![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মহাধর্ম: মানবধর্ম ভিত্তিক অন্ধবিশ্বাস মুক্ত মানব বিকাশ মূলক ধর্ম। মানুষের মৌলিক ধর্ম।
কর্ম ও কর্মফল (প্রথম পর্ব)
~মহর্ষি মহামানস
আমার কর্ম— এই মহাজাগতিক কর্মকান্ডেরই একটা অংশ। আমার কর্ম হতে উৎপন্ন হয় যে ফল, অর্থাৎ আমার কর্মফল— তা’ শুধু আমার নয়, তা’ এই জগতেরই—, এবং জগৎ জুড়েই তা’ প্রভাব বিস্তার করে। আর, সমস্ত জগতই সেই ফল ভোগ ক’রে থাকে।
জগতের কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। সব কিছুর সাথেই সবার যোগ রয়েছে। জাগতিক কর্মকান্ড এবং তা’ থেকে উৎপন্ন ফলের অধিকাংশই আমাদের পক্ষে অনুভব যোগ্য নয়। আমরা তার খুব সামান্য অংশই উপলব্ধি করে থাকি।
এই মহাজাগতিক কর্মকান্ড থেকে উৎপন্ন অসংখ্য প্রকারের— অসংখ্য ফলের মধ্যে আমিও একটি ফল। আমি যা কিছু করছি, তা’ এই জগতব্যাপী ঐচ্ছিক—অনৈচ্ছিক অসংখ্য কর্মকান্ডের মিলিত ফলেরই একটা অংশ।
আমার দ্বারা কৃত সমস্ত কর্ম— আমার ইচ্ছা মতোই সংঘটিত হয়না। এর পিছনে রয়েছে— বহু ইচ্ছা—অনিচ্ছা, স্বয়ংক্রিয় ঘটনা, স্থান-কাল-পাত্র, অবস্থা প্রভৃতি। আর, এ সবই পুর্বনির্ধারিতভাবে যখন যেটা ঘটার— ঘটে চলেছে। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, —আমার-তোমার —সবার এবং সবকিছুর ক্ষেত্রেই।
সামাজিক দৃষ্টিতে কেউ খারাপ কাজ করলেই যে তাকে খারাপ ফল ভোগ করতে হবে— তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আবার কেউ ভালো কাজ করলেই যে সে ভালো ফল পাবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। পেতেও পারে, আবার নাও পেতে পারে। হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।
কোনো কর্মই শুধু ভালো কর্ম অথবা শুধুই মন্দ কর্ম— এমন হয়না। প্রতিটি কর্মই কম-বেশি ভালো-মন্দ হয়ে থাকে। কোনো কর্ম কারো দৃষ্টিকোণ থেকে বা কারো পক্ষে ভালো, তো অপর কারো পক্ষে মন্দ হতে পারে।
আবার, ভালো—মন্দের নুন্যাধিক্য গুণ বিচার ক’রে কেউ কেউ কোনো কর্মকে ভালো, আর কোনো কর্মকে মন্দ বলে, মনে করতে পারে।
কর্ম হ’তে উৎপন্ন কর্মফলের মধ্যেও ভালো ও মন্দ উভয় ফলই বিদ্যমান থাকে। কেউ শুধু ভালোটা দেখতে পায়, মন্দটা তার দৃষ্টিগোচর হয়না। আবার কেউ শুধু মন্দটাই দেখতে পায়, ভালো দিকটা সে উপলব্ধি করতে পারেনা।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে উভয় দিকই সঠিকভাবে দেখতে পায়— এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
সাধারণত, কর্মের জন্য— কর্মফলের জন্য— একজন অপরজনকে দায়ি ক’রে থাকে। আবার, দুরদৃষ্টি সম্পন্ন নিরপেক্ষ ব্যক্তি দেখে, এদের মধ্যে কেউই দায়ি নয়, —পূর্ব-নির্দিষ্টভাবে যা ঘটার তা-ই ঘটে চলেছে। কোনো কর্মেই কারো হাত নেই। আর, তাই কোন কর্মের জন্যই কেউ দায়ি নয়।
