নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সময়ের চাহিদা মতো মানববিকাশ মূলক যুগোপযোগী ধর্ম~ মহাধর্ম -এর আবির্ভাব ঘটেছে। \'মহাধর্ম\' হলো অন্ধবিশ্বাস মুক্ত, খোলা মনের, যুক্তিবাদী আধ‍্যাত্মিক চেতনা সম্পন্ন, আত্মবিকাশকামী মানুষদের উপযোগী একটি ধর্ম।

মানব ধর্মই মহাধর্ম

মহাধর্ম: মানবধর্ম ভিত্তিক অন্ধবিশ্বাস মুক্ত মানব বিকাশ মূলক ধর্ম। মানুষের মৌলিক ধর্ম।

মানব ধর্মই মহাধর্ম › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিশ্বাস ও জ্ঞান : মহর্ষি মহামানস

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৯:৪৪

বিশ্বাস ও জ্ঞান
~মহর্ষি মহামানস

প্রকৃত জ্ঞানের অভাব থেকেই বিশ্বাসের জন্ম। প্রকৃত বা অপর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব সত্ত্বেও, কোন বিষয়-বস্তু বা ব্যক্তি সম্বন্ধীয় ধারণাকে , অথবা স্পষ্ট উপলব্ধ নয়--- এমন কোনো ধারণাকে সত্য বলে মনে করা বা মেনে নেওয়া অথবা লব্ধ জ্ঞান বলে মনে করাই হল প্রকৃত বিশ্বাস। আর, এই সহজ স্বভাবজ বিশ্বাসকে দৃঢ়মূল এবং আমাদের মজ্জাগত করে তুলেছে, প্রচলিত ধর্ম।

দুর্বল বা শিথিল বা সন্দেহযুক্ত বিশ্বাসকে প্রকৃত বিশ্বাস বলা যায় না। সেক্ষেত্রে বিশ্বাস দৃঢ়--- একমুখী হয় না। বিশ্বাসের মধ্যে দ্বিধা- দ্বন্দ্ব- সন্দেহ যুক্ত থাকে। অথবা বিশ্বাসের সাথে জ্ঞান মিশ্রিত থাকে সেখানে।

তবে, কোনো কিছু অনুমান করা অথবা কাজের সুবিধার জন্য কোন কিছু ধরে নেওয়া, অথবা কল্পনা করে নেওয়াটা--- বিশ্বাস নয়।

অবিশ্বাসও বিশ্বাস। তা অপর কোন কিছুতে বিশ্বাস। অপর কোনো কিছু বিশ্বাসের সাপেক্ষে--- 'এটা নয়' অথবা 'এটা হতে পারে না' ---এরূপ বিশ্বাস।

বিশ্বাস অনেক প্রকারের হতে পারে, ---প্রকৃত বিশ্বাস বা দৃঢ় (অন্ধ) বিশ্বাস, জ্ঞানের মোড়কে বিশ্বাস, আংশিক বিশ্বাস বা আংশিক জ্ঞান মিশ্রিত বিশ্বাস, বিশ্বাসের মোড়কে জ্ঞান--- যে জ্ঞানকে যুক্তি-প্রমাণের দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আর এক প্রকার হলো, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্ট বিশ্বাস--- কাল্পনিক কোনো কিছুকে, কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে বিশ্বাস রূপে, অর্থাৎ সত্য বলে, প্রতিষ্ঠা করা--- বিশ্বাস।

প্রকৃত বা দৃঢ় (অন্ধ) বিশ্বাসী বা বিশ্বাসকারীদের কাছে, তার বিশ্বাসই শেষ কথা। ---তা'ই পরম সত্য! সেখানে কোনো তর্ক- বিতর্ক চলতে পারে না। তবে, যারা তাঁদের বিশ্বাসকে--- লব্ধ জ্ঞান বলে মনে করে, তারা অনেক সময়েই যুক্তি প্রমাণাদির দ্বারা তাদের বিশ্বাসকে প্রকৃষ্ট জ্ঞান রূপে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। অনেক সময়েই এদের বিশ্বাসের সাথে জ্ঞান মিশ্রিত থাকে।

অনেক সময়, জ্ঞান আর বিশ্বাসকে আলাদা ক'রে বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সাধারণত, মানুষ যাকে 'জ্ঞান' বলে থাকে, অনেক সময়েই দেখা যায়, সেই জ্ঞানও এক প্রকার বিশ্বাস। অর্থাৎ কোনো অপ্রত‍্যক্ষ অনুপলব্ধ তথ্য বা তত্ত্বকে জ্ঞান বলে, বিশ্বাস করা হয়ে থাকে। অনেক সময়, এই সমস্ত জ্ঞান নানা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে, এবং এই সমস্ত জ্ঞানের সাথে বিশ্বাসও মিশ্রিত থাকে। তাই, এইসব জ্ঞান আসলে বিশ্বাসেরই নামান্তর। এগুলি প্রকৃত বা বিশুদ্ধ জ্ঞান নয়।

জ্ঞান হলো--- কোন বিষয়-বস্তু সম্বন্ধে নিরপেক্ষ দৃষ্টি সম্পন্ন অথবা ওই বিষয়-বস্তুতে অনাসক্ত একজন সজাগ-সচেতন-সত্যপ্রিয় সত‍্যানুসন্ধিৎসু মানুষের উপলব্ধ পর্যাপ্ত ধারণা। একজনের কাছে যেটা জ্ঞান, আরেকজনের কাছে সেটাই আবার বিশ্বাস হতে পারে। যদি কোনো বিশ্বাসপ্রবন মানুষ ওই জ্ঞানীর উপলব্ধ জ্ঞানের কথার উপর বিশ্বাস ক'রে থাকে, তখন তার কাছে তা' শুধুই বিশ্বাস।

