নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

ফাহমিদা বারী

আমার ব্লগ মানে গল্প। গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানাই :)

ফাহমিদা বারী › বিস্তারিত পোস্টঃ

আত্মজৈবনিক লেখা - ল্যাভেন্ডারের সুবাস

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:১৮




(ইউকে থেকে ফিরে 'ল্যাভেন্ডারের সুবাস' নামে একটা আত্মজৈবনিক লেখা শুরু করেছিলাম। নানা কারণে লেখাটা শেষ করা হয়নি। ইউকেতে আমার ছেলের পড়াশুনা নিয়ে এই পর্বটি লেখা হয়েছিল। পড়তে পারেন।)
ইতিমধ্যে তাহসিনের স্কুলে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করতে হলো। যে স্কুলে তাকে ভর্তি করানো হলো তার নাম ‘লোন্সউড স্কুল’ (Lawnswood School)। আমরা হেডিংলি’র বাসাটা পাল্টাতে চাচ্ছিলাম। বাসাটা ছোট ছিল। মূলত সেটাই কারণ। ব্যাচেলরদের থাকার জন্য আদর্শ হলেও ঠিক ফ্যামিলি নিয়ে থাকার মতো নয়। যদিও একটা সুবিধা ছিল, তা হলো বাসাটা ইউনিভার্সিটির বেশ কাছে। নতুন বাসা দেখতে গিয়ে ‘আইভসন ড্রাইভ’ (Iveson Drive) এর কাছে একটা বাসা বেশ মনে ধরলো আনিসের। বাসাটা ফার্নিশড ছিল না। যদিও আমরা ফার্নিশড বাসাই খুঁজছিলাম। কারণ এই দুই বছরের জন্য বাসাকে বাসোপযোগী করার জন্য নেহায়েত কম ফার্নিচার কিনতে হবে না। কাজেই ফার্নিশড বাসাই এক্ষেত্রে আমাদের জন্য ভালো হবে। ব্যবহার কর...যাওয়ার সময় পরিষ্কার করে রেখে যাও। নো ঝামেলা।
কিন্তু সব মিলিয়ে ব্যাটে বলে মিললো না। ফার্নিশড একটা বাসা কিছুটা মনে ধরেছিল বটে, কিন্তু সেই বাসাটা একটু বেশী পুরনো হওয়াতে শেষমেষ বাতিল করে দেওয়া হলো। দেশে একটা স্ট্যাণ্ডার্ড বজায় রেখে এতদিন থাকা হয়েছে। কাজেই সহজেই সেই স্ট্যাণ্ডার্ডের নীচে নামা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছিলো।
কাজেই আইভসন ড্রাইভ এলাকার আশেপাশে স্কুল দেখা শুরু হলো। আর আশেপাশে স্কুল দেখতে গিয়ে ‘লোন্সউড স্কুল’ টাকেই সবদিক দিয়ে উপযোগী মনে হলো।
তাহসিন দেশে বাংলা মিডিয়ামে পড়াশুনা করেছে। কাজেই ইংরেজী মিডিয়ামের এমনকি খোদ ব্রিটিশ স্কুলে পড়ার ধকল সামলাতে তাকে বেশ ভালোই বেগ পেতে হয়েছিল। সেটা এক কঠিন সময় ছিল তাহসিনের জন্য। তবে এই দুটো বছর তাহসিনের পড়াশুনার যাবতীয় দায়িত্ব তার বাবা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। নিজের পড়াশুনার অযুহাতে আমি এই দুটো বছর তাহসিনকে পড়ানোর কাজ থেকে বিশ্রাম পেয়েছিলাম। কাজেই আমি তো এই ব্যাপারে আরামেই ছিলাম, কিন্তু নতুন পরিস্থিতি সামলাতে বেশ কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল তাদের দুজনকেই।
তাহসিন দেশে ক্লাস ফাইভের পিএসসি না দিয়েই ইউকে চলে গিয়েছিল। কাজেই সেটা নিয়েও একটা টেনশন কাজ করছিল যে, দেশে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করতে এর কোন প্রভাব থাকবে কী না।
