নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাহিত্যকর্মী, সংবাদকর্মী এবং শ্রমজীবী
২০০৮ সাল। ঈদের দিন। সারাদিন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আজ বাড়িতে ভুনা খিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না হবে।
আইডিয়াটা কুদ্দুসের। তার মতে ঈদের দিনে ভুনাখিচুড়ির অন্যরকম একটি মজা আছে। কুদ্দুস আমার বন্ধু শ্রেষ্ঠ একজন। রাজবাড়ী শহরের চন্দনা পারের ছেলে সে। আর আমি পদ্মা পারের। জীবনের দ্রোহ কুদ্দুসকে টলাতে পারে না একদমই। দারুণ জীবন দর্শন জানে কুদ্দুস। ওর বাসা থেকে আমার বাসা পায়ে হাঁটার দশ মিনিটের পথ। কুদ্দুস আমার পাশে বসে হরদম সিগারেট ফুঁকছে। বাইরে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। বৃষ্টির দিনে কুদ্দুসের সিগারেট ফুঁকা বেড়ে যায়। আমার চোখ পাশের বাড়ির ঝুল বারান্দায়। ও বাড়িতে জানালার রেলিং ধরে অদ্ভুত সুন্দর একটি মেয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছে এক দৃষ্টিতে। বৃষ্টি নামলেই মেয়েটি এভাবে উদাস হয়। এ ব্যাপারটি আমি প্রায়ই লক্ষ্য করেছি। মাঝে মাঝে মেয়েটি অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকায়। আমার ঘরের জানালা আর মেয়েটির পড়ার ঘরের জানালা ঠিক সামনা সামনি। মাঝখানে একটি হাত তিনেকের চওড়া সরু গলি সোজা চলে গেছে কমলাপুর বাজারের দিকে। মেয়েটি প্রায়ই এভাবে উদাস হয়ে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার দিকে তাকায়। কোনো কথা হয় না। তাছাড়া বেশিক্ষণ আমি তার দিকে তাকাতে পারি না। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এত সুন্দর মেয়ে আমি আগে কখনো দেখিনি। মাঝে মাঝে ভাবি, মেয়েটির এমনকি কষ্ট আছে, এমনকি শূন্যতা আছে যে, ও এমন উদাস। প্রায়শই আমরা দুজন এভাবে চোখে চোখে চেয়ে লুকোচুরি খেলি। মেয়েটি নীরব থাকে ঠিক নিঃসঙ্গ প্রকৃতির মতো। পাহাড়ের মতো মৌনতায় ওর মুখের ভাষা যেন কেউ কেড়ে নিয়েছে জোর করে। মেয়েটিকে আমার পাথরের মূর্তির মতো মনে হয়। কিন্তু আমার তো ছটফটানিয়া এক কলরবমুখর ময়না পাখি চাই। পাহাড় দিয়ে আমি কী করব। তাছাড়া পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালাতে আমার তেমন স্বাধ নেই।
বাইরে বেরুচ্ছি। সাথে চন্দনা পারের ছেলে আব্দুল কুদ্দুস। ব্যালকনি পার হয়ে সদর গেটের সামনে এসে দাঁড়াতেই একটি রিকশা আমাদের প্রায় গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। রিকশার সিটে চোখ পড়তেই আমার প্রায় হতভম্ভ হওয়ার মতো অবস্থা। রিকশার হুডের ভেতর থেকে মুখ গলিয়ে পাশের বাড়ির সেই উদাস মেয়েটি নামছে ধীর পায়ে। আরো অদ্ভুত যে, মেয়েটি আমাদের দিকেই এগোচ্ছে। আমি ওকে বাড়ির ভেতরে আসতে বলি। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে পিট পিট করে হাসে। আমি অবাক হই। তাহলে মেয়েটি হাসতে জানে। ওর হাসি থেকে আজ যেন লক্ষ লক্ষ মুক্তা ঝরছে। এত বিষণ্ণ মেয়ে এভাবে অসম্ভব অদ্ভুতুড়ে হাসতে পারে তা আমার জানা ছিল না।
♦ আপনার বাইরে যাওয়াটা আজ মাটি করে দিলাম। মেয়েটি আমাকে বলে।
♦ না, মানে, আপনি কী কিছু বলতে এসেছেন…?
