![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভারতীয় একজন বিখ্যাত কমেডিয়ান জাকির খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “দুজন ড্রাইভার যখন গাড়ি চালান তখন তারা একে অন্যের চোখের দিকে একবার তাকান। এরপর নিশ্চিন্তে যে যার সাইডে চলে যান এবং কোন দূর্ঘটনা ছাড়াই।” এই উক্তির মাধ্যমে তিনি ভারতীয় সমাজে অবিশ্বাস ও বিশ্বাসের মধ্যে একটি তূলনামূলক আলোচনা আমাদের সামনে আনেন। এবং, উপরোক্ত উক্তির মাধ্যমে আমরা অবগত হই, যদি বিশ্বাস না থাকতো তাহলে যানজটের দুনিয়ায় (ভারত ও বাংলাদেশ) আমাদের প্রচুর দূর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হত।
আরো একটু খেয়াল করুন, যেহেতু বাংলাদেশের মত দেশে অধিকাংশ জায়গায় ভাঙ্গা রাস্তাঘাট, ট্রাফিক জ্যাম লেগেই থাকে, নির্দিষ্ট কোন গাড়ির গতির দিক নির্দেশনা কেউ-ই ঠিকঠাক পালন করেন না, এ সমস্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভালো নয় সেহেতু রোজ রোজ একটি বিশাল অঙ্কের দূর্ঘটনা এখানে ঘটবার কথা।
একেবারে যে কিছুই হয় না আমি কিন্তু আবার সেটাও বলার চেষ্টা করছি না। কিন্তু এই অনিয়মে যে পরিমাণ দূর্ঘটনা এখানে ঘটতে পারতো সে পরিমাণ দূর্ঘটনা কিন্তু ঘটে না। এখানে একজন ড্রাইভার যখন রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হোন এরপর তিনি যখন আরেকটি গাড়িকে কাটিয়ে যাচ্ছেন তখন শুধুমাত্র এই দুইজন ড্রাইভার একে অন্যের দিকে তাকান এবং বুঝে যান যে, কীভাবে বা কোনদিকে গেলে সমস্যা হবে না, দূর্ঘটনা ঘটবে না।
এই গল্পে এক ড্রাইভার জানেন না অন্য ড্রাইভারের ধর্ম কি? জাত কি? বর্ণ কি? গায়ের রঙ কি? কোন বংশের? কতবড় ক্ষমতাবান? কে বেশি ধনী? সমাজে কে কোন শ্রেণীতে বসবাস করছেন? কে জুনিয়র বা কে সিনিয়র? — এসব প্রশ্নের কোন উত্তর তাদের কাছে নাই, তারা এসবের কিছুই জানেন না। ঠিক ঐ মুহুর্তে তারা দুজন স্রেফ এবং স্রেফ ড্রাইভার পরিচয়ে একে অন্যের সাথে আই-কন্টাক্ট করেন এবং সেভাবেই গাড়ি ঘুরিয়ে চলেন। রাস্তা খারাপ থাকলে কোন একজন এবং অবস্থা প্রেক্ষিতে দুজনেই গাড়ি থামান এবং এক এক করে রাস্তা পার হোন।
আমাদের দেশে সবাইকে গাড়ি চালানোর সময় বামদিক দিয়ে চলতে হয়। কোথায় ব্রেক কষা দরকার, কোথায় একটু ধীর গতিতে যাওয়া দরকার, কখন হর্ণ দেওয়া উচিত — সত্যি বলতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন বিশেষ কোনো ম্যানুয়াল নাই। আর থাকলেও তা যথেষ্ট নয়, অপ্রয়োজনীয়। বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে শুধুমাত্র একটি গাড়ির জন্য যতগুলো পেপারের প্রয়োজন হয় তা একটি বৈবাহিক সম্পর্কেও আমার জানা মতে প্রয়োজন হয় না। চৌদ্দ রকমের কাগজ উপস্থিত করা সত্ত্বেও আমরা ঐ পুলিশের হাতে মামলা খাই যারা ট্রাফিক ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না বা করতে চান না। অবশ্য এই বিষয়ে আলোচনা আরো বিস্তারিতভাবে অন্য কোন একদিন করা যেতে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কমেডিয়ান জাকির খান শুধুই কি বিশ্বাসের কথা বলেছিলেন? আমার মতে, না, তিনি শুধুমাত্র বিশ্বাসের কথা বলেননি। তিনি বলার চেষ্টা করেছেন, আমাদের সমাজে একটি অলিখিত আইন আছে, একটি অলিখিত চুক্তি আছে, একধরণের অলিখিত নিয়ম আছে। বাংলাদেশের এই ড্রাইভারদের বা চালকদের ক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতেই পারি যে, তাদের মধ্যে একটি অলিখিত চুক্তি আছে।
যে চুক্তি তারা জানেন, যে চুক্তি তারা মানেন এবং যে চুক্তির জন্য আরো বড় অঙ্কের দূর্ঘটনা থেকে প্রতিদিন অনেকগুলো প্রাণ বেঁচে যায়। চালক সমাজের কাছে একটি জনপ্রিয় শব্দ আছে, ‘ওস্তাদ’। আমার মতে, চালক সমাজের ‘ওস্তাদ’ হচ্ছেন ঐ ব্যক্তি যিনি গাড়ি সম্পর্কে ভালো জানেন এবং ঐ এলাকার ঐ নির্দিষ্ট চালক সমাজের মধ্যে সেরা চালক।