ছোট ছোট বাচ্চাদের প্রায় এসএসসি’র মতো সিরিয়াস একটা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিয়ে কী যে মজা নীতি নির্ধারকদের, তা কে জানে! সেই পরীক্ষা আবার এত সিরিয়াসলি দিতে হয় যে, বাচ্চার মায়েদেরও হাঁফ উঠে যায়। শুধু বাচ্চাদেরই নয়, মায়েদের মধ্যেও একটা গোপন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় সেই পরীক্ষার প্রস্তুতিকে কেন্দ্র করে। কার বাচ্চা কত দ্রুত এগুচ্ছে...কারটা কিছুটা পিছে পড়ে থাকছে। যেন এই পরীক্ষার সাফল্য বা ব্যর্থতাই এই বাচ্চাগুলোর জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন। দেশে থাকাকালীন সময়ে আমি নিজেও এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সতস্ফূর্তভাবে জড়িয়ে পড়েছি। পিছিয়ে থাকার উপায়ই নেই কোন।
এত চাপ নিশ্চয়ই সব বাচ্চার পক্ষে নেওয়া সম্ভবপর হয় না। কেউ কেউ হয়ত এই চাপের কারণেই অকালে ঝরে পড়ে। পড়াশুনার প্রতি অহেতুক বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। যে শিশুটি সুস্থ পড়াশুনার ধারায় নিজেকে সুন্দরভাবে বিকশিত করে তুলতে পারতো, সেই শিশুটিই হয়ত এই তুমুল প্রতিযোগিতা ও চাপে মাঝপথেই হারিয়ে যায়। বিষয়টা উদ্বেগজনক ও ভেবে দেখার মতো। তবে অনেক বাচ্চাই আবার দিব্যি এই চাপ নিতেও পারে। সকলের লোড বিয়ারিং কাপাসিটি(!!) তো আর এক নয়!
দেশে এত চাপ সহ্য করে যে বাচ্চা ভালোভাবে পড়াশুনা করতে পারে, তার দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশুনার চাপ নেওয়াটা মোটেও তেমন কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয় না। কারণ উন্নত দেশগুলোতে বিশেষ করে স্কুল লেভেলে বাচ্চাদের মোটেও তেমন চাপ দেওয়া হয় না। বরং তাদের সুকুমার বৃত্তি আর সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা হয়। নানারকম গ্রুপওয়ার্কের মাধ্যমে বাচ্চাদের ছোট ছোট প্রজেক্ট করানো হয়। নানারকম সমাজ সচেতনতামূলক অথবা সাম্প্রতিক বা সমসাময়িক কোন বিষয় নিয়ে সৃজনশীল পোস্টার তৈরি করতে বলা হয়। সেই প্রজেক্ট অথবা পোস্টার তৈরি করার মধ্য দিয়ে বাচ্চার সৃজনশীল সত্ত্বাটাকে বের করে আনা হয়, অতি সুকৌশলে। তাহসিনকে পড়াতে গিয়ে ওর বাবাকে প্রায়ই বলতে শুনতাম,
‘ইস! আমরা যদি এভাবে পড়াশুনা করার সুযোগ পেতাম!’
এই আফসোস আসলে কখনো ঘুঁচবার নয়। একটা অনুন্নত পিছিয়ে থাকা দেশে জন্মগ্রহণ করে আমরা আমাদের মেধার সর্বোচ্চ ব‍্যবহার করতে পারি না। বিশেষ করে শিক্ষাণীতি নিয়ে আমাদের দেশে অনেক কাজ করার আছে। কোমলমতি শিশু গুলোকে শিক্ষার নামে যে ভয়াবহ চক্রে ফেলে দেওয়া হচ্ছে...তা বিবেকবান যেকোন মানুষকেই ভাবিয়ে তুলবে।
তবে পড়াশুনার তেমন আলাদা চাপ না থাকলেও ঐসব (ইউকে) দেশে বাংলা মিডিয়াম অথবা অন্য কোন মিডিয়াম থেকে পড়ে আসা বাচ্চাদের ইংরেজীর চাপটা বেশ ভালোরকমই থাকে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
তাহসিনের জন্ম ১৬ই আগস্ট। আর ঐ দেশে বাচ্চাদের একাডেমিক ইয়ার শুরু হয় সেপ্টেম্বর থেকে। কাজেই মাত্র দুই সপ্তাহের এই গ্যাপের কারণে তাহসিনকে সেখানে ক্লাস সিক্সের পরিবর্তে ক্লাস সেভেনে ভর্তি করাতে হলো। নতুন দেশ, নতুন ভাষা...তার ওপরে এক ক্লাস এগিয়ে যাওয়া। শুরুতে একেবারে ভয়াবহ প্যাঁচ লেগে গেল!