কোনটা জ্ঞান কোনটা জ্ঞান নয়, অথবা শুধুই বিশ্বাস, ---এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনা থাকা আবশ্যক। সেইসাথে নিরপেক্ষ দৃষ্টি বা অনাসক্ততা সহ থাকতে হবে সত্যপ্রিয়তা। বিশ্বাসপ্রবণতা--- ব্যক্তিকে প্রকৃত জ্ঞান লাভে অক্ষম করে তোলে।

এই মানব জগতে--- এত অন্ধকার কেন! এই জগতের একটা অংশ গড়ে উঠেছে--- জ্ঞান-বুদ্ধি যুক্তি-বিচার ও বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি ক'রে। আর, অপর অংশটি গড়ে উঠেছে--- অজ্ঞান অবচেতন মনের অন্ধবিশ্বাস, সহজপ্রবৃত্তি ও অন্ধ-আবেগের উপর ভিত্তি করে। সচেতন মনের বিকাশের সাথে সাথে--- মানুষ এদের সম্পর্কে সচেতন হয়ে, এদের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভে সক্ষম হয়ে উঠলে, তবেই এই জগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমাট বেঁধে থাকা অন্ধকার দূর হয়ে--- জ্ঞান ও চেতনার আলোকে আলোকিত হয়ে উঠবে এই জগত।

বিশ্বাস হলো--- অন্ধ ধারণা মায়াত্মক জ্ঞান। আবার, সাধারণত আমরা যাকে জ্ঞান বলে, বিশ্বাস করে থাকি, --- তার অধিকাংশই কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে প্রতীয়মান সত্য বা আপাত সত্য। যাকে বলে, ওপর ওপর--- ভাষা ভাষা জ্ঞান। বিশ্বাসের বিষয়-বস্তু কখনো সত্য হতেও পারে, আবার কখনো নাও হতে পারে। কখনো আবার আংশিক সত্যও হতে পারে। কিন্তু সে যা-ই হোক, তা' বিশ্বাসকারীর উপর নির্ভর করেনা।

আমরা সত্যকে ভালোবাসি--- শুধু মুখের কথায়, ওপরে ওপরে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা সত্যকে চাইনা। আমরা আসলে সত্যকে ভয় পাই। এই ভয় হলো, আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার ভয়। যা দাঁড়িয়ে আছে অনেকাংশে মিথ্যার উপর ভিত্তি করে। আমরা আমাদের বিশ্বাসকেই সত্য বলে ভাবতে ভালোবাসি। তবে এসবই ঘটে আমাদের অজান্তে--- অবচেতনে।

আমাদের অজ্ঞান-অন্ধ মন, ---তার বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করতে, সে নানা যুক্তি--- কারণ--- প্রমাণ খোঁজ ক'রে থাকে। অনেক সময় সে তার বিশ্বাসকে মজবুত করে তুলতে--- ভালো কোনো গল্প ফাঁদে। যারা তার ওই বিশ্বাসকে এবং তার গল্পকে সত্য বলে মেনে নেয় বা বিশ্বাস করে, সে তাদেরকেই ভালোবাসে এবং তাদেরকে তার নিজের লোক বলে, মনে করে। অধিকাংশ মানুষ গল্পেই মজে থাকতে ভালোবাসে, সত্যে তাদের অত্যন্ত অনীহা।

এ এক মায়াময় জগত। বিশ্বাসই এই জগতকে কখনো স্বর্গীয় সুষমামন্ডিত করে তোলে, আবার বিশ্বাসই এই জগতকে নরকে পরিনত করে তোলে। বিশ্বাসেই মানুষ নিজেকে সুখী মনে করে, আবার বিশ্বাসেই মানুষ নিজেকে দুঃখী ভেবে থাকে। অজ্ঞান-অন্ধ মানুষ--- তাদের এই মায়াত্মক বিশ্বাসের জগত থেকে বেরিয়ে এসে--- নিজের এবং এই জগতের প্রকৃত স্বরূপকে জানার বা দেখার কথা ভাবতেই পারেনা। তাদের মধ্যে নিজের সম্পর্কে এবং এই জগৎ ও তার কার্যকারণ সম্পর্কে জানার প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হয়না। তাদের কাছে তাদের ঐ বিশ্বাসের জগৎটাই বাস্তব জগত। তার বাইরে আর যা কিছু--- সব অবাস্তব।

এত অল্প জ্ঞান--- চেতনা ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে, মানুষ মোটেই সুখী--- সন্তুষ্ট নয়। আবার এই স্বল্প জ্ঞান ও চেতনার কারণেই মানুষের অহংকার--- আত্মম্ভরিতাও বেশি। জ্ঞানাভাবকে মানুষ তাই মেনে নিতে পারে না। অনেকে আবার তাদের জ্ঞানাভাবকে স্বীকারই করতে চায় না। অপরাপর মানুষের কাছে নিজেদেরকে অসাধারণ জ্ঞানী প্রতিপন্ন করতে গিয়েই যত সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক বিশ্বাসের সৃষ্টি হয় এখান থেকেই।

