নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাহিত্যকর্মী, সংবাদকর্মী এবং শ্রমজীবী
শ্রাবণের প্রাণবন্ত রাত। আমি আকাশের উপরে মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে উড়ে দূর থেকে দূরে কোথাও যাচ্ছি। উড়ে উড়ে শেষে কোন এক অদ্ভুত ভয়ংকর আর সুন্দর এক সমতল ভূমিতে এসে দাঁড়ালাম। চারদিকে সুন্দর সুন্দর সব দালান আর অসংখ্য ফুলের বাগান। ছোট, বড়, মাঝারি নানা রকমের ফুলগুলো পাপড়ি মেলে চোখ টিপে হাসছে। মনে হচ্ছে চারদিকে কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব। আমি চোখে কেমন একটা ছাই রংয়ের আবছা আবছা কুয়াশা দেখছি। কুয়াশাটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে আর আধো আলো আধো অন্ধকারের কি এক অদ্ভুত আলোছায়ার খেলা। কেউ একজন আমার ডানহাত ধরে টানতে টানতে আমাকে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ঠিক টানছে না, আমার হাত ধরে ‘জামাইবাবুর’ মত করে অতি আদরে যতেœর সাথে আমাকে পথ দেখাতে দেখাতে কে একজন সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কোন এক অজানা অদ্ভুত মোহের টানে অচেনা লোকটির সাথে সামনের দিকে আগাচ্ছি। যত আগাচ্ছি ততোই ভয়ংকর সব অদ্ভুত শিহরণ আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমার ডান হাত ধরে এখনো লোকটি আমাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে বুঝলাম যে আমাকে টানছে সে একজন মেয়েমানুষ। একজন পূর্ণ বয়স্ক যুবতী, অথবা পরিপূর্ণ নারী। মেয়েটির চোখের দিকে আমি বেশ ভালো করে তাকালাম। মেয়েটি অতি বিনয়ের সাথে আমার চোখ থেকে তার চোখ নামিয়ে নিলো। মেয়েটিকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। জীবনে কখনো আমি তাকে কোথাও দেখেছি বলেও মনে হচ্ছে না। তাছাড়া সে বড়ো অদ্ভুত এক মেয়ে। সমস্ত শরীর দুধে ধোয়া ফর্সা, অথচ হাত-পাগুলো ভীষণ কালো কুৎসিত। মেয়েটির নাক ঠিক জাপানিজদের মতো। চুলগুলো হরেক রঙে বর্ণিল একেবারে নিগ্রো নারীর মতো। মুখের আদল অন্য রকম। আবার কোমরের নিচে মেয়েটির কোন বস্ত্র আছে কি না তা বুঝতে পারছি না। অনেকটা মৎস্য কন্যার মতই। পেছনে আবার লেজের মতো কি একটি ঝুলছে। এ ধরনের অদ্ভুতুড়ে মেয়েমানুষ আমি ইহকালেও দেখিনি। এমনকি কোন এনিমেশন ফিল্ম নয়তো কোন ইংলিশ হরর ছবিতেও এরকম গড়নের মেয়ে আমি কখনোই দেখিনি তা আমি হলফ করেই বলতে পারি। মেয়েটির চোখ দুটো ভীষণ মায়াবী। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় যেন ইটের ভাটার মতো। চোখ দিয়ে আগুনের লেলিহান শিখার মত কি এক অদ্ভুত দ্যুতি বের হচ্ছে। হঠাৎ করেই আবার রূপ পাল্টায় মেয়েটি। মনে হয় আমাদের চিরচেনা বাঙালি কোন সুন্দরী নারী। সে এক অদ্ভুত ভৌতিক নারী, না কি পিশাচিনী, ডাকিনী অথবা কোন প্রেত।আরো দু’জন নারী এসে দাঁড়াল আমার সামনে। একজন দেখতে ভীষণ কুৎসিত। মনে হয় এসিডে ঝলসানো তার পুরো শরীর। এত কুৎসিত যে তার দিকে তাকালে বমি এসে যায়। আরেক জন ভীষণ রকম অদ্ভুত রূপসী। তার শরীর দিয়ে বের হচ্ছে কোন এক অচেনা পারফিউমের তীব্র ঘ্রাণ। সে ঘ্রাণ যেকোন পুরুষকে উদ্বেলিত করে তুলতে পারে যৌন উত্তেজনায়। শুনেছি এমন এমন কিছু পারফিউম আছে মার্কেটে যা নাকি পুরুষকে যৌনতায় উসকে দেয়। কী এক অদ্ভুত ব্যাপার, এত সুন্দরী নারী অথচ তার সমস্ত শরীরে কেমন রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। মনে হচ্ছে কেউ তাকে বেদমভাবে প্রহার করেছে। নয়তো কেউ তাকে জোর করে নির্যাতন করেছে শারীরিকভাবে অথবা কেউ তাকে জোর করে উপর্যুপরি ধর্ষণ করেছে রাতভর। আবার মেয়েটির গলার নিচে কিসের এক কালো জটালো চিহ্ন। গলায় ফাঁস নিলে যে রকম দাগ হয় ওটা ঠিক তেমনই। মেয়েটি তার চোখ দিয়ে এমনভাবে আমাকে আহ্বান করছে যে, নিজেকে ধরে রাখা খুবই অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।
ভীষণ এক অজানা ভয়ে আমার বুকটা ধুকধুক করছে। আমার এই বুঝি হার্টফেল হয়ে যায় যায় অবস্থা। ভয়ে ভয়ে মেয়েগুলোর দিকে তাকাচ্ছি আর সামনের দিকে আগাচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো ব্যাস..., পেতœীর হাতে পড়েছি। পেতœীর। তো শুনেছি এমন অদ্ভুত বদ চেহারার হয়, রূপ পাল্টায়। কিন্তু মাঝে মাঝে যে মেয়েগুলো আবার ঠিক মানুষের মতোই। তবে কি জ্বীন, পরী। পরীদের তো নাকি কোনো শরীর থাকে না। কিন্তু ওরা তো ঠিক মানুষের মতোই আমার হাত ধরে আছে। আমি ভয়ে মনে মনে ‘আয়াতুল কুরছি’ পড়লাম। আমার মাথার ভেতর কেমন একটা চক্কর দিয়ে উঠছে। ভিমরতি’তে ধরেছে নাতো...? এবার বুঝি সত্যিই ‘ফিট’ হয়ে যাব। মেয়েগুলো আমাকে সামনে পিছে আড়াল দিয়ে কোন অজানায় নিয়ে যাচ্ছে। উঁচু-নিচু পথ পাড়ি দিয়ে হাঁটছি তো হাঁটছি। এভাবে কত কিলোমিটার হাঁটলাম তা বুঝতে পারছি না। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পা ফসকে স্লিপ করে পড়ে যেতেই, কোথা থেকে যেন অদৃশ্যভাবে ওদের মতো আরো একটি অদ্ভুত রূপসী মেয়ে এসে আমার শরীরটাকে দুহাতে কোমল পরশে আঁকড়ে ধরল। মেয়েটির উঠতি যৌবন আর শরীরের অদ্ভুত স্পর্শে আমি মরে যেতে যেতেও ঠিক বেঁচে উঠলাম আকস্মিকভাবে। কী নরম তার শরীর। ঠিক একেবারে কমলালেবুর মতোই। দেখলে লোভ হয়। আদর করতে ইচ্ছা হয়। চুমু খেতে ইচ্ছা হয়। মেয়েটিও আমার দিকে তাকিয়ে জিহŸা বের করে হাসছে, চোখ মারছে। মেয়েটি বুকের বসন সরিয়ে আমাকে তার উঁচু বুক দেখাচ্ছে। আমার শরীর যেন আগুন হচ্ছে দ্রুতগতিতে। মেয়েটি ইশারায় আমাকে আহŸান জানাচ্ছে তার শরীরে হাত দেয়ার জন্য। আমার কেমন লজ্জা হচ্ছে তার এমন আচরণ দেখে। এ মেয়েটি অন্য অদ্ভুূত মেয়েগুলোর চাইতে অন্য রকম । তার শরীরের বসন আর বডিল্যাংগুয়েজ দেখে তাকে বেশ আধুনিক মনে হচ্ছে। অন্য মেয়েগুলো এদিক-ওদিক তাকিয়ে অদৃশ্য কারো সাথে কথা বলছে। আকার-ইঙ্গিতে কী যেন তাদের বোঝাচ্ছে। আমাকে ধরে রাখা অদ্ভুত রূপসী মেয়েটির দিকে আমি তাকাচ্ছি। মেয়েটি আমার চোখ থেকে তার চোখ নামাল না। সে আমার হাত ধরে টানছে আর হাসছে। তার শরীরের ঘ্রাণে আমি পাগল হচ্ছি।
-স্যার এক্সকিউজ মি, আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন? আপনার জন্য কি সকটের ব্যবস্থা করব।
আমার মাথাটা তিন গুণ জোরে ঝিমঝিম করে উঠল। এরা তাহলে ইংরেজিও জানেন। আবার আমাকে ‘স্যার’ বলেও সম্বোধন করছেন।
-স্যার কী আমাদের নিয়ে কিছু ভাবছেন? আমরা পৃথিবীর সব ভাষাতেই কথা বলতে পারি। দ্বিতীয় মেয়েটি বলে উঠল।
আমি অবাক হচ্ছি। তাহলে এরা মানুষের মনের কথাও বুঝতে পারে। মানে অন্তর্যামী। আমি বিস্মিত হচ্ছি।
-আচ্ছা, আপনারা কে বলুন তো?
আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কেন?
আমি ভয়ে চোখ দুটো বিড়ালের মতো করে বললাম। অদ্ভুত মেয়েগুলো আমার প্রশ্নে কেমন মুষড়ে পড়ে। আবার কেমন লজ্জা পেল বলেও মনে হচ্ছে।
-স্যার আমি হচ্ছি এই পরকাল দপ্তরের রিসিপশনিস্ট। এখানে যত মৃত লাশ আসে আমি তাদেরকে রিসিভ করি।
অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটি আমাকে উদ্দেশ করে বলছে।
পরকাল দপ্তর? রিসিপশনিস্ট, লাশ? আমি অবাক হচ্ছি তার কথায়।
-তাহলে আমি কী মরে গেলাম নাকি?
-জি স্যার। এটা আপনাদের পৃথিবী নামক গ্রহ নয়।
এটা অন্য জগৎ। পৃথিবীতে যারা মরে যায়, বিশেষ করে যাদের অপমৃত্যু হয়, এই ধরুন নির্যাতন, ধর্ষণে, আত্মহত্যা, নয়তো অ্যাক্সিডেন্টে অথবা অপঘাতে যাদের অপমৃত্যু হয় আমরা তাদেরকে এই অপজগতে নিয়ে আসি। এটা হচ্ছে অপদুনিয়া, পরকাল দপ্তর, আবার এটাকে দোযখ বা নরক বলেও ধরে নিতে পারেন। মেয়েটি বলল।
-তাহলে আমি কী নরকে চলে এসেছি? মানে তোমরা কী আমাকে নরকে নিয়ে এসেছ?
আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কথাগুলো বলে যাচ্ছি আর ওদের দিকে তাকাচ্ছি।
মেয়েগুলো সমস্বরে বলে উঠল।
-জি স্যার। শুধু আপনিই নন, আপনাদের পৃথিবীতে ইতিপূর্বে যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। নয়তো যারা অত্যাচারিত হয়ে মারা গেছে। অথবা যারা অত্যাচারিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। তাদের সবাই এই নরকে অবস্থান করছেন। তারা সবাই এখানে আছেন। আপনি নতুন মেহমান। সবার সাথেই আপনার এক এক করে দেখা হবে। পরিচয় করানো হবে। সবার সাথেই আপনার কথা হবে। মেয়েগুলো একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রহস্যের হাসি হাসছে আর আমার সাথে কথা বলছে।
আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত শরীর টলছে। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছি না, চোখে শুধু অন্ধকার আর ছোপ ছোপ কুয়াশার-ধোঁয়াশা।
তাহলে আমি কী আর আমার জগতে নেই? আমি কী তাহলে সত্যিই মৃত? আমার কি মৃত্যু হয়েছে? আমাকে কী মেরে ফেলা হয়েছে? কিন্ত কী করে তা সম্ভব? আমি আর সামনের দিকে আগাতে পারছি না। আমি মাথা ঘুরে ভিরমি খেয়ে অজ্ঞাত হয়ে পড়ে গেলাম । মেয়েগুলো দুহাত ধরে টেনে তুলে আমাকে সুস্থ করে তুলল। আমার পাছায় আর শার্টের কলারে লেপ্টে থাকা ধুলোবালিগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল-
-এই, স্যার বোধহয় অসুস্থ। তোরা তাড়াতাড়ি মৃত্যুপুরীতে খবর দে। স্যারের জন্য একটা গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বল।
পর্ব-২
আমি সাদা ধবধবে একটি শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছি। হঠাৎ চোখে মুখে পানির ঝাপটা লাগায় চেতনা ফিরে পেলাম। কেউ একজন আমার মুখে পানির ঝাপটা দিয়েই যাচ্ছে। আসলে আমি কখন থেকে যে ভয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছি তা আমি বুঝতে পারিনি। আমার সবকিছু কেমন অচেনা লাগছে। কোথায় এসেছি আমি? এটা কী সেই মৃত্যুপুরী? নাকি অন্য কোনো জায়গা তা আমি ঠাওর করতে পারছি না। অজানা এক ভয়ে আমার সমস্ত শরীর কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছে। রক্ত কণিকা হিম হয়ে আসছে ভয়ে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো
-মে আই কামিং স্যার।
দরজার ওপাশ থেকে কে একজন কামরার ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাচ্ছে। পুনরায় অজানা এক ভয়াল তন্দ্রাময়তায় আমার মাথাটা টনটন করছে।
আমার অনুমতি দীর্ঘক্ষণেও না পেয়ে শেষে লোকটি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। কিন্তু একি, এটা আবার কোনো ধরনের মানুষ! উপরের দিকটা মানুষের মতো আর নিচের দিকটা ঠিক শূকরের মতো। চোখ দুটো তার যেন রক্তলোলুপ। প্রফেশনাল খুনিরা যেমন মানুষ খুন করতে ভয় পায় না। জীবটাকে দেখেও আমার ঠিক তেমনই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা বুঝি এখনই আমাকে হত্যা করবে। তাহলে পৃথিবীতে যারা মানুষ খুন করে পরকাল দপ্তরে এসে তারা কী এ রকম হয়ে যায়? এ রকম অদ্ভুত জীব তো আমি পৃথিবীতে কখনই দেখিনি। এটা ঢাকার চিড়িয়াখানায় গেলে তো বেশ মার্কেট পেত। আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এবারেও বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাব।