তবে আগেই বলেছি, পড়ালেখাটা তেমন কঠিন ছিল না। বিশেষ করে ওদের ক্লাসে যেসব অংক করাতো, তা দেখে আমরা শুরুতে মনে করতাম, তাহসিন হয়ত ঠিকমত লিখে আনতে পারেনি। ক্লাস সেভেনে এত সহজ অংক কীভাবে করায়? পরে দেখা গেল, তাহসিন ভুল করেনি। ক্লাসে এসব পানিপান্তা অংকই করানো হচ্ছে যা দেশে সে ক্লাস থ্রি ফোরে করে এসেছে। কাজেই প্রথমে অংক সাবজেক্টটা নিয়ে তেমন পরিশ্রমই বলতে গেলে করতে হলো না। তবে তাহসিন ছোটখাট ভুল খুব বেশি করতো, সেটার কথা ভিন্ন।
কিন্তু অংকে চাপ না থাকলেও অন্য সাবজেক্টে সময় বেশ ভালোই লাগলো। যেহেতু ওদের দেশের পুরো পাঠক্রম পদ্ধতিটাই ভিন্ন, সেটার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে তাহসিনকে যথেষ্ট সময় দিতে হয়েছে। ওসব দেশে নির্দিষ্ট কোন পাঠ্যবই অনুসরণ করা হতো না। ‘বিবিসি বাইট সাইটস’ নামের একটা ওয়েবসাইটে ওদের ক্লাসে পড়ানো টপিকগুলো খুঁজে পাওয়া যেত। সেই ওয়েবসাইট অনুসরণ করেই ওকে পড়ানো হতো।
আর এই ওয়েবসাইট সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদের কারণেই টিচাররা বলে দিয়েছিলেন। এমনকি পুরনো কিছু সায়েন্স বইও তাহসিনকে দেওয়া হয়েছিল যাতে সে কোথা থেকে পড়ানো হচ্ছে তা ঠিকমত অনুসরণ করতে পারে। দেশে যেহেতু প্রতিটি বিষয়ের নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক আর সিলেবাস ধরে দেওয়া থাকে, কাজেই তাহসিনকে খেই ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তার ক্লাসের টিচাররাও অনেক সাহায্য করেছিলেন।
তাহসিন দেশে ক্লাস ফাইভে বেশ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরেছে। সে ক্লাস ফাইভে মোটেও সেভাবে পড়াশুনা করেনি। কাজেই সেখানে গিয়ে শুরুতে তাকে বেশ কঠিন সময়ই পার করতে হয়েছে। বিশেষ করে ইংরেজী সাবজেক্টটা যথেষ্ট কঠিন ছিল। আমাদের দেশে যেমন বাংলা মিডিয়ামে যথেষ্ট এডভান্সড বাংলা পড়ানো হয়, ওদের দেশেও ইংরেজী বইটা থাকে বেশ এ্যাডভান্সড লেভেলের।
আমার ক্লাস শুরুর আগে কিছুদিন আমি তাহসিনের ইংরেজী বইয়ের একটা গল্প নিয়ে বসেছিলাম। আমি রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছি! যে গল্পটা আমি ওকে পড়িয়েছিলাম, তার নাম হচ্ছে ‘ দ্য এ্যানিমেল ফার্ম’। গল্পটা অবশ্য ওদের ক্লাসে কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে পড়ানো হয়েছিল, কিন্তু তারপরেও যে খটমট ইংরেজী শব্দ ও বাক্য সেখানে ছিল...তা ভয় পেয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। এই গল্পটাতে তাদের দেশের রাজনৈতিক কিছু চরিত্রের রূপক হিসেবে কিছু পশু চরিত্রকে উপস্থাপন করা হয়েছে, যারা ঐ দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই চরিত্রগুলোর অন্তর্নিহিত দন্দ ও পারষ্পারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন অতি নিখুঁত বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে গল্পটিতে। অথচ গল্পটা শুরু হয়েছে একেবারে নীরিহ একটা এ্যানিমেল ফার্মের বর্ণনার মধ্য দিয়ে। আমি সেই গল্প পড়ে টাসকি খেয়ে বসে থাকলাম।
