নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\'এম এল গনি\' cut & paste করে Google-এ search করলে আমার সম্পর্কে জানা যাবে। https://www.facebook.com/moh.l.gani

এমএলজি

এমএলজি › বিস্তারিত পোস্টঃ

আতংক না ছড়িয়ে ভূমিকম্প মোকাবেলায় এখনই যা করা দরকার

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২২

দৈনিক ইত্তেফাক হতে পড়তে এই লিংক ব্যবহার করুন: https://www.ittefaq.com.bd/763605/

এক.

সোশ্যাল মিডিয়া এবং সংবাদ মাধ্যমের কল্যানে দেশবাসী ঢাকা ও তার আশপাশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ভূমিকম্প সম্পর্কে অনেককিছুই ইতোমধ্যে জেনেছেন। বিশেষজ্ঞবৃন্দও এতো ক্ষয়ক্ষতি কেন হয়েছে, কিভাবে তা এড়ানো যেত, ভবিষ্যতে কিভাবে কম্পন প্রতিরোধক স্থাপনা বা স্ট্রাকচার তৈরী করা যায়, ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা করেছেন। বিষয়টি নিয়ে মাত্রাধিক আতংকও ছড়িয়েছেন অনেকে। ওসব তথ্য ও আলোচনার বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বাংলাদেশে অবস্থানকালীন কর্মক্ষেত্রে প্রকৌশলী ও নগরপরিকল্পনার দায়িত্ব পালনের কিছু মূল্যবান অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের বাস্তবতায় নির্মোহভাবে পাঠকের সাথে শেয়ার করার প্রচেষ্টা থাকবে এ লেখায়, যাতে সংশ্লিষ্টরা ভূমিকম্প মোকাবেলায় কিছুটা হলেও দিকনির্দেশনা পেতে পারেন।

ভূমিকম্প বিষয়ক এ লেখার মর্মার্থ ও গুরুত্ব বুঝতে লেখাটির লেখক, অর্থাৎ, আমার, শিক্ষা ও পেশাগত ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা দরকার মনে করি।

আমি বাংলাদেশের বুয়েট হতে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং (কাঠামো প্রকৌশল)-এ মেজর নিয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং (সিভিল) ডিগ্রি অর্জন করি। কিছুকাল পর দেশের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি 'অথোরাইজেশন কমিটি'র একজন সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাই। যারা জানেন না তাদের জন্য একটু খোলাসা করে বলি, সরকার অনুমোদিত এই বিশেষ কমিটি ইমারত বা ভবনের নকশা অনুমোদন এবং বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন এক্ট ও রেগুলেশন মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য কর্তৃত্বপ্রাপ্ত।

দেশে চাকুরীরত অবস্থায় এক পর্যায়ে নেদারল্যান্ড সরকারের বৃত্তি নিয়ে সেদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় হতে নগর পরিকল্পনায় মাস্টার্স ডিগ্রিও অর্জন করেছিলাম। পাশাপাশি, আমি একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেও কাজ করেছি। সে সুবাদে দেশে শতাধিক ভবনের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন আমি নিজে করেছি। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)-তে দায়িত্বপালনরত একজন সম্মানিত বোর্ড সদস্যের দৃষ্টিনন্দন আবাসিক ভবনটির স্ট্রাকচারাল ডিজাইনও আমি করেছিলাম। কয়েক বছর আগে কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি-আইআরবি) হিসেবে কাজ শুরু করার আগে কানাডায়ও প্রায় দেড়দশককাল আমি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় নিবিড়ভাবে কাজ করেছি। কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিও অর্জন করেছি।সঙ্গতকারণেই, ভূমিকম্প দুর্যোগ মোকাবেলা ও ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ বিষয়ে অর্থপূর্ণ আলোচনা করার মতো প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও পেশাগত অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে।

দুই.

