![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিজের অজ্ঞতা নিজের কাছে যতই ধরা পড়ছে প্রচলিত বিশ্বাসের প্রতি ততই অবিশ্বাস জন্মাছে!
বিসিএস প্রশ্নপত্র এখন কেবল চাকরি পরীক্ষার উপকরণ নয় - এ এক ধরনের রাষ্ট্রীয় মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবেদন। একেক সরকারের আমলে একেক প্রশ্নে বোঝা যায়, তখন কে ক্ষমতায়, কী ভাবনা শাসন করছে, আর কোন আদর্শ নিরবে পরীক্ষার ঘরে ঢুকছে। আজ অনুষ্ঠিত বিশেষ শিক্ষা বিসিএসও তার ব্যতিক্রম নয়। এই পরিবর্তন যেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এক নতুন রাজনৈতিক-সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে পরিণত করেছে ।
অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব ধরা যায়: বিশেষ বিসিএস পুনরায় চালু করা। শেখ হাসিনার আমলে স্থগিত থাকা এই পরীক্ষাগুলো তারা দ্রুত শিক্ষকদের সংকট মেটাতে আয়োজন করেছে। এর আগে একইভাবে ৩,০০০ চিকিৎসক নিয়োগের মাধ্যমে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সংকট কিছুটা হ্রাসের চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে অনেকে মনে করছেন, প্রশাসন অন্তত কাজের গতি আনতে চাচ্ছে যদিও প্রশ্নপত্রের ভাষা বলে, গতি আসছে কেবল রাজনীতির বর্ণপরিচয়ে ।
প্রশ্নপত্র সবসময়ই ক্ষমতাসীনদের মনস্তত্ত্বের একখণ্ড আয়না। ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারির কথা এখনো মনে পড়ে। তখন ক্ষমতায় শেখ হাসিনা। সদ্য নির্বাচনের পরপরই সেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রশ্নপত্রে হঠাৎ দেখা গেল: “জাতীয় নির্বাচনে ভোটার হার কত শতাংশ ছিল?” চারটি অপশন দেওয়া, তার মধ্যে একটিতে লেখা: ৫ শতাংশ, আরেকটিতে ৪০ শতাংশ। পুরো দেশ জানত ভোটে দিতে মানুষ যায়নি , কিন্তু তিন লাখ পরীক্ষার্থী জানত সঠিক উত্তর কেবল একটাই: সরকারি সত্য। তাই পরীক্ষার হলে সবাই নিরবে ৪০ শতাংশ-এর পক্ষে ব্যালট দিল। এভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জনমত জরিপ সম্পন্ন হয় বাধ্যতামূলকভাবে।
বিগত সতেরো বছরের প্রশ্নে শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ, মুজিবনগর সরকার, শেখ হাসিনার ভিশন, কিংবা বাংলাদেশ কোন কোন আন্তর্জাতিক সংগঠনে যোগ দিয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনার সময়: এসব প্রশ্ন ছিল অতি পরিচিত । কিন্তু দুঃখজনকভাবে, জিয়াউর রহমানের সাথে যুক্ত সার্ক (SAARC) নিয়ে প্রশ্ন করার প্রবণতা তখন এড়িয়ে চলা হতো । কিন্তু ক্ষমতা বদলের সাথে সাথেই যেন সব উল্টে গেল ! সদ্য অনুষ্ঠিত বিশেষ বিসিএস-এর প্রশ্নপত্র দেখে মনে হয় আমরা যেন এক টাইম মেশিনে চড়ে বসেছি ! হঠাৎ করেই মঞ্চে এলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, স্যার সৈয়দ আহমেদ, এবং দ্বিজাতি তত্ত্ব। তবে প্রশ্নপত্রের এই পরিবর্তনে জিয়াউর রহমান আর সার্ক হালকা করে ফিরে এলেও, মূল ফোকাস এখন যেন ইতিহাসের অন্য অধ্যায়ে।
আজ বিশেষ বিসিএস-এ বেশ কিছু কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন এসেছে। যেমন, 'আয়নাঘর' কী? (উত্তর: গোপন কারাগার!) অথবা, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটভূমিতে আসা প্রশ্ন, শহীদ আবু সাঈদ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, এমন প্রশ্নও এসেছে। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরও এসে গেছে প্রশ্নে, সঙ্গে ১৯৭০ সালের পাকিস্তানি নির্বাচন আর তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক আবুল কাশেম। অন্য এক প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়: চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর সংসদ সংস্কারে ঐকমত্যের অন্যতম প্রস্তাব কী ছিল? অপশন: দ্বিস্তর সংসদ, আসন বৃদ্ধি, নারী আসন বাতিল, পিআর চালু। মানে ইতিহাস এখন কেবল অতীত নয়, সদ্য লেখা ঘটনাপঞ্জিও পরীক্ষার অংশ । মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে প্রশ্ন আসা বেশ ইতিবাচক - দেশের অর্থনীতি নিয়ে ভাবা তো ভালো !
বাংলা সাহিত্যের অংশে পরিবর্তনটি সবচেয়ে কাব্যময়। রবীন্দ্রনাথ ও জসীমউদ্দীনের জায়গায় এখন ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজি ; যেন প্রশ্নপত্রে এখন কবিতার ছন্দ নয়, মতাদর্শের স্পন্দন। একদা যে কবিরা ধর্মভিত্তিক পরিচয় দিয়ে পাঠ্যবইয়ের প্রান্তে ছিলেন, তারা এখন কেন্দ্রে। যেন রাষ্ট্র বলছে: শুধু আলোর কবি নয়, বিশ্বাসের কবিও লাগবে এই আলোচনায় । আশ্চর্যের বিষয়, আওয়ামী ও বিরোধী দুই ধারার ভাবধারাই কাজী নজরুলকে রেখেছে মাঝপথে: যা অন্তত কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ বলতেই হয়।
অদ্ভুত এক সময় : প্রশ্নপত্রে ১৯৫২ আছে, ১৯৭০ আছে, ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানও আছে, কিন্তু ১৯৭১ নেই। কেউ কেউ বলছেন, এটা মুক্তিযুদ্ধের অবমূল্যায়ন। কিন্তু সম্ভবত রাষ্ট্র নতুন কৌশল নিয়েছে: যা নিয়ে সব দল একমত, তা নিয়ে প্রশ্ন নয়; যা নিয়ে বিভাজন, সেটিই এখন মেধার পরীক্ষা। পরীক্ষার্থীদের জন্য কিছুটা স্বস্তির বিষয়, কারণ মুক্তিযুদ্ধের 'কঠিন' প্রশ্ন নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাতে হচ্ছে না। আজকের প্রশ্নপত্র তাই এক নতুন ধরণের সাহিত্য। যেখানে উত্তরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের দিকনির্দেশ।
এক সময় ছাত্ররা মুখস্থ করত শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা, এখন তারা মুখস্থ করছে PR চালুর প্রস্তাব। সব মিলিয়ে, বিসিএস প্রশ্নপত্র দেখলেই বোঝা যায়, আমরা কোন হাওয়ায় ভাসছি এবং কোন আদর্শের ছায়ায় আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ তৈরি হচ্ছে। পরীক্ষার্থীরা এখন আর শুধু জ্ঞান আহরণ করে না, তারা পরীক্ষার হল থেকেই দেশের রাজনৈতিক গতিপথের পূর্বাভাস পাচ্ছে: এর চেয়ে বড় শিক্ষা আর কী হতে পারে?
©somewhere in net ltd.
১|
১১ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৩:০৮
জেনারেশন একাত্তর বলেছেন:
BC-ASS