তাহসিনকে আমি প্যারা প্যারা করে বোঝাতাম। অর্থাৎ যখন বসতাম তখন এক প্যারা অর্থসহ ভালোভাবে পড়াতাম। কী পরিমাণ সময় যে এই গল্পটাতে দিতে হয়েছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাহসিনের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেই বেচারার মুখ শুকিয়ে গেছে। আমি সামনের সময়ের জন্য চিন্তিত হয়ে উঠলাম। ইয়া আল্লাহ্‌! এত কঠিন ইংরেজীতে কীভাবে আমার ছেলে দাঁত বসাবে?
পরবর্তীতে আনিস পড়ানোর ভার নেওয়ার পরে প্রথমদিকে এই ইংরেজীতেই বেশি সময় দিতে হয়েছিল। ক্লাস এইটে গিয়ে ওদের একটা গল্প পড়ানো হয়েছিল, যার নাম হচ্ছে ‘ম্যাগট মুন’ (Maggot moon- শুঁয়োপোকা)। এই গল্পটার নাকি বেশিরভাগ অংশই জুড়ে রয়েছে ‘অন্তর্নিহিত অর্থ’ বা ‘ইনার মিনিং’। অর্থাৎ গল্পটা পড়ে এর ভেতরের অর্থটাকে বের করে আনতে রীতিমত মাথা খাটাতে হবে। এমন নয় যে, যা পড়লাম তারই সাদামাটা অর্থ করে ব্যাখ্যা দাঁড় করালাম। যা ভাষায় ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে, তা ভাবগত ভাবে বোঝানো হচ্ছে না।
আমি অভিভাবকদের জন্য যে ‘টি মর্নিং’ এর ব্যবস্থা ছিল, সেখানে মাঝে মাঝে যেতাম। এই ‘টি মর্নিং’ মূলত আন্তর্জাতিক শিশুদের অভিভাবকদের সাথে শিক্ষকদের একটা ‘আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা’ বলা যেতে পারে। স্কুলে মানিয়ে নিতে বাচ্চার কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, সমাধানের উপায় কী... এসব নিয়ে সেখানে আলাপ করা হতো, তবে খুবই হাল্কা আন্তরিক পরিবেশে। সেই ‘টি মর্নিং’ এর এক আয়োজনে এই ‘ম্যাগট মুন’ গল্পটার প্রসঙ্গ একবার উঠেছিল। তখন ব্রিটিশ এক অল্পবয়সী শিক্ষিকাকে বলতে শুনেছি,
‘দিস স্টোরি ইজ রিয়েলি টাফ!’
তাহসিনের একটা খাতা ছিল, তাতে সে যেখানে যত নতুন নতুন শব্দ পেত, লিখে রাখতো। সেই খাতা তাকে মাঝে মাঝে রিভিশন করানো হতো। ধীরে ধীরে বেশ ভালো একটা ভোকাবোলারি গড়ে উঠেছিল ওর। তবে রিভিশন না দিলেই আবার ভুলে খেয়ে ফেলতো।
আর আরেকটা জিনিসও রপ্ত করতে হয়েছিল তাকে। কীভাবে একটা বড় প্যারাগ্রাফ পড়ে সম্পূর্ণ নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করা যায়। ক্রিয়েটিভ রাইটিং কে এসব দেশে খুবই সম্মান ও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। মুখস্থ বিদ্যার বিন্দুমাত্র চর্চা এখানে নেই। পড়, বুঝো আর সম্পূর্ণ নিজের ভাষায় লিখো...দেশে থাকাকালীন যে চর্চা সেভাবে গড়ে ওঠার অবকাশই পায়নি। কিছু একটা পড়তে বললে বুঝিয়ে দিলেও সে চট করে মুখস্থ করে ফেলতে চাইতো। আর সেখানে গিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও পরিবেশে একপর্যায়ে সে বুঝতে সক্ষম হলো যে, এখানে সেই রাস্তায় চলা যাবে না।
এভাবে নানারকম চড়াই উতরাই পার হয়ে তাহসিন মোটামুটি মানিয়ে নিতে পেরেছিল স্কুলের সাথে।
স্কুলের এই ‘টি মর্নিং’ গুলো নিয়ে সে বেশ উত্তেজিত থাকতো। তার একজন শিক্ষিকা তাকে প্রথম এই ‘টি মর্নিং’ এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছিলেন,