বাংলাদেশে চাকুরীরত অবস্থায় অথোরাইজেশন কমিটির মেম্বার থাকাকালীন আমার অর্জিত একটি দুঃখজনক অভিজ্ঞতা শেয়ার করি যা বাংলাদেশে মাঠ পর্যায়ে নগর পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ধারণা পেতে সহায়ক হবে।

আমি যে কলেজ হতে এইচএসসি পাশ করেছিলাম সে কলেজের সে সময়ের অধ্যক্ষ মহোদয় নীতির প্রশ্নে ছিলেন অবিচল। ভদ্রলোক এতটাই নীতিবান ছিলেন যে, পরীক্ষার হল পরিদর্শনের সময় তাঁর নিজের কন্যাকে পাশের সীটের অন্য এক পরীক্ষার্থীর সাথে কথা বলতে দেখে এক বছরের জন্য বহিস্কার করেছিলেন। মেয়েটি হয়তোবা ভেবেছিল, 'বাবা এসেছেন, কথা বললে আর সমস্যা কি?' এ ঘটনা কলেজের গন্ডির বাইরেও বেশ আলোচিত হয়েছিল সে সময়ে। সে আমলে ফেইসবুক বা ইউটিউব থাকলে তা হয়তো ভাইরাল হয়ে কয়েকমিলিয়ন শেয়ারও হতো।

সেই অধ্যক্ষ মহোদয় একদিন আমার অফিসে হাজির। আমি ভক্তি-শ্রদ্ধায় তাঁকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। তিনি আমাকে জানালেন, তাঁকে কেউ একজন বলেছেন আমি তাঁর কলেজেরই ছাত্র ছিলাম। একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় তিনি তাঁর পাশের প্লটের এক প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। সমস্যাটি হলো, প্রতিবেশী তাঁর (অধ্যক্ষ) ভবনের সাথে কোন প্রকার গ্যাপ বা ফাঁক না রেখেই ব্যালকনি নির্মাণ করছিলেন। মৌখিক বাধা দিয়েও কাজ হয়নি। তিনি এর প্রতিকার চান। সাথে, তিনি তাঁর নিজের ভবনের প্ল্যানের একটা কপিও এনেছিলেন, আর বলেছিলেন, তোমরা চাইলে লোক পাঠিয়ে মেপে দেখতে পারো আমি নির্মাণ কাজে কোন ভায়োলেশন করেছি কিনা।

দুদিন পর তাঁকে আরেকবার কষ্ট করে আসতে বলে তাঁকে বিদায় জানাই সেদিন। তারপর দ্রুতই অথোরাজেশন কমিটির সদস্য সচিব সাহেবের কাছে বিষয়টি খুলে বলি। তিনি আমার সামনেই ওই এলাকার বিল্ডিং ইন্সপেক্টর (ইমারত পরিদর্শক) সাহেবকে ডেকে জানতে চাইলেন পাশের প্লটের মালিক কে?

খানিক পরই জানা গেলো, ওই প্লটের মালিক তৎকালীন এক স্থানীয় এমপি সাহেবের নিকটাত্মীয়। পরিচয় পেয়ে সদস্য-সচিব মহোদয় আমাকে বললেন, 'দেখো, ওই প্লটের মালিককে ইমারত নির্মাণ আইন ভায়োলেশনের নোটিশ পাঠালে আমাকে আর এ চেয়ারে থাকতে হবে না।' কথাটা অমূলক নয়, কারণ, তাঁকে এ পদে পদায়ন পেতে বিস্তর টাকা পয়সা খরচের পাশাপাশি এই বিশেষ এমপি'র আশীর্বাদও নিতে হয়েছিল। এ পরিবেশে সদস্য-সচিব সেই নীতিবান অধ্যক্ষ মহোদয়কে নীতিগত সুবিধা বা সহায়তা দেন কিভাবে?

এই হলো, আমার দেখা মাঠ পর্যায়ে ইমারত নির্মাণ আইন প্রয়োগের বাস্তবতা। শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ওসব আইনকানুন আসলে দুর্বলের উপরই প্রয়োগযোগ্য, সবলের উপর নয়। দুই ভবনের মাঝখানে বা আশপাশে নিরাপদ গ্যাপ রাখা, বা পার্শ্ববর্তী সড়ক হতে পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রাখার নিয়মাবলী ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ থাকলেও স্বার্থান্বেষীদের লোভলালসা বা অনৈতিক প্রভাবে তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন আর হয়ে উঠে না। এ যেন 'কাজীর গরু কাগজে আছে, গোয়ালে নেই' অবস্থা। সৌভাগ্যক্রমে, অধ্যক্ষ মহোদয় দুদিন পর আমার অফিসে আর আসেননি। কয়েকদিন পর জেনেছি, তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়েছিলেন। তারও কিছুদিন পর আমারও চাকুরী ছাড়ার সুযোগ হয়ে যায়।

