নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাহিত্যিক, সংগঠক, প্রযুক্তিবিদ
আগুনে পোঁড়া ভালোবাসা
---- জসিম উদ্দিন জয় -------
তখন ভরা বর্ষা । পানিতে থৈ থৈ করছে । তার মাঝখানে পদ্ম ফুটেছে । পদ্ম ফুলে ফুলে ফড়িং উড়ছে । হালকা হওয়া জল নড়ছে। পুরোনো বাশঁবাগনটি ছাতার মতো ছায়া হয়ে আছে। তার মাঝখানে মাছরাঙ্গা, ঘুঘু আর শালিকের দল। পুকুরটি উত্তর দিকটায় আমগাছের তকতা বিছিয়ে কাপড় কাচঁছেন ফাহমিদা খালা। ধাপাস্ ধাপাস্ শব্দে পুকুরের জলে মৃদু টেউ তুলছে। বয়সের ভারে যেমনটী হয়। ফাহমিদা খালার একমাত্র মেয়ে আদুরী। বড় শখের মেয়ে আদুরী। এগুলো আদুরীর কাপড়। খুব যতন করে ধুতেঁ হবে। কোন ছাঁড় দেওয়া যাবে না। প্রতি সপ্তাহে একবার তিনি এই কাপড়গুলো ধৈাত করেন। তারপর পুকুর পারে দুটি তালগাছ আছে তার মাঝ বরাবর একটি রশি ঝুলিয়ে দেন। পরম মমতা নিয়ে কাপড়গুলো রৌদে শুকাঁতে দেন। পাশের জামগাছটার নিচে একটি মাদুর বিছিয়ে সেখানে অপেক্ষো করেন। ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁিকয়ে থাকে কাপড়গুলোর দিকে। কখন কাপড়গুলো রৌদে শুঁকাবে । তারপর এক অজনা আতংকে দুঃস্বপ্নে বাতাসে শুনতে পান......‘ “মা..গো, পুঁেড় যাচ্ছি”। শব্দটা শুনেই কয়েক ফোঁটা চোখের পনি পরে। কষ্টটা ভীষন বেদনাদায়ক। তাই সহ্য না করতে পেরে গাছটার নিচে ঘুমিয়ে পরে । অবশ্য পাশের কবিরাজ, মাওলানা, গ্রাম্য ডাক্তার অনেককে দেখানো হয়েছিলো। সবাই এটা মিথ্যা স্বপ্ন বলে চালিয়ে দিয়েছে । বলেছে ‘‘আগুনে পুঁড়লে কেহই পুঁেড় যাচ্ছি বলে না, বলে ‘‘ বাচাঁও.... বাচাওঁ.....। এই স্বপ্নটা ফাহমিদা খালা প্রায় দেখে। উত্তপ্ত রৌদ্রে কাপড় শুকিয়ে বিকেল হয়। তখনও ফাহমিদা খলার ঘুম ভাঙ্গে না। আর এভাবেই কেটে যায় ফাহমিদা খালার দিন। কখনও রোদ কখনও বৃষ্টি । কখন বাসায় কখনও গাছের নিচে। পাশের বাড়ীর তরুন স্বপন। সন্ধ্যে হতেই স্বপন দৌড়ে যেয়ে বলে ‘‘ খালা, ও খালা সন্ধে হয়েছে ” ঘুম থেকে ওঠো, বাসায় যাবে না। খালা ধপ করে ওঠে, অষ্পষ্ট বলে ‘‘আমার আদুরির কাপড় গুলো শুঁিকয়েছে।’’
স্বপন উত্তর দেয় ‘‘ হ্যা খালা শুঁকিয়েছে’’। খালা কাপড়গুলো সুন্দর করে ভাজ করে। আদুরীর কাপড় । মেয়ে আদুরী এগুলো পড়বে। তার সামনে রাজকুমারীদের মাতে হেসেখেলে বাড়ী মাতিয়ে রাখবে। ফাহমিদা খালা মেয়ে আদুরী শাহড়ে একটি এনজিওতে চাকুরী করে। সাপ্তাহে দু‘দিন সে গ্রামের বাড়ীতে মায়ের কাছে এসে থাকে। আদুরী অনেক শখ ছিলো সে তার মাকে শহড়ে নিয়ে যাবে। বড় একটা ফ্লাট ভাড়া করবে। তারপর মা ও মেয়ে মিলে সমস্ত শহড় টই টই করে ঘুরে বেড়াঁবে।
স্বাপন ফাহমিদা খালাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। সন্ধ্যের সুর্য্যটা পশ্চিমা আকাশে ডুবে যায়। নেমে আসে অন্ধকার। পুরোনো খালটার জরাজির্নতা মাঝে জোনাকী পেকাঁর মিট মিট আলো । একা একা পথ চলছে স্বপন । স্বপন গায়ের ছেলে । আদুরী আর সে একই সাথে বড় হয়েছে এই গ্রামে। পড়াশুনা করেছে একসাথে । প্রতিদিন ২ থেকে ৩ মাইল হেটে পাশের গ্রামের স্কুলে পড়তে যেতে। বিকেলে কাঠাঁলি চাপা, তোতুল, আর পেয়ারা খেতে খেতে বাসায় ফেরা। ছুটির দিনগুলোতে খালেবিলো মাছ ধরা, মাঠের পর মাঠ দৌড়ে ছুটোছুটি করা। এলোমোলো কাঠাঁলি চাপার গাছ থেকে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া। আদুরী যেদিন থেকে পুকুরপাড়ে গোসল করা বন্ধ করে দিয়েছে । সেদিন স্বপন বুঝতে পারলো যে আদুরী বড় হয়েছে। তারপর একদিন একটি চাকুরী নিয়ে সে শহড়ে চলে যায়। সেদিন স্বপন এর বুকটা কেমন যেনে কেঁপে উঠেছিলো। মনে হচ্ছিলো তার বুকটা ছিরে কে যেনো চলে যাচ্ছে। স্বপন সেদিন বুঝেছিলো যে.... সে কতটা ভলোবাসে আদুরীকে। গত বর্ষায় একসাথে দুইজনে সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজেছিলো। পুকুরপাড়ে এক কোনে বাতাবি লেবুর গাছ লাগানোর সময় আদুরী বলোছিলো ‘‘যেদিন এই গাছটিতে লেবু হবে সেদিন আমি রান্না করবো। তারপুর একটু মিষ্টি হেসে বলে পুটি মাঝের ঝোল পাক করবো। স্বপন সেদিন কিন্তুু তুই আমাদের বাসায় খাবি.... বুঝলি। তখন অঝড়ে বৃষ্টি হচ্ছিলো । বৃষ্টিতে ভিঁজে আদুরী গায়ে জড়িয়ে থাকা কাপড়টি গায়ের রংয়ের সাথে একাকার হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিলো একটি সুন্দর জীবন্ত মুর্তি। যার গায়ে কোন কাপড় নেই। একটি ফুটন্ত তরতাজা পদ্ম । আদুরীর শিশুকালো পার হয়েছে। টসটসা যৌবনের রং লেগেছে গায়ে। বৃষ্টিতে না ভিজলে হয়তো বোঝা যেতো না। স্বপন সেদিন থেকেই মনে মনে বাসনা করে । আদুরীকে তার বউ বানাবে। রাজকন্যাদের মতো সাজিয়ে গুজিয়ে রাখবে তাকে। ইত্যাদি নানা কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ বেয়ে পানি পরতে থাকে স্বপনের । একটি কথা সে গ্রামের কাউকে বলতে পারছে না। এমনকি আদুরীর ‘মা’ ফাহমিদা খালাকেও না। আদুরী আর কোন দিন ফিরে আসবে না । সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। শেষ দেখাটি হয়েছিলো ছয়মাস আগে। আদুরী ঢাকায় তার কর্মস্থলে যাবে । তখন প্রায় সুর্য্য ডুবুডুবু । আদুরীকে বাসষ্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে স্বপন। যখন গাড়ী ছেরে দিবে ঠিক পূর্ব মহুুর্তে স্বপন বিদায় নিবে । তখনই বাস থেকে নেমে দৌড়ে আসে আদুরী । লোক-চুক্ষুর আড়ালে স্বপনকে একটি চুম্বন দিয়ে বলে ‘‘ বেশ কিছু টাকা জমিয়েছি, তাছাড়া অফিস থেকে একটা স্পেশাল বোনাস পাবো, এবার এসেই আমাদের বিয়ে। তুমি প্রস্তুত থেকো। আগামী সাপ্তাহে তোমার-আমার বিয়ে । বাস ছেরে দেওয়ার আগেই হেলপার ডাকা শুরু হয়ে গেলে। হেলপার জেড়ে জেড়র চিৎকার দিয়ে ডাকছে ‘‘ ও আপার তারা তারি আইয়েন, বাস কিন্তু এখনই ছেড়ে দিবে। বাধ্য হয়ে সেই ডাকে পুনরায় বাসে ফিরে যায় আদুরী। স্বপন তাকিয়ে দেখে বাস ছেরে দিয়েছে । জানালার পাশে বসে আদুরী হাত দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে স্বাপনকে। ভালোবাসার মমতা ঘেরা সেই হাতের বিদায় যেনো কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না স্বপন। স্বপন মুগ্ধবিস্ময়ে ভালোবাসার চরম আকুতি আর স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে আদুরীর দিকে। বাস চলে গেছে। তখনও স্বপ্নের ঘোর কাটছে না । বিয়ের স্বপ্ন । সেদিন সরারাত ঘুমাতে পারেনি স্বপন। আগামী সাপ্তাহে তার বিয়ে। বাসা-বাড়ী ঠিকঠাক করতে হবে। টাকাপয়সা জোগার করতে হবে। বাবা-মাকে-এ ম্যানেজ করতে হবে। আত্মীয় স্বজন সকলকে দাওয়াত করতে হবে। নানাবিধ চিন্তাভাবনা তাকে অস্থির করে ফেলে। নতুন বউকে