‘টেল ইয়োর মাম টু কাম এলাং উইথ আ ডিশ।’
আমি বিষয়টা কী হতে যাচ্ছে তা তেমন ভালো না বুঝলেও ধারণা করলাম, কিছু একটা বানিয়ে নিয়ে যেতে যখন বলা হয়েছে তখন হয়ত প্রত্যেকেই কিছু না কিছু বানিয়ে আনবে। বাস্তবেও তাই দেখা গেল। প্রত্যেক গার্ডিয়ানই কিছু না কিছু বানিয়ে এনেছেন। এই ‘টি মর্নিং’ এ যতবার গিয়েছি, জম্পেশ একটা খাওয়া দাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সাওদি আরাবিয়ান আর কুয়েতী কিছু ভদ্রমহিলা ছিলেন যারা প্রচুর আইটেম বানিয়ে নিয়ে যেতেন। বেশিরভাগই মিষ্টি জাতীয়। সামুচা বা প্যাটিস টাইপের আইটেমও তারা নিয়ে যেতেন।
তারা যে পরিমাণে খাবার নিয়ে যেতেন... সেই পরিমাণ খাবার তারা নিজেরা খেতেন... আবার সেই পরিমাণ খাবার তারা অন্যদের জোর জবরদস্তি করে খাওয়াতেন। আমি তাদের সুবাদেই বেশ কিছু এ্যারাবিয়ান ডিশ সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে গিয়েছিলাম। তবে সেই আরবী নামগুলো এখন আর মনে নেই। তাদের বেশিরভাগ খাবারই ছিল বেশ মজাদার।
একটা খাবার তারা নিয়ে যেতেন, বিরিয়ানি টাইপের। সেখানে আস্ত আস্ত পটল জাতীয় কী যেন থাকতো। দেখতে পটলের মতো। আল্লাহ্‌ জানে আদতে কী বস্তু! সেই খাবার খাওয়ানোর জন্য তারা খুব সাধাসাধি করতেন। কিন্তু অন্যরা কেউই সাহস করে এই খাবার খেত না। তারা নিজেরা একটা বড় ডিশে সেই খাবার বেড়ে নিয়ে একসাথে সবাই মিলে চামচ দিয়ে উঠিয়ে উঠিয়ে খেতেন।
তার টিচার একটা ডিশ রান্না করে নিয়ে যেতে বলেছেন, এই ব্যাপারটাতে তাহসিন খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো যে তার মা আদৌ কিছু রান্না করে নিয়ে যেতে পারবে কী না! যতবার এই ‘টি মর্নিং’ থাকতো, আমার একেবারে ঘুম হারাম করে ছেড়ে দিত সে। সাতদিন আগে থেকে তাগাদা দিয়ে যেত,
‘মনে আছে তো তোমার?’... ‘কী রান্না করে নিয়ে যাবা?’... ‘রোজ রোজ একই খাবার কেন নিবা? অন্যকিছু কেন নিবা না?’...
আমার জান একেবারে কাবাব করে দিত। এমনকি একবার আমার ক্লাসের মাঝখানে তাদের স্কুলের এই ‘টি মর্নিং’ পড়ে গিয়েছিল। আমাকে সেই ক্লাস দুই ঘণ্টা দেরি করে পৌঁছাতে হয়েছিল। তবু তার এই ‘টি মর্নিং’ মিস করার সুযোগ ছিল না।
তাহসিনের চাপাচাপিতেই হোক অথবা এ্যারাবিয়ান ভদ্রমহিলাদের আতিথেয়তার বিনিময়েই হোক, আমিও বেশ কিছু নতুন নতুন ডিশ তৈরি করে নিয়ে যেতাম। নানারকম ভাবে স্যাণ্ডউইচ, বিরিয়ানী, মাংসের নানারকম বৈচিত্রময় আইটেম...। আমাদের এই আইটেমের বন্যায় দেখার মতো মজা হতো টিচারদের। তাদের তো মোটামুটি পিকনিক লেগে যেত। দিনের পরে দিন ব্রিটিশ আইটেম খেয়ে খেয়ে তাদের শুকনো ঝুরো ঝুরো হয়ে যাওয়া মুখগুলো বহুদিন পরে বেশ সরস হয়ে উঠতো। যে ক’জন টিচার সাধারণতঃ উপস্থিত থাকতেন, তারা গিয়ে আবার অন্যদেরও ডেকে নিয়ে আসতেন। একবার দেখি ‘হেড টিচার’ও গুটি গুটি পায়ে এসে হাজির।
শেষের দিকে বেশ ঘনঘনই হতে লাগলো এই ‘টি মর্নিং’। আমার তো মাথায় ঢুকতো না, আলোচনাটা হচ্ছে কী! যা হচ্ছে তা তো ভুড়িভোজন! শেষেরদিকে তাই আমার গড়িমসি দেখে আনিস জিজ্ঞেস করতো,