অন্ধ বিশ্বাসপ্রবণ সেই সব মানুষদের সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই। জ্ঞান---চেতনা, বোধশক্তি অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও, যারা ওপর-চালাকির দ্বারা জ্ঞানের ঘাটতি পূরণে সর্বদা তৎপর, যারা মনে করে অথবা ভান করে--- তারা সব জানে, অথচ বিশেষ কিছুই জানে না, জাগতিক দুর্ভোগ--- দুঃখ -কষ্ট, যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই তিলে তিলে জ্ঞান ও চেতনার বিকাশ ঘটে থাকে তাদের।

চেতনা বৃদ্ধির সহজ ও স্বাভাবিক পথ হলো--- মানুষ যদি তার নিজের সম্পর্কে, নিজের ক্ষমতা-অক্ষমতা ---অজ্ঞানতা সম্পর্কে সজাগ থেকে, জ্ঞান লাভের জন্য সত্যান্বেষীর মতো চোখ-কান খোলা রেখে--- সর্বদা সচেষ্ট থাকে, তাহলেই তার দ্রুত জ্ঞান ও চেতনা বৃদ্ধি পাবে।

কিন্তু জ্ঞান অর্জন করতে যে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, বিশ্বাস করতে তো আর তার দরকার হয় না! তাই পরিশ্রম বিমুখ কল্পনাবিলাসী মানুষ জ্ঞানের পথে না গিয়ে--- বিশ্বাসেই মজে থাকতে ভালোবাসে।

অল্প বা স্বল্প চেতন-স্তরের মানুষের পক্ষে বিশ্বাস ছাড়া বাঁচাই সম্ভব নয়। জ্ঞান ও বিশ্বাস উভয়কেই প্রয়োজন। এদের জ্ঞানের যা অবস্থা, তাতে করে সেই জ্ঞানের উপর নির্ভর বা ভরসা করে থাকা সম্ভব নয়। তাই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে বা ভরসা করেই বেঁচে থাকে তারা। কিন্তু এভাবে তো আর চিরকাল চলে না, জীবনের পথে চলতে চলতে--- মনোবিকাশের সাথে সাথে, জ্ঞান ও চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে--- বিশ্বাসের ক্ষয় হতে থাকে ক্রমশ।

চেতনায় এগিয়ে থাকা অনেক মানুষই এটা বোঝেন, যে অন্ধ-বিশ্বাস তাদের বিকাশের পরিপন্থী। তাই, বিশ্বাস থাকুক বিশ্বাস রূপেই, জ্ঞান বা সত্য রূপে নয়।

বিশ্বাসের প্রয়োজন আছে, কিন্তু বিশ্বাসকে সচেতন ভাবে--- 'বিশ্বাস' রূপেই চিহ্নিত করতে হবে, এবং গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বাসকে সত্য বা উপলব্ধ জ্ঞান রূপে গ্রহণ করলে, আমাদের বিকাশ প্রায় থমকে যাবে, অথবা বিকাশের গতি অতি মন্থর হয়ে পড়বে। আর যথাযথ বিকাশ না ঘটলে, এইভাবে অজ্ঞান- অন্ধ হয়ে--- দুঃখ-কষ্ট যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই কাটাতে হবে সারা জীবন। মনে রাখতে হবে, আমাদের একটি সচেতন মন আছে বলেই, আমাদের অন্ধ-আবেগকে সচেতন মনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হই বলেই, আমরা মানুষ। সেই সচেতন মনের বিকাশ ঘটাতে সচেষ্ট হওয়াই প্রতিটি মানুষের প্রধান কর্তব্য।

.

শুনতে অবাক লাগলেও, আমার অভিধানে 'বিশ্বাস' নামে কোনো শব্দ নেই। এই 'বিশ্বাস'-ই হলো~ পৃথিবীতে যত নষ্টের গোড়া।

যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ধর্ম মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে, তার স্বার্থে। তাই বিশ্বাস মানুষের মজ্জাগত হয়ে গেছে। বিশ্বাস ছাড়াও যে জীবন চলতে পারে, এ কথা মানুষ ভাবতেই পারেনা।

আমি কখনোই বলি না, আমার কথা বিশ্বাস করো। আমি বলি, যুক্তি- বিচার আর বিজ্ঞান- মনষ্কতার কষ্ঠিপাথরে আমার কথা যাচাই করে, তারপর গ্রহণযোগ্য মনে হলে, তবেই তাকে গ্রহণ করো। আমি তোমাদের বিশ্বাস অর্জন করতে চাইনা, চাই নির্ভরযোগ্য হতে।

বিশ্বাস কথাটা নয়, বলো-- জানি অথবা জানি না। এর মাঝখানে আছে--- হতে পারে, অনুমান, ধারণা, মনে হয়, প্রভৃতি। বড়জোর বলা যেতে পারে, আপাত বিশ্বাস।

এভাবে চললে, কখনোই বিশ্বাস হারানো--- বিশ্বাস ভঙ্গ, অবিশ্বাস, বিশ্বাস ঘাতকের কবলে পড়তে হবেনা। 'বিশ্বাস' ছাড়াই---বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে চললে, জীবন অনেকটাই শুভ ও ধনাত্মক হয়ে উঠবে। ঋণাত্মকতা দূর হয়ে যাবে।

