নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সবাই যখন নীরব, আমি একা চীৎকার করি \n-আমি অন্ধের দেশে চশমা বিক্রি করি।

গিয়াস উদ্দিন লিটন

এত বুড়ো কোনোকালে হব নাকো আমি, হাসি-তামাশারে যবে কব ছ্যাব্‌লামি। - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গিয়াস উদ্দিন লিটন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন সমগ্র- পর্ব ১

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:০৭


ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ইমদাদুল হক ইমদু



এমদাদুল হক ইমদু গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার সাতানিপাড়া গ্রামে আনুমানিক ১৯৫৫ সালেএক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে , যাকে স্থানীয়ভাবে সবাই চিনত 'ইমদু' নামে।

ইমদুর পিতা আশরাফ আলী ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক । ইমদু লেখাপড়া করেছিল স্থানীয় সাতানিপাড়া খৈ কোরা হাইস্কুলে মাত্র সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত।স্বাধীনতার পরপরই সে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে।

সে ১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, এবং যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দেয়নি। যুদ্ধের সময় অস্ত্রের নেশায় পেয়ে বসেছিল ওকে। এজন্যেই কিনা- পরবর্তী জীবনে এই অস্ত্রকেই বুকে জড়িয়ে সে হয়েছিল কালীগঞ্জের নরপিশাচ 'ইমদু'!

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ইমদু জড়িয়ে পড়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর রাজনীতিতে।

১৯৭৪ সালের দিকে কালীগঞ্জের প্রভাবশালী জাসদ নেতা আলী হোসেন তালুকদারের হাত ধরে সে জাসদের সক্রিয় কর্মী হয়। শুরুতে আলী হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও ধীরে ধীরে ক্ষমতার লোভে আলী হোসেনের সাথেই তার মতবিরোধ তৈরি হয়।

১৯৭৭ সালে আলী হোসেনের বাহিনী ইমদুর বাড়িতে হামলা চালায় এবং ইমদুকে না পেয়ে তার ছোট ভাই এনামুলকে কুপিয়ে হত্যা করে।

এ ঘটনাই ইমদুকে পুরোপুরি সন্ত্রাসের পথে নিয়ে যায়। ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে সে জাসদেরই অনেক নেতা-কর্মীকে টার্গেট করেন।
জয়দেবপুরের বাবুল, আব্দুল কাদের ভূইয়া, কফিলসহ একাধিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার নাম জড়ায়। প্রকাশ্যে মানুষকে কুপিয়ে বা গুলি করে হত্যা, গুম, ডাকাতি—কোনো অপরাধই বাকি রাখেনি সে।

তার নামে ২২টিরও বেশি খুনের মামলা হয়। কালীগঞ্জে তার এতটাই দাপট যে, লোকে তাকে "ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব" বলে ডাকত।

জাসদ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর ১৯৮০ সালে সে যোগ দেয় জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে। বিএনপি তখন সবে গঠিত হয়েছে। বিভিন্ন গ্রুপের মানুষ এসে বিএনপিতে আশ্রয় নেয়।
একদম নতুন একটি রাজনৈতিক দলে যা হয়- ইমদুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। কেউ খতিয়ে ও দেখেনি ইমদু কত বড় সন্ত্রাসী। সে তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য।

সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় তার সন্ত্রাস আরও বেড়ে যায়। সে "জাসদ খতম" মিশন শুরু করে—প্রতিপক্ষ জাসদ নেতা-কর্মীদের নির্মূল করতে। তার দাপট এতটাই ছিল যে, শোনা যায়, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এক জনসভায় (পুবাইল রেল স্টেশনের কাছে) মঞ্চে জিয়া ছাড়া আর কাউকেই বসতে দেয়নি।

মঞ্চে ছিল শুধু দুজন- জিয়া আর ইমদু—অন্য কোনো মন্ত্রী বা নেতাও ছিলেন না সেখানে। সবাই ইমদুর পায়ের দিকে চেয়ারে বসে সেদিন সার্কাস দেখেছিল।



