| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
খায়রুল আহসান
অবসরে আছি। কিছু কিছু লেখালেখির মাধ্যমে অবসর জীবনটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করছি। কিছু সমাজকল্যানমূলক কর্মকান্ডেও জড়িত আছি। মাঝে মাঝে এদিক সেদিকে ভ্রমণেও বের হই। জীবনে কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করিনি, এখন তো করার প্রশ্নই আসে না। জীবন যা দিয়েছে, তার জন্য স্রষ্টার কাছে ভক্তিভরে কৃতজ্ঞতা জানাই। যা কিছু চেয়েও পাইনি, এখন বুঝি, তা পাবার কথা ছিলনা। তাই না পাওয়ার কোন বেদনা নেই।
আজিজিয়ায় আমাদের হোটেলে আমি ও আমার ছেলে ছাড়াও অপর যে তিনজন হাজ্জ্বী মিলে আমরা পাঁচ শয্যার কক্ষটি ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম, তাদের সম্বন্ধে কিছু কথা আগের পর্বেও বলেছিলাম। তার অতিরিক্ত ওদের আরও কিছু গুণাবলী আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল বলে সে কথাগুলোও এখানে বলে নিচ্ছি, কেননা এক মুসাফিরের সৎকর্মের কথা অপর মুসাফিরকে প্রেরণা যোগাতে পারে। জনাব ফুয়াদ তানভির তার নিকটাত্মীয়া দুইজন বয়স্কা মহিলার মাহরাম হিসেবে গিয়েছিলেন। তিনি পুরোটা সফরে তাদের দুইজনের এবং তার নিজের ব্যাগগুলো হাতে, কাঁধে ও পিঠে বহন করেছেন। এর পরেও তিনি সুযোগ পেলেই আমার হাতের ব্যাগ নিয়েও টানাটানি করেছেন বহন করার জন্য। আরব মরুভূমির দেশে জুন মাসের সর্বোচ্চ গরমের সময় তার এ নিঃস্বার্থ কায়িক শ্রম এবং আত্মত্যাগ আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। জনাব নূরুজ্জামান খান এর সহৃদয়তার কিছু কথা আমি “মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব-২০২৫-(২)” পর্বে লিখেছি। কিন্তু আজ লিখছি তার অন্য একটা অনন্য গুণের কথা। আমাদের রুমে যে যত ফল আনুক না কেন, ফলগুলো সুন্দর করে কেটে সবাইকে পরিবেশন করতেন জনাব নূরুজ্জামান খান। এ কাজে তিনি বিশেষ পারদর্শিতার অধিকারী ছিলেন। তবে শুধু পারদর্শিতা থাকলেই সবাই এত মনযোগের সাথে এ কাজটি করতে এগিয়ে আসেন না। এর জন্য আগ্রহ থাকতে হয়। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় অনেক আগ্রহের সাথে এ কাজটি করতেন। আজিজিয়া থেকে মক্কায় চলে আসার পরেও তিনি তার এই অসামান্য সার্ভিস আমাদেরকে দিয়ে গেছেন, বিশেষ করে লাঞ্চের সময় যখন মেনুতে ফল থাকতো।
