নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাহিত্যিক, সংগঠক, প্রযুক্তিবিদ
এরই নাম জীবন
-জসিম উদ্দিন জয়
প্রচন্ড শীত আর কুয়াসার আবরণ দিয়ে ঘেরা তখন প্রায় মধ্য রাত্র। রাজ দোকান বন্ধ করবে। শহরের মধ্যে সবচেয়ে কোলাহল যুক্ত এই বাসষ্ট্যান্ড। এবং এই বাসষ্ট্যান্ডকে কেন্দ্র করে এর একপাশে গড়ে উঠেছে একটি মার্কেট। মাকের্টের আশে পাশে বিভিন্ন দোকান রয়েছে যা মধ্যরাতের বেশী সময় পর্যন্ত খোলা থাকে। রাজের দোকানটি ঠিক তেমনিই মধ্যরাত্রীতেও কাষ্টমার আসতো, ফোন করার জন্য। কেননা তখন বাংলাদেশে মাত্র ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এবং ইন্টারনেটে খুব কমপয়সায় বিদেশে ফোন করা যেতো। তাই দূর দুরান্ত থেকে কাষ্টমার আসতো রাজের দোকানে।
মধ্যরাতের সময় লাঠিতে ভর করতে করতে তরিঘরি হেটে এলে এক বৃদ্ধ। শীতে থরথর করে কাঁপছে । বৃদ্ধ লোকটি, রাজকে লক্ষ করে বললো,‘‘ বাবা, আমি একটা ফোন করবো আমেরিকাতে, তুমি বাবা একটু পরে দোকানটি বন্ধ কর।” রাজ বৃদ্ধ লোকাটির পরিচয় জানে। বৃদ্ধ লোকটির ছেলে বাহিরে থাকে। এখানে শুধুৃ বৃদ্ধ লোকটি এবং তার স্ত্রী বৃদ্ধা থাকে। এই গলির শেষ প্রান্তে ২৩ নং বাড়িটির মালিক উনারা। তবে সপ্তাহখানেক হবে তার স্ত্রী বৃদ্ধা পৃথিবী ছেরে চলে গেছে, রেখে গেছে এই বৃদ্ধকে। এই বৃদ্ধ লোকটি এখন ঐ বাড়ীতে একা থাকে। কিন্তু এই মধ্যরাত্রীতে সে ফোন করতে এসেছে নিশ্চয়ই খুব বিপদে পরে এসেছে। রাজ তরিঘরি করে বৃদ্ধ লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে, ”চাচাঁ আসেন, ভেতরে আসেন, তারপর কিছুক্ষনের মধ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমেরিকাতে ফোন ধরিয়ে দিলো। অপরপ্রান্তে বৃদ্ধলোকটির ছেলে ফোনটি ধরলো।, ‘‘কোন কুশল বিনিময় না করেই হাউমাউ করে কেদেঁ উঠে,‘‘তার ছেলেকে বলতে থাকে,‘‘ আব্বু , আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি তোর মা‘কে ছেরে এই পৃথিবীতে থাকতে পারবো না। আপর প্রান্ত থেকে একমাত্র ছেলে তাকে শান্তনা দেবার জন্য চেষ্টা করছে। বৃদ্ধলোকটি কান্নাদেখে মনে হচ্ছে হাজার বছরের যুগলপ্রেম ছিলো তাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে। তার কিছুক্ষন পরেই আবারও বৃদ্ধলেকটি কন্না, ক্রমাগত আত্মনাতের কান্না, বৃদ্ধ লোকটির কান্না দেখে রাজেরও চোখ বেয়ে পানি পরতে থাকে, বৃদ্ধলোকটি ক্রমশ গুমরিয়ে গুমরিয়ে কাদঁতে থাকে, কান্নার শব্দে ফোনে কোন কথা বলতে পারছে না। তবু খানিক কান্নার শব্দ বন্ধ করে আবারও বললো তার ছেলেকে, ‘‘আব্বু তোর মায়ের কম্বলটা খুজেঁ পাচ্ছি না, বাসায় কোথায় রেখেগেছিস ?
আপরপ্রান্ত আমেরিকা থেকে বৃদ্ধলোকটির ছেলে বোঝানোর চেষ্টা করছে, বাবা তুমি মায়ের কম্বল দিয়ে কি করবে ?
