![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সুন্দর ও মননশীল জীবনের প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে চাই।
ভূ-রাজনীতি বর্তমান সময়ের একটি বিশ্বব্যাপী আলোচিত বিষয়। যদিও ভূ-রাজনীতি সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা শুরু হয় অনেক আগে থেকেই, কিন্তু এর ব্যাপক প্রচার বা প্রসার হয় উনবিংশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রীয় নীতি, দেশীয় বা আর্ন্তজাতিক রাজনীতি ও রাষ্ট্রসমূহের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে। প্রাচীন কালের ভূ-রাজনীতি এবং বর্তমান কালের ভূ-রাজনীতিতে রয়েছে ব্যাপক তফাৎ। সেকালে ভূ-রাজনীতি বলতে বুঝাত নিজের শক্তি সামর্থ দিয়ে অন্যের ভূমি বা দেশ দখল করা । কারণ, ভূ-রাজনীতি হচ্ছে একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। জনগণের জীবনধারণ, সম্পদ আহরণ এবং শক্তি অর্জনের জন্য ভূমির নিশ্চয়তা বিধান করা ছিল সেকালের ভূ-রাজনীতির মৌলিক উদ্দেশ্য। তৎকালেকালে রাষ্ট্রকে একটি জৈবিক সত্তা বলে অভিহিত করা হয়। যার অবশ্যই ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি প্রয়োজন, না হয় পতন অনিবার্য বলে মনে করা হত। তখনকার ভূ-রাজনীতির যে সকল তাত্ত্বিকরা
ভূ-রাজনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব প্রদান করেন তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হল ফ্রেডরিক রেজেল, আলফ্রেড টি. মাহান, রুডলফ কিয়েলেন, হালফোর্ড জে. ম্যাকাইন্ডার প্রমূখ।
রেজেল The Laws of the territorial Growth of the states নামে একটি লেখায় জাতিসমূহের বিকাশের বিশ্লেষণ দেন এবং তার জন্য একগুচ্ছ বিধি প্রনয়ণ করেন। তার মতে রাষ্ট্র বৃদ্ধির জন্য এসব বিধি মেনে চলা আবশ্যক। তার মতে, রাষ্ট্রের ক্রমবৃদ্ধির সাথে ভৌগোলিক বিন্যাসও জরিত। তিনি আরো বলেন যে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কৌশল হচ্ছে ভূমি দখলের প্রতিযোগিতা এবং একটি রাষ্ট্রের ক্রমবৃদ্ধি তখনি বন্ধ হবে, যখন তা প্রাকৃতিক সীমায় পৌছাবে। বাস্তবিক পক্ষে, তার মতে, এ ক্ষুদ্র গ্রহে শুধু একটি বড় রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি রয়েছে।
অন্যদিকে সুইডিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুডলফ কিয়েলেন রেজেলের মতকে পূর্ণ সমর্থন করেন এবং তার সাথে যোগ করে বলেন “ রাষ্ট্র শুধু একটি জৈবিক সত্তাই নয় বরং এটি একটি সচেতন সত্তাও। তিনি বলেন, ভূমি বিস্তারের জন্য সহজ জৈবিক নীতিমালার পরিবর্তে আধুনিক কলাকৌশল অবলম্বন করতে হবে। তিনি ভবিষ্যতবানী করেন যে জার্মানী হবে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়ার শক্তিধর রাষ্ট্র।
আলফ্রেড টি. মাহান নামক আমেরিকান নৌ-ইতিহাসবিদ অবশ্য ভূমি থেকে সমুদ্র শক্তি বা সমুদ্র নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দিয়েছেন। তার মতে, ভূমি দখল নয়, সমুদ্রের উপর যার যত বেশি নিয়ন্ত্রণ থাকবে সে তত বেশি শক্তিশালী হবে। তার এ তত্ত্বের বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে বৃটেন, যে জাতি সমুদ্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে একদিন পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছিল। তার মতে, ভূমি থেকে বেশি ক্ষমতাধর হল নৌবাহিনী। যদি একটি রাষ্ট্রের নৌবাহিনী শক্তিশালী হয় তবে তার সমুদ্রের উপর বেশি নিয়ন্ত্রণ থাকবে এটা সাভাবিক।
বৃটেনের প্রখ্যাত পন্ডিত হালফোর্ড জে. ম্যাকাইন্ডার হৃদভূমি তত্ত্বের প্রবক্তা। তার মতে, হ্রদভূমির উপর যার কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে সে-ই বেশি শক্তিশালী হবে। তিনি হৃদভূমি বলতে বুঝিয়েছেন পূর্ব ইউরোপের বিরাট বিস্তৃত এলাকা ও মধ্য এশিয়ার পর্বত বলয়ের উত্তর পার্শ্বে সমগ্র এশিয়া জুড়ে বিস্তৃর্ণ এলাকা। তিনি বলেন যে, নৌবাহিনীর সে ক্ষমতা নেই যে সমুদ্র থেকে হৃদভূমিতে আঘাত হানবে। উপরোক্ত ভূগোলবিদ ও পন্ডিতরা যে সকল তত্ত্ব দেন তা প্রাচীন ( Classical)