প্রশ্ন জাগে, দুই ভবনের মাঝে পর্যাপ্ত গ্যাপ বা ফাঁক রাখতে হয় কেন? একি কেবলই আলোবাতাসের জন্য? সাধারণভাবে, পর্যাপ্ত আলোবাতাস পেতে এ গ্যাপ থাকা জরুরি। তাছাড়া, অগ্নিকান্ড, বা ভূমিকম্পের মতো দুর্ঘটনায় উদ্ধার কাজ চালাতেও এমন স্পেস বা ফাঁক থাকা অত্যাবশ্যক। কিন্তু, প্রভাবশালীরা এসব শুনবেন কেন, তাঁদের তো দরকার প্রশস্ত শয়নকক্ষ, ড্রয়িং রুম, ব্যালকনি, ইত্যাদি? তাছাড়া, বাংলাদেশের কালচার বা সংস্কৃতি এমন যে, ক্ষমতা বা প্রভাব থাকলে তারা প্রচলিত নিয়মকানুন ভেঙে সাধারণকে জানান দিতে চান যে তারা আসলেই ক্ষমতাধর। তা কেবল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেই নয়, সমাজের অন্যসব ক্ষেত্রেও সত্য। যেমন, এই কিছুদিন আগেও আমরা ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাদের একমুখী (ওয়ানওয়ে) সড়কে জোরপূর্বক বিপরীত দিকে গাড়ি চালাতে দেখেছি। বাধা দিলে তারা পুলিশকেও পিটিয়েছে।

তিন.

একসময় ভাবা হতো, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের উৎসস্থল চট্টগ্রাম বা সিলেট অঞ্চলে। ঢাকার অদূরে নরসিংদীতে গত শুক্রবার ঘটে যাওয়া ৫.৭ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প সে ধারণা বদলে দিয়েছে। কমপক্ষে দশটি তাজা প্রাণ কেড়ে নেয়া ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর মাধবদীতে। এর প্রভাবে পুরান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে হয়েছে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি। ভূমিকম্প থেমে যায়নি, এখনো অপেক্ষাকৃত ছোট মাত্রার কম্পন বা আফটার-শক ঘটেই চলেছে। সঙ্গতকারণেই, দেশবাসীর সময় কাটছে চরম আতংক ও অস্বস্তিতে।

ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার বিষয়টি কেবল প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদদের উপর ছেড়ে না দিয়ে তাতে সাধারণ মানুষকেও অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত জরুরি। সেটি হতে পারে দুর্যোগ মোকাবেলায় মানুষকে যথাযথ জ্ঞান দিয়ে বা প্রশিক্ষিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ভূমিকম্পের সময় ভবন থেকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে হবে কোন পথ দিয়ে, এবং ভবনের বাইরে গিয়ে কোথায় নিরাপদ অবস্থান নিতে হবে, তা আগে থেকেই ব্যবহারকারীদের জানিয়ে দেয়া উচিত। সেসব বিষয়ে বছরে অন্ততঃ দুবার ড্রিল করানো যেতে পারে। যাদের চলৎশক্তি সীমিত তাদের ক্ষেত্রে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় তাও বিবেচনায় রাখতে হবে।

ভবন ব্যবহারকারীরা যথাযথভাবে নিরাপত্তামূলক নির্দেশনা পালন করছেন কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে তাদের নিজেদের উদ্যোগেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, ইমার্জেন্সি এক্জিট দ্রুত পলায়নের জন্য উন্মুক্ত না রেখে স্টোর রুম বা অন্যরূপ ব্যবহারের আওতায় নিয়ে আসা হয়। অনেকক্ষেত্রে, দারোয়ান নিজেই আগেভাগে সরে যাওয়ায় ইমার্জেন্সি এক্জিট খুলে দেবার মতো কেউ আর থাকেনা। এ শঙ্কা এড়াতে অফিস প্রধানের কক্ষে রাখতে হবে একটি বাটন যা চাপলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইমার্জেন্সি এক্জিট খুলে যাবে।