♦ আমার নাম শ্রাবণী। বিবিএ। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি।
♦ জানলাম, কিন্তু আমার কাছে কী মনে করে বলুন তো…?
♦ আপনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি।
♦ গুরুত্বপূর্ণ কথা? আচ্ছা বলুন। আমি বলি।
♦ কিছু মনে করবেন না। দয়া করে আপনার ঘরের জানালায় একটি পর্দা লাগাবেন। শ্রাবণী ম্লান মুখে বলে।
♦ আমার জানালায় পর্দা না থাকলে আপনার সমস্যা কোথায়?
♦ সমস্যা আমার না, আপনার। মানে আপনার চোখের প্রবলেম হতে পারে!!
♦ নিজে তাহলে বারান্দায় না এলেই হয়। আমি বলি।
♦ না, হয় না। কারণ ওই বারান্দাটা ছাড়া আকাশ, বৃষ্টি, প্রকৃতিকে দেখার জন্য আমার আর অন্য কোনো বারান্দা নেই যে।
♦ আচ্ছা, আপনি এত বিষণ্ণ থাকেন কেন? বৃৃষ্টি বুঝি আপনার খুব ভালো লাগে?
শ্রাবণী আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে দ্রুত গেট পার হয়ে চলে যায়। এদিকে কুদ্দুস আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে রিকশা খোঁজার জন্য। মেয়েটির কথাগুলো আমাকে স্বপ্নাবেশে আবেশিত করে রাখে মিনিট থেকে মিনিট। রিকশায় বসে আমি কোনো কথা বলি না। কুদ্দুস আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসে। আমার মাথায় জোরে একটি গাট্টা দিয়ে কুদ্দুস বলে,
♦ শালা গোবলেট, ধরা খাইছস।
আমি সত্যি সত্যি যে, শ্রাবণীর, হাতে ধরা খেতে চাই তা বোধহয় কুদ্দুস জানে না।
অনেকদিন পরে…
মাত্র নতুন চাকরিতে জয়েন করেছি। ভীষণ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। দম ফেলার সময় পাই না। কারো বারান্দায়ই এখন আমার চোখ তুলে তাকানোর সময় নেই। সকাল আটটায় অফিসের বারান্দায় ঢুকি। বেরুই ছয়টা কিংবা সাতটায়। কোনদিন রাত দশটাও বেজে যায় অফিস থেকে ফিরতে। বারান্দা চর্চা তাই এখন প্রায় স্থগিত। শুধু শুক্রবার হলেই বারান্দা বিষয়ক মনোরোগটা আমাকে জেঁকে ধরে। পুরনো অভ্যাস, ঝেরে ফেলা বেশ কঠিন। একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি, অনেকদিন পার হলো। শ্রাবণীর কোনো দেখা নেই। ওর ঘরের লাইট রাতে বন্ধ থাকে। শুক্রবার, আজ অফিস ছুটি। শরীর বেশ ক্লান্ত, শ্রান্ত, অসুস্থও। মা ডাকছেন নাশতা খাওয়ার জন্য। আমি তাকিয়ে আছি শ্রাবণীর বারান্দার দিকে। তাকাতে তাকাতে আমি প্রায় অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। শ্রাবণীর কোনো পাত্তাই নেই।
♦ তাহলে মেয়েটি কোথাও চলে গেল নাকি?