-স্যার ক্ষমা করবেন। আপনার অনুমতি না নিয়েই ঢুকে পড়েছি। এ জন্য স্যার আমি ভীষণ লজ্জিত। অদ্ভুত প্রাণীটি আামকে উদ্দেশ করে বলল।
অদ্ভুত লোকটির হাতে একটি চামড়ার ট্রে। সে ট্রেটি আমার সামনে নামিয়ে রাখল।
ট্রেটিতে রাখা আছে নানা রকমের খাবার ও পানীয়। যেমন মানুষের হাড়গোড়, মলমূত্র, অন্যসব প্রাণীর মাথার খুলি। একটি বাটিতে সাজিয়ে রাখা আছে মানুষের মগজ। আরেকটি গ্লাসে টলমল করছে ঠিক কোকের মতো টকটকে তাজা লাল রক্ত। নেহারীর মতো বড় একটি হাড়ও আছে অন্য একটি কাচের পাত্রে। অদ্ভুত প্রাণীটি এসব খাবার আমাকে খেতে বলছে। পান করতে বলছে।
-মানুষ কি এসব খায় নাকি? আমি বললাম।
অদ্ভুত প্রাণীটি বিনয়ের সাথে বললÑ
-স্যার আপনি তো মৃত মানুষ।
আমার পা টলছে, মাথা ঘুরছে, দুর্গন্ধে আমার বমি হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমি বুকে ফুঁ দিয়ে ‘কুলহুআল্লাহ পড়লাম। এতক্ষণে আমি নিশ্চিত যে, আমি সত্যিই পরকালে চলে এসেছি। আমি এসব খাচ্ছি না দেখে অদ্ভুত প্রাণীটি আমাকে চোখের ইশারায় অন্য একটি কামরায় যেতে বলছে। আমি যেন ঠিক মন্ত্রমুগ্ধের মতোই তাকে অনুসরণ করে চলেছি। একটির পর আরেকটি কামরা, তারপর আরেকটি, এরপর আরেকটি, এভাবে কত লক্ষ কোটি কামরা আমি পার হচ্ছি তা আমি জানি না। একেক কামরায় একেক ধরনের প্রাণী। ওরা যেন কারাগারের মতোই বন্দি জীবনযাপন করছে। বেরিয়ে আসতে পারলে হয়তো ওরা সমস্ত পৃথিবী, ইহকাল-পরকালকে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে একাকার করে ফেলবে। ওদের চোখ তাই বলছে। আবার আমার মতো ভদ্র মানুষ দেখে ওরা হিংস্র হয়ে উঠছে। এভাবে অনেক লক্ষ কোটি কামরা পার হয়ে আমি অদ্ভুত প্রাণীটির সাথে সুন্দর এক সাজানো কামরার সামনে এসে দাঁড়ালাম। বিশাল একটি হলরুম। চারপাশে নানা রকমের সাজানো সব দামি তৈজসপত্র। ফুলদানিতে ফুলগুলো সাজানো। আহা কী অদ্ভুত ফুলের বাহার। ভাবছি, তাহলে নরকেও ফুলের বাগান আছে! ফুলগুলো কী অদ্ভুত, অচেনা। যা আমি আগে কখনোই দেখিনি। পৃথিবীর ফুলের থেকে একেবারে সম্পূর্ণ আলাদা। ফুলগুলো আমি হাত বাড়িয়ে ছুঁলাম। কী আশ্চর্য, হাত বাড়িয়ে ছুঁতেই ফুলগুলো সব ঝরে ঝরে ছাই হয়ে পড়ছে মেঝেতে। আর কী বিচ্ছিরি গন্ধ তাতে। তা হলে এগুলোও কী মেকি। সব নকল ফুল। আমি যে সত্যিই দোযখে এসে পড়েছি তাতে এখন আর আমার কোনো সন্দেহ নেই। কামরার পাশে বিশাল আকৃতির একটি কম্পিউটারের মতো যন্ত্র। যা সুপার কম্পিউটারের চাইতেও একশত গুণ বড় হবে নিঃসন্দেহে। মাউসটা হবে প্রায় দশ হাত লম্বা। মনিটর সিনেমার পর্দার প্রায় পঞ্চাশ গুণ বড় হবে। আমার মাথা ভন ভন করে ঘুরছে। এত বড় স্ক্রিন আমি স্বপ্নেও দেখিনি। স্ক্রিনে ভেসে উঠছে শুধু মানুষের মাথার খুলি আর তার নিচে কী সব অদ্ভুত অক্ষরে কী যেন লেখা।
-আপনার নাম বলুন?
কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা সুন্দরী এক যুবতী আমার দিকে তাকিয়ে আমার নাম জানতে চাচ্ছে। মেয়েটিকে আমার বড্ড চেনাচেনা লাগছে। কিন্তু কোথায় দেখেছি তা ঠিক মনে করতে পারছি না। তার পরনে কোনো কাপড় নেই। যোনিতে অসংখ্য লালচে দাগ। বাম পাশের স্তনটা ছুরি দিয়ে কেটে দিয়েছে বোধহয় কেউ। শরীরে ক্ষত আর আঁচড়ের দাগ। তার চেহারাটা আমার অনেক পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। মেয়েটিকে চেনার চেষ্টা করলাম। মস্তিষ্ক ঘুরপাক খাচ্ছে স্মৃতিবিষয়ক জটিলতায়।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমি কোনো এক খবরের কাগজে ওর ছবি দেখেছি। কী ক্ষত-বিক্ষত সে ছবিটি। অনেক বছর আগে মেয়েটিকে পুলিশরা ধর্ষণ করে ছিঁড়ে চিটকে খুবলে খেয়ে পরে হত্যা করে ভ্যানে তুলে দিয়েছিল। তাহলে সত্যিই ধর্ষিতারা নির্যাতিতরা এখানে এনে পুনর্বাসিত হচ্ছে। বিস্ময় আর ভয়াল যন্ত্রণায় আমার চোখ বুজে আসছে। আমি ভিরমি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম মেয়েটির ডান পায়ের ওপরে। মাথায় ঝাকুনি খেয়ে জ্ঞান ফিরে এল।
-ম্যাডামকে আমাদের পরকাল দপ্তরে ‘ডেড ম্যান রিলেশন অফিসার’ পদে চাকরি দেয়া হয়েছে। অদ্ভুত প্রাণীটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল।
-আপনার নাম বলুন, মেয়েটি পুনরায় আমার নাম জানতে চাচ্ছে।
-ইয়াকুব আলী, আমি বলি।
মেয়েটি কম্পিউটারের বোতামগুলো টিপছে। স্ক্রিনে কী সব মৃত মানুষের লাশ ভেসে উঠেছে।
-আপনার নাম তো খুঁজে পাচ্ছি না, সে বলল।
-আপনার কী পৃথিবীতে অন্য কোনো নাম ছিল। মেয়েটি আবার জানতে চাইল।
-হ্যাঁ, বন্ধুরা আমাকে ‘পাগলা কানাই’ নামে ডাকে।
মেয়েটি পুনরায় কম্পিউটারের বাটন টিপছে, কী সব কমান্ড দিচ্ছে, খটখট শব্দ হচ্ছে। আমার নাম লিখছে। কিন্তু তার ফাইলে আমার এই নামটা খুঁজে পাচ্ছে না।
-আপনার কী পৃথিবীতে এ দুটো ছাড়া অন্য নাম কোনো ডাকনাম ছিল।
-হ্যাঁ, আমার স্ত্রী আমাকে শিশির নামে ডাকে।
মেয়েটি পুনরায় কী সব কমান্ড দিয়ে কম্পিউটারে আমার নাম খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
-সরি স্যার, আপনার নাম এখনো আমাদের পরকাল দপ্তরে এসে পৌঁছায়নি।
-আপনি মৃত নন, এখনো জীবিত। জীবিত মানুষের নাম তো আমাদের কম্পিউটারের ফাইলে থাকে না। আপনাকে অনাকাক্সিক্ষতভাবে মৃত বলে ভুল করে পৃথিবী থেকে এখানে ধরে আনা হয়েছে। এজন্য আমরা ভীষণ লজ্জিত, দুঃখিত ও অনুতপ্ত। দয়া করে স্যার আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করে দেন প্লিজ। মেয়েটি হাত জোড় করে আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে।
-এই কালাজাহাঙ্গীর, তুমি এখনই ওনাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিয়ে এসো। উনি এখনো জীবিত। কোনো অপঘাতে বা ক্রসফায়ারেও ওনার এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়নি।
মেয়েটি অদ্ভুত প্রাণীটির দিকে চোখ পাকিয়ে আমাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দিচ্ছে।
-তাহলে আমি সত্যিই জীবিত!