ভূমিকম্পের সময় ভবনে আগুন ধরে যাবারও প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ইমার্জেন্সি এক্জিটগুলো যেন অগ্নিপ্রতিরোধক (ফায়ারপ্রুফ) হয় তেমন ব্যবস্থাও নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে, বিশেষতঃ গার্মেন্টস সেক্টরে, সেইফটি বা নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী/পরিদর্শক থাকলেও আর্থিক বা অন্যভাবে প্রভাবিত হয়ে তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননা। ফলে, প্রায়ই দুর্যোগে কর্মীদের প্রাণহানি ঘটতে শোনা যায়। তাই, এ ধরণের ইন্সপেকশনের দায়িত্বে সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি ভবনের ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি।

চার.

বিদ্যমান পদ্ধতিতে ভবনের নক্সানুমোদন হতে শুরু করে মাঠ পর্যায়ে নক্সা বাস্তবায়নের সব দায়দায়িত্ব রাজউকের। এ দায়িত্ব দুভাগে বিভক্ত করে রাজউকের উপর চাপ কমানো যেতে পারে। যেমন, মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ভবনের নকশা বা ডিজাইন অনুমোদনের দায়িত্ব রাজউকের হাতে রেখে অনুমোদিত নক্সা অনুযায়ী স্থাপনা বা ভবন নির্মিত হচ্ছে কিনা তা দেখভালের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে সিটি কর্পোরেশনকে। কেবল একটি সরকারি দপ্তরের চেয়ে দুটি দপ্তরকে দায়িত্বগুলো বন্টন করে দিলে উভয়ের উপরেই কাজের চাপ কমে যাবে, এবং তারা যারযার লোকবল দিয়ে নিজনিজ দায়িত্ব পালন করবে।

ভবনের ব্যবহার (occupancy) শুরু করার আগে অবশ্যই সিটি কর্পোরেশনের সনদ গ্রহণ করতে হবে এ মর্মে যে, আলোচ্য ভবন রাজউক অনুমোদিত নকশা অনুসারে নির্মিত হয়েছে এবং ভবনের বিদ্যুৎ, পানি সংযোগ, ইত্যাদি মানসম্পন্ন ও ব্যবহার উপযোগী। কানাডাসহ উন্নতদেশগুলোতে এ ধরণের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সেখানে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের ইন্সপেকশন ও ক্লিয়ারেন্স ছাড়া ভবন ব্যবহার করা যায়না।

এ সনদের একটি কপি সিটি কর্পোরেশনে ইলেক্ট্রনিক্যালি সংরক্ষিত থাকবে যাতে পাসওয়ার্ড দিয়ে ব্যবহারকারী বা সংশ্লিষ্ট অফিস তা মুহূর্তেই যাচাই করে নিতে পারেন। ভবনের নকশাও ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত থাকতে হবে যাতে নকশা হারিয়ে গেছে, বা নকশা ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে, এ জাতীয় অজুহাত ভবনের মালিক বা ব্যবহারকারী দেখাতে না পারেন।

পাঁচ.

সাম্প্রতিক ভূমিকম্প বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC) পুনঃপর্যালোচনার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়। মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা আছে তেমন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ ও গবেষকবৃন্দের সমন্বয়ে শক্তিশালী কমিটি গঠন করে কোড-এর বিভিন্ন ধারা উপধারা হালনাগাদ করা অতীব জরুরি। এক্ষেত্রে, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের তথ্য-উপাত্তও ব্যবহার করা প্রয়োজন।

ছয়.

রাজউক অনুমোদিত নকশা অনুসারে ভবন তৈরী করা হচ্ছে কিনা তা তদারকির জন্য জনবল বাড়াতে হবে।

দেশে কর্মরত অবস্থায় আমি দেখেছি, কোন এলাকায় যতসংখ্যক ইমারত পরিদর্শক দরকার অনেকক্ষেত্রে তার সিকিভাগও নিয়োগ দেয়া হয়না। এছাড়া, ইমারত পরিদর্শকগনকে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে সার্ভেয়ারের দায়িত্বও দিতে দেখেছি। ইমারত পরিদর্শকদের সবাইকে যাতায়াতের জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহনও দেয়া হয়না। এ পরিবেশে অনেকে ইচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেন না। ফলে, তাঁরা অনেকসময় নির্মাণস্থল পরিদর্শন না করেই ইন্সপেকশন রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে এমনও দেখেছি, দুই-তিন তলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে এমন ভবনের ক্ষেত্রেও 'নির্মাণকাজ শুরু হয়নি', তেমন প্রত্যয়ন তারা দিয়েছেন। বলতে দ্বিধা নেই, আর্থিকভাবে প্রভাবিত হয়েও এমন ঘটনা নিয়মিতভাবেই ঘটে রাজউক, চউক, বা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে।