‘কর্মফল’-কে বুঝতে হলে, সর্বাগ্রে আমাদেরকে পূর্বনির্ধারিত ‘ভাগ্য’-কে বুঝতে হবে। ‘ভাগ্য’ আসলে কী— তা’ না বোঝা পর্যন্ত নানা সংশয়-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঢেউয়ের দোলায় ও ধাক্কায় বিপর্যস্ত হতে হবে আমাদেরকে।
কোনো ব্যক্তি ভাগ্য মানবে--- কেউ মানবে না, কেউ কর্ম করবে--- কেউ করবে না, কেউ ভাগ্যের দোহাই দিয়ে কর্ম ত্যাগ করে বসে থাকবে, আবার কেউ ভাগ্যকে জেনেও কর্মের তাড়নায় কর্মে লিপ্ত হবে। যে যা-ই করুক না কেন, সবাই ভাগ্যক্রমে বা ঘটনাক্রমেই করবে। করতে বাধ্য হবে।
কর্ম ও কর্মফল (দ্বিতীয় পর্ব)
~মহর্ষি মহামানস
জীব হলো ঈশ্বর (বিশ্বাত্মা) সৃষ্ট--- বিভিন্ন চেতন স্তরের চেতনা যুক্ত, বিভিন্ন আকার ও প্রকারের দেহ ও মনরূপ 'হার্ডওয়্যার' ও 'সফ্টওয়্যার' সম্পন্ন যৌগ জৈব যন্ত্রবিশেষ। যার মধ্যে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মতোই ঈশ্বরের নির্দেশ অন্তর্গ্রথিত করা আছে। জীব যা কিছু করে--- সেই নির্দেশ বা প্রোগ্রাম অনুযায়ী সে কাজ করে থাকে। জাগতিকব্যবস্থা এবং জাগতিক ঘটনা পরম্পরা, আর জগতে জীবের অবস্থান অর্থাৎ পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং জীবের দেহ ও মনের অবস্থা সহ অন্তর্নিহিত প্রোগ্রাম বা নির্দেশের ভিত্তিতে জীবের কর্ম সংঘটিত হয়। আমাদের মন-সফট্ওয়ারে ঈশ্বর কৃত প্রোগ্রামের বিশেষত্ব হলো, মন ওই প্রোগ্রামের ভিত্তিতে--- নিজেকে নিজে এবং অপরের দ্বারাও প্রোগ্রামড্ করতে এবং হতে পারে।
অনেক মানুষই তলিয়ে ভাবতে চায় না, যে যা বলে, তা-ই সে বিশ্বাস করে। পূর্বজন্ম এবং পূর্বজন্মের কর্মফল পরবর্তী জন্মে ভোগ করা, ---তেমনই একটি অন্ধ-বিশ্বাস। পূর্বজন্ম বলে যে কিছু নেই, ---সে সম্পর্কে 'মহাবাদ' গ্রন্থে বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। আর, পূর্বজন্ম না থাকলে--- পূর্বজন্মের কর্মফল ভোগ করার কথাই আসে না। তবুও, দৃঢ়মূল অন্ধ-বিশ্বাস এমনই একটা 'প্রোগ্রাম' বা সংস্কার--- যে যুক্তির ধার ধারে না।
মানুষ আংশিক জ্ঞান ও চেতনা সম্পন্ন--- সচেতন ও অবচেতন মনের অধিকারী। তাই সে নানা দোষ-গুণে ভরা। সুকর্ম--- কুকর্ম করা একমাত্র মানুষ নামক জীবের পক্ষেই সম্ভব। তবে, মনুষ্যসমাজে তার দোষ-গুণের বিচার হলেও, ঈশ্বর বা জাগতিক-ব্যবস্থার কাছে সে কিন্তু তার কর্মের জন্য মোটেও দায়ী নয়। মানুষ যা কিছু করে--- সবই সে করতে বাধ্য হয়। তার স্বতন্ত্র কর্মক্ষমতা বলে কিছু নেই। মানুষ যন্ত্রবৎ কর্ম করে যায়। স্বল্প জ্ঞান ও চেতনার কারণে সে ভাবে, ---'আমিই করছি'। আসলে, এই জগতে প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন কর্ম ও অবস্থার জন্য দায়ী হলো--- ভাগ্য।