ভূ-রাজনীতির সাথে আঙ্গাআঙ্গিকভাবে জরিত। এসকল তত্ত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে হিটলার, মুসোলীনির মত রাজ্যবিলাসীরা অন্যদের ভূমি দখলের প্রয়াস পান। ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পর আমরা দেখি নৎসিরা পরাজিত হয় কিন্তু তারা ভূ-রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেছিল। তারপরেও সিদ্ধান্ত প্রনেতাদেরকে ভূ-রাজনীতির এ ধরনাগুলো প্রভাবিত করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আধুনিক ভূ-রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশবাদ বিলুপ্ত হলে বিশ্বরাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন দেখা যায়। বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন হৃদভূমির উপর কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং সাম্যবাদ এর ব্যাপক প্রসার করে। যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে আসে পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো এবং পুজিবাদের ব্যাপক প্রসার হয় এবং NATO নামক একটি সামরিক জোট গঠন করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। অপরদিকে টিকে থাকার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নও WARSAW PACT নামক সামরিক জোট গঠন করে। উভয় জোটের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ভেবেছিল যে তাদের নিরাপত্তা দরকার। দ্বিতীয় যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র পুরো পৃথিবীর উপর কতৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ঠান্ডা লড়াইয়ের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর উপর একক কতৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু, বর্তমানে চীন, জাপান, জার্মান, ইরান, ভারতসহ অন্যান্য কিছু রাষ্ট্র অবশ্য আধিপত্ত বিস্তার করার চেষ্ঠা করছে যার যার অঞ্চলে।
কিন্তু একালের ভূ-রাজনীতি আরো আধুনিক। বর্তমান কালের ভূ-রাজনীতি প্রাচীন (Classical) সকল ভূ-রাজনৈতিক ধারনা ত্যাগ করে নতুন নীতিমালা তৈরি করেছে। বর্তমানের ভূ-রাজনীতিকে খুবই সুক্ষভাবে (Critically) আলোচনা করা হয়। কারণ এখন আর কোন রাষ্ট্র-ই চায়না যে যুদ্ধ বিগ্রহ করে দেশের জনসম্পদ ও অর্থ নষ্ট করে অন্য দেশ দখল করতে। বর্তমানে এক দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে অন্যদেশ প্রভাব বিস্তার করছে। যেমন, ভারত বাংলাদেশের রাজনীতি প্রভাব বিস্তার করছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বচানের পর থেকে এ প্রভাব প্রবল এবং আমেরিকা ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়াসহ অনেক রাষ্ট্রে সামরিক হস্তক্ষেপ করছে।
বাংলাদেশ মধ্যপ্রচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখতে চায়। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য হল বাংলাদেশের শ্রমবাজার ও যুক্তরাষ্ট্র হল তৈরি পোষাকশিল্পের বড় বাজার। এটিও ভূ-রাজনীতির অংশ। বর্তমান কালের ভূ-রাজনীতিকে বলা হয় লোকপ্রিয়(popular) ভূ-রাজনীতি। কারণ এর মাধ্যমে একটি দেশ অন্য একটি দেশের জনগণের মনোজগতে প্রবেশ করতে পারে। এর উদ্দেশ্য হল মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি নিজেদের সংস্কৃতি প্রচার করা। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর কথা, যার মাধ্যমে ভারত প্রচুর আয় করছে এবং ভারতীয় সংস্কৃতিকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে এমনকি সারা পৃথিবীতে প্রচার করছে।
বর্তমানে বা আগেও সকল ভূমির রাজনৈতিক গুরুত্ব সমান নয়। কারণ, বর্তমান রাজনীতিতে ভারত, চীন, জাপানের যে গুরুত্ব আছে তেমন গুরুত্ব নেপাল বা ভূটানের নেই। আবার দক্ষিণ চীন সাগর তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ভারত সাগর ভারতের এবং বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে অভিবাসী বা শরনার্থীদের জন্যও ভূ-রাজনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান কালের ভূ-রাজনীতি সাথে জরিয়ে আছে একটি দেশের সামাজিক রীতি-নীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও তথ্য-প্রযুক্তিসহ অনেক কিছু । যার দরুন একটি দেশ অন্য একটি দেশকে খুব সহজে প্রভাবিত করতে এবং প্রভাবিত হতে পারে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : লেখাটি একই সাথে nobinkontho.wordpress.com এ প্রকাশিত।
©somewhere in net ltd.