দুঃখজনক হলেও বলতে হয়, আমাদের দেশের বাস্তবতা এমন যে কিছুক্ষেত্রে লোকবল বাড়ানোর দরকার না থাকলেও আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কর্মচারীকে পদোন্নতি বা নতুন নিয়োগ দেই। উদাহরণস্বরূপ, প্রশাসনে উপসচিব বা যুগ্মসচিবের যতগুলো পদ খালি থাকে প্রকৃত পদোন্নতিপ্রাপ্তদের সংখ্যা তার চেয়ে ঢের বেশি, যে কারনে আজকাল ছোটখাট প্রতিষ্ঠানেও সচিব বা সিইও নিয়োগ দিতে দেখা যায়। অন্যদিকে, রাজউক, চউক, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে ইমারত পরিদর্শকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় নেহায়েতই কম। অথচ, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবেলায় নিয়ম ভেঙে ভবন নির্মাণ প্রতিরোধে মাঠ পর্যায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক ইমারত পরিদর্শক দরকার।

সাত.

সময় এসেছে ভবনের মালিক, ভবনের নকশায় যে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার স্বাক্ষর করে থাকেন তিনি এবং নির্মাণকাজ তদারকিতে যারা নিয়োজিত থাকেন তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে ভাবার।

এটা হতে পারে এভাবে, ভূমিকম্প বা ভিন্ন কোন কারণে ভবনে ফাটল দেখা দিলে, বা ভবন হেলে গেলে, নক্সায় স্বাক্ষরকারী প্রকৌশলী যথাযথভাবে ভবনটির স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করেছিলেন কিনা তা তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাল্কুলেশনের ডকুমেন্ট দিয়ে প্রমান করতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার আইনি বিধান প্রণয়ন করতে হবে। মোটা অংকের অর্থদন্ড ও গুরুতর ক্ষেত্রে জেল-এ দেবার প্রভিশন থাকতে হবে আইনে। অনুরূপ আইনি বিধানের আওতায় নিয়ে আসতে হবে ভবনের মালিক, নির্মাণকারী সংস্থা বা ঠিকাদারকেও, ভবন নির্মাণে তাদের বিধিবিধান মানার অনীহা বা অবহেলার প্রমান পাওয়া গেলে। ত্রুটিপূর্ণ স্থাপনা বা ভবন ডিজাইন বা নির্মাণের জন্য উন্নতদেশগুলোতে বহু প্রকৌশলী তাঁদের প্রকৌশলবিদ্যা চর্চার লাইসেন্স হারিয়েছেন। আমাদের দেশেও তেমন নিয়ম চালু করা প্রয়োজন।

আট.

তুলনামূলকভাবে খরচ বেশি হলেও কিছু ভবন যেমন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ, ইত্যাদি উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে তৈরী করতে হবে যাতে ভূমিকম্পের কারণে বাসাবাড়ি হতে প্রতিস্থাপিত মানুষের সাময়িক অবস্থানের ব্যবস্থা এসব ভবনে করা যায়।

নয়.

'পৃথিবীতে মানুষের অসাধ্য বলে কিছু নেই।' - এটি একটি প্রচলিত প্রবাদ। এ কথা সত্য হয়ে থাকলে ভূমিকম্প পুরোপুরি ঠেকিয়ে দেবার ক্ষমতাও মানুষের থাকা উচিত। কিন্তু, বাস্তবে তা কি সম্ভব?