সংক্ষেপে, ভাগ্য হলো--- পূর্বনির্ধারিতভাবে সমস্ত জগতব্যাপি সংঘটিত--- পরম্পরাগত ঘটনাপ্রবাহ এবং তার কারণ। প্রতিটি ঘটনা তার পরবর্তী পরম্পরাগত ঘটনার আপাত কারণ। কখন--- কোথায়--- কী ঘটবে---, সবই সুনির্দিষ্ট হয়ে আছে--- সমস্ত জাগতিক ঘটনা অর্থাৎ জগত সৃষ্টির একেবারে শুরুতেই। ---এরই নাম ভাগ্য ('ভাগ্য' প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)। এই ভাগ্যকে ভালোভাবে জানতে পারলেই, আমাদের ভিন্ন ভিন্ন কর্ম ও অবস্থা এবং অবস্থানের কারণ বোঝা যাবে। জীবের যাবতীয় কার্যকলাপ--- সবই ভাগ্য নির্ধারিত। আমরা কেউই জাগতিক ঘটনাপ্রবাহের বাইরে নই। ভাগ্য আমাদের ভিতরে--বাহিরে, জ্ঞাতে--অজ্ঞাতে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দিক থেকে ক্রিয়াশীল। আমাদের চিন্তাভাবনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছাসহ আমাদের সমস্ত কার্যকলাপ ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমাদের অস্তিত্বও ভাগ্যের দান।
এই ভাগ্য--- এই পূর্বনির্ধারিত ঘটনা কিন্তু আকস্মিক বা অযৌক্তিক কিছু নয়। কার্য-কারণের পথ ধরেই--- জগতের প্রতিটি ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। স্বল্প জ্ঞান ও চেতনার কারণে সে সমস্ত আমাদের বোধগম্য হয়না। আর, এসবের পিছনে কোন নিয়ন্তা বা নিয়ন্ত্রক সত্তাও নেই। যা কিছু ঘটছে প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ঘটে চলেছে।
পূর্বজন্মের কর্মফল না থাকলেও, পূর্বপুরুষদের কর্মফল অনেকাংশেই আমাদের ভোগ করতে হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে, নিজের এবং সমসাময়িক মানুষ এবং বিগত প্রজন্মের অপরাপর মানুষের কর্মফলও কম-বেশি আমরা আমাদের জীবদ্দশাতেই ভোগ করে থাকি। জাগতিক ক্ষেত্রে, সুকর্ম করলেই যে সব সময় এর সুফল অথবা জাগতিক সুখ লাভ হবে, আর কুকর্ম করলেই দুঃখ কষ্ট বা কুফল ভোগ করতে হবে, এইরকম অতি সরল হিসেবে জগত-সংসার চলে না। ভালো-মন্দ--- কম-বেশি কিছু না কিছু ফল তো আমরা পেয়েই থাকি। তবে সবসময়ই যে তা' স্পষ্ট বোঝা যাবে, এমন নয়। জাগতিক কর্মের ফলে আধ্যাত্মিক উন্নতি অবশ্যই ঘটে থাকে। ---তা' সে সুকর্মই হোক আর কুকর্মই হোক। কর্মের মধ্য দিয়ে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভ এবং তার পরিণতিতে চেতনা লাভই হলো আধ্যাত্মিক উন্নতি।
