![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শিক্ষানবীস
আমার একজন ‘পরিচিত’ ভাই আছেন; যাঁর সাথে সম্পর্ক আজ ২/৩ বছরের মত হবে। বেশ ভাল মানুষ। উনার সাথে সারাদিন কাটালেও কেউ বলতে পারবেন যে এক মুহুর্তের জন্যেও বিরক্তি অনুভব হয়েছে। একসাথে একটা স্কুলে পার্ট-টাইম হিসেবে পড়াতাম। সেই থেকে পরিচয়। আমার দেখা অত্যন্ত পড়াপাগল মানুষদের একজন উনি। মাঝে কিছু ব্যাক্তিগত ব্যাস্ততার কারণে উনার সাথে খুব একটা যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। যাই হোক, এরই মধ্যে উনার বিবিএ ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে ফলাফলও পেয়ে গেছেন। এবং খুব ভালো রেজাল্টও করেছেন। ওদিন হঠাৎ মেসেজ দিলো, “তোমাকে অনেকদিন দেখিনা, যদি পারোতো এসে দেখা করে যেও। কিছু জরুরী কথাও আছে তোমার সাথে।”
অতঃপর এর একদিন কি দুইদিন পর সময় করে গেলাম উনার কাছে।
উনার নামটা বলে নিই। রমিজ উদ্দিন।
অনেকদিনের জমানো কথার ফুলঝুরির পর উনি হঠাৎ আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলেন। বললাম অনার্সটা শেষ করে নিই আগে। তারপর মাস্টার্স। এরপরে দেখা যাক কি করতে পারি। এখনও কোন প্ল্যান নেই।
তারপর উনার ব্যাপারে জানতে চাইলাম।
উত্তরে প্রথমে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস। তারপর বললেন উনার বিড়ম্বনার সাতকাহন।
বিবিএ কমপ্লিট করার পর একটা কাকা নাকি ঢাকাতে তার বায়িং হাউজে কোয়ালিটিতে কাজের অফার করেন। ব্যাপারটাকে এড়িয়ে গিয়ে উনি কয়েকটা ব্যাংকে অ্যাপ্লাই করেছিলেন। কিন্তু তাজ্জব বনে গেলেন যখন শুনলেন যে ব্যাংকে লিখিত পরীক্ষার পরেই টাকার ঝুলি খুলে বসতে হয়! এরপর কয়েকটা সরকারী প্রতিষ্ঠানে অ্যাপ্লাই করেন, ওগুলোতেও একই গল্প। অবশেষে প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলেন কাকার বায়িং হাউজে কাজ করবেন। আর, ওখানে ভালো না লাগলে বিদেশ চলে যাবেন।
দেশের কথায় আসি, অর্থনৈতিকভাবে মোটামুটি দুর্বল পরিবারের ছেলে তিনি।তবুও কোনভাবে নাহয় টাকা ম্যানেজ করে নিলেন। কিন্তু এই লোকটা জীবনের ১৬/১৭ টি বছর পড়ালেখার পেছনে ব্যয় করেছিলেন এইজন্যে?
তাঁর রাতজেগে পড়া, টয়লেটের মধ্যেও ‘Financial Management’ কোলে নি্যে বসে থাকা, ভার্সিটি ছুটির পর ‘সময় নষ্ট’ না করে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে বই নিয়ে বসে যাওয়া, জীবনের সমস্ত সাধ-আহলাদের জলাঞ্জলী কি এইজন্যে?
তাঁর এত পরিশ্রম কি পরীক্ষাকক্ষে তাঁর পিছনের ইতিউতি মেরে কোনক্রমে উতরে যাওয়া সেই ‘ডামিশ’ ছেলেটার কাছ থেকে ‘সরকারী প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার’ অনুমোদনস্বরুপ স্বাক্ষর-সীলমোহর নিয়ে চাকরীতে আবেদন করার জন্য?