মৃত নই এই ভেবে আমার মনে এখন আনন্দের ফল্গুধারা প্রবাহিত হচ্ছে। বেঁচে থাকার আনন্দে আমি এখন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি। এই অদ্ভুত জীবটাই কী তাহলে সেই কুখ্যাত খুনি। ওকি তাহলে মৃত? সন্ত্রাসীদের বুঝি মৃত্যুর পর পরকাল দপ্তরে এসে মানুষ আর বন্য শূকরের মিলিত চেহারা হয়। ওরা তো পৃথিবীতেও ঠিক পশুর মতো। আমার চোখের সামনে এখন একরাশ বিস্ময়।
পর্ব-৩
পরকাল দপ্তর আমাকে পৃথিবীতে রেফার করে দেয়ায় দুটো ছাগলের মতো মুখওয়ালা অর্ধমানুষ আমাকে গুঁতিয়ে ঠেলে ঠেলে অন্য একটি অন্ধকার কামরায় ঢুকিয়ে দিল। কামরাটির মধ্যে আমার মতো আরো অনেক প্রাণী আছে বলে মনে হচ্ছে। তবে তাদের মুখের মানচিত্র আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না। পেছন থেকে একটি কঙ্কালসার হাত আমার কাঁধে এসে ধাক্কা দিল। ভয়ে আমার বুকের পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
-মিয়া সাবরে চিনা চিনা লাগতাছে? আমাকে উদ্দেশ্য করে একটি কঙ্কাল বলে উঠল।
আমি দুচোখ বন্ধ করে দৌড়াচ্ছি। এক কামরা থেকে অন্য কামরা, তারপরে আরেক কামরা, তারপর আরেকটি, এভাবে লক্ষ, কোটি কামরা। দৌড়ে আমি আগাতে পারছি না। আমার পেছন পেছন দৌড়ে আসছে অনেক কঙ্কাল, অনেকগুলো হাত। এরা সবাই আমাকে ধরতে চাচ্ছে। ধরতে পারলে আমার পিণ্ডি চটকাবে বলে মনে হচ্ছে। ওরা বুঝে গেছে যে, আমি মৃত নই, জীবিত মানুষ। জীবিতদের প্রতি ওদের দারুণ ক্ষোভ। একজন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে।
-ভাইজান শুনেন, আমি সেই মেধাবী ছাত্র রুবেল। ডিবি পুলিশ আমাকে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছিল মনে আছে। এবার পেয়েছি আপনাকে। বদলা নিব, বলে সে আমাকে ধরতে যাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে।
আমি দৌড়াচ্ছি। দৌড়াচ্ছি। পেছন থেকে আরেক জন বলছে
-ভাইজান আমি রিমা। মনে পড়ে, অনেক দিন আগের কথা, আমার স্বামী মনির আমাকে খুন করে লাশ ফেলে দিয়েছিল।
আরেকজন বলছে।
-শুনেন, আমি তানিয়া। আমার বয়স ছিল তিন বছর। আমাকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল এক নরপিশাচ।
আরেকজন বলছে
-আমি শাজনীন। মনে আছে, আমাকে হত্যা করেছিল এক পাষণ্ড।
আরেজন বলছে
-স্যার শুনেন, আমি সীমা চৌধুরী। পুলিশ আমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছিল।
আরেক জন বলে
-ভাইসাব শুনেন, আমি শিল্পপতি আলম। ওই যে ঢাকার আলম মার্কেটের মালিক। আমার নিকটাত্মীয়রা সম্পত্তির লোভে আমাকে জবাই করে হত্যা করেছিল।
আরেক জন বলছে,
-আমি সেই নববধূ।
যাকে জোর করে বাসরঘর থেকে তুলে এনে গণধর্ষণ করে মেরেছিল আমার প্রাক্তন প্রেমিক ও তার সতীর্থরা। চিনেছেন...,