জানালায় নতুন পর্দা লাগিয়েছি। শ্রাবণীর ঘরেও যে পর্দা, আমারটায়ও ঠিক একই রং একই কাপড়ের। এটা আমি ইচ্ছে করেই করেছি। হয়তো এতে শ্রাবণী হাসবে নয়তো রাগবে। তাতে আমার কী। কার কী আসে যায়। আমার ঘরে যা খুশি তাই করার অধিকার শুধু আমার। বারোটা বাজার সংকেত দিচ্ছে ঘড়িটা। জুমার নামাজ পড়তে যাব একটু পরেই। এখনো নাশতা না করে বসে থাকার জন্য মা বকাঝকা শুরু করে দিয়েছেন। আমি শ্রাবণীদের জানালার দিকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকাচ্ছি বারবার। মনে হলো জানালার পর্দাটা একটু নড়েচড়ে উঠল। ওপাশে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে। তাহলে জানালার ওপাশে কেউ বসে আমাকে ফলো করছে। হঠাৎ একটি কাগজের টুকরো শ্রাবণীর জানালা থেকে আমার ঘরটা লক্ষ্য করে কেউ একজন ছুঁড়ে মারল। ভয়ে আমার বুকটা কাঁপছে। অজানা এক বিপদের আশঙ্কায় ভেতরে ভেতরে আমি কুঁকড়ে যাচ্ছি। দ্রুত হাত দিয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা কাগজের টুকরোটি তুলে নিই। চিরকুটটিতে সুন্দর হাতে গোটা গোটা করে লেখা।
শিশির,
আমার কষ্টের, বিপন্নতার ভাগ তো আর আপনি নেবেন না। পর্দা না হয় একই রঙের লাগালেন। আমার মনের রং কি আপনার মনে ছায়াপাত করে?
আমি অবুঝ নই। আপনিও যথেষ্ট ম্যাচিউরড। আশাকরি বুঝবেন। তারপরেও ভাবুন। পরে না হয় সিদ্ধান্ত জানাবেন।
ইতি-
শ্রাবণী
আমি আসলে ড্রিম মার্চেন্ট, একজন স্বপ্ন বিক্রেতা। স্বপ্ন ফেরি করতে করতে আমি বেশ ক্লান্ত আর আমার আমিত্বকে যখন আমি পরিপূর্ণভাবে ভুলতে বসেছিলাম, ঠিক সেই সময়ে শ্রাবণী আমাকে নতুন করে বাঁচার জন্য আহ্বান জানাল। আমন্ত্রণ জানাল দুজনে একসাথে জীবনের স্বাদ গ্রহণ করার জন্য। জীবনকে যাপন করার জন্য শ্রাবণীর সে যে কী ব্যাকুলতা। তার সেই অদ্ভুত ব্যাকুলতাই এখন আমার মাঝে ভাঙন ধরাচ্ছে। ভেঙ্গে চুরে আমি এখন প্রতিনিয়তই নির্মিত হচ্ছি শ্রাবণীর স্থাপত্যে। যখন আমার যাপিত জীবনে তামাদি রঙের দারিদ্র্য আর মনের চৌকাঠে কষ্টের মৃত জ্যোৎস্নার কান্না, আমার হতাশা আর কষ্টের বয়স যখন ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। ঠিক তখনই বুঝলাম শ্রাবণীর আহ্বান আমাকে নিত্যনতুন ফ্লেভারে সুখ দিতে শুরু করেছে। তার এই বন্ধুত্বের উদাত্ত আহ্বানকে আমি কী করে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারি। ওর চিরকুটটিকে খড়-কুটোর মতো করে আঁকড়ে ধরে বাঁচার তাগিদে আমি শ্রাবণীকে ভালবাসতে শুরু করি। ভালবাসলাম। সেও এভাবে একটু একটু করে আমাকে একদিন ঠিকই তার আঁচলে বেঁধে নিল ভালবাসার দায়ে। একদিন সন্ধ্যায় শ্রাবণী তার জানালার গ্রিলে মুখ গলিয়ে দিয়ে আমাকে উদ্দেশ করে বলল,
♦ শিশির, তোমার জন্য আজীবন প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে কষ্ট হবে না আমার।
♦ কিন্তু, সমুদ্রজলে কখনই টুংটাং শব্দ হয় না, হয় যা-তা ভয়ঙ্কর গর্জন। আমি বলি।
♦ তোমার জন্য ওই গর্জন আমার কাছে শুধুই জলতরঙ্গ।
♦ আমি গরিব, তুমি রাজার মেয়ে। ধনীর দুলালী।
♦ আমি তো তোমাকে তাজমহল বানাতে বলিনি। বলেছি একটু ভালবাসা ভিক্ষে দিতে। কৃপণ কেন তুমি?
