নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মীর্জা প্রীয়ম

মীর্জা প্রীয়ম › বিস্তারিত পোস্টঃ

গণসঙ্গীতের বিবর্তনের ধারা

১৮ ই এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৫:৩৫

গানের ভেতর দিয়ে বাঙালীর সৃজনশীলতার যে বিপুল বিকাশ, তার স্বরূপকে সংক্ষেপে বিবৃত করা সম্ভব নয়। সুদীর্ঘকাল ধরে বৃহৎ প্রেক্ষাপটে ও বৈচিত্রপূর্ণ উপায়ে বাংলাগানের বিকাশ ঘটেছে। মানুষ যখন থেকে সংগ্রাম শুরু করেছে শোষণের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, তখন থেকেই তার প্রতিবাদ উঠে এসেছে তার গানে, কবিতায়, সুরে এবং নানা শিল্প মাধ্যেমে। বাংলা ভাষাভাষি মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস যতো দিনের তার গণসংগ্রামের গানও ততো দিনের।

মানুষের যে কয়টি হৃদয়বৃত্তি তার সৃজনশীল চেতনাকে প্রবুদ্ধ করে দেশপ্রেম তার অন্যতম। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বাংলা শিলীত সংগীতে দেশপ্রেমের গভীর অনুভব রূপায়িত হতে শুরু করে এবং ক্রমে কয়েকটি কাল পর্যায়ে এই সঙ্গীতের ধারা বিপুল রূপে পল্লবিত হয়ে ওঠে। স্বদেশ সঙ্গীত, স্বদেশী সঙ্গীত, স্বদেশী গান, মুক্তির গান, অধিকারের গান, জাগরণের গান, গণসংগ্রামের গান, দেশাত্মবোধক গান প্রভৃতি নানা নামে এই দেশপ্রেমমূলক সঙ্গীতধারা আখ্যায়িত হয়েছে। এক সময় স্বদেশীগান কথাটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। বর্তমানকলে দেশাত্মবোধক গান ও গণসঙ্গীত কথাটি বহুল ব্যবহৃত। সংক্ষেপে দেশাত্মবোধক ও গণসঙ্গীতের সংজ্ঞা দেয়া যেতে পারে এই বলে যে, যে গানে স্বদেশের প্রতি বন্দনা ও অনুরাগ প্রকাশ করা হয় এবং স্বদেশ ও স্বদেশের মানুষের দুঃখ-দৈন্য ও সার্বিক মুক্তির জন্য দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করা হয় তারই নাম গণসঙ্গীত বা দেশাত্মবোধক গান। বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেম নির্ভর সাহিত্য রচনার উদ্ভবের কারণের মূলে প্রধান ও অপ্রধান কয়েকটি কারণ আছে। প্রধান কারণটি সাহিত্যিক নয়-রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ। ইংরেজ শাসন এবং পরাধীনতার বোধ এই দু’টি বোধের সম্মিলনের ফলে আমাদের দেশপ্রেমের বোধ পরিপুষ্টি লাভ করে এবং সাহিত্যে নানা ভাবে সেই বোধটি উন্মেষিত হতে থাকে। দেশপ্রেম নির্ভর সাহিত্য বা সাহিত্যে দেশপ্রেমের স্থান মূলতঃ নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল পরাধীনতার বোধ থেকে।

দেশপ্রেমের গান রচনা শুরু হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশক থেকে, আর রাজনৈতিক আন্দোলনের গতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গানগুলিরও নানা পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলা গণসংগ্রামের গানের প্রধান উৎস বাঙালীর পরাধীনতা বোধ। প্রকৃত পক্ষে সব ভাষাতেই গণসঙ্গীত ও স্বদেশীগান রচনার পেছনে ঠিক পরাধীনতা না হলেও, দেশের বিপন্নতা বা বিপর্যয়ের একটি নিগুঢ় যোগ আছে। কারণ দেশ সম্পর্কে জাতির ভাবনা ও উৎকন্ঠার গভীরতা ও ব্যাপকতা সব চেয়ে বেশী ফুটে ওঠে বিপর্যয়ে বা বিপর্যয়ের সম্ভাবনার মধ্যে। পরাধীনতার বেদনা, স্বধীনতার আকাঙ্খা, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম ও আত্মৎসর্গের আহ্বান, ইংরেজদের শোষণ, দেশের আর্থিক দূরবস্থা, স্বাবলম্বনের কামনা, বিদেশী পন্য বর্জন, স্বদেশী দ্রব্যের পৃষ্ঠপোষকতা, পূর্বগৌরব চৈতন্য, জন্মধন্যতা বোধ, মাতৃভূমির নৈসর্গিক শোভার বর্ণনা, মাতৃভাষা প্রীতি, সাম্প্রদায়িক প্রীতি, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আকুতি-দেশবোধ সম্পৃক্ত এসব বিষয় অবলম্বনে এই বহুশাখায়িত সঙ্গীতধারা পরিপুষ্টি ও সমৃদ্ধি লাভ করে।

এই সঙ্গীত প্রবাহের মূল অনুপ্রেরণা ছিল রাজনৈতিক। ইংরেজ বশ্যতা ও ইংরেজ শাসনের সংঘর্ষে এসে এই রাজনৈতিক প্রেরণার উৎপত্তি ঘটে; ক্রমে দেশোন্নতি ও সামগ্রিক সামাজিক মুক্তির নানা কামনা এসে এর সাথে যুক্ত হয়।

