![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সরাসরি পত্রিকা হতে পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন: https://bangla.bdnews24.com/arts/a8c84d0b6a36
মাধব চৌধুরী এ শহরে নামকরা উকিল। তবে, জটিল মামলা মোকদ্দমার ফায়সালা করে তিনি যে যশখ্যাতি কুড়িয়েছেন তা কিন্তু নয়। তার মামলাগুলো সহজ, সাদামাটা। পুলিশের হাতে ধরা পড়া পকেটমার, ছিঁচকে চোর বা ছিনতাইকারীদের জামিনে আইনি সহযোগিতা দেয়াই তাঁর কাজ। সচরাচর নামি-দামি উকিলরা এসব বিতর্কিত খদ্দের নিতে চান না। ইংরেজিতে একে বলে নীশ (niche) এরিয়া, বা বিশেষায়িত ক্ষেত্র, যেখানে প্রতিযোগিতা অপেক্ষাকৃত কম। এ সুযোগটাই চতুর মাধব কাজে লাগিয়েছেন।
শহরে দিনরাতে চুরি-ছিনতাই তো আর কম হয়না। উত্তম মধ্যম দিয়ে জনতা চোরদের শেষ অব্দি পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ওদিকে, পুলিশের উপরও থাকে উপরিমহলের চাপ। শহরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি প্রমাণে পুলিশ অনেক মামলাই রেকর্ড করে না। এ অবস্থায়, পুলিশ সচরাচর জনসম্মুখে গালিগালাজ আর দুচার ঘা লাগিয়ে দিয়ে মানুষের চোখের আড়াল হতেই নগদ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে অপরাধীদের ছেড়ে দেয়। অর্থযোগের সুযোগ পাওয়া না গেলে তবেই একপ্রকার সহায়সম্বলহীন চোরদের আদালতে চালান দেয়। অতঃপর, জেলে পুরে দেয়া এইসব চোরদের নিয়ে জামিনের ব্যবসা শুরু হয়, যার সুবিধা এক শ্রেণির অসৎ বিচারকও ভোগ করে থাকেন। নেপথ্যে থাকে চোর ডাকাতদের গডফাদাররা। এ অর্থে, চৌর্যবৃত্তি বাংলাদেশে একপ্রকার ব্যবসাও বটে।
মাধব উকিলের সাথে কিছু নীতিভ্রষ্ট বিচারকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকায় আন্ডার ওয়ার্ল্ডের এ জগতে মাধব এক পরিচিত নাম। নগদ নারায়ণ আর নানাবিধ কূটকৌশলের ব্যবহারে প্রতিদিন গন্ডায় গন্ডায় পকেটমার, বা চোর-ছিনতাইকারীর জামিন হয় তাঁর হাত দিয়ে। দীর্ঘকাল সেপথে হেঁটেই তিনি আজ লাখ লাখ টাকার মালিক, আদালত পাড়ার সফল আইনজীবী।
মাধব বাবুর বড়ভাই যাদব চন্দ্র থাকেন কানাডার আলবার্টা প্রদেশে। কানাডার অভিবাসন পদ্ধতি আমেরিকার মতো উদার নয়। আমেরিকায় যেভাবে পরিবারের কেউ একজন অভিবাসন পেলে ধীরে ধীরে তার চৌদ্দগুষ্ঠি সেদেশে ঢুকে যেতে পারে, কানাডায় ব্যাপারটা তেমন নয়। অন্যের হাত ধরে কানাডায় ঢুকতে পারে কেবল স্বামী-স্ত্রী, বা বড়োজোর মা-বাবা। কিন্তু, বছর দশেক আগে কর্মীর হাত কমে যাওয়ায় কানাডার আলবার্টা প্রদেশ সেখানে এক বছরের বেশি সময় ধরে যারা বসবাস করেছেন তাদের ভাইবোনদের কানাডায় নিয়ে আসার এক সুযোগ দিয়েছিল। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে যাদব আবেদন করেছিলেন তার সহোদর মাধব ও তাঁর পরিবারের জন্য। সেসূত্রেই মাধব পরিবার নিয়ে আজ প্রায় এক দশক ধরে কানাডায়।
'যার নাই কোন গতি, সে পড়ে ওকালতি।' - এটা বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ। ছাত্র হিসেবে মাধবও খুব উঁচুদরের ছিলেননা কখনো। সে আমলে দুই বা তিন বছরের একটা বিএ ডিগ্রি লাভ করে টেনেটুনে এলএলবি পাশ। ওদিকে, কানাডায় লইয়ার বা উকিল হতে ভালো ছাত্র হতে হয়। ইংরেজি ভাষাতেও থাকতে হয় দক্ষতা। এছাড়া বিদেশ থেকে ওকালতি পড়ে আসাদের সরাসরি ওকালতি করার সুযোগও দেয়া হয়না কানাডায়। বৈরী পরিবেশে কানাডায় ওকালতি পেশা বাদ দিয়ে ভিন্ন কিছু করার চিন্তা তাঁকে তাড়া করে। সঙ্গতকারণেই, বিকল্প উপায়ে অর্থ উপার্জনের নানা ধান্ধা মাধব বাবুর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