তা'ই বলে আমি বলছি না, অবিশ্বাস-- সন্দেহের চোখে দেখতে। আমি বলতে চাইছি, সর্বদা সজাগ- সচেতন ভাবে থাকতে।

'বিশ্বাস' কথাটার মধ্যেই নিহিত থাকে-- অজ্ঞান-অন্ধত্ব, অনিশ্চয়তা, সন্দেহ-অবিশ্বাস -এর একটা চোরা স্রোত। থাকে বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়ার বা বিশ্বাস হারানোর আশঙ্কা।

'বিশ্বাস' মানেই নিশ্চয় জ্ঞান নয়, এটা জানা সত্বেও, সম‍্যক জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও, সচেতন মনের সতর্কতার বিরুদ্ধে গিয়ে-- কোনো কাউকে বা কিছুকে জোর ক'রে সত্য বলে মেনে নেওয়ার ভিতরে প্রচ্ছন্ন থাকে-- আত্মপ্রবঞ্চনা। থাকে দুটি (সচেতন ও অবচেতন) মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব।
.

মানব জাতির বহু সমস্যার কারণ এবং প্রগতি ও বিকাশের প্রধান প্রতিবন্ধ হলো অন্ধ বিশ্বাস বা দৃঢ় বিশ্বাস। আমাদের একথা ভুললে চলবেনা, এ জগতের অধিকাংশ সমস্যা, সঙ্কট, ধ্বংসাত্মক বা অনিষ্টকর ঘটনার পিছনেই রয়েছে অন্ধবিশ্বাস। এই বিশ্বাসের দ্বারা এ' জগতে যতটুকু ভালো কাজ হয়েছে, মন্দ হয়েছে তার চাইতে অনেক অনেক গুণ বেশি।

আমি বরাবরই অন্ধবিশ্বাসের বিরোধী এবং মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস এবং তার মূল কারণ অজ্ঞান-অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করতে সর্বদা সচেষ্ট রয়েছি। কিন্তু সমদর্শী মনোভাব নিয়ে দেখলে, বিশ্বাসেরও কিছু সুফল আছে, বিশেষত শরীর মন ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশ্বাসের একটি ধনাত্মক ভূমিকাও রয়েছে।

আর বাস্তব সত্য হলো, পৃথিবীব্যাপী অসংখ্য স্বল্প-জ্ঞান ও স্বল্প-চেতন মানুষের চেতনার যথেষ্ট বিকাশ ঘটতে এখনো বহু সময় লাগবে। মানুষ যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনা সম্পন্ন না হওয়া অবধি বিশ্বাস আছে--- বিশ্বাস থাকবে।

তাই, মানুষকে অজ্ঞান অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা বজায় রেখে, মানুষকে সুস্থ ও যন্ত্রণা মুক্ত করে তোলার উদ্দেশ্যে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশ্বাস মূলক পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে। যদি না সেখানে মানুষকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্য থাকে।

সব চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গেই সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বিশ্বাস যুক্ত থাকে। তার মধ্যে, শুধু বিশ্বাস ভিত্তিক চিকিৎসা হলো একেবারেই নির্মল চিকিৎসা। 'ফেইথ হিলিং' হলো মনোপথে আরোগ‍্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি।

তবে, আমি একথা বলছি না, যে এই পথেই সমস্ত রোগ আরোগ্য করা সম্ভব। জানতে হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে আরোগ্য হতে পারে। সাইকোটিক ও সাইকোসোমাটিক রোগ-ব‍্যাধির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অধিক কার্যকর।

তবুও বলবো, অন্ধ-বিশ্বাসে এই পদ্ধতির উপর রোগীকে দীর্ঘকাল ফেলে না রেখে, প্রয়োজনে অন‍্যান‍্য চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নিতে হবে। গুরুতর রোগের ক্ষেত্রে, তা আরোগ্য করতে, বিশ্বাস খুব তীব্র হওয়া দরকার। সাংঘাতিক বা মারাত্মক রোগ-ব‍্যাধির ক্ষেত্রে, এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা উচিৎ নয় বলেই মনে ক‍রি।

বিশ্বাসের পিছনে থাকে অবচেতন মন। আর, এই অবচেতন মনের অধিকারে রয়েছে আমাদের শরীর ও মন অনেকাংশে। বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে অবচেতন মনের আরোগ্যকর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, বিশ্বাস ভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি সাফল্য লাভ করে থাকে।

সাংঘাতিক কুফল দায়ক বিষাক্ত ওষুধ গ্রহণের চাইতে, সম্ভাব্য ক্ষেত্রে বিশ্বাস ভিত্তিক নির্মল চিকিৎসাপদ্ধতি বহুগুণে ভালো বলেই মনে করি আমি।
.

অন্ধবিশ্বাস, সাধারণ বিশ্বাস ও আপাত বিশ্বাস নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে, কিছু কিছু কথার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।

অন্ধবিশ্বাস ও সাধারণ বিশ্বাস সম্পর্কে আলোচনা করার আগে, বিশ্বাস সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকা প্রয়োজন। জানতে হবে, বিশ্বাস আসলে কী!

