নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

মি. বিকেল

আমি মোঃ মেহেদি হাসান, কলম নাম মি. বিকেল।

মি. বিকেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

নিয়মানুবর্তিতা: শৃঙ্খলার ওয়াদা ও সমাজের সংকট

২৩ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১০:৩৬



নিয়মানুবর্তিতা (Discipline) একটি এমন ধারণা যা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে—ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সমাজের বৃহত্তর কাঠামো পর্যন্ত। কিন্তু এটি আসলে কী?

নিয়মানুবর্তিতা বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট পরিকাঠামো বা নিয়মকানুন মেনে চলার প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যা সমাজ, পরিবার বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা নির্ধারিত হয়। এটি ব্যক্তিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে এবং একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই শৃঙ্খলা কি সবসময় আমাদের উন্নত করে, নাকি কখনো কখনো এটি শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়?

কোনো ব্যক্তি অনেক বেশি নিয়মানুবর্তী হলে আমরা কী বুঝি? যখন আমরা বলি কেউ “অনেক বেশি নিয়মানুবর্তী (Disciplined)”, তখন সাধারণত আমরা বুঝি যে, সে ব্যক্তি সময়ানুবর্তী, নিয়ম মেনে চলে, এবং তার কাজে একটি সুস্পষ্ট শৃঙ্খলা বজায় রাখে। উদাহরণস্বরূপ, একজন নিয়মানুবর্তী ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শুরু করে, এবং তার দায়িত্বগুলো পূরণে অটল থাকে। আমাদের সমাজে এটি একটি ইতিবাচক গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এই নিয়মানুবর্তিতা যদি বাধ্যতামূলক হয় বা অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, তবে তা কি সত্যিই ইতিবাচক থাকে?

নিয়মানুবর্তী হওয়া কি একটি নির্দিষ্ট পরিকাঠামো? হ্যাঁ, নিয়মানুবর্তী হওয়া মানে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট পরিকাঠামো মেনে চলা। যেমন, একটি গানে যদি কন্ঠ, কথা ও শব্দ একটি নির্দিষ্ট ছন্দ ও পরিকাঠামো অনুসরণ করে, তবে তা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু যদি তা পরিকাঠামো ভেঙে ফেলে, তবে তা শব্দদূষণে পরিণত হয়। বিখ্যাত গায়ক অরিজিৎ সিংয়ের গান এবং হিরো আলমের গানের মধ্যে পার্থক্য এখানেই—একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিকাঠামোর মধ্যে থাকে, অন্যটি তা থেকে বিচ্যুত হয়।

সমাজেও আমরা একটি নির্দিষ্ট নিয়মের কাঠামো মেনে চলি, যা আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এই পরিকাঠামো কি সবসময় ন্যায্য বা উপকারী? নিয়মানুবর্তিতা বনাম উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে পার্থক্য কী?

কবি সলিল চৌধুরী তাঁর বিখ্যাত কবিতা শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলা-য় লিখেছেন:

“বিশৃঙ্খলা কথাটা কিন্তু শৃঙ্খলার ঠিক বিপরীত নয়
শৃঙ্খল থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়,
ওর মধ্যেও শৃঙ্খলের একটা ঝনঝন আছে
তবে সেটা বাজে বেতালায়।”

এখানে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে বিশৃঙ্খলা (উচ্ছৃঙ্খলতা) এবং শৃঙ্খলা (নিয়মানুবর্তিতা) একেবারে বিপরীত নয়। বিশৃঙ্খলার মধ্যেও এক ধরনের শৃঙ্খলা থাকে, তবে তা বেতালা বা অগোছালো। উদাহরণস্বরূপ, একটি গান যদি তার পরিকাঠামো মেনে চলে, তবে তা শৃঙ্খলাবদ্ধ; আর যদি না চলে, তবে তা বিশৃঙ্খল। কিন্তু এই বিশৃঙ্খলাও পুরোপুরি শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত নয়—এটি শৃঙ্খলারই একটি বিকৃত রূপ। সমাজে নিয়মানুবর্তিতা আমাদের শৃঙ্খলার প্রতিশ্রুতি দেয়, যেখানে উচ্ছৃঙ্খলতা আমাদের বিরক্তি ও অস্থিরতার দিকে নিয়ে যায়।