তৃতীয় রুমমেট জনাব তাওফিক আহমেদ চৌধুরী প্রবাল বেশ ঘন ঘন চা পান করতেন। তিনি যখনই চা পান করতেন, সবাইকে জিজ্ঞেস করে নিতেন কে কে চা পান করতে চান। যারা চাইতেন, সবাইকেই তিনি চা বানিয়ে দিতেন। এছাড়া তিনি একজন দক্ষ ফটোগ্রাফার ও ভিডিওগ্রাফার। দর্শনীয় স্থানসমূহ সফরের সময় তিনি ধারা বর্ণনাসহ ভিডিওচিত্র ধারণ করে রাখতেন। ইউটিউবে “টুকটাক গল্প” নামে তার একটি চ্যানেল রয়েছে, যেখানে তিনি তার দেশবিদেশে ঘুরে বেড়ানো নিয়ে গল্প বা ট্রাভেলগ লিখে থাকেন। ওয়াইল্ড লাইফ নিয়েও তিনি লিখেন। এমনিতেও তিনি গল্প করতে ভালোবাসেন। হজ্জ্বের এক মাস যেমন তার মুখে অনেক গল্প শুনেছি, এখন তার ইউটিউব চ্যানেল দেখেও তার কণ্ঠে অনেক “টুকটাক গল্প” শুনে থাকি। এই তিনজন ছাড়া আরও কয়েকজন সফরসঙ্গী হজ্জ্বযাত্রী তাদের আচরণে আমাকে মুগ্ধ করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন জনাব মোহাম্মদ এহসানুল হক মজুমদার। অস্ট্রেলিয়ার সিডনী-মেলবোর্নের মাঝামাঝি কোন এক জায়গায় তিনি সপরিবারে বাস করেন। তিনি সিডনী থেকে সস্ত্রীক এসেছিলেন, কিন্তু পুরোটা সময় তিনি আমাদের সাথে থাকতে পারেন নাই। বাচ্চাদেরকে অস্ট্রেলিয়ায় রেখে এসেছিলেন বলে হজ্জ্বের পরে পরেই তিনি সিডনী ফেরত চলে গিয়েছিলেন। তিনি অসামান্য একজন সহৃদয় ব্যক্তি। যখনই আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে, তখনই তিনি আন্তরিকভাবে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেছেন এবং উভয়ের কমন ইন্টারেস্ট এর বিষয়াদি নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছেন। লন্ডন থেকে দুই ভাই আর তাদের বাবা এসেছিলেন। ঐ দুই ভাইয়ের মধ্যে যে কে কার চেয়ে বেশি ভালো ছিল তা নিরুপণ করা কঠিন। ওরা যে কোন ব্যাপারে সাহায্যের জন্য ভলান্টীয়ার ছিল। ওদেরকে কোন সাহায্যের ব্যাপারে কখনও কোন অনুরোধ জানাতে হতো না। ওরা নিজেরা দেখেই এগিয়ে আসতো। জনাব সরোয়ার এবং তার স্ত্রী জেনি উভয়ে ছিলেন ভীষণ পরোপকারী ব্যক্তি। ফিরে আসার আগের রাতে জনাব সরোয়ার একাই আমার সবগুলো লাগেজের ওজন পরীক্ষা করে ওকে করে দিয়েছিলেন এবং ওজনের ব্যাপারে আমার অনুমানের প্রশংসা করেছিলেন। তার স্ত্রীও “রিয়াজুল জান্নাত” দর্শনের ব্যাপারে আমার স্ত্রীকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। এরা সবাই একেকজন উজ্জ্বল প্রফেশনাল ক্যারীয়ারের অধিকারী। তথাপি এরা প্রত্যেকেই কি সুন্দর করেই না সাংসারিক এবং অন্যান্য বিবিধ গুণও রপ্ত করেছেন!