এক পরিচিতের সহযোগিতায় টরোন্টোর কোন এক সবজির দোকানে ক্যাশিয়ারের পার্টটাইম কাজ জুটলো তাঁর। প্রতিদিন চার ঘন্টার শিফট। তার স্ত্রী মিনতিও কাজ নিলেন কাছাকাছি এক বাঙালি রেস্টুরেন্টে। বছরখানেক এভাবে চলার পর একসময় সবজির দোকানের কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন মাধব।
ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে এভাবে ক্যাশিয়ারের কাজ তিনি আগে কখনো করেননি। দেশে থাকতে তাঁর কাজ ছিল বৈচিত্রময়। তার নিজ কর্মক্ষেত্রে তিনি ছিলেন রীতিমতো সেলিব্রেটি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত, ভালোমন্দ, বিচিত্রসব মানুষের সাথে। রাতদিন ব্যস্ততা ছিল তার। সেসব সোনালী দিন দারুণভাবে মিস করেন উকিল মাধব। তাছাড়া, তাঁর কাজটাও ছিল খুব ক্রিয়েটিভ বা সৃজনশীল ধাঁচের। একই গল্প তো আর সব পকেটমার বা চোরের ক্ষেত্রে খাটে না! তাই, খদ্দেরদের জামিন নিশ্চিত করতে তাকে প্রতিদিনই নতুন নতুনসব গল্প বানাতে হতো। তাছাড়া, বাংলাদেশের কোর্ট-কাচারীতে কি কেবল কথায় চিড়া ভিজে? গল্পের সাথে নগদ নারায়ণযোগেই তিনি সফল হতেন খদ্দেরদের জামিন করিয়ে নিতে। একই পকেটমারের জামিন মাধব উকিলের হাত দিয়ে সাতাশবার পর্যন্ত হয়েছে; এ কাজে এতটাই দক্ষ ছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে পেশাগত জীবনে মাধব বাবুর আত্মতৃপ্তি ছিল ঈর্ষণীয় রকমের।
সাফল্যের শীর্ষে থাকা এমন লোভনীয় ওকালতি পেশ ছেড়ে কানাডায় সর্বনিম্ন বেতনে (মিনিমাম ওয়েজ) স্বামী-স্ত্রী দুজনে গাধার খাটুনি খাটছেন। তারপরও টরোন্টোর মতো ব্যয়বহুল শহরে মাত্র এক বেডরুমের বাসা ভাড়া, খাবারদাবার এবং অন্যবিধ খরচ মেটাতে গলদঘর্ম হচ্ছে তাদের। তাই, কিছুদিন ধরেই দেশের ওকালতি ব্যবসায় ফিরে যাবার চিন্তা মাধব বাবুর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। ওদিকে বয়সে তরুণ মিনতিকে কানাডায় একা রেখে যেতেও মন চাইছিলো না তার। কেননা, কানাডায় মেয়েদের স্বাধীনতা সীমাহীন। ফলে, সংসার করতে মন না চাইলে মেয়েরা স্বামী ছেড়ে ভিন্ন পথে হাঁটে দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে।
ছাত্রজীবনে সোনালী নামের এক সহপাঠিনীর সাথে মাধবের গভীর সম্পর্ক ছিল। তবে, দীর্ঘ প্রেমের পরও তাদের বিয়েটা হয়নি। 'মাধব চোর-বাটপারের উকিল।' - মাধবের আয়-রোজগার ভালো হলেও সোনালীর পরিবার এ অপবাদটুকু মেনে নিতে পারছিলো না। পুরোনো প্রেমের সম্পর্ক ভুলে নতুন বিবাহের জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতেই চল্লিশ পেরিয়ে গেছে মাধবের বয়স। কেবল বছর সাতেক আগে গরিব ঘরের মেয়ে চব্বিশ বছরের মিনতির সাথে সাত পাকে বাঁধা পড়েছেন। পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলেও মিনতি রূপে গুনে অসাধারণ। তার মুখমন্ডল যেন জ্যোৎস্নার নরম আলোয় ভরা। আওয়ার গ্লাস ফিগার, ঘন-কালো-কোমল চুলে ঢাকা তার পৃষ্ঠদেশ। প্রাকৃতিক, আড়ম্বরহীন, অথচ নজরে লাগার মতো সুন্দরী সে।