তাঁর ঘর্ম-রক্ত একত্র করে অর্জিত যোগ্যতার মুল্য কি কোন বায়িং হাউজ অথবা গারমেন্টসের কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্সে ৮/১০ হাযার টাকা বেতনের দৈনিক ১৮ ঘন্টা দিনমজুর টাইপ চাকরী?
(না, আমি কোন কাজকেই ছোট জ্ঞান করছিনা। কিন্তু ‘যোগ্যতার বিচার’ নামক একটা মাপকাঠিতে কাউকে দাঁড় করানোর অধিকার অবশ্যই আমার আছে।)
তাঁর ১৬/১৭ বছরের এই মেধাসম্পদ কি ‘দেশে কিছু করতে না পেরে’ বিদেশ গিয়ে সিমেন্টের বোঝা টানার জন্য?
আমাদের মেধাসম্পদ কি এতোই মুল্যহীন?
সত্যিকার পরিশ্রমী মানুষগুলো কি এভাবেই আজীবন আক্ষেপ করে যাবে?
কি করে একটা গন্ডমূর্খের সাহস হয় ম্যানেজমেন্টে অনার্স করা একটা ছেলেকে কোন বায়িং হাউজে ‘কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স’ –এর মত এসএসসি/এইচএসসি যোগ্যতার চাকরী অফার করার?
কেন একজন গ্র্যাজুয়েটকে ৮/১০ লাখ টাকার বিনিময়ে দেশকে সার্ভিস দিতে হবে?
কাকে করা উচিৎ এসব প্রশ্ন?
যাদের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া উচিৎ তারাতো দিব্যি কানে তুলো গুঁজে ‘কান থেকেও কালা’ সেজে বসে আছে। বিকল্প উত্তরদাতা কারা?
আমরাই নাকি দেশের ভবিষ্যৎ, আর এই হলো আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। রূঢ় বাস্তবতা।
দাঁড়িপাল্লায় মেধার তুলনায় টাকার ওজন ভারী।
দেশে থেকে ‘কিছু একটা’ তারাই করতে পারবে, যাদের বাবার অগাধ টাকা আছে নয়তো ক্ষমতা আছে।
আর যাদের সত্যিই আগ্রহ এবং উদ্যম আছে; যোগ্যতা থাকা সত্বেও টাকা না থাকলে তাদের রক্ত-ঘাম-পরিশ্রমের মুল্যস্বরূপ যেটা মেলে, তার যোগ্যতার মাপকাঠিতে ওই প্রাপ্তি নিতান্তই ফকিরের প্রাপ্ত ভিক্ষার সাথে তুলনাযোগ্য।।
আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থাটা এমনই যে, যেকোন সুশিক্ষিত ব্যাক্তিকে এভাবেই দায়ে পড়ে অসহায়ত্বের কাছে আত্মসমর্পন করতে হয়।
কোনদিনই হয়ত আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থায় পরিবর্তন আসবেনা।
শিক্ষা হয়ত সারাজীবন অর্থের মাপকাঠিতে অবমুল্যায়িত হয়ে যাবে।
‘রমিজ উদ্দিন’রা সারাজীবনই চোখে ধোঁয়া দেখে যাবে।
কারণ, তাদের যে বিত্তবান বাবা নেই। অর্থের যোগ্যতায় তারাতো নচ্ছার।
তাদের আবার ২/৪ টা ক্ষমতাশালী মামা/কাকাও নেই।
তাদের আছে শুধু ‘যোগ্যতা’ এবং ‘পরিশ্রমে অর্জিত জ্ঞান’; যা নিতান্তই অযোগ্য ও মুল্যহীন।
সারাজীবনই জাতিকে ‘রমিজ উদ্দিন’ দের দীর্ঘশ্বাস আর পেটতান্ত্রিক আমলাদের দাঁতক্যালানো হাঁসির শব্দ শুনে যেতে হবে।
এবং কাঁধে করে বয়ে বেড়াতে হবে ‘রমিজ উদ্দিন’ নামক অসংখ্য যোগ্যতাসম্পন্ন অযোগ্য মনুষ্যরুপী অভিশাপ।।
©somewhere in net ltd.