কোনো বিষয়--- বস্তু, তথ্য--- তত্ত্ব, ব‍্যক্তি প্রভৃতি যেকোনো কিছু সম্পর্কে একজনের সম‍্যক জ্ঞান বা ধারণা না থাকা সত্ত্বেও, তাকে সত্য বলে মেনে নেওয়া অথবা মনে স্থান দেওয়ায়ই হলো--- বিশ্বাস।

অন্ধবিশ্বাস কোনো যুক্তি--- বিচার, প্রমানের ধার ধারে না। অন্ধবিশ্বাস হলো দৃঢ়মূল অটুট বিশ্বাস।

আর সাধারণ বিশ্বাস হলো--- কতকটা আপাত বিশ্বাসের মতো অস্থায়ী বিশ্বাস। এই বিশ্বাস--- যুক্তি-প্রমাণ এবং বিশেষ ঘটনা সাপেক্ষে যেকোনো সময় বদলে যেতে পারে।

তবে, 'আপাত বিশ্বাসের' সঙ্গে এর পার্থক্য আছে। 'আপাত বিশ্বাস' হলো সজাগ-সচেতন যুক্তিবাদী মানুষের, ব‍্যবহারিক কাজ চালানোর জন্য, কর্ম সম্পাদনের জন্য সাময়িক বিশ্বাস। এই বিশ্বাস যেকোনো সময় ভঙ্গ হতে পারে বা পরিবর্তীত হতে পারে, এমন মানসিক প্রস্তুতি থাকা--- সজাগ-সচেতন মনের বিশ্বাস।
.

অন্ধবিশ্বাস--- সাংঘাতিক সংক্রামক জীবাণুর চাইতেও ভয়ংকর!

মাঝে মাঝেই অন্ধবিশ্বাসীদের বলতে শোনা যায়, --তাঁঁদের বিশ্বাস (যা আসলে অন্ধবিশ্বাস) -এর বিরোধিতা করা নাকি তাঁঁদের ব‍্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা!

এখন, একজন অন্ধবিশ্বাসী কি তার বিশ্বাস শুধু তাঁঁর ব‍্যক্তিগত ক্ষেত্রে--- নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন? ---না, তা' রাখেন না। তা' যদি রাখতেন, তাহলে খুব বেশি সমস্যা সৃষ্টি হতোনা।

ঠিক ভয়ানক সংক্রামক জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত মানুষের মতোই, একজন অন্ধবিশ্বাসী--- তাঁঁর সন্তান এবং নিকটজনসহ তাঁঁর চারিপাশের বহু মানুষের মধ্যেই তাঁঁর অন্ধবিশ্বাসের সংক্রমণ ঘটাতে সদা তৎপর থাকেন। আর এইভাবেই, ক্রমাগত মানব সমাজের সাংঘাতিক ক্ষতি করে চলেছেন তাঁঁরা!
.

'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর' ---বাস্তবিকই, বিশ্বাসের যে কি অসাধারণ বিস্ময়কর ক্ষমতা, ---সে সম্পর্কে অনেক মানুষই অবগত নয়। অনেক ক্ষেত্রেই, দৃঢ় বিশ্বাসকারী জানেনা--- তার বিশ্বাসের ফলেই তথাকথিত অলৌকিক ঘটনাটি ঘটে গেছে। এই না জানার কারণ হলো--- মন সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব। আর, মানুষের এই বিশ্বাস ও অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়েই, কিছু ধূর্ত প্রবঞ্চক ব্যক্তি মানুষকে প্রতারিত করে চলেছে।

প্রকৃত ঘটনা হলো: বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে অনেক সময় আমাদের (অবচেতন) মন কোন একটি বিষয়বস্তু বা চাহিদাতে একাগ্র কেন্দ্রীভূত হয়ে, সেই চাহিদাকে সফল করে তুলতে, কার্যকর বিশেষ মনঃশক্তি বা অবচেতন মনের ইচ্ছাশক্তির স্ফুরণ বা বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে এ সমস্তই ঘটে থাকে সেই বিশ্বাসী ব‍্যক্তির সচেতন মনের অগোচরে।

আবার, মনের এই কর্মকাণ্ডটি সচেতন মনের ইচ্ছাক্রমেও কখনো কখনো সম্পাদিত হয়ে থাকে, বিশেষ যোগ বা তন্ত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে অত‍্যন্ত কর্মদক্ষ বা সিদ্ধ ব‍্যক্তির দ্বারা। যদিও, সেখানেও থাকে বিশ্বাস।

আমরা জগতের বিভিন্ন বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞানলাভে আগ্রহী ও সচেষ্ট হলেও, যে শরীর ও মন নিয়ে আমরা অস্তিত্বশীল, --যাদের ক্ষয়-ক্ষতিতে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, ---তাদের সম্পর্কে জ্ঞান লাভে আমাদের তেমন আগ্রহ নেই। নিজেদের মনের ক্ষমতা সম্পর্কেও আমাদের বিশেষ ধারণা নেই। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণভাবে নিজেকে জানা--- নিজের শরীর-মনকে জানার শিক্ষা অবহেলিত।

আংশিক বিকশিত এই সচেতন মনটি ছাড়াও যে আমাদের আরও একটি সক্রিয় মন আছে, আমরা অনেকেই তা' জানি না। আমাদের মনের ঐচ্ছিক চিন্তাশীল অংশটি ছাড়াও যে তার একাধিক শক্তিশালী অনৈচ্ছিক অংশ আছে, সে সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত নই। ( 'নিজের মনকে জানো' ও 'মন-আমি' প্রবন্ধ দুটি দ্রষ্টব্য)।