নিজের দেহসৌষ্ঠব সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও মাধবের মতো মধ্যবয়সী স্বামীকে মিনতি এতটুকু অবজ্ঞা বা অবহেলা করেনি কোনোদিনও। তারপরও মাধবের সন্দেহ কাটে না। ইউটিউব বা পত্রপত্রিকায় যে হারে প্রবাসী স্বামীর স্ত্রীদের উচ্ছন্নে যাওয়া চোখে পড়ে তা দেখে অন্য অনেকের মতো মাধব বাবুও সদাসর্বদা চিন্তিত থাকেন এ ভেবে, তরুণী মিনতিকে কানাডায় রেখে তিনি একা দেশে গেলে সে আবার বিপথগামী হয় কিনা। মানুষের মন বলে কথা; তাও আবার উদ্ভিন্ন যৌবনা তরুণীর মন!
অবশেষে এক সন্ধ্যায় মাধব স্ত্রী মিনতিকে তার বাংলাদেশে ওকালতি ব্যবসা চালিয়ে যাবার পরিকল্পনা বলে ফেললেন। তাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, বাঙালি কম্যুনিটির দোকানে ক্যাশিয়ারের কাজ বা রেস্টুরেন্টের রান্নাবান্নার কাজ দশকের পর দশক করে গেলেও কানাডায় তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। তার চেয়ে বরং, দেশে ফিরে ওকালতি ব্যবসায় আবারো নামা দরকার।
আয় রোজগার বাড়াতে মাধব বাবুর মাথায় ভিন্ন এক চিন্তাও আছে। কানাডা-বাংলাদেশে ঘনঘন যাতায়াত ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। তাই, যাতায়াতের সুযোগ কাজে লাগিয়ে হুন্ডি ব্যবসা করেও কিছু বাড়তি আয়ের পরিকল্পনা তিনি মাথায় রাখলেন, যদিও মিনতিকে বিষয়টা জানালেন না। কানাডায় চাকুরী করে মিনতিও সেদেশের বাস্তবতা বুঝেছেন। তাই, স্বামীর বাংলাদেশে ওকালতি চালিয়ে যাবার পরিকল্পনায় বাধা দিলেন না। - -
আজকাল মাধব বছরে দুইবার বাংলাদেশ-কানাডা যাতায়াত করেন। একবার কানাডা এলে মাস দেড়-দুয়েক স্ত্রীর সাথে কাটিয়ে যান। কানাডা অবস্থানের সময়টায় যখন যে কাজ পান তা করে কিছু আয়ের চেষ্টাও করেন। বেকার বসে থাকার লোক মাধব চৌধুরী না। তার আবার কাজের ফাঁকে কবিতা পড়া এবং লেখালেখির অভ্যেসও আছে। নিজ খরচে ছোট্ট একটি কবিতার বই-ও প্রকাশ করেছেন কানাডা আসার আগে আগে।
একদিন টরোন্টোর উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন মাধব বাবু। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ডেপার্চার লাউঞ্জে বসে আছেন। হাতে নিজের লেখা সেই কবিতার বই: 'আলো-ছায়া।' রিডিং গ্লাসের আড়ালে থাকা চোখজোড়া দিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে বইয়ের কবিতাগুলো পড়ছেন তিনি, পড়ছেন লেখকের কথা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন বইয়ের প্রচ্ছদ। পাশের আসনে বসে থাকা মানিক সাহেব আঁড়চোখে বিষয়টা খেয়াল করলেন।
কবিতা পাঠে এতটা মনোযোগী মানুষ মানিক এর আগে দেখেননি। তিনি তার এক কবি বন্ধুর মুখে শুনেছেন, আজকাল বইমেলায় কবিতার বইয়ের নাকি চাহিদা কম। সাম্প্রতিক এক বইমেলায় রবিঠাকুরের মতো লম্বা দাড়ির এক শীর্ষ কবির কবিতার বই বিক্রি হয়েছিল নাকি মাত্র তিনখানা। বাস্তবতা বিবেচনায় মানিকের ওই বন্ধুটি কখনো কবিতার বই প্রকাশের উদ্যোগ নেয়নি। কবিতার বইয়ের এমনই দৈন্যদশায় কোন এক স্বদেশী পরম আগ্রহে বিড়বিড় করে কবিতা পড়ছেন দেখে তার সাথে আলাপের আগ্রহ মানিক আর চেপে রাখতে পারলেন না।
খানিক ইতস্তত করে মানিক জিজ্ঞেস করলেন, ভাই কি কবিতা খুব ভালোবাসেন?