তাছাড়া, সুকর্ম বলতে ঠিক কী বোঝায়, বাস্তবিকই তা' সুকর্ম কি না, এবং তার মধ্যে কোনো দোষ-ত্রুটি আছে কি না, কর্ম কারকের শারীরিক--- মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-পরিস্থিতি, চারিপাশের মানুষ তাকে এবং তার কর্মকে কিভাবে দেখছে, স্থান-কাল-পাত্র, উচিত-অনুচিত প্রভৃতি বিভিন্ন অবস্থা ও ঘটনা সাপেক্ষে এক-একটি ফললাভ হয়ে থাকে। সমস্ত জগতব্যাপি অসংখ্য ঘটনার যোগ--বিয়োগ--গুণ--ভাগ প্রভৃতির জটিল টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে এক-একটি ঘটনার সৃষ্টি হয়। আমাদের সোজাসাপ্টা হিসেবে--- একে মিলানো সম্ভব হয় না সব সময়। সুকর্মের মতো কুকর্মের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটে থাকে।
মানুষের ক্ষেত্রে সুকর্ম-- কুকর্মের মোটামুটি বিচার করা গেলেও, মানবেতর নিম্নচেতন-স্তরের জীবদের ক্ষেত্রে সুকর্ম--- কুকর্মের বিচার হবে কিভাবে? কীট-চেতন, সরিসৃপ-চেতন বা পশু-চেতন স্তরের জীবদের পক্ষে কি সুকর্ম বা কুকর্ম করা সম্ভব? এইসব নিম্ন-চেতন-স্তরের জীবদের মধ্যে সচেতন মন নেই। নেই বিবেকের শাসন। এরা যা কিছু করে, অত্যন্ত সহজ --- সরল প্রোগ্রাম বা প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত হয়েই তা' করে থাকে। এরা তেমন ভেবেচিন্তে কিছু করে না। এদের কর্ম ধারাকে তাই ওভাবে ভাগ করা চলে না। এদের কর্মের জন্যেও এরা কোনভাবেই দায়ী হতে পারে না।
কিন্তু যখন দেখা যায়, একটি কীট বা একটি পশু খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে, আর ঘটনাচক্রে অপর একটি কীট বা পশু ভালোভাবে জীবন অতিবাহিত করছে, ---পূর্বজন্মের কর্মফলের 'সূত্র' কি তখন তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে? ---হবে না। ঘটনাচক্রে বা ঘটনাক্রমেই কেউ ভালো--- কেউ মন্দ, কেউ ভালো স্থান--- কেউ মন্দ স্থান লাভ করেছে। ভিতর থেকে মেনে নেওয়া শক্ত হলেও, এটাই জগতের (অপ্রিয়) সত্য!
কর্ম ও কর্মফল (তৃতীয় পর্ব)
~মহর্ষি মহামানস
'নিষ্কাম কর্ম' নিয়ে অনেকবারই আমাকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এখানে 'কর্ম ও কর্মফল' প্রসঙ্গে সে সম্পর্কে কিছু বলবো। 'নিষ্কাম কর্ম' বলতে বোঝায়--- কাম বা কামনাশূণ্য কর্ম। কামনা কথাটির অর্থ ইচ্ছাও হয়, আবার প্রত্যাশাও হয়। তবে 'নিষ্কাম কর্ম' কথাটি অনৈচ্ছিক কর্ম বা ইচ্ছা বিরহিত কর্ম হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা যায় না। সাধারণত এই কথাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে--- প্রত্যাশা বিহীন কর্ম অর্থাৎ কোনো ফলের আশা না করেই কৃত হয় যে কর্ম।