কামরাটির সবাই একসাথে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে যে যার নিজস্ব পরিচয় দিচ্ছে আর আমার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে কামরাগুলোতে এমন নির্যাতিত, ধর্ষিতা, খুন হওয়া, ক্রসফায়ারে মৃত্যু হওয়া নয়তো অত্যাচারে আত্মাহুতি দেয়া লক্ষ কোটি কঙ্কাল আছে। সবার চিৎকার আর চেঁচামেচিতে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভয়ে আমি মরে যাচ্ছি, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি। মাথাটা আমার ঘুরছে, আমি ভয়ে চিৎকার করে মা, মাগো বলে ডাকছি। হঠাৎ আমার মাথায় কে যেন জোরে একটি ধাক্কা দিল। চোখে-মুখে পানির প্রলেপ লাগায় জ্ঞান ফিরে চোখ খুলে দেখি, মা আমার হাত ধরে জোরে টান দিচ্ছেন। আর বলছেনÑ
-কী হয়েছে ইয়াকুব। চিৎকার করছিস ক্যান?
শান্ত আমার পাশে দাঁড়ানো। অর্পিতা আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে আর বলছ-
-এই, কী হয়েছে? তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এভাবে চিৎকার করছো কেন? দুঃস্বপ্ন দেখছো না তো? এই নাও পানি খাও।
মা আমার বুকে দোয়া পড়ে ফুঁ দিচ্ছেন। আমি বাম হাত দিয়ে লুঙ্গিটা ঠিক করতে করতে খাটের ওপর উবু হয়ে বসলাম। জানালা দিয়ে এক ঝিলিক বাতাস এসে আমার শরীর স্পর্শ করল। দুহাত দিয়ে চোখ দুটো ভালো করে কচলে নিলাম। আমার চোখের সামনে থেকে একটা কুয়াশার চাদর সরে গেল। আমি যে এতক্ষণে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম তা আমি এতক্ষণে বুঝলাম। খাট থেকে উঠে এসে জানালার সামনে দাঁড়ালাম। বাইরে কী সুন্দর বাতাস বইছে। আমার চিরচেনা পৃথিবীর সাথে দুঃস্বপ্নের সেই নরকের কোনো মিল নেই। তবে ওটা যে, আমাদের এই পৃথিবীর মানুষেরই কৃতকর্মের অন্য সংস্করণ তা আর আমার বুঝতে বাকি রইল না।
বাইরে কী অদ্ভুত রোদ্দুর। বিকেলের শান্ত আকাশে কী চমৎকার দখিনা সমীরণ। আমি সেই বাতাসে নিজেকে সঁপে দিয়ে অবগাহন করছি।
অর্পিতা আমার সামনে এসে দুহাতে আমার মুখটাকে আজলা করে ধরে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললÑ
-কানাই ভয় কী তোমার। আমি তো তোমার সাথে আছি আজীবন।
অর্পিতাকে আমি বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিই। অর্পিতা আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকায়।
দূর থেকে মাগরিবের আজানের সুর ভেসে আসছে মসজিদ থেকে। অর্পিতা আমার দিকে তাকিয়ে পিট পিট করে হাসছে।
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:২৯
স্ট্রাটাজেম বলেছেন: দারুন লিখেছেন .।.।.।.।.।
মুগ্ধ হয়ে শুধু পরলাম, ধন্যবাদ আপানাকে পোস্ট করার জন্য