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মাধব উত্তর দিলেন, জী, তাছাড়া নিজের লেখা কবিতা হলে তো কথাই নেই।
- তবে কি বইটা আপনার নিজের?
- ঠিক ধরেছেন, আমারই লেখা এ বই।
তারপর দুজন পরস্পরের নাম জেনে নিয়ে একে অন্যের সাথে পরিচিত হলেন।
- এর আগে বই প্রকাশ পেয়েছে এমন কোন কবি-সাহিত্যিকের সাথে আমার সরাসরি কথা হয়নি। আপনার সাথে আলাপের সুযোগ পেয়ে পুলকিতবোধ করছি, সহাস্যে মানিক মন্তব্য করেন।
- কি যে বলেন ভাই, এ আর তেমন কি? ... সবিনয় জবাব দেন কবি মাধব।
গল্প-আড্ডায় মাধব বাবু আর মানিক সাহেব একসময় টরন্টো পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছান। ঘটনাচক্রে তারা দুজনই বৃহত্তর টরোন্টোর দুই কাছাকাছি শহরে থাকেন। মাধব থাকেন এজাক্স শহরে, আর মানিক থাকেন পিকারিংয়ে। মাত্র কয়েক মিনিটের ড্রাইভিং দূরত্বে তাদের বসবাস।
কানাডায় প্রায় প্রতি পরিবারেই এক বা একাধিক গাড়ি থাকলেও মাধব বাবুরা এখনো গাড়ি কেনেন নি। তাঁরা শহর এলাকায় বাস বা ট্রেনে চড়েই যাতায়াত করেন। মাধবের ব্যক্তিগত গাড়ি না থাকার বিষয়টা মানিক জানতেই তিনি তাকে এয়ারপোর্ট হতে তার বাসায় পৌঁছে দেবার প্রস্তাব দিলেন। মাধবও তাতে অমত করলেন না।
টরন্টো এয়ারপোর্টে নেমে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মানিক তার লাগেজ/ব্যাগ বুঝে পেলেন। কিন্তু, মাধব বাবুর ব্যাগটা অনেক অপেক্ষার পরও পাওয়া গেলনা। এ নিয়ে মানিক সাহেব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অথচ, মাধব বাবুর চেহারায় তা নিয়ে চিন্তার লেশমাত্র নেই। এভাবেই চলে গেলো ঘন্টাখানেক। উৎকণ্ঠাহীন মাধবকে দেখে মানিক সাহেব মনে মনে ভাবলেন, কবি-সাহিত্যিকরা 'ভিন গ্রহের মানুষ' হয়তোবা; তারা সাধারণের মতো করে জাগতিক বিষয়গুলো ভাবেন না। মূল্যবান লাগেজ/ব্যাগ হারিয়েও মাধব বাবুর নিশ্চিন্ত, বরং একপ্রকার হাসিখুশি, ভাব দেখে তার এমন ভাবনা আরো পোক্ত হলো।
- 'মাধবদা, ব্যাগেজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তারপরও আপনি এতটা স্বাভাবিক, নির্বিকার আছেন কি করে জানতে পারি? আমার ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটলে তো খুব নার্ভাস হয়ে পড়তাম।' মানিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।
- 'ভাই, এখানে নার্ভাস হবার কি আছে? ব্যাগটা পাওয়া না গেলে আমার জন্য বরং ভালোই হবে।' মাধব কিছু না ভেবেই জবাব দেন।
- মানে! .. ঠিক ধরতে পারলাম না কি বুঝাতে চাইলেন।
- ব্যাগটা সত্যিই হারিয়ে গেলে আমি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের কাছে বিশ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ চাইবো।।
- ওই ব্যাগে কি বিশ হাজার ডলারের জিনিস ছিল? - মানিকের চোখেমুখে বিস্ময়।
- ছিল তো অবশ্যই। - আত্মবিশ্বাসের সাথে মাধব জবাব দেন।
- কি ছিল জানতে পারি?