আশা বা কামনা-ই যেহেতু দুঃখ-কষ্টের অন্যতম কারণ, তাই নিষ্কাম কর্মকে জাগতিক দুঃখ-কষ্টসহ মোহ-মায়া থেকে মুক্ত হওয়ার এবং মুক্ত থাকার এক অতি সরলীকৃত উপায় হিসেবে উপদিষ্ট হয়ে থাকে কোথাও কোথাও। কিন্তু বেঁচে থাকার স্বার্থেই--- আমাদের মধ্যে অন্তর্গ্রথিত প্রোগ্রামের তাড়নাতেই--- আমাদেরকে অনেক কিছু কামনা করতে হয়, কামনা করতে বাধ্য হতে হয়। একমাত্র অসাধারণ ও অস্বাভাবিক ক্ষেত্র ছাড়া, কোনোরূপ প্রত্যাশাবিহীনভাবে অর্থাৎ কর্মফলের আশা ছাড়াই--- উদ্দেশ্যহীনভাবে সাধারণত কোনো কর্ম সংঘটিত হতে দেখা যায় না। কর্মের জন্য কর্ম, কর্মকে ভালবেসে কর্ম, কর্ম করতে ভালোলাগে--- তা-ই কর্ম, এছাড়া, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা বা বিপদ থেকে রেহাই পাওয়ার বা শান্তি পাওয়ার জন্যেও অনেক কর্ম আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে প্রায়শই সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু এই কর্মগুলির ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো ফলপ্রাপ্তির আশা না থাকলেও, সূক্ষ্ম বা সূক্ষ্মভাবে এর মধ্যে--- ভালোলাগা -ভালোবাসা থাকে। অথবা শরীর এবং/ অথবা মনের আরাম-- সুখ কিছু না কিছু থাকেই।
ভালো লাগছেনা, আবার কোন উদ্দেশ্যও নেই, কোনো ফলপ্রাপ্তির আশাও নেই, অথচ কেউ ঐচ্ছিকভাবে কর্ম করে চলেছে, এটা কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক' সাধারণ চেতনাসম্পন্ন জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ যদি ক্রীতদাসের মতো কোনো শক্তি বা শক্তিমানের কাছে পরাভূত হয়ে--- অনিচ্ছা সত্বেও, ভালো না লাগা সত্ত্বেও, বাধ্য হয়ে কোন কর্ম সম্পাদন করতে থাকে, ---সেক্ষেত্রে, সে প্রাণ বাঁচানোর জন্য, শাস্তি বা মৃত্যু থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই তা' করে। তার সে কর্মও নিষ্কাম কর্ম নয়। তাই, 'নিষ্কাম কর্ম' যেন 'সোনার পাথরের বাটির' মতোই একটা কিছু।
ঈশ্বর তথা জাগতিক ব্যবস্থা--- জীবের চেতনা বিকাশের উদ্দেশ্যে, জীবকে কর্মে প্রবৃত্ত করার জন্য--- প্রধানত দুটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তার একটি হলো--- কর্মের মধ্য দিয়ে সুখকর ও সার্থানুগ ফল লাভের ব্যবস্থা। আর অপরটি হলো--- কর্মের মধ্য দিয়ে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা--- বিপদ, ক্ষয়ক্ষতি প্রভৃতি থেকে রেহাই বা মুক্তি পাওয়ার ব্যবস্থা। উভয় ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু ফল লাভের ব্যবস্থা রয়েছে। মানুষ কর্মফলের আশা না করলে, মনুষ্যকৃত এই বিচিত্র কর্মময় জগৎ সৃষ্টিই হতো না। মানুষের চেতনার বিকাশও ঘটতো না সেভাবে। আর তা' ঈশ্বর বা বিশ্বাত্মার অভিপ্রায়-ও নয়। যথেষ্ট চেতনার বিকাশ না ঘটা পর্যন্ত--- জীবকে সকাম কর্মপথে চালনা করাই ঈশ্বরের ইচ্ছা।
