছিল। নিজের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততায় দ্বিতীয়বার বিয়ের চিন্তাও মাথায় আনেনি। সন্তান দত্তক নিতে চেয়েছিল। কিন্তু স্ত্রীর সেই ব্যাপারে অনাগ্রহ থাকায় সেটি নিয়েও জোর করেনি। সারাজীবন নিঃসন্তান হয়েই তারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে।
বোনের সন্তানদের প্রতি একটা সুপ্ত স্নেহ কাজ করলেও সেটার প্রকাশ ঘটেনি জীবনে। আজ যখন জীবনের এই সায়াহ্নে ভাগ্নেরা নিজেরাই তাদের মামাকে দেখতে এসেছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধ আশফাক হক বেশ উত্তেজনা বোধ করল। তার আগ্রহ আর উচ্ছ্বাস দেখে স্ত্রী সামারা হক আশ্বস্ত করল, ‘তুমি এত চিন্তা কোরো না তো! ওদের না খাইয়ে ছাড়ব নাকি আমি? তুমি একটু আরাম করো। এত হৈ চৈ করলে তোমার শরীর খারাপ হবে!’
‘আহ আমাকে নিয়ে ভেবো না সামারা! আমার আর কদিন! আজ আছি কাল নেই! এখন বসে বসে পুরনো দিনগুলো নিয়ে ভাবি। বাবা রাগ করে আমার আদরের বোনটাকে দূরে সরিয়ে দিলো... আমরাও ওর কোনো খোঁজখবর রাখলাম না! জীবনের শেষে কত কষ্ট করল বেচারি! লোকমুখে সবই শুনেছি, তবু পাশে গিয়ে দাঁড়াইনি! এই অপরাধবোধ আমাকে কুরে কুরে খায়। তোমাকে সেটা কী করে বোঝাই সামারা?’
আশিক ভাবল, এটাই মোক্ষম সময়। আবেগের ঝড় বইছে যখন, এটা থেমে যাওয়ার আগেই একটু গাছ ধরে ঝাঁকাতে হবে। ঝড় আর ঝাঁকানিতে তলায় যেটুকু পড়ে সেটুকুই লাভ!
মুখটাকে শ্রদ্ধায় গদগদ করে আশিক বলল, ‘মামা, আপনি শুধু শুধুই নিজেকে অপরাধী ভাবছেন। আমরাই বা কোথায় আপনার খোঁজখবর নিয়েছি বলুন? এই যে এত অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন, কয়দিন দেখতে এসেছি?’
আসিফ চোখের কোন দিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। আশিক আজ ভালোরকম আটঘাট বেঁধেই এসেছে। এই সুযোগ সে কিছুতেই হাতছাড়া হতে দিবে না।
আশফাক হক তবু নিজের দোষের বয়ান করে চলে। সামারা হক উঠে যায় নাস্তার আয়োজন করতে। (ক্রমশ)
©somewhere in net ltd.