এবার ইমদুর ঢাকায় উত্থান শুরু হয়। গাজীপুর-কালীগঞ্জ থেকে তার সন্ত্রাস এসে আস্তানা গাড়ে ঢাকা শহরে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তার উত্থানের স্বর্ণযুগ। সে ছিল দূর্ধষ স ন্ত্রাসী। প্রতিপক্ষ জাসদ বা অন্য কারো সাহসই ছিলোনা ওর সামনে গলা তুলে কথা বলে। মেরে লা শ বাঁশে ঝুলিয়ে পালিয়ে যেত সে।

এরপর বিকেলেই দেখা যেত সে কোন একটা দোকান উদ্ভোধন করছে আর সেই খবর বিটিভি প্রচার করছে। এতোটাই ধূর্ত ছিল সে।

ইমদুর অপরাধের প্রতিবাদ করলেই সে প্রকাশ্য দিবালোকেই গুলি করে বা কুপিয়ে মেরে ফেলত। পুলিশ ও রেহাই পায়নি। সে বিভিন্ন সময় পুলিশ হ ত্যা করে লুটে নিয়েছে অস্ত্র।


নারী বা শিশু- কাউকেই সে ছাড়তো না। ওর অবাধ্য হলেই মৃত্যু-এমনই পিশাচ হয়ে উঠেছিল সে। কালীগঞ্জের বহু পরিবারকে সে স্বপরিবারে হ ত্যা করেছে। অনেকেই তার ভয়ে ভিটেবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ছিল বছরের পর বছর।

পাইকারি হারে খুন করলেও ইমদু নিজে অসংখ্যবার মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়, তাও অলৌকিকভাবে। যেন ভাগ্যদেবীর বিশেষ দৃষ্টি ছিল ওর প্রতি।

প্রতিপক্ষরা অ্যাম্বুশ করে গুলি চালিয়েও তাকে হ ত্যা করতে পারেনি, কয়েকবার । মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার এমন বহু গল্প রয়েছে ওর জীবনে।

রাজনৈতিক কারণে অপরাধ করেও পার পেয়ে যেত ইমদু। একদিকে সে খুন করে বেড়াত, অন্যদিকে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিত।

সাংবাদিকদের ও কিছু করার ছিলোনা- ওর ছবি ছাপানো হত পত্রিকায়। আগের দিনই সে যে খু ন করেছে- সেটা বাদ দিয়ে খবর বের হত সে সময়। যে কারণে পুলিশও তাকে খুব একটা বেশি ঘাঁটাত না।

নিজে অনেক খু ন করলেও বার বার প্রাণে রক্ষা পায় এই ইমদু। ১৯৭৭ সালে আলী হোসেন তার দলবল নিয়ে ইমদুর গ্রামের বাড়িতে হামলা চালায়। হামলার কিছুক্ষণ আগেই ইমদু বুঝতে পেরেছিল।
এজন্যে পালিয়ে জীবন বাঁচায় সে। হামলাকারীরা ইমদুকে না পেয়ে তার ছোট ভাইকে কু পিয়ে-পি টিয়ে খু ন করে।


কয়েক মাস পর আলী হোসেনের কয়েকজন সাগরেদ গাজীপুর টঙ্গীতে ধরে ফেলল ইমদুকে। ওরা অস্ত্র নিয়ে তৈরীই ছিল। ইমদুর বুকে স্টেনগান চেপে ধরল একজন। গুলি চালালো। কিন্তু ট্রিগার জ্যাম! ব্যাস- সুযোগেই পালালো ইমদু।

১৯৭৯ আলী হোসেন ইমদুকে ডেকে পাঠায়। খবর বাহক বলে- আলী হোসেন আপোষ করতে চায়। বৈঠকি খুনের আভাস পায় ইমদু।
তবুও সে যায়। আলোচনার স্থান নির্ধারিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের দোতলায়। ইমদু কলাভবনের দোতলায় এসে পৌছায় সন্ধ্যায়। আলোচনা করতে করতেই হুট করে আলী হোসেন ইমদুকে পায়ে গুলি করে বসে।
গুলি খাওয়া ইমদু তখনই দোতলার বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ে- আর খুড়িয়ে খুড়িয়ে পালায়। সেইবার ও ইমদুকে কিছুই করতে পারেনি কেউ।

