![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বেশুমার লানত
কুফা ও সিরিয়ার উদ্দেশ্যে নবী বংশের বন্দীদের যাত্রা
উমর ইবনে সা’দ ইমাম হোসাইন (আ.) এর পবিত্র মাথা খওলা ইবনে ইয়াযীদ আসহাবী এবং হামীদ ইবনে মুসলিম আযদীর মাধ্যমে আশুরার দিন বিকেল বেলা ইবনে যিয়াদের কাছে প্রেরণ করে। এরপর উমর ইবনে সা’দের আদেশে ইমাম হোসাইন (আ.) এর সঙ্গী-সাথী ও বনী হাশিমের নিহত যুবকদের লাশের মাথা কেটে শিমার ইবনে জুল জওশন, কায়স ইবনে আশ্আস্ এবং আমর বিন হাজ্জাজের কাছে কুফায় পাঠানো হয়। ঐ সব কর্তিত মাথা ইবনে যিয়াদের কাছে আনা হয়। উমর ইবনে সা’দ আশুরার দিন এবং পরের দিন (১১ মুহররম) দুপুর পর্যন্ত কারবালায় থেকে গেল। তারপর সে ইমাম পরিবারের বন্দী সদস্যদের নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হল। ইমাম পরিবারের মহিলাদেরকে শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় খোলা মাথায় এবং হাওদা বিহীন উঠের উপর বসান হয়েছিল। অথচ এ সব পূণ্যবতী মহিলা ছিলেন মহান নবীর পবিত্র আমানত। আর তাদেরকেই তুর্কী ও রোমের যুদ্ধবন্দীদের মত সবচেয়ে কঠিন দুরবস্থা, শোক ও বেদনার মধ্য দিয়ে বন্দীত্বের শিকল পড়ানো হয়েছিল।
কবি এ হৃদয়বিদারক দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনঃ
হাশেমী বংশোদ্ভূত নবীর (সা.) উপর তারা (নবী বংশের হত্যাকারীরা) দরুদ ও সালাম পাঠ করে। আর তারাই তার (সা.) বংশধরদের সাথে যুদ্ধ করে। সত্যিই এটা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।
যারা হোসাইনকে (আ.) শহীদ করেছে তারা কি করে কিয়ামত দিবসে তার মাতামহের (সা.) শাফায়াতের প্রত্যাশা করে ?
বর্ণিত আছে যে, ইমাম হোসাইন (আ.)এর সঙ্গী-সাথীদের কর্তিত মাথার সংখ্যা ছিল ৭৮। আর যে সব গোত্র কারবালায় ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল তারা ইবনে যিয়াদ ও ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন করার জন্য ঐসব কর্তিত মাথা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। কায়স ইবনে আশআসের নেতৃত্বে কিন্দা গোত্র ১৩ টি মাথা, শিমার ইবনে জুল জওশনের নেতৃত্বে হাওয়াযিন গোত্র ১২টি মাথা, বনী তামীম গোত্র ১৭ টি মাথা, বনী আসাদ গোত্র ১৬টি মাথা, বনী মুযহাজ গোত্র ৭ টি মাথা এবং আরো অন্যান্য গোত্র ১৩ টি মাথা কুফায় নিয়ে আসে।
শহীদদের দাফন এবং কুফায় বন্দী আগমন
রাবী থেকে বর্ণিতঃ উমর ইবনে সাদ কারবালা থেকে বেরিয়ে গেলেই বনী আসাদ গোত্রের একদল ব্যক্তি কারবালায় এসে শহীদদের জানাযার নামায পড়ে এবং যে স্থানগুলো এখন শহীদদের কবর হিসেবে প্রসিদ্ধ সেখানেই তারা শহীদদের লাশগুলো দাফন করে। ইবনে সা’দ বন্দী নবী পরিবারের সাথে আগমন করে। আর তারা কুফার নিকটবর্তী হওয়া মাত্রই কুফাবাসীরা তাদেরকে দেখার জন্য সেখানে সমবেত হয়। কুফা নগরীর এক মহিলা ছাদ থেকে উচ্চঃস্বরে জিজ্ঞেস করলঃ তোমরা কোন দেশের বন্দী রমণী? নবী পরিবারের বন্দী রমণীগণ তাকে বললেনঃ আমরা নবী পরিবারের বন্দী রমণী। ঐ মহিলা ছাদ থেকে নেমে এসে ঘর থেকে পোশাক পরিচ্ছদ, মাথার চাদর ওড়না এনে তাদেরকে দিল । অসুস্থ, কৃশকায় এবং শোকাভিভূত আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) এবং ইমাম হাসান (আ.)