উচ্চচেতনা সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের অনেকে--- সচেতনভাবেই তাদের মনের শক্তিকে ব্যবহার করতে সক্ষম। আর, স্বল্প-চেতন বিশ্বাসনির্ভর মানুষ, তারা তাদের বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে নিজেদের অজান্তেই--- নিজেদের মনঃশক্তির দ্বারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিস্ময়কর ফলেলাভ করে থাকে। এবং তারা ভেবে থাকে, কোন দেবতা অথবা কোন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিই সেই ফলদাতা।

অবশ্য, কোন কোন ক্ষেত্রে যে সুফলদাতা ব্যক্তি থাকেনা তা' নয়। ফলদাতা ব‍্যক্তিও যদি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে কিছু ঘটাতে চায়, অথবা কোনোরূপ সুফল দিতে চায়, তাও হতে বা ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে দাতা এবং গ্রহীতা উভয়ের মনের শক্তি একত্রিত হয়ে, আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে--- কার্যটি সম্পন্ন হয়ে থাকে।

এছাড়া ফলদাতা যদি প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি হয়, এবং যদি সে নিজের মনের শক্তি দ্বারা সরাসরি কার্যসম্পন্ন করতে সক্ষম হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। সেক্ষেত্রে বিশ্বাসের কোন ভূমিকা থাকে না।

এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে, প্রেতলোকের বাসিন্দাদের দ্বারাও অনেক কার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষ যাদের দেব-দেবী ভেবে ভুল করে থাকে।

বিশ্বাসভিত্তিক এই মনঃশক্তি--- সাধারণত আমাদের শরীর ও মনের উপরেই কাজ করে থাকে। তবে, কখনো কখনো এর ব্যতিক্রম হতেও দেখা যায়। অর্থাৎ শরীর ও মনের বাইরেও তাকে ক্রিয়া করতে দেখা যায় কখনো কখনো। শরীর ও মনের বাইরে ক্রিয়া করতে হলে, তাকে অনেক বেশি শক্তিশালী হতে হবে। এবং তার জন্য মন ও মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ অংশের বিকাশ ঘটে থাকতে হবে।

বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে উৎপন্ন বা জাগ্রত মনঃশক্তি শুধু বিশ্বাসকারীর শরীর ও মনের উপরেই যে ক্রিয়াশীল হয়, এমন নয়। সে অপর ব্যক্তির শরীর ও মনের উপরেও ক্রিয়া করতে সক্ষম। যেমন, মন্ত্রপুতঃ জল বা জলপড়া-র দ্বারা একটি শিশুও আরোগ্য লাভ করতে পারে। যার নিজের কোন বিশ্বাস থাকে না। 'মেডিকেল ট্রিটমেন্ট' -এর ক্ষেত্রেও চিকিৎসক ও রোগী উভয়েই যদি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে ঔষধ প্রদান ও সেবন করে, সেক্ষেত্রে উভয়ের মনঃশক্তির সাথে ওষুধের গুণ বা শক্তি মিলিত হয়ে চমৎকার ফল দিয়ে থাকে।

আবার, কোনো চিকিৎসকের মধ্যে যদি আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে, ওষুধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে যদি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভাব থাকে, সে অনেক ভেবে-চিন্তে বিচার-বিবেচনা ক'রে রোগীকে সঠিক ওষুধ দিলেও, চিকিৎসক হিসেবে সাফল্য লাভ করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এমনও দেখেছি, একজন কোয়াক ডাক্তার--- চিকিৎসাশাস্ত্রে তার বিশেষ জ্ঞান নেই। মাত্র অল্প কয়েকটি ওষুধের ব্যবহার সে জানে। তা-ও সেই ওষুধগুলির সঠিক কার্যকারিতা সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা নেই। কিন্তু তার মধ্যে আছে একমুখী তীব্র বিশ্বাস--- যে, এই ওষুধেই রোগী সেরে উঠবে। এই অন্ধবিশ্বাসযুক্ত আবেগময় মনঃশক্তির দ্বারাই সে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জয়ী হয়ে আসছে। তার বিশ্বাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, রোগীরাও বিশ্বাস করে--- এই ডাক্তারের ঔষধ একেবারে অব্যর্থ! ফলে, তার ডাক্তারখানায় সবসময় রোগীর ভীড় লেগেই থাকে।

.
বিশ্বাস প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, আমার পরিচিত একটি ছেলের কথা। যে তার (বহুগামী) মায়ের কথামতো অর্থাৎ মায়ের কথার উপর বিশ্বাস ক'রে, এক ব্যক্তিকে বহুকাল যাবৎ তার পিতা বলে জেনে এসেছে। অবশেষে হঠাৎ একদিন ঘটনাচক্রে সে জানতে পারে, সেই ব্যক্তি তার পিতা নয়। তার পিতা অন্য কেউ।

এক ব্যক্তিকে জানি, ঈশ্বর সম্পর্কে সে একটি বিশেষ ধারনা বা মতে বিশ্বাস ক'রে এসেছে--- দীর্ঘকাল ধরে। একদিন সেই বিশ্বাসে চিড় ধরে যাওয়ার ফলে, তার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায়। তারপর থেকে বহুকাল যাবৎ সে বিষাদ-উন্মাদ অবস্থায় দুঃসহ জীবন কাটানোর পর, তাকে সুস্থ করে তোলা হয়--- 'মাইণ্ড-প্রোগ্রামিং' -এর মাধ্যমে। ঈশ্বরকে তার প্রকৃত স্বরূপ না জেনে, শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে--- ঈশ্বর লাভের জন্য, ঈশ্বরের কৃপা লাভের জন্য--- আজীবন ছুটে মরছে কত যে মানুষ, তার কোন হিসেব নেই। আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত অসংখ্য বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটে চলেছে। এই জগতে বিশ্বাসের দ্বারা যত ভালো কাজ হয়েছে, মন্দ কাজ হয়েছে তার চাইতেও অনেক গুণ বেশি।