এই জগতে কারণ ছাড়া কিছু ঘটে না। আর, চেতনা ও মন সম্পন্ন কোনো সত্তা-ই এখানে উদ্দেশ্য ছাড়া কিছু করে না। আদি-সত্তা (পরমাত্মা) থেকে ঈশ্বর (বিশ্বাত্মা) তথা জাগতিক-ব্যবস্থা--- কেউই উদ্দেশ্য বিহীন নয়। কোনো লক্ষ্য ছাড়া--- কোনোরূপ স্বার্থ ছাড়া, কোনো অভিপ্রায় ছাড়া, কেউ কিছু করে না। অংশানুক্রমে ঈশ্বর সৃষ্ট জীবও--- তাদের মন-সফট্ওয়ারে অন্তর্গ্রথিত প্রোগ্রাম বা নির্দেশ মতো, কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কর্ম ক'রে চলেছে। আর, যেখানেই উদ্দেশ্য আছে--- উদ্দেশ্য সিদ্ধির বাসনাও আছে সেখানে।
কামজ সন্তান--- সম্ভোগজাত বা কামনা থেকে জন্ম নেওয়া সন্তান যদি নিষ্কাম হয়, বুঝতে হবে--- সে অতি উচ্চ চেতনস্তরের মানুষ। আর নয় তো সে অসুস্থ। উচ্চ চেতনাসম্পন্ন জ্ঞানী মানুষ জানে, এখানে যা ঘটার--- ঠিক তা-ই ঘটে চলছে। সবই পূর্বনির্ধারিত মতো যথাস্থানে--- যথাসময়ে--- যথাযথভাবে ঘটে চলেছে। সে যা করছে, সে সবই পূর্বনির্ধারিতভাবে তাকে করতে হচ্ছে--- করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। তার কর্মের ফলও পূর্বনির্দিষ্ট। তাছাড়া, অজ্ঞান-অন্ধত্বের কারণে সৃষ্ট অনেক চাওয়া পাওয়াই আসলে মোহ-মায়ার খেলা। উচ্চ চেতনার কারণে ব্যক্তি--- মোহ-মায়া অজ্ঞান-অন্ধত্ব থেকে অনেকটাই মুক্ত হওয়ার ফলে, এবং তার জ্ঞান পাকাপোক্ত হওয়ার ফলে, সে তখন অনেকটাই নিস্পৃহ-- নিরাসক্ত-- উদাসীনভাবে কর্ম করে চলে। পূর্ণ জ্ঞান--- পূর্ণ চেতনা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত, পুরোপুরি কামনা-বাসনা আসক্তি শূন্য হওয়া সম্ভব হয় না। আর এই মানব জীবনেই পূর্ণ বিকাশলাভ-ও সম্ভব নয়।
পূর্ণ জ্ঞান পূর্ণ চেতনার জন্য আমাদেরকে মানবোত্তর জীবনে ক্রমশ উচ্চ চেতন-স্তরগুলি পার হতে হবে। উচ্চ মানব-চেতনায় যা হয়ে থাকে, তা' হলো--- কামনার উগ্রতা অনেকটাই কমে গিয়ে, তা' ক্ষীন হয়ে আসে ক্রমশ। উদ্দেশ্য এবং উদ্দেশ্য সিদ্ধির কামনা--- ফল লাভের আশা-আকাঙ্ক্ষা ---সবই থাকে, তবে তা' বেশ কম এবং নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় থাকে। আসলে, চেতনার সেই স্তরে--- যা ঘটার ঠিক তাই ঘটে থাকে। তেমনি, নিম্ন চেতন-স্তরগুলিতেও, যেখানে যেমনটি ঘটার, ঠিক ঠিক ঘটে চলেছে। শত উপদেশ দিয়েও নিম্ন চেতনস্তরের মানুষকে উচ্চ চেতনস্তরের আচরণে অভ্যস্ত করে তোলা যাবে না। উচ্চ চেতন স্তরের মানুষের পক্ষে যে আচরণ স্বাভাবিক, নিম্ন চেতন-স্তরের মানুষের পক্ষে তা-ই অস্বাভাবিক। যে ব্যক্তি মানুষকে নিষ্কাম-কর্ম করার উপদেশ দিচ্ছে, দেখা যাবে, সে নিজেই তা' করে উঠতে পারছে না।।
©somewhere in net ltd.