এর পুত্র দ্বিতীয় হাসান যিনি পিতৃব্য ইমাম হোসাইন (আ.) কে সাহায্যার্থে কারবালার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আহত হয়েছিলেন তিনিও যুদ্ধ বন্দীদের মাঝে ছিলেন। মাসাবিহ গ্রন্থের লেখক বর্ণনা করেছেনঃ ইমাম হাসান (আ.) এর পুত্র দ্বিতীয় হাসান শত্রুপক্ষের ১৭ জনকে হত্যা করেন এবং তার দেহ আঠারো বার জখম হলে তিনি অশ্ব পৃষ্ঠ থেকে পড়ে যান। তার মামা আসমা বিন খারেজাহ তাকে মাটি থেকে তুলে কুফায় নিয়ে চিকিৎসা করেন। সুস্থ হয়ে গেলে দ্বিতীয় হাসান মদীনায় ফিরে আসেন। যায়দ এবং আমরের বন্দীদের মধ্যে ইমাম হাসান মুজতাবার সন্তানগণও ছিলেন। এরপর কুফাবাসীরা কান্না কাটির উদ্যোগ নিলে ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন।
“তোমরা আমাদের জন্য কাদতে চাও ? তাহলে কে আমাদেরকে হত্যা করেছে ”
হযরত যয়নাবের (আ.) ভাষণ
বশীর বিন হাযীম আল-আসাদী থেকে বর্ণিত খোদার শপথ, আমি আমীরুল মুমেনীন হযরত আলীর (আ.) কন্যা হযরত যয়নাবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বক্তা রমণীকে আর দেখিনি। যেন তার কন্ঠ দিয়ে হযরত আলী (আ.) এর বাণীগুলো নিঃসৃত হচ্ছিল।
তিনি উপস্থিত জনতাকে নীরবতা অবলম্বন করতে বললে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যেন স্তিমিত হয়ে গেল। এমন কি উটের ঘন্টাধ্বনিও আর শোনা গেল না। এরপর হযরত যয়নাব (আ.) নিম্নোক্ত ভাষণ দিলেন,
মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তার পবিত্র বংশধরদের উপর দরুদ ও সালাম পাঠ করার পর তিনি বললেন, “হে কুফাবাসীরা হে প্রতারক ও চক্রান্তকারীরা, তোমরা কি এখন আমাদের জন্য কাদছ ? এখনো আমাদের নয়ন অশ্রু দ্বারা সিক্ত, এখনো আমাদের কান্না থামেনি। তোমরা ঐ রমণীর ন্যায় যে সূতা দিয়ে সুন্দর করে কাপড় বোনার পর আবার সেই কাপড় থেকে সূতাগুলো আলাদা করে ফেলে। তোমরা তোমাদের ঈমানের রজ্জুকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলেছ। আত্মপ্রশংসা, বিশৃংখলা এবং দাসীদের মত হিংসা দ্বেষ, চাটুকারিতা এবং উপেক্ষা করার মত দোষ ছাড়া আর কোন ভাল গুনই তোমাদের নেই। তেমার পচা আবর্জনার ভেতরে জন্মানো উদ্ভিদের ন্যায়, যা খাওয়ার অযোগ্য।