কিন্তু ক্ষমতার খেলায় গণেশ উল্টাতে সময় লাগেনা। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আকষ্মিক মৃত্যুর পর (১৯৮১) বিএনপির মধ্যে কোন্দল বাড়তে থাকে।

এই ফাঁকে ইমদু চলে যায় অনিয়ন্ত্রিত জীবনে। সে যা ইচ্ছা তাই করতে শুরু করে। চাঁদাবাজি, অস্ত্র চালান, হেন কোন অপরাধ নেই- সে করেনি।

১৯৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কাকভোরে রাজধানীর মিন্টো রোডের মন্ত্রীপাড়ায় (সাত্তার সরকারের যুব প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারি বাসভবন) এর চারপাশে হুট করে জড়ো হয় শত শত পুলিশ।

ছাদে, গ্যারেজে, আঙিনায়- কোথায় নেই পুলিশ! হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দেয় পুলিশ- 'ইমদু' আমরা পুরো বাড়ি ঘিড়ে ফেলেছি। দয়া করে আত্মসমর্পন করো'।

কিন্তু কে শোনে কার কথা? ইমদু মন্ত্রীর বাড়ি থেকে বের হলোনা। যেন কিছুই ঘটেনি - এমন ভাবেই নিস্তব্ধ পুরো বাড়ি। সবাই জানে- ইমদু ভেতরেই আছে। কিন্তু পরবর্তী একশন না দেখে সে সামনে আসছেনা।

পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনা। একজন মন্ত্রীর বাড়িতে একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী ঢুকে বসে আছে!ইমদুকে এরেস্ট করার জন্যে আড়ালে থেকে চাপ দেয় সেনাপ্রধান এরশাদ।

এদিকে ইমদু বের হয়না। একদিন যায়। দুই দিন যায়। পুলিশেরা পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে যায়। মন্ত্রীর বাড়ি দেখেই কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনা।
শেষমেষ তিন দিন পর ইমদু নিজেকে ধরা দিতে বাধ্য হয়। একাধিকবার পালিয়ে ও সে কখনো অসম্মানিত হয়নি- যতটা ওকে পুলিশ ধরাতে হয়েছিল।

সে ভেঙে পড়েছিল। এত শক্ত নার্ভের একজন আসামী- প্রায় সব অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য হলে- ওর বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়।

এর মধ্যে তাড়াহুড়া করে আরো কয়েকটা মামলায় ফাঁসির আদেশ দেখিয়ে ইমদুকে প্রায় জোর করেই ফাঁসি দেয়া হয়েছিল।

এই পুরো ঘটনা তৎকালীন সরকারকে বিব্রত করে এবং সেনাপ্রধান এরশাদের সামরিক শাসন জারির একটি বড় উপলক্ষ হয়ে ওঠে (২৪ মার্চ ১৯৮২)। বলা যেতে পারে একমাত্র ইমদুর কারণেই বাংলাদেশের ভাগ্য পেয়ে যায় একজন সৈরাচার রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে।

যিনি জেঁকে বসেছিলেন বাংলাদেশের ঘাড়ে। সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেন তিনি।

আজও কালীগঞ্জের বুড়োরা গল্প করে ইমদুর কথা—কীভাবে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা একজন সাধারণ মানুষকে দানবে পরিণত করে, আর শেষে সেই দানবই ধ্বংস হয়ে যায় নিজের পাপের আগুনে। এ গল্প শুধু সন্ত্রাসের নয়, সত্তর-আশির দশকের বাংলাদেশের রাজনীতির অন্ধকার দিকেরও এক জ্বলন্ত সাক্ষ্য।

তথ্যসূত্রঃ ফেসবুক , বিভিন্ন ব্লগ ও অন্যান্য

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩৪

সৈয়দ কুতুব বলেছেন: সে সময় কতজন ফ্রাংকেস্টাইনের গল্প জানতো? আপনার কি মনে হয় এই উপাধি সমসাময়িক কেউ দিয়েছে না?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.