- 'ওখানে আমার ঠাকুরদার হাত ঘড়ি ছিল যেটি অর্ধশতাব্দী আগের। ওই ঘড়িতে সেকেন্ডের কাঁটা নেই, আছে কেবল মিনিট আর ঘন্টার কাঁটা। পুরোনো দিনের ঘড়ি। স্বর্গবাসী হবার আগে আমার বাবাকে তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন ঘড়িটি, যা পরে আমি পেয়েছি। ঐতিহাসিক সেই ঘড়ির একটা ইমোশনাল ভ্যালু বা আবেগমূল্য আছে যা কম করে হলেও বিশ হাজার ডলার। সেই ক্ষতিপূরণই আমি দাবি করবো।' এক নিঃশ্বাসে মাধব উত্তর দেন।
বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। চোর-বাটপারের মামলা হতে তাদের ছাড়াতে উকিল মাধব যেভাবে নিয়মিত নতুন নতুন গল্প ফেঁদে 'সৃজনশীলতার' পরিচয় দিতেন এক্ষেত্রেও সে দক্ষতা বজায় রাখার ধান্ধায় আছেন তিনি। তেমন কোন ঘড়ির অস্তিত্ব তার জীবনে ছিলোনা কোনোদিনও।
- 'ওরা যদি আপনার দাবি না মানে?' মানিক পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।
- ব্যাটারা না মেনে যাবে কোথায়? আমি নিজে উকিল। তাছাড়া, কানাডীয়ান উকিল নিয়োগ দেব প্রয়োজনে। মামলা হবে। আইনের দেশ কানাডা। ক্ষতিপূরণ না দিয়ে ওরা যাবে কোথায়?
- শুনেছি, কানাডায় নাকি উকিল ফি অনেক বেশি?
- তা বেশি। তবে, আমার পাঁচ টাকাও দিতে হবে না?
- ওরা বিনামূল্যে আপনাকে সার্ভিস দেবে?
- বিনামূল্যে দেবে না, ওদেরও লাভ আছে। আমি যত ডলার পাবো তার তিরিশ শতাংশ উকিলকে দেব।
- মামলায় না জিতলে?
- না জিতলে উকিলকে কিছুই দিতে হবে না। চুক্তি সেভাবেই হবে।
- বাহ্, বেশ তো!