♦ শুধু ভালবাসা কেন? তোমাকে আমি জীবনটাই দিয়ে দিলাম।
♦ আমার জীবনটাও আজ থেকে তোমার। শ্রাবণী বলে।
শ্রাবণী এখন সত্যিই আমার মাঝে সংক্রামিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। আর আমার অন্তরে এখন দারুণ দুপুর। রোদেলা দুপুরে আমি খরস্রোতা নদীর বহতার মতো করে শ্রাবণীকে ভালবেসে যাই দীপ্ত অনুভবে। শ্রাবণীকে ভালবেসে বেসে এখন আমার পূর্ণতা পাওয়ার সময়। সে আমার হাতে হাত রেখে এখন দিব্যি হাঁটে। আমি যতো বেশি তাকে দেখি, ততো বেশি আমি মরে যাই। আমি শ্রাবণীকে উপহার দিই কবিতার লাল ইস্তেহার। ও দেয় আমাকে ফুল, ভালবাসা আর অসংখ্য চুম্বন। ওর চুম্বনে আমার ভালবাসা খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে কচুপাতার মতো করে। ঠিক যেভাবে খুব দ্রুত বাড়ে বালিকার বুক…!
এখন আমরা চোরাবালি পথে পাশাপাশি হেঁটে পাড়ি দিই অনেকটা দীর্ঘ পথ। কষ্টগুলো এখন আর তেমন দীর্ঘ বলে মনে হয় না আমার। আমি শ্রাবণীর শরীরে হাত রাখি। তার শরীর থেকে চন্দনের গন্ধ বেরোয়। এই প্রথম জানলাম প্রতিটি নারীরই নিজস্ব একটি গন্ধ আছে। তার প্রতিটি আঙ্গুলেরও নিজস্ব একটি ভাষা আছে। আমরা মুখে কথা না বলে, আঙ্গুল দিয়ে, চোখ দিয়ে, নাক দিয়ে কথা বলতে থাকি। অন্ধকারের মধ্যেও এখন এক অসহ্য কোমলতা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে । শ্রাবণীর হাত, পা, মুখ, বুক, শরীর যেন ঘন দুধের মাখন দিয়ে তৈরি। তার শরীরে কোনো হাড় নেই। যখন তার লাল ব্লাউজ উপচে চাঁদ গলে পড়ে, তখন সেই অদ্ভুত চাঁদের আলো থেকে নিজেকে আড়ালে রাখতে বড় কষ্ট হয় আমার। শ্রাবণী আমার হাতধরে যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটে তখন আমার মনে হয় রাস্তায় যেন চাঁদ নেমে আসে। চাঁদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে আমি পার হই শাহবাগ মোড়, এলিফ্যান্ট রোড। পাড়ি দিই সমগ্র ঢাকা শহরের অলি-গলি রাজপথ। আমি সম্মোহিত হই নিখুঁত চাঁদের আলোয়। শ্রাবণী তার নিজের বাড়ন্ত শরীর আমার থেকে আড়ালে রাখে। তার শরীরে হাত বুলাতে না পারলেও, তাতে আমার পৌরুষে কখনই ধুলো জমে না এতটুকুও। কারণ তার নিখাঁদ ভালবাসায় ধুয়ে যায় আমার মনের সব ময়লার স্তূপ, আবর্জনার পাহাড়।
♦ তোমার শরীরের ঘ্রাণ আমার বুকে আলপিনের মতো এসে লাগে। আমি বলি।
শ্রাবণী তখন হেসে হেসে প্লাবিত হয় চাঁদের সাথে।
♦ ছুঁয়ে দেখ! শ্রাবণী বলে।
♦ অনুমতি প্রার্থনা করি।
♦ দিলাম। মনভরে নাও।
অতপর, তার শরীরের সমস্ত সৌন্দর্য আমি হাতের আঙ্গুল দিয়ে অনুভব করি। এই প্রথম আমি তার শরীরে হাত রাখি। বুকে হাত দিই। ঠোঁট দুটো আঙ্গুল দিয়ে টিপে দিই। আমি তাকে ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ দুহাত দিয়ে জাপটে ধরি। শ্রাবণী এখন আমাকে স্বপ্নের খুব কাছে নিয়ে গিয়েছে।
♦ শিশির, তুমি দুগোলার্ধের নারী শরীরের সংস্থান সূত্রটি খুব ভালো জান।
তুমি পুরুষ, অদ্ভুত পুরুষ। শ্রাবণী আমাকে উদ্দেশ করে বলে।
♦ তুমিই আমাকে তৈরি করে নিয়েছ। আমি বলি।
♦ আমি তোমাকে নিজের মতো করে গড়ে নিতে চাই।
♦ নাও, ইচ্ছেমতো তুমি আমাকে সৃজন কর প্রিয়তমা। আমি বলি।