ঘরে তুলতে হবে। ঘরটা সুন্দর করে সাঁজাতে হবে। স্বপন এক দৌড়ে উঠোনে যায়। স্বপনের উঠনে মাঝখানে আজ চাদেঁর আলোর ঝরনা বয়ে যাচ্ছে। উঠনের ঠিক মাঝখানে হাত দুটিকে মেলে ধরে জেৎস্না ধরার চেষ্টা করে । এক মুঠো নীল জেৎন্সা আমি আদুরী কে দিবো’’ এই বলে চিৎকার করে আনন্দে। আর এভাবেই সেদিন সারারাত কেটে যায়। সুন্দর একটি সকাল হয় । সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই স্বপন দেখতে পেলে, তাদের বাড়ীর দক্ষিন দিকে থানার হাবিলদার এক পুলিশ একটি ব্যাগ আর কিছু কাগজ পত্র নিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে ব্যাগটি দেখে ছুটে যায়। ব্যাগটি আদুরীর চিনে ফেলে স্বপন। তাই দৌড়ে পুলিশটির কাছে ছুটে যায়। পুলিশ জানালো এই ব্যাগ আদুরীর তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে এসেছি।
স্বপন তড়িঘড়ি করে বলে ‘‘ কেন ? আদুরী কোথায় ?
পুলিশটা খানিকটা চোখের পানি মুছে বললো “ সে নোংরা রাজনীতির প্রতিহিংসার স্বীকার হয়েছে। সে মারা গিয়েছে, গত রাতে ঢাকায় ফেরার পথে দুবৃত্তরা পেট্টল বোমা ছুরে মারে গাড়িতে। সাথে সাথে সর্ম্পুর্ন গাড়ীটি আগুন পুরে যায়। ২৫ জন যাত্রী আগুনে পুরে মারা যায়। এর মধ্যে আদুরী একজন। সেখানে সে পুরে মারা যায়। ব্যাগটি গাড়ীর পাশে পরে ছিলো । সে জানালা দিয়ে নামার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু পারে নি। সেখানেই অগ্নিগ্ধ হয়ে পুরে যায়।
স্বপন কথাটা শুনামাত্রই ঃ নিজের মুখ নিজে চেপে ধরে । আত্মচিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পরে। পুলিশ হাবিলদার তাকে টেনে তুলতেই সে আবার শক্ত হয়ে দাড়িঁয়ে পুলিশকে প্রশ্ন করে ‘‘ আমার আদুরীর লাসটি কোথায় ?
পুলিশ আবার হাতাশা আর উৎকন্ঠা নিয়ে কান্নাবিজরিত কন্ঠে বলে ‘‘ তার লাসটি এতটাই পুরে গিয়েছে এখানে আনার মতো না তাকে মেডিকেল থেকে সোজা......... কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
স্বপন পুলিশটিকে জোর অনুরোধ জানালো এই খবরটি যেনো আদুরীর মাকে না জানায় । কেননা তার মা জানালো মারা যাবো ।
পুলিশটি ঘটঁনাটা বুঝতে পেরে চলে যায়।
স্বপন আদুরীর ভালোবাসার কাছে সে সারা জীবন নিজেকে সপে দিয়েছে। জীবন্ত আদুরী থেকে মৃত আদুরীকে সে বেশী ভালোবাসে। প্রায় সেই আদুরীর কবরস্থানে ছুটে যায়। একটি গোলাপ নিয়ে তার কবরে সামনে দাড়িঁয়ে থাকে। ভালোবাসার গভীর আকুতিতে চোখের পানি পরে অজান্তে বলে উঠে ‘‘আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি আদুরী ” আমি সারাজীবন তোমাকে ভালোবাাসবো। আর এভাবেই স্বপন প্রায় একটি গোলাপ নিয়ে আদুরীর কবরস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে এবং একই কথা বলে । অন্যদিকে আদুরী মা প্রতি সপ্তাহে তার মেয়ের কাপড় ধুয়ে চলে । তার মেয়ে ফিরবে .. পথ চেয়ে বসে থাকে। আজও সেন দুঃস্বপ্ন দেখে ফাহমিদা খালা। তার মেয়ে আদুরী ডাকছে... মাগো ““ পুরো যাচ্ছি ? ”” .......
( হায়রে পেট্টোল বোমা শেষ করে দিলো দুটি জীবনের নিষ্পাপ ভালোবাসা এবং একটি স্বপ্ন । )
©somewhere in net ltd.
১| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:১২
জসিম উদ্দিন জয় বলেছেন: ছোট গল্পটিতে গঠন মূলক মন্তব্য করার জন্য অনুরোধ করছি।