ঘন্টাখানেক পরও ব্যাগ না পাওয়ায় এয়ারপোর্টে এক লিখিত রিপোর্ট দিলেন মাধব বাবু। ফুরফুরে মেজাজে বিশ হাজার ডলার ক্লেইমের যৌক্তিকতাও লিখলেন সেখানে। কর্তৃপক্ষ তাঁর অভিযোগপত্র গ্রহণ করে তা রেকর্ডে রাখলো। তাৎক্ষণিক তাঁকে আশ্বস্থ করে বলা হলো, সাত দিনের মধ্যে ব্যাগটি পাওয়া না গেলে এয়ারলাইনসের নিয়মানুযায়ী তাকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। অতঃপর, মানিক সাহেবের গাড়িতে চড়েই একপ্রকার নিশ্চিন্তে মাধব নিজ বাসায় ফিরলেন।
মাধবের স্ত্রী মিনতি চট্টগ্রামের মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই শুঁটকি খেয়ে তার অভ্যাস। তার মা তার জন্য দুই কেজি ওজনের ছুরি শুঁটকি পাঠিয়েছেন অন্যান্য জিনিসের সাথে। ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার না করে টাটকা মাছ রোদে শুকিয়ে এ শুঁটকি বানানো হয়েছে। সুস্বাদু আর স্বাস্থ্যকর নিঃসন্দেহে। সে শুঁটকি হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরী হওয়ায় মিনতি রীতিমতো কেঁদে ফেললেন।
স্ত্রীর এ অবস্থা দেখে মাধব বাবু তাকে বুকে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। টানা দুমাস স্বামীকে কাছে না পাওয়ায় মিনতির মন এমনিতেই কাতর ছিল। মাধবের স্পর্শ পেতেই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কিছু একটা বয়ে গেলো সারা শরীরে। ক্রমশ নিস্তেজ হতে থাকে দেহমন। নিঃশ্বাসের গতি ও বাড়ে তার। মিলনের মোহ তাকে পেয়ে বসে।
আদর সোহাগ শেষে মাধব মিনতিকে বললেন, কেবল সাতটা দিন অপেক্ষা করো মিনতি। ভগবান সুপ্রসন্ন হলে তোমার শুঁটকির চেয়েও অনেক দামি কিছু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। মা লক্ষ্মীর কৃপায় বিশ হাজার ডলার-এর মালিক হবো আমরা। কেবল ব্যাগটি সত্যি সত্যি হারিয়ে গেলেই হলো।
- বলো কি? বিশ হা-জা-র ড-লা-র! ডলার না টাকা, আমি ঠিক শুনছি তো? .. নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মিনতি। তার সারা বছরের আয় মোটামুটি বিশ হাজারের মতোই। এত্তো টাকা একসাথে পাওয়া কি ছোটখাট বিষয়?
- ডলার বলছি তো ডলার, টাকা নয়। আপাততঃ এ সুখবর নিজের মধ্যে রেখো, কারো সাথে শেয়ার করোনা। আর, সকাল সন্ধ্যা ভগবানের নাম জপ করো। ভগবান চাহে তো ত্রিভুবনে সবই সম্ভব।
মিনতি সরলমনা মেয়ে। স্বামী মাধব তার কাছে দেবতাতুল্য। তার সব কথাই বিনা তর্কে বিশ্বাস করেন মিনতি। বিশহাজার ডলার পাবার আকুতিতে তার চোখ বন্ধ হয়, ঠোঁট নড়ে; 'জয় মা লক্ষ্মী, হে মা, তোমার কাছে কিছু চাইতে লজ্জা হয়, কিন্তু এবার একটু শোনো মা .. আমাদের ব্যাগটি যেন অন্তত সাতদিনের মাঝে খুঁজে পাওয়া না যায় .. এটুকুই শুধু চাই মা, আর কিছু না। .. মা, তুমি বৈভবের উৎস, ধনের দেবী। তোমার কৃপা ছাড়া এ সংসারে শান্তি ও সমৃদ্ধি অসম্ভব। আমি তোমার কৃপা প্রার্থী। .. হে লক্ষ্মী মা, আমাকে দান করো মঙ্গল, ধন ও শুভ ফল। ওঁ শ্রীং মহালক্ষ্ম্যৈ নমঃ। (অর্থ: হে সম্পদ ও সমৃদ্ধির দেবী মহালক্ষ্মী, আপনাকে আমার প্রণাম।)'
সন্ধ্যা প্রদীপের আলোয় পাশের দেয়ালে মিনতির মুখের ছায়া নাচে। সে সাথে, বাতাসে সিঁদুরের গন্ধ, চন্দনের ধোঁয়া, আর, তার চোখ থেকে পড়া ক’ফোঁটা জল।
মা লক্ষ্মী মিনতির আবেদন কতোটা আমলে নিয়েছেন তা আর জানা হলো না। তবে, এ ঘটনার পঞ্চম দিনের মাথায় এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করে মাধবকে দেয়া হলো তাঁর ব্যাগ খুঁজে পাবার সুসংবাদ। মূল ফ্লাইটের ওজন বেড়ে যাওয়ায় পরের কোন এক ফ্লাইটে ব্যাগটি টরন্টো এয়ারপোর্টে পৌঁছানো হয়েছে।
২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪২
এমএলজি বলেছেন: ধন্যবাদ। কেমন লেগেছে, খোলামনে জানান।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪
রাজীব নুর বলেছেন: লেখাটা পড়লাম।
ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।