বৃদ্ধলোকটি খানিকটা থেমে আবারও কাদঁতে শুরু করে, বাধঁভাঙার কান্নার শব্দ করে বলে‘‘ ‘‘আব্বু বাহিরে খুব ঠান্ডা পরেছে, ’’ তোর মা’ তো ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না, এই বিশাল উদোম করা কবরে তোর মায়ের খুব কষ্ট হবে। আমি কম্বলটি তোর মায়ের কবরে বিছিয়ে দিয়ে আসবো।
এভাবেই প্রতিদিন রাতেই বৃদ্ধলোকটি রাজের দোকানে আসে। কিন্তু অবাক করা একটি বিষয় বৃদ্ধলোকটি যতবারই দোকানে এসেছে তার গায়ে কালো পাঞ্চাবি আর মাথায় বেশ সাজানো একটি টুপি । ইতিহাসের কুইন ভিক্টোরিয়া এবং প্রিন্স আলবার্ট কথা শুনেছি ভিক্টোরিয়ার তরুণ বয়সেই নাকি জার্মান রাজকুমার আলবার্টের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তাদের বিবাহ হয়। তারা মধ্যবিত্ত পরিবারের মত জীবনযাপন করতেন। ২১ বছরের দাম্পত্যের জীবনে তাদের ৯ টি সন্তান হয় তারপর একদিন ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে আলবার্ট মারা যান। এরপর থেকে ভিক্টোরিয়া কালো পোশাক পরিধান করতেন এবং মাথায় তার বিয়ের পোশাকের ঘোমটা পড়ে থাকতেন। বৃদ্ধালোকটির গায়ে সব সময় সেই কালোপোষাক দেখে সেই গল্পটি মনে পরে গেলো রাজের।
ঐ কালো পোষাকে ছেলের কাছে ফোন করে। ঐ একই কথা বলে। রাজ, ‘এই দৃশ্য দেখে রাজের চোখে পানি চলে আসে। বৃদ্ধলোকটির দেখাশুনা করার মতো কেহ নাই। একটিমাত্র ছেলে। ছেলে বাহিরে থাকে। সেখানে বিয়ে করেছে। সেখানেই সংসার করে। দেশে প্রতিবছরই আসে । কিন্তু সপ্তাহ খানেক থেকে আবার চলে যায়। দেশে থাকার মতো এই বুড়ো আর বুড়ি ছিলো। আর কতগুলো কাজের লোক । বিশাল রাজকীয় বাড়ি । পুরো বাড়ি হাহা কার করে ।
এভাবে দিন যায় রাত আসে। এভাবে শীত-বসন্ত কাল পার হয়ে গরমকাল এলো। ঐ বৃদ্ধলোক কালোপোষাকে আবারও দোকানে আসে। ছেলের কাছে ফোন করে। গোমরিয়ে গোমরিয়ে কেদেঁ উঠে কলে ‘‘আব্বু আমি তোর মাকে ছাড়া এই পৃথিবীতে একলা থাকতে পারবো না । আমাকে বিদায় দে আব্বু।” আমি তোর মায়ের সাথে থাকবো । তোর মায়ের পাশেই যেনো আমার কবর হয়।
রাজের এই ফোনের দোকানে সে অনেক কাহিনী শুনেছে, তরুন তরুনী উগ্র ভালোবাসা , যুবক যবতীদের বিরহের ভালোবাসা, সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার গল্প, হাজারে গল্পের স্বাক্ষী রাজ । কিন্তু বৃদ্ধ লোকাটি তার স্ত্রী বৃদ্ধার জন্য করুন আত্মনাত, মায়া মমতার বন্ধন সত্যিই মনে হবে হাজার বছরের যুগলবন্দী ।
তারপর অনেকদিন কেটে গেলে । দিন পেরিয়ে মাস কেটে গেলো । ঐ বৃদ্ধ রাজের দোকানে আসে না । তার কোন সাক্ষাত নেই । রাজের ভিতরে একটি সত্যিকারের ভালোবাসার গল্প জন্মনিলো। রাজ ঐ বৃদ্ধর কথা খুব ভাবছে । রাজ কি করবে বৃদ্ধলোকটি তার একজন ভালো কাষ্টমার ছিলো। খুব মায়াও লাগছে।
একদিন একজন লোক তার দোকানে বাসা । আমেরিকায় তার স্ত্রীর কাছে ফোন করবে বলে বসে আছে । রাজ ঐ লোকটিকে দেখে খুব বৃদ্ধার কথা মনে পরলো । এবং লোকটিকে খুব আপন ভেবে বললো আপনি যানেন এখানে এক বৃদ্ধলোক ফোন করতে । রাজ ঐ লোকটির কাছে বৃদ্ধ লোকটির গল্পটি বলছিলো । এবং গল্প শেষে রাজ বললো, ‘‘ এখন আর ঐ বৃদ্ধ লোকটিকে ‘আর দেখি না । রাজ দেখতে পেলো ঐ লোকটির চোখ বেয়ে পানি পারছে । রাজ জিজ্ঞাস করলো আপনি কাদঁছেন কেন ?
লোকটি চোখের পানি মুছে বলে “সে আর কোন দিনও আসবে না । সে চলে গেছে না ফেরার দেশে ।” সে আমার বাবা হয় । আমি তার একমাত্র সন্তান। আমার বাবা-মা বেচেঁ থাকতে তাদের কাছে থাকলাম না । আমেরিকাতে পরে রইলাম স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। আমি আমার বাবা মাকে আর দেখতে পাবো না । আমি এখন এতিম হয়ে গেছি। বলেই হাউমাউ করে কেদেঁ উঠে।
- - - -- --
খুবই ছোট একটি গল্প কিন্তু এর বিস্তৃতি বিশাল ।
মানুষ নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, অলেকিক ভাবে পৃথিবীতে বাচেঁ, শেষ মহুর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করে বেচেঁ থাকতে চায়, শেষ পর্যন্ত জীবন যুদ্ধে হেরে যায় এবং অসহায় ভাবে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয় । এই পৃথিবীতে রয়ে যার তার ভালোবাসা । এরই নাম জীবন . . ..
©somewhere in net ltd.
১| ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৩১
আখেনাটেন বলেছেন: বেদনার্ত জীবন। সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকা। দুঃখ-বেদনা-সুখ-ভালোবাসা এগুলোর যোগফলই জীবন।
ভালো লাগল পড়ে।