০৫ জুন ২০২৫ তারিখে আমাদেরকে বাসে করে মিনায় নিয়ে আসা হলো। যেহেতু আমি এর পূর্বেও বিশ বছর আগে একবার হজ্জ্ব পালন করেছিলাম, সেহেতু মিনা ও আরাফাতে অবস্থানকালে আমাদেরকে মানসিকভাবে কী কী প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে, সে ব্যাপারে আমার মোটামুটি একটা ধারণা ছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী এবং ছেলের জন্য এবারেই প্রথম হজ্জ্ব পালন ছিল বিধায় তাদের কোন ধারণা ছিল না। আমি যতটুকু পেরেছি, বলেছি। আমরা এতদিন ছিলাম আমাদের বাংলাদেশি মুয়াল্লেম বা এজেন্সী’র (জনাব শাহীন) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। বাংলাদেশ থেকে হাজ্জ্বী নিয়ে আসা তার মত আরও অনেক এজেন্সী মিলে একজন সৌদি মুয়াল্লেমের অধীনে তার লোকজনের নির্দেশমত কাজ করতেন। মিনায় গিয়ে মনে হলো, অনেকগুলো নদীর স্রোতধারা যেমন সাগরে নিপতিত হবার আগে একটি মোহনায় এসে মিলিত হয়, তেমনি মিনাও যেন বিভিন্ন দেশীয়, বিভিন্ন ভাষাভাষী, বিভিন্ন সংস্কৃতির হাজ্জ্বীদের এক মোহনা। তবে চেষ্টা করা হয়ে থাকে একই তাঁবুতে যেন একই ভাষাভাষী হাজ্জীগণ অবস্থান করতে পারেন। এতে অনেক প্রশাসনিক জটিলতা এড়ানো যায়। আমরা যে তাঁবুতে অবস্থান নিয়েছিলাম, সেখানকার অন্যান্য সকল হাজ্জী ছিলেন বাংলাদেশ থেকে আগত, বিভিন্ন এজেন্সী’র অধীনে। বিভিন্ন দল উপদলের পৃথক নেতা ছিলেন, যাদের হাতে হ্যান্ডমাইক ধরা ছিল এবং তারা কারণে অকারণে সেটার যথেচ্ছ অপব্যবহার করছিলেন। তাদের উচ্চঃস্বরে শব্দদূষণ অন্যান্য হাজ্জ্বীগনের জন্য কোন অসুবিধার কারণ হচ্ছে কিনা, সেদিকে তাদের ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তারা মাইকে যেসব ওয়াজ নসিহত করছিলেন, হজ্জ্বের প্রাথমিক জ্ঞান হিসেবে সেগুলো সকল হাজ্জ্বীর জানার কথা। তথাপি তারা অন্যের অসুবিধা করে হলেও তাদের তথাকথিত নেতৃত্বের (এবং অর্বাচীনতার) স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছিলেন।
মিনায় হাজ্জীদের শোবার জন্য একটি করে কুশন বা ফোমের বিছানা (তোষক) বরাদ্দ ছিল। সেটা পরিষ্কার সাদা চাদর দ্বারা আবৃত ছিল। লক্ষ লক্ষ হাজ্জ্বীর জন্য এ বিশাল আয়োজন করা সহজ কথা নয়, তাই হজ্জ্বের সময় এ নিয়ে কারও কোন অভিযোগ বা আপত্তিও থাকে না, কারণ সবাই এটা সহজেই উপলব্ধি করতে পারে। ঐ ফোমের বিছানায় সহজেই একজন হাজ্জ্বী চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমাতে পারেন, কিন্তু সমস্যা হয় যখন তিনি পাশ ফিরতে চান। পাশ ফিরতে চাইলে শরীরটাকে তোষক থেকে একটু আলগা করে তবে পাশ ফিরতে হবে, গড়িয়ে পাশ ফেরা যাবে না। অন্যথায় নিজ দেহটা আপন সীমানা পেরিয়ে অন্যের বিছানায় গড়িয়ে যেতে পারে। আরেকটা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় যখন ওয়াশরুমে কিংবা অন্যত্র যাবার জন্য তাঁবুর বাইরে বের হতে হয়। তখন খুব সাবধানে পা ফেলে এগোতে হয়, নতুবা ঘুমন্ত মানুষের পায়ে পা লেগে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যাহোক, এইসব অসুবিধাকে কোন হাজ্জ্বীই বড় করে দেখেন না। সবাই সব অসুবিধা মানিয়ে নিয়ে নিজ নিজ উপায়ে শান্তির সাথে সমাধান খুঁজে বের করেন।
অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা মিনার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিলাম। জনসংখ্যার চাপের কথা বিবেচনায় রাখলে বলা যায় যে ওয়াশরুম/টয়লেট এবং অজুখানা’র ব্যাবস্থাপনা উত্তম ছিল। নামাজের ওয়াক্তসমূহে ভিড়ের সময়েও লাইনে অপেক্ষা করার সময়সীমা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। তার পরেও যদি কারও খুব জরুরী প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে অন্যান্য হাজ্জ্বীগণ তাকে স্বেচ্ছায় ছাড় দিয়ে লাইনে অগ্রবর্তী করে দিয়েছেন। পরের দিন আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের সময় সেখানকার ব্যবস্থাপনা মিনা’র মত এত ভালো নাও হতে পারে, মনে মনে এ রকমের একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে হাতে যতটা সময় পেলাম, ইবাদতে মনোনিবেশ করলাম।
ঢাকা
০৮ নভেম্বর ২০২৫
শব্দ সংখ্যাঃ ৯৮৭
২|
০৮ ই নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৪
জেনারেশন একাত্তর বলেছেন:
অসাধারণ স্মৃতি, আপনি ১ম বাংগালী এত অসাধারণভাবে হজ্ব করেছেন। আপনার হজ্ব সামুর লোকদের জন্য ও দেশবাসীর জন্য বিশাল ঘটনা ও আনন্দের ব্যাপার।
৩|
০৮ ই নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৬
জেনারেশন একাত্তর বলেছেন:
আশাকরি, আল্লাহ আপনাকে প্রতিবছর ওখানে যাবার সুযোগ করে দিবেন ও আমরা প্রতি বছর ২০/৩০টা পোষ্ট পাবো।
৪|
০৮ ই নভেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:০৭
কালো যাদুকর বলেছেন: চমৎকার বর্ণনা। শুয়ে পাস ফেরার বর্ণনা আমার হজের স্মৃতি ফিরিয়ে নিয়ে এলো। আপনার বর্ণনার মোট এরকম মানুষের দেখা মেলশুধু হজে গেলেই। আগের গুলো পরে আবার ওআসছি।
©somewhere in net ltd.
১|
০৮ ই নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৪
নতুন নকিব বলেছেন:
অসাধারণ একটি পর্ব! লেখাটি পড়ে মনে হলো যেন আমিও সেই আজিজিয়ার হোটেল কক্ষের একজন সহযাত্রী ছিলাম। আপনার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, সহযাত্রীদের মানবিক গুণাবলির প্রশংসা আর হজ্জের অভিজ্ঞতার বাস্তব বর্ণনা, সব মিলিয়ে পুরো লেখাটি এক অনবদ্য স্মৃতিচিত্র হয়ে উঠেছে। প্রতিটি চরিত্র যেন নিজেদের সহজ-সরল কর্মের মধ্য দিয়ে হজ্জের সত্যিকারের শিক্ষা, নিঃস্বার্থতা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বাস্তবিকভাবে ধারণ করেছে। বিশেষভাবে জনাব নূরুজ্জামান খান, ফুয়াদ তানভির ও তাওফিক আহমেদ চৌধুরী প্রবালের আচরণগুলো এক কথায় অনুপ্রেরণাদায়ক।
মিনার অংশের বর্ণনায় আপনার বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই প্রশংসনীয়। এত বিশাল আয়োজনেও যে মানবিকতা ও ধৈর্য্য সবচেয়ে বড় শক্তি, তা আপনি অত্যন্ত নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
সার্বিকভাবে, “মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব” সিরিজের এই পর্বটি শুধু ভ্রমণগল্প নয়, বরং এক হৃদয়স্পর্শী শিক্ষা, মানুষের সৎ মন ও সহযোগিতার মধ্যেই হজ্জের প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে।
আপনার সুস্বাস্থ্য এবং নেক হায়াত প্রার্থনা করছি, মহান রব্বে কারিম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার নিকট।