না, সম্ভব নয়। এর কারন বহুবিধ। তবে, প্রধান কারণগুলোর একটি হলো, ভূস্তরের গভীর তলদেশে মাটির কোথায় কি গুণগতমান বা অবস্থা তা নির্ভুলভাবে জানা সম্ভব নয়। অধিকন্তু, মাটির নিচে গভীরে বিশাল আকৃতির সব ফাটল রয়েছে যা কালের সাথে তাল মিলিয়ে কখনো প্রসারিত, কখনো সংকুচিত হচ্ছে, আবার কখনোবা স্থান পরিবর্তন করছে। মুভমেন্ট বা সঞ্চালন অতি ধীরে হয় বলে আমরা তা সাধারণভাবে আঁচ করতে পারিনা, কিন্তু, কখনো তা অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতিতে হলেই ভূমিকম্প হিসেবে তা আমরা অনুভব করি। মানুষের পক্ষে ভূপৃষ্ঠের গভীরে থাকা মাটির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তবে, যা সম্ভব তা হলো, স্ট্রাকচার বা ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কারিগরি ও প্রযুক্তি জ্ঞানের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ভূমিকম্পে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা।

বাংলাদেশে ভূমিকম্প মোকাবেলার স্বার্থে ভবন বা তার ভিত্তি কতটা শক্তিশালী হওয়া উচিত তাতে অনেক ভবন মালিকই তেমন গুরুত্ব দিতে চাননা। এর একটি কারণ হলো যথাযথ জ্ঞানের অভাব, অন্যটি হলো, ভূমিকম্পের বিষয় বিবেচনায় নিলে নির্মাণ খরচ বেড়ে যায়।

দশ.

সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকা শহরের বড় অংশই নরম, পানিসিক্ত পলিমাটির ওপর নির্মিত, যা ভূমিকম্পের সময় ভবনের কম্পন বাড়িয়ে দিতে পারে এবং বড় ভূমিকম্পে ভবনের নিচের মাটি তরল হয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়তে পারে। তাই, সময় এসেছে ঢাকাকেন্দ্রিক পরিকল্পনা বাদ দিয়ে বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে ভাবার। কর্মসংস্থানের সুযোগ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষ যেন কেবল ঢাকামুখী না হন সে চিন্তাও মাথায় রাখতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্যে দেরি না করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অফিস আদালত ঢাকার বাইরে সরিয়ে নিতে হবে, যাতে বড়ো ধরণের ভূমিকম্পে ঢাকা অচল হলে পুরো দেশটাই অচল হয়ে না যায়।

এগারো.

জাপানের বেইস আইসোলেশন প্রযুক্তি হতে পারে বাংলাদেশে ভূমিকম্প প্রতিরোধক ভবন নির্মাণের নতুন ধারা - বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশ এমন পরামর্শ দিচ্ছেন। অনেকে আবার প্রশ্ন তুলছেন, ঊন্নতদেশের আদলে সাইসমিক ডেম্পার (seismic damper), রাবার বিয়ারিং, ইত্যাদির মতো এনার্জি ডিজিপেশন ডিভাইস (energy dissipation device) কেন বাংলাদেশ ব্যবহার করছে না?

এ প্রশ্নের উত্তর সহজ। উপরের পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করতে গেলে যে মানের নির্মাণ সামগ্রী, নির্মাণ শৈলী, প্রশিক্ষিত জনবল ও অর্থায়নের দরকার তা আমাদের নেই। একবার ভেবে দেখুন না, মূল প্রাক্কলনের চেয়ে খরচ বহুগুনে বাড়িয়েও মেট্রোরেলে বিয়ারিং প্যাড লাগানোর মতো সাধারণ কাজেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি; ভূমিকম্প ঠেকানো তো বহু দূরের কথা।

বলা বাহুল্য, ভূমিকম্পের কারণে ভবনের ক্ষতি হলেও তা যাতে প্রাণঘাতী না হয় প্রকৌশলীবৃন্দ মূলত সেদিকেই মনোনিবেশ করেন, যা যথাযথ স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের মাধ্যমে অনেকাংশেই সম্ভব। তারা নিশ্চিত করতে চান, উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পে ভবনের প্যানকেক (pancake) ধাঁচের প্রাণঘাতী কলাপ্স বা পতন না ঘটিয়ে যাতে কন্ট্রোল্ড বা নিয়ন্ত্রিত উপায়ে কলাপ্স ঘটানো যায়।

বারো.

বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশে অনেক শিক্ষিত মানুষও অভিজ্ঞ রাজমিস্ত্রি আর প্রকৌশলীতে তফাৎ খুঁজে পাননা, বা আর্কিটেক্ট আর প্রকৌশলীর কাজের পার্থক্য বুঝেননা। খরচ বাঁচাতে ছয়-সাততলা ভবনে বিদ্যুতের কাজ করান অর্ধশিক্ষিত ইলেক্ট্রিশিয়ান দিয়ে। নির্মাণকাজে ব্যবহৃত মালামালের গুণগতমান নিয়ে মাথাব্যথা থাকেনা অনেক নির্মাতার। ভবন নির্মাণের আগে মাটির শক্তি পরীক্ষাকে অযথা বাড়তি খরচ মনে করেন বেশিরভাগ ভবন মালিক। অবৈধ আর্থিক লেনদেনে মালিকগণ ভবনের চারপাশে যে উন্মুক্ত স্পেস রাখা দরকার তাও ব্যালকনি বাড়িয়ে দখল করে ফেলেন; অনেকক্ষেত্রে, ছয়-সাত তলার নক্সা অনুমোদন নিয়ে তৈরী করে ফেলেন আট-দশতলা। এহেন নৈরাজ্যকর ও হতাশাব্যঞ্জক পরিবেশে ভূমিকম্পরোধে অতি ব্যয়বহুল 'বেইস আইসোলেশন' জাতীয় উন্নতদেশের প্রযুক্তি ব্যবহারের চিন্তা আকাশকুসুম কল্পনা নয়কি? বলা বাহুল্য, অত্যাধুনিক এসব প্রযুক্তির ব্যবহারে ভবনের নির্মাণ খরচও পাঁচ হতে দশ গুন বেড়ে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞবৃন্দের কেউ কেউ বলছেন ভবিষ্যতে ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের অর্ধেকেরও বেশি ভবন ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে। কিন্তু, একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমি মনে করি, ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প দরকার নেই, কেবল ৭ মাত্রার ভূমিকম্পই ঢাকা শহরে বর্ণিত মাপের ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে যথেষ্ট। এর কারন হলো, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ১ বেড়ে যাওয়া মানে কম্পনের শক্তি ১০ গুন বেড়ে যাওয়া; ২ বেড়ে যাওয়া মনে ১০০ গুন বেড়ে যাওয়া। হিসাবটা তেমনই। এর অর্থ দাঁড়ায়, সম্প্রতি ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে আমরা যে মাপের ক্ষয়ক্ষতি প্রত্যক্ষ করছি, ৬.৭ মাপের ভূমিকম্পে এর কমপক্ষে ১০ গুন ক্ষয়ক্ষতি দেখবো; আর, ৭.৭ এ দেখবো কমপক্ষে ১০০ গুন। এবার আপনিই ভেবে দেখুন, ঢাকা শহরকে মাটির সাথে গুড়িয়ে দিতে ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের প্রয়োজন আদৌ আছে কি? এর সাথে সুনামি যোগ হলে কি হতে পারে ভেবেছেন?

তবে কি ভূমিকম্পের ভয়ে ঢাকাবাসী এখনই গর্তে ঢুকে পড়বে? - তা অবশ্যই নয়, মরার আগে মরবো কেন?, সাহসিকতার সাথে এ দুর্যোগ আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। আগেও বাংলাদেশে ছোটখাট মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, যা সরকার তথা সাধারণ মানুষ তেমন আমলে নেয়নি। ফলে, ভূমিকম্প দুর্যোগ নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা হলেও তা মোকাবেলার কোন কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে অবহেলা করে কালক্ষেপণের সুযোগ আর নেই। অতীতের ভুলত্রুটি হতে শিক্ষা নিয়ে এ সমস্যা মোকাবেলায় সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথেই এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। পরম করুনাময় দেশবাসীর সহায় হউন।

- এম এল গনি, কানাডীয় অভিবাসন পরামর্শক (RCIC-IRB) - প্রকৌশলী
ইমেইল: [email protected]

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৪

জেন একাত্তর বলেছেন:




আপনার এই পোষ্টের পর আর ভুমিকম্প হবে না, মনে হয়।

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৯

এমএলজি বলেছেন: কেন এমন মনে হচ্ছে জানতে পারি?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.