শ্রাবণী হাসে। আমার বুকে ঝলক দিয়ে রোদ ওঠে। আমি হাসি। শ্রাবণীও হেমন্তের কাশবনে চাঁদের আলোর মতো করে হেসে ওঠে। তার মুখটি এখন আমার কাছে পূর্ণিমার চাঁদ বলে মনে হয়। তার ঠোঁটের ছোঁয়া বেশি কোমল, নাকি ফুলের পাপড়ির স্পর্শ বেশি কোমল তা আমি বুঝতে পারি না। সে আমাকে প্রতিদিনই পুরুষ করে তৈরি করে নিচ্ছে। পুরুষ হওয়ার আনন্দে এখন আমি শ্রাবণীকে পূর্ণতায় ভরিয়ে দিতে থাকি নিত্যদিন।
এভাবে তিন বছর আমরা একে অপরকে ভালোবাসলাম, কাছে এলাম, আপন হলাম। বদলিযোগ্য চাকরির সুবাদে আমাকে অফিস ট্রান্সফার করে দিল পার্বত্য শহর রাঙামাটিতে। প্রথমত অনেক চেষ্টা করেছিলাম ঢাকায় থেকে যাওয়ার না হলে তো শ্রাবণীর সাথে আমার ভালবাসা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ঢাকায় থেকে যাওয়া আর হলো না আমার। শ্রাবণী এমবিএ পাস করে চাকরি নিয়েছে দেশের খ্যাতনামা একটি ব্যাংকের কাস্টমার সার্ভিসে। প্রতিদিনই তাকে অনেক নারী-পুরুষের ব্যাংকিং বিষয়ক সমস্যার সমাধান করতে হয় কাস্টমার কেয়ারে বসে। কলিগদের সাথে হাতে হাত রেখে কাজ করতে হয়। আর আমি রাঙামাটিতে ফরেস্ট বিভাগের গাছগুলো গুনে গুনে দিন পার করছি। এক একটি দিন আমার কাছে প্রায় অর্ধ বছরের সমান। তাছাড়া রাঙামাটিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক খুব মজবুত নয় যে, ঢাকায় সবার সাথে যোগাযোগ রাখব প্রতিদিন। তবুও শ্রাবণীকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর আমি প্রতিনিয়ত। এভাবে চলছিল ভালোই। ফেসবুকে যোগাযোগ হতো নিয়মিত। ২ কিমি পথ হেঁটে পাহাড়ে উঠে ফোনে কথা হতো প্রতিদিন। এভাবে দিন গুনে দিন পার হয়। সময় যায় কেটে দ্রুত তাবৎ হ্যালুসিনেশানে। অফিসে কাজের চাপে শ্রাবণীর সাথে আমার প্রায় একমাস যোগাযোগ রাখা সম্ভব হলো না। লক্ষ্য করলাম শ্রাবণীও আমার সাথে যোগাযোগ অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। ভাবলাম এটা তার কাজের ব্যস্ততার জন্যও হতে পারে। প্রথমত সপ্তাহে একটি চিঠি, তারপরে মাসে একটি, এরপরে তিন মাসে একটি চিঠি, এভাবে চলতে থাকল কিছুদিন।
চৈত্রের ক্লান্ত দুপুর। স্বাধীনতা দিবসের সরকারি ছুটি আজ। মনটা খারাপ, শরীরটাও অবসন্ন যাচ্ছে। খাটে শুয়ে শুয়ে অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ বইটি পড়ছি। সিকিউরিটি এসে খবর দিল ঢাকা থেকে ছোট ভাই শান্ত এসেছে। সদর গেটের কাছে এসে দেখি শান্ত দাঁড়িয়ে আছে ব্যাগ হাতে করে। শান্তকে নিয়ে চিন্তিত মনে ঘরে ঢুকলাম। মা’র অসুস্থতার খবর শুনে মনটা বেদনায় ভরে যাচ্ছে। মাকে দেখার জন্য মনটা কবে থেকেই ব্যাকুল হয়ে আছে। বুকটা ছটফট করছে ঢাকা যাওয়ার জন্য। ছুটি নেই। বাড়তি কোনো ছুটিও পাব না বসের কাছে চেয়ে। ভাবছি নতুন বসকে হাতজোড় করে বলে কয়ে অন্তত দুদিনের জন্য বিনা বেতনে হলেও ছুটি চেয়ে নেব। শান্তকে নিয়ে চিন্তিত মনে ঘরে ঢুকলাম। কাপড় গোঁজগাছ করলাম। শান্ত বাথরুম থেকে বেরিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাটের এককোণে উবু হয়ে বসে আছে। আমার চোখের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি দিয়ে শান্ত তাকাচ্ছে বারবার। মনে হয় ও অন্যকিছু বলতে চাচ্ছে, অথবা কিছু লুকাচ্ছে।
♦ কিরে, কিছু বলবি?