নিয়মানুবর্তিতার সংজ্ঞা: দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি: নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে বিভিন্ন দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছেন। এখানে ১০ জনের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:

১. মিশেল ফুকো (Michel Foucault): শৃঙ্খলা হলো সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি প্রক্রিয়া। স্কুল, কারাগার বা হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং একটি নিরীক্ষণমূলক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

২. ফ্রিডরিখ নিচে (Friedrich Nietzsche): শৃঙ্খলা হলো ইচ্ছাশক্তি অর্জনের মাধ্যম, যা ব্যক্তিকে দুর্বলতা কাটিয়ে আত্ম-উন্নয়নের পথে নিয়ে যায়।

৩. বি.এফ. স্কিনার (B.F. Skinner): শৃঙ্খলা হলো পুরস্কার ও শাস্তির মাধ্যমে আচরণ নিয়ন্ত্রণ। পরিবেশগত প্রেরণা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৪. সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud): শৃঙ্খলা হলো অহং এবং পরাহং-এর মধ্যে ভারসাম্য, যা জন্মগত কামনাকে নিয়ন্ত্রণ করে সমাজসিদ্ধ আচরণ শেখায়।

৫. আলফ্রেড অ্যাডলার (Alfred Adler): শৃঙ্খলা হলো সামাজিক সুবিধা ও ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্ব-প্রণোদিত প্রচেষ্টা।

৬. আব্রাহাম মাসলো (Abraham Maslow): শৃঙ্খলা হলো আত্ম-প্রকাশের পথে একটি মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা, যা নিরাপত্তা ও সম্মানের স্তরে পৌঁছাতে সহায়তা করে।

৭. জন লক (John Locke): শৃঙ্খলা হলো শিক্ষা ও অভ্যাসের ফল, যা যুক্তিসঙ্গত ও নৈতিক আচরণ গঠন করে।

৮. অ্যারিস্টটল (Aristotle): শৃঙ্খলা হলো সদগুণ অর্জনের জন্য নিয়মিত অভ্যাস, যা পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে গঠিত হয়।

৯. কার্ল ইয়াং (Carl Jung): শৃঙ্খলা হলো ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ের জন্য অপরিহার্য, যা অচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করে।

১০. উইলিয়াম জেমস (William James): শৃঙ্খলা হলো ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার, যা অভ্যাস গঠন ও লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক।

আমাদের সমাজ আমাদেরকে নিয়মানুবর্তী হওয়ার উপদেশ দেয়, কিন্তু এই শৃঙ্খলা সবসময় উন্নয়নের পথে নিয়ে যায় না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, নিয়মানুবর্তিতার নামে প্রায়ই শোষণ ও সংকট দেখা যায়।

যেমন:
১. বিদ্যালয়ে: ভিকারুননিসা স্কুলে চুলের দৈর্ঘ্য নিয়ে কঠোর নিয়ম শিক্ষার্থীদের উপর চাপ সৃষ্টি করে।
২. পরিবারে: UNICEF-এর তথ্য অনুযায়ী, ৯০% শিশু বাড়িতে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়, যা শৃঙ্খলার নামে প্রয়োগ করা হয়।
৩. অর্থনীতিতে: ব্যাংকিং সেক্টরে ৩ লক্ষ ৭৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ দেখায় যে শৃঙ্খলা শক্তিশালীদের জন্য নমনীয়, কিন্তু দুর্বলদের জন্য কঠোর।

এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে নিয়মানুবর্তিতা কখনো কখনো ক্ষমতার হাতিয়ারে পরিণত হয়, যা সমাজের নিষ্পেষিত শ্রেণিকে দমিয়ে রাখে। নিয়মানুবর্তিতা আমাদের জীবনে শৃঙ্খলা আনে, কিন্তু এর অপব্যবহার সমাজে সংকট সৃষ্টি করে। সলিল চৌধুরীর কবিতার মতো, শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলা একই মুদ্রার দুই পিঠ।

প্রশ্ন হলো, আমরা কোন শৃঙ্খলা চাই? যে শৃঙ্খলা আমাদের উন্নত করবে, নাকি যে শৃঙ্খলা আমাদের দমিয়ে রাখবে? আমাদের সমাজের উচিত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা।

ছবি: Grok-3 Ai

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লেখা। পড়তে ভালো লাগলো।

২৭ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ২:৩৮

মি. বিকেল বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.