নিত্যকার প্রয়োজনে--- ব্যবহারিক ক্ষেত্রে, অনেক সময়েই আমাদেরকে অনেকের উপর বিশ্বাস করতে হয়, অথবা বিশ্বাস করতে বাধ্য হতে হয়। এবং বিশ্বাস ক'রে ঠকতে হয় অথবা প্রতারিত হতে হয় অনেক ক্ষেত্রেই। এক এক সময় এই বিশ্বাস ভঙ্গের ফল এতো সাংঘাতিক বা এতো মারাত্মক হয়ে ওঠে, যে স্বভাবতই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, ---তাহলে কি আর কাউকে বিশ্বাস করব না? বিশ্বাস করা কি তাহলে খারাপ? একটু জ্ঞান চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথেই এই প্রশ্ন জাগ্রত হয় মনে। কিন্তু পর্যাপ্ত জ্ঞান -চেতনার অধিকারী না হওয়া অবধি, এই বিশ্বাস করার প্রবণতা যায় না আমাদের মন থেকে।

জাগতিক ব্যবস্থা বা 'ওয়ার্ল্ডলি সিস্টেম' আমাদের মধ্যে প্রয়োজনের তাগিদেই বিশ্বাস প্রবনতার জন্ম দিয়েছে। আবার সেই বিশ্বাসকে দূর ক'রে সেখানে জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থাও রেখেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কি কর্তব্য? যারা জ্ঞান-পথের পথিক, তাদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো--- 'বিশ্বাস' কথাটিকে তোমাদের খাতা থেকে আস্তে আস্তে তুলে দিতে চেষ্টা করো। তার জায়গায় 'অনুমান'--- 'ধারণা' বা 'আপাত ধারণা' 'আপাত বিশ্বাস' এইরূপ অন্যান্য কথা ব্যবহার করতে শুরু করো। কারো উপর বিশ্বাস থাকা--- এক্ষেত্রে বলতে পারো, তার উপর আমার আপাতত আস্থা, অথবা আপাত ভরসা আছে। অগাধ বিশ্বাস মানেই অগাধ অজ্ঞানতা--- অন্ধত্ব। বিশ্বাস বা জ্ঞান যা-ই হোক না কেন, তাকে 'আপাত সত্য' বলে গ্রহণ করবে। তাহলেই দেখবে, সমস্যার সবটা না হলেও, অনেকটাই দূর হয়ে যাবে।

এবার, বিশ্বাসপ্রবণ মানুষ, যাদের পক্ষে বিশ্বাস না করে থাকা সম্ভব নয়, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, বিশ্বাস করবে--- খুব সাধারণভাবে। তা' যেন দৃঢ়--- অন্ধবিশ্বাস না হয়ে ওঠে। অন্ধবিশ্বাসের কুফল অনেক সময়ই মারাত্মক হতে পারে। যে বিষয়-বস্তু সম্পর্কে তোমার কোন সম্যক ধারণা নেই, তার উপর অগাধ বিশ্বাসের কোন মানেই হয় না। সাধারণত মানুষের মন পরিবর্তনশীল, এবং যে কোন সময় সে অসুস্থ--- বিকারগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। পরিবেশ-পরিস্থিতি, ঘটনাপ্রবাহও পরিবর্তনশীল। সেখানে মানুষের বিশ্বস্ততা কি করে স্থায়ী হতে পারে! তাই, বিশ্বাস করবে--- নির্ভর করবে ততটাই, যাতে পরবর্তীকালে বিশেষ আশাহত বা শোকাহত হতে না হয়।

মনে রাখবে, যেকেউ যেকোনো সময়, বিশ্বাসভঙ্গ করতেই পারে। এ ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি থাকলে, তখন আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকবে না। এটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারলে, অন্য ক্ষতি হলেও, বিশেষ কোনো মানসিক ক্ষতি হবে না। কিন্তু তাই বলে, এখানে কোন সন্দেহ--- অবিশ্বাস থাকবে না। থাকবে বাস্তব জ্ঞান। মন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। মানুষ চেনা ও নিজেকে জানার চেষ্টা সহ, বাস্তব জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে--- যথেষ্ট আত্মবিকাশ লাভ করতে পারলে, আর বিশ্বাস হারাতে হবে না।

বিশ্বাস (বা ভরসা বা আপাত বিশ্বাস) করার আগে, নিজেকে প্রশ্ন করো--- কেন আমি বিশ্বাস করবো? বিশ্বাস করার কি যুক্তি আছে? খুব ভালো করে না ভেবে, না বিচার করে--- তুমি যদি সরল মনে সবকিছু বিশ্বাস করে নাও, তাহলে কিন্তু ভবিষ্যতে তোমাকে আবার হোঁচট খেতে হবে, বিপর্যস্ত হতে হবে।