আর তোমারা সৌন্দর্য বিবর্জিত ও অব্যাবহার্য রূপার মত। তোমরা পরকালের জন্য কত মন্দ পাথেয়ই না সংগ্রহ করেছ যার ফলে তোমরা খোদার রোষানলে আপতিত হয়েছ এবং তোমাদের জন্য চিরস্থায়ী ব্যবস্থ্ করা হয়েছে। আমাদেরকে হত্যা করার পর কি তোমরা আমাদের জন্য অশ্রু বিসর্জন করছো এবং নিজেদেরকে ধিক্কার দিচ্ছো ? খোদার শপথ তোমরা বেশী বেশী কাদবে এবং কম হাসবে। নিশ্চয় তোমরাইতো নিজেদেরকে কালের কলংকে কলংকিত ও কলুষিত করেছ যা থেকে তোমরা কখনো পরিত্রাণ পাবেনা। বেহেশতের যুবকদের নেতা নবী দৌহিত্র যিনি ছিলেন যুদ্ধ ও সংকটজনক পরিস্থিতিতে তোমাদের আশ্রয়স্থল, যিনি ছিলেন শত্রুদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে তোমাদের নেতা যার কাছে তোমরা ধর্ম ও শরীয়তের বিধি বিধানের শিক্ষা নিতে, তাকে হত্যা করার মত জঘন্য অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে সম্ভব ? জেনে রেখো যে, তোমরা কত বড় পাপের বোঝা বহন করছ। খোদা তোমাদেরকে তার দয়া ও করুনা থেকে বঞ্চিত করুক । তোমাদের ধ্বংস হোক। নিঃসন্দেহে তোমাদের শ্রম বিফল হয়েছে এবং তোমাদের হাত পাপ দ্বারা কলুষিত হয়ে গেছে। আর তোমাদের পাপের ব্যবসা তোমাদের জন্য ক্ষতিই ডেকে এনেছে। নিশ্চয়ই তোমরা খোদার রোষানলের দিকেই প্রত্যাবর্তন করেছ। অপমান লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা তোমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। হে কুফাবাসীরা! তোমাদের জন্য আক্ষেপ। তোমরা জান কি যে, তোমারা মহানবীর (সা.) কত বড় কলিজার টুকরা ছিন্ন ভিন্ন করেছ। তোমারা জান কি যে, তোমারা তার নিস্পাপ পর্দাবৃতা কন্যা ও রমণীদের পর্দা ছিনিয়ে নিয়ে তাদেরকে বেআব্রু করেছ ! ! তেমারা জান কি, মহানবীর (সা.) কত বড় রক্ত তোমরা ঝরিয়েছ এবং তার কত বড় বেইজ্জতি তোমরা করেছ। তোমরা জান কি যে, কত বড় জঘন্য অন্যায় করেছ এবং আকাশ ও পৃথিবীর সমান অত্যাচার ও জুলুম করেছ। নিঃসন্দেহে পরকালের শাস্তি সবচেয়ে কঠিন ও অপমানজনক আর কিয়ামত দিবসে তেমাদের কোন সাহায্যকারীই থাকবে না। মহান আল্লাহ প্রদত্ত সুযোগ যেন তোমাদের কোন কাজে না আসে এবং তোমাদের পাপের বোঝাও যেন না কমে । কারণ তিনি (মহান আল্লাহ) তাড়াহুড়া করে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন না এবং শহীদের রক্ত বৃথা যাওয়ার কোন আশংকা নেই। তোমাদের প্রতিপালক অবশ্যই তোমাদের ধরার অপেক্ষায় আছেন।
বর্ণনাকারী বলেনঃ খোদার শপথ এ বক্তৃতাটি শোনার পর জনগণ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে কাদতে লাগল এবং নিজেদের আঙ্গুলগুলো দাত দিয়ে দংশন করতে লাগল । যে বৃদ্ধ লোকটি আমার পাশে দাড়িয়ে ছিল এবং যার দাড়ি চোখের জলে ভিজে গিয়েছিল সে বলতে লাগল, আমার পিতা মাতা আপনাদের চরণতলে উৎসর্গ হোক। আপনাদের মধ্যে যারা বৃদ্ধ তারা বৃদ্ধদের মধ্যে সর্বোত্তম, আপনাদের যুবকরাই সর্বোত্তম যুবক এবং আপনাদের রমণীরাই সর্বশ্রেষ্ঠ নারী এবং আপনাদের বংশই সর্বশ্রেষ্ঠ বংশ যারা কস্মিনকালেও লাঞ্ছিত ও পর্যদস্ত হবে না
©somewhere in net ltd.