মা কি বেশি অসুস্থ? আমি বলি।
♦ না, মা’র বিষয়টা তেমন সিরিয়াস না। তুমি টেনশন করো না। তবে…
♦ তবে কী, অন্য কোনো সমস্যা?
♦ মানে, ভাইয়া তোকে বলি শোন। পাশের বাসার শ্রাবণী আপু গতকাল কোর্টে গিয়ে তার কলিগ সুমন শাহরিয়ারকে বিয়ে করেছে।
♦ বলিস কিরে!
♦ হ্যাঁ, শ্রাবণী আপুর বাবা-মা এখনো এটা মেনে নেয়নি। ওনাদের বাসায় এখন প্রায় প্রতিদিন ঝগড়া হচ্ছে এই নিয়ে।
শান্ত বলে যাচ্ছে শ্রাবণীর বিয়ের কথা, পরিবারের মেনে না নেয়ার কথা। আমার মাথায় বজ্রপাত হচ্ছে। মনে হচ্ছে আকাশটা যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আছড়ে পড়ছে আমার মাথায়। শ্রাবণী কী করে এটা করতে পারল। আমার চোখ থেকে চিক চিক করে গড়িয়ে পড়ছে কাঁচাসোনা অশ্র“। শান্ত আমার মুখের দিকে কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমি আমার কষ্টাশ্র“গুলোকে শান্তর চোখ থেকে আড়াল করতে পারছি না। খবরের কাগজ পড়ার আড়ালে এখন শান্তও কাঁদছে আমি জানি।
তিন তলার ফ্ল্যাট থেকে ইথারে ভেসে আসছে আইয়ুব বাচ্চুর গান, চলো বদলে যাই…!!!
বদলে যাওয়ার হাওয়ায় শ্রাবণী আমাকে এভাবে হারিয়ে দেবে আমি তা আর ভাবতে পারছি না।
ভাবছি ঢাকা থেকে ফিরে এসে এই বন পাহাড়ের ঢালে বন বিভাগের গাছগুলোকে আগলে রেখে জীবনের বাকিটা সময় পার করে দেব। তাছাড়া প্রকৃতিতো কখনই কারো সাথে প্রতারণা করে না। মানুষ করে। নিজেকে সেই মানুষ ভেবে কী বিস্ময়কর এক কষ্ট বুকের ভাঁজে চিন চিন করে বেড়ে উঠছে খুব দ্রুতগতিতে।
…….
(পরিমার্জিত)
২| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৮ সকাল ১০:৪০
রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর।
©somewhere in net ltd.
১| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ৩:১৯
জুনায়েদ বি রাহমান বলেছেন: ভালোবাসা কারো কারো ক্ষেত্রে ব্লুটুথ, ওয়াইফাই'র মতো। কাছের ডিভাইসে সহজে'ই কানেক্ট হয়ে যায়। এবং দূরে গেলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এমন চরিত্রের মানুষগুলো বউ, স্বামী, প্রেমিক বা প্রেমিকা হিসেবে খুব বিপদজনক।
উপস্থাপন ভালো লেগেছে।