যে গ্রন্থই হোক, আর যে ব্যক্তিই হোক, ---তার কথা গ্রহণ করার পূর্বে, সেই বক্তব্যের বাস্তব সম্ভাবনা--- যুক্তি-বিচারপূর্বক খতিয়ে দেখে, তবেই তা' গ্রহণ করবে--- আপাতসত্য রূপে। যুক্তি-বিচার প্রয়োগে কারো অনীহা--- আলসেমি থাকলে, তাকে কলুর বলদের মতো বিশ্বাসের ঘানি টানতেই হবে।

'জ্ঞান' সম্পর্কে আরো দু-চার কথা বলে, এখনকার মতো এই প্রসঙ্গ শেষ করবো। সাধারণভাবে জ্ঞান হলো--- কোন বিষয়-বস্তু, ঘটনা, তথ্য বা তত্ত্ব সম্পর্কে ইন্দ্রিয়, চেতনা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লব্ধ ধারণা--- উপলব্ধি--- বোধ। যেসমস্ত ইন্দ্রিয়, অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস ও সূত্র বা উৎস গুলির উপর ভিত্তি করে জ্ঞান অর্জিত হয়, সেগুলির একটিও যদি ব‍্যক্তিকে ভুল পথে চালনা করে অথবা প্রতারণা করে, তাহলে লব্ধ জ্ঞানও অসম্পূর্ণ বা ভুল বা মিথ্যা হয়ে যাবে।

বিশ্বাসের উপর ভিত্তি ক'রে অর্জিত জ্ঞান অনেক সময়েই অপ্রকৃত জ্ঞান বা ভুল ধারণা হতে পারে।

পূর্বলব্ধ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস এবং ইন্দ্রিয়াদির কার্যক্ষমতা সহ মনের বোধশক্তি বা বোঝার ক্ষমতার উপর ভিত্তি ক'রে জ্ঞান অর্জিত হয়। এছাড়া, যে বিষয়বস্তুর উপর জ্ঞান লাভ ঘটছে, সেই বিষয়বস্তুও যে সব সময় সঠিক ভাবে জ্ঞান লাভকারী ব্যক্তির কাছে আত্মপ্রকাশ করবে, এমন নাও হতে পারে। লব্ধ জ্ঞান সব ব্যক্তির ক্ষেত্রে--- সব সময় একরকম এবং সঠিক হবে এমন নয়।

বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভের জন্য, জ্ঞান লাভের যথেষ্ট চাহিদা সহ--- সত্যপ্রিয় এবং যথাসাধ্য (জ্ঞান ও সত্য ব্যতীত অন্যান্য বিষয়বস্তুতে) আসক্তিমুক্ত--- নিরপেক্ষ হয়ে, জ্ঞান লাভের সময় বিভিন্ন দিক থেকে--- বিষয়-বস্তুকে পর্যবেক্ষণ এবং যাচাই ক'রে তারপর তাকে গ্রহণ করতে হবে। জ্ঞান--- বিশ্বাস--- অনুমান--- ধারণা, চিন্তা-ভাবনা সবকিছুকেই সজাগ ও সচেতন মনের আলোকিত আলোকিত আঙিনায় নিয়ে আসতে হবে।

তারপরেও সময়ান্তরে মনে পড়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, এটা আমার জ্ঞান না বিশ্বাস? তারপর তাকে নানা দিক থেকে--- নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ক'রে 'আপডেট' করতে হবে। এর পরেও মনে রাখতে হবে, তোমার এই জ্ঞান প্রকৃত সত্য নাও হতে পারে। সমস্ত জ্ঞানকে 'আপাত সত্য' ধরে নিয়েই এগোতে হবে তোমাকে। ছাত্র-ছাত্রীদের এই প্রক্রিয়ায় জ্ঞান লাভে উৎসাহিত করতে পারলে, পরবর্তীকালে তারা বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভে সক্ষম হয়ে উঠবে।

জ্ঞান অনেক প্রকারের হতে পারে--- অপ্রকৃত জ্ঞান বা ভুল ধারণা, ত্রুটিপূর্ণ জ্ঞান, অসম্পূর্ণ জ্ঞান, প্রকৃত বা বিশুদ্ধ জ্ঞান, জ্ঞানের মোড়কে বিশ্বাস, বিশ্বাসের মোড়কে জ্ঞান, বিশ্বাসের সাথে আংশিকভাবে মিশ্রিত জ্ঞান প্রভৃতি।

প্রকৃত জ্ঞান কখনো শেষ কথা বলে না। বলে না, আমিই একমাত্র সত্য। প্রচুর জ্ঞান অর্জন করার পরে--- কেউ যদি বলে, 'আমি যা জানি তা-ই একমাত্র সত্য, এর অন্যথা হতেই পারে না'। অথবা 'এটাই শেষ কথা'। তাহলে বুঝবে, এটা তার জ্ঞানের কথা নয়, বিশ্বাসের কথা। আর, সেই ব্যক্তিও প্রকৃত জ্ঞানী নয়।

প্রাক-চেতনা থেকে পূর্ণ-চেতনার লক্ষ্যে--- ক্রমবিকাশের পথ ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা সবাই। এই পথের মধ্যবর্তী কোন চেতন স্তরে অবস্থান ক'রে, পূর্ণতার জ্ঞান বা সম্পূর্ণ পথের জ্ঞান সম্ভব নয়। ---একথা বলার সাথে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে, এই জ্ঞানও আপাত সত‍্য।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.