‘কী যাবা না টি মর্নিং এ?’
আমি তো ততদিনে ‘টি মর্নিং’ এর অন্তঃসারশূন্যতা টের পেয়ে গিয়েছি। টিচারদের ভুড়ি ভোজনের সাধ জাগলেই ‘টি মর্নিং’ এর দাওয়াত (!) দিয়ে বসতেন। তাই শেষেরদিকে দু’একবার তাহসিনকে না জানিয়ে ‘অনুপস্থিত’ থেকে গেলাম এই ‘টি মর্নিং’ এ। কিন্তু তাতেও কি রেহাই আছে? তাহসিন স্কুলে গিয়ে ঠিকই জেনে যেত, তার মা ‘টি মর্নিং’ এ অনুপস্থিত ছিল। বাসায় এসে তার কাছে ‘অনুপস্থিত থাকা’র যথাযথ কারণ দর্শিয়ে তবে আমার নিষ্কৃতি মিলতো।
তাহসিনের শিক্ষিকাদের মধ্যে একজন ছিলেন মিসেস ব্রাউন, টুকটাক বাংলা জানতেন। ভদ্রমহিলা ব্রিটিশ। তিনি আমার ডাক নাম শোনার পর থেকে সেই নামেই ডাকতেন। বেশ মজা লাগতো তার মুখে ‘বিফু’ শুনতে। একবার তাকে আমার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল। তিনি বেশ আগ্রহ নিয়েই শুনেছিলেন বলে মনে হয়েছিল। এই আগ্রহ কতটা খাঁটি ছিল তা বলতে পারবো না। তবে আপাত আগ্রহী এক বিদেশী শ্রোতা পেয়ে আমিও ঝেড়ে পনেরো মিনিট লেকচার দিয়েছিলাম বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন নিয়ে।
তিনি একবার আমাদের বাসার কাছের (ওল্ড ওটলী রোড) এক বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন। সেটার বর্ণনা দিয়ে আমাকে বলেছিলেন,
‘ইটস ন্যাম ইজ ‘ভাউজান’।’
আমি আর বুঝি না এই ‘ভাউজান’ মানে কী। একবার মনে হলো ‘রাউজান’। আরেকবার মনে হলো ‘ভাইজান’। কিন্তু রেস্টুরেন্টের নাম কেন ভাইজান হবে তাও বুঝলাম না। অনেক মগজ খেলানোর পরে মনে হলো, আচ্ছা ‘ভোজন’ নয় তো! আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘ডিড ইউ আস্ক হিম, হোয়াট দ্যাট মিনস?’
‘ইয়েস...সারটেইনলি! হি সেইড ইট মিনস ইটিং!’
অবশেষে আমিও বুঝলাম, এই ‘ভাউজান’ মানে আর কিছু নয়... ভোজন!

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

এ পথের পথিক বলেছেন: বিফু B-) আপু পুরাটা পড়রলাম . ভাল লেগেছে ।

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৩০

ফাহমিদা বারী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই :) বড় লেখা। আজকাল সবাই বড় লেখা দেখলেই ভয় পায়। ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী!

২| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:১৫

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন:

আপনি কি Leeds এ থাকতেন?
আমি ওখানে গিয়েছিলাম।
আমি আছি ম্যানচেস্টারে।

৩| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৩০

আলামিন১০৪ বলেছেন: মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন:

আপনি কি Leeds এ থাকতেন?
আমি ওখানে গিয়েছিলাম।
আমি আছি ম্যানচেস্টারে


ম্যানটেণ্টারে বসে আন্নে ইউটিউব ভিডিও বানান? কাম কাজ কিছু পান নাই?

৪| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৩২

আলামিন১০৪ বলেছেন: বিপু, লম্বা গল্প... ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। আরেক দিন পড়ার চেস্টা করব

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.