ডিরোজিও-যিনি ভারতবর্ষকে নিয়ে প্রথম কবিতা লেখেন। কবিতায় তিনি লুপ্তগৌরব, বেদনামলিন ভারতবর্ষের বন্দনা করেন। "My country ! In thy days of glory post, A beauteous halo circles round thy brow, And worshiped as a deity thou wast..." এই কবিতাটি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালীর স্বদেশ চেতনার স্বরূপটি তুলে ধরেছে। ভারতবর্ষের মানুষকে তিনি স্বদেশ নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছে। দেশমাতৃকার বর্তমান ঐশ্বর্য, গৌরব সম্পর্কে গৌরববোধ, শীর্ষোন্নত দেশের শক্তি ও সার্মথ্যের উপলব্ধি তাই বাংলা স্বদেশ বিষয়ক সাহিত্যের প্রাথমিক যুগের রচনায় ততটা উপজীব্য ওয়ে ওঠেনি, যতটা প্রকাশ পেয়েছিল পরাধীন, হতশ্রী, লুপ্তগৌরব, বেদনামলিন স্বদেশ বন্দনায়। ১৮২৭ সালে প্রকাশিত ডিরোজিও-র এই কবিতাটিকে ভারতবর্ষের প্রথম দেশাত্মবোধক কবিতা রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। গভীর জাতীয় অনুভূতি স্বদেশিকতার বোধকে আরও তীব্র করে তুলেছিলো। ক্রমে কবি ও গীতিকার স্বদেশিক প্রেরণার গান রচনা করেন এবং সবার মিলিত প্রয়াসে বাংলা দেশপ্রেম ও গণসংগ্রামের গানের ধারাটি গড়ে ওঠে। তবে একক ঘটনা হিসেবে বাংলা দেশাত্মবোধক গানের বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যান্ত প্রভাব বিস্তার করেছিল হিন্দুমেলা নামে একটি স্বদেশিক কর্মসূচি। ১২৭৩ সালের চৈত্রসংক্রান্তির দিন বেলগাছিয়ায় এই মেলার উদ্বোধন হয়। ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলে ভক্তির সঙ্গে উপলব্ধির চেষ্টা সেই প্রথম। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সময় বিখ্যাত জাতীয় সঙ্গীত “মিলে সবে ভারত সন্তান, একতান একপ্রাণ, গাও ভারতের যশোগান...” রচনা করেন। বাংলা দেশাত্মবোধক গানের বিবর্তনের ধারায় এই গানটির গুরুত্ব অসাধারণ। বাংলা তথা ভারতবর্ষে রচিত এটিই প্রথম উল্লেখযোগ্য জাতীয় সঙ্গীত।

এই গানের মধ্যে দিয়ে যে স্বদেশানুরাগের অঙ্কুরোদ্গম হচ্ছিল; স্বদেশের অস্তিত্ব সম্পর্কে উপলব্ধি; দেশের দুঃখ-দুর্দশায় বেদনাবোধ; কর্ম ও চিন্তার ক্ষেত্রে নবজাগ্রত প্রেরণা ইত্যাদী নানা বৈশিষ্ঠের সমন্বয়ে তা আরও পরিণত রূপ লাভ করেছিল পরবর্তী পর্যায়ে। তৎকালীন জাতীয়তাবোধের স্ফূরণের অন্যতম মাধ্যম এবং জাতীয়তাবোধের প্রকাশ হল এযুগে রচিত বিভিন্ন দেশাত্মবোধক ও গণসংগ্রামের গানগুলিতে।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বঙ্গবিভাগকে কেন্দ্র করে সারা বাংলায় যে প্রতিবাদের ঝড় হঠে তারই প্রেক্ষাপটে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে রচনা করেন “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসী, চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি...” বিখ্যাত গানটি। এই নান্দনিক গানের মধ্যে দিয়েই বাংলা দেশগানের পূর্ণতাপ্রাপ্তি। পরবর্তীকালে দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, মুকুন্দ দাস, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস সহ বাংলার কবি সাহিত্যিকেরা ছড়িয়ে দিয়েছিল স্বদেশ চেতনার বীজ কবিতায়, গানে, নাটকে। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে এসে সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রভাবে গণসঙ্গীতে ব্যাপক স্ফূরণ ঘটে। নজরুলের লেখা “জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত, জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত...”, এই গানটিই বাংলাভাষায় রচিত প্রথম গণসঙ্গীত। দেশ চেতনা আর শ্রেণী চেতনার যুগল সম্মিলনে চল্লিশের দশকের বাংলা গণসঙ্গীত গয়ে ওঠে এক অনবাদ্য রতœভান্ডার। পঞ্চাশের দশকে মহান ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকে গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের দশকের প্রারম্ভেই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং নব্বই দশকে স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান এসবের পেছনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে দেশগান আর গণসঙ্গীত। সংগ্রামের আবেগে, মুক্তির আকাঙ্খায় এ সময় যেন বান ডেকেছিল সৃজনশীলতায়। রচিত হয়েছিল অজস্র গণসঙ্গীত, জাগরণের গান, মুক্তির গান, অধিকারের গান, ঐক্যের-সাম্যের গান, দেশপ্রেমের গান। জেগে উঠেছিল জাতি। অর্জন করেছিল বিজয়। ভাষা আন্দোলন আর মহান মুক্তিযুদ্ধ ধারণ করেছিল আমাদের দেশগান আর গণসঙ্গীতের সমগ্র ঐতিহ্যকে। তাই ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি দেশ গানই আজ স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।



-মির্জা রানা

সম্পাদক, বাঙলাদেশ লেখক শিবির

পাবনা শাখা



মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৩:৩৯

দৃষ্টির সীমানায় বলেছেন: সুন্দর ...।।

ধন্যবাদ ......শুভ কামনা রইলো

২| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:৩৬

চাঁদগাজী বলেছেন:



সবকিছু বদলায়ে যায়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.