বর্তমান বাংলাদেশের চিত্র হলো, আমাদের সবাইকেই ড্রাইভিং শিখতে হচ্ছে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে খুবই সম্ভব ড্রাইভিং শেখাটা অপরিহার্য বা বেসিক একটি দক্ষতা মানা হবে। আর এখানে আরো বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ড্রাইভিং শেখানোর রাষ্ট্রীয় কিছু পরিকাঠামো বা প্রতিষ্ঠান থাকলেও তা অনেক দূর্বল। অন্তত ওঁদের দ্বারা ড্রাইভিং শিখে কোন গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামতে পারবেন না।
আমার মতে, রাষ্ট্রীয় পাঠশালার ড্রাইভিং শিখে নিজ বাড়ির আঙিনায় গাড়ি চালাতে পারবেন; রাস্তায় ভুলেও যাবেন না। ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, গাড়ির অস্বাভাবিক গতি, অনিয়ম ও রাস্তায় অনিয়ন্ত্রিত যানজট নিয়ে অন্য কোন একদিন আলোচনা করা যেতে পারে কিন্তু আপনারা কিছুটা হলেও এ বিষয়ে জানেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বহু দূর্ঘটনা ব্যক্তি উদ্যোগে রুখে দিয়েছেন; অন্তত চেষ্টা করেছেন।
এখানেই ঐ ‘ওস্তাদ’ গণ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। আমাদের ড্রাইভিং পাঠদানে অধিকাংশ ‘ওস্তাদ’রা হচ্ছেন অশিক্ষিত কিন্তু তাদের ড্রাইভিং করা ব্যক্তিগতভাবে আমি যতবার দেখি ততবার মুগ্ধ হই। ‘অভিজ্ঞতা’ বিষয়টির আসলেই কোন তুলনা হয় না। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, এই ওস্তাদগণ শুধু ড্রাইভিং শেখান না, তারা ঐ অলিখিত চুক্তিও খুব সুন্দরভাবে শেখান।
মানে হলো, আপনি বাংলাদেশের রাস্তায় ড্রাইভিং পারেন এটুকুই যথেষ্ট নয়। আপনি কোন গর্তে পরলে কীভাবে গাড়ি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখবেন সেটাও তারা বুঝিয়ে দেন। অপরিচিত রাস্তা হলে সেখানে গাড়ির গতি কেমন হওয়া উচিত সেটাও তারা বলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা তারা জানান, সেটা হলো, আপনি যখন আরেকটি গাড়িকে ওভারটেক করছেন বা তাকে সাইড দিচ্ছেন সেখানে অন্য ড্রাইভারের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো খুবই সতর্কভাবে খেয়াল করা।
শুধুমাত্র চোখের ঈশারায় বাংলাদেশের বহু স্থানে বড় অঙ্কের গাড়ি চলাচল করছে। আমি বামদিক থেকে ডানদিকে যাবো তার জন্য যতটুকু গাড়ির সিগন্যাল ব্যবহার করা হয় তারচেয়ে বেশি চোখের ঈশারা ব্যবহার করতে হয়, হাত দিয়ে দিক নির্দেশ করতে হয়। এবং, খুব সম্ভবত কোন দুই ড্রাইভারের মধ্যে চোখের ঈশারায় সঠিক নির্দেশনা ছিলো বলেই আমাদের অনেকেই আজও একটি দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরেছেন।
এই সামাজিক চুক্তি কোথাও লেখা নাই। কোথাও ঘটা করে ক্লাস নিয়ে এসব বিষয়ে উচিত শিক্ষা দেওয়া হয় না। কোনো ওস্তাদ বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান এসব লিখে রাখেন নাই। কিন্তু তবুও এদেশের অধিকাংশ চালক এই চুক্তি মেনে চলেছেন। ঢাকার বিশাল যানজটে যখন গাড়ি পার হয় তখন ‘তওবা’ পড়তে হয় বহুবার। দেখে মনে হয়, আমি এখানে আজ আছি তো কাল নাই!
আবার দেখবেন, কোথাও কোথাও ডানদিক দিয়ে যাওয়াটাকে উচিত বলে মনে করা হয়। ঐ রাস্তায় ঐ সময়ে আপনি বামদিক দিয়ে গেলে আপনাকে দোষী সাব্যস্ত করা হতে পারে। অদ্ভুত না এই বিষয়গুলো? এসবও তো এক ধরণের সামাজিক চুক্তির মধ্যে পড়ে। বামদিক দিয়ে সঠিক গতিতে দূর্ঘটনার দায় কিন্তু আপনাকে নিতে হয় না (বেশিরভাগ সময়ে)।
আবার কিছু কিছু রাস্তায় ডান দিক দিয়ে গাড়ি চালানোকে ভুল ধরা হয় না। আবার কিছু কিছু রাস্তায় আপনি যেখানে আছেন সেখান থেকে সোজা বরাবর সামনে যেতে হবে। মানে এসব যদি কেউ নিয়ম আকারে লিখতেও চায় তাহলেও অসম্ভব বলে মনে হয়। কারণ শুধুমাত্র ঢাকা শহরে নিউইয়র্ক শহরের চেয়ে বেশি বাইক চলাফেরা করে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বুয়েটের একটি গবেষণা মতে, শুধুমাত্র ঢাকায় যে পরিমাণ নিবন্ধিত বাইক রয়েছে তা পুরো যুক্তরাষ্ট্রে নাই।
তার মানে কি ঢাকা শহর কি নিউইয়র্ক শহরে পরিণত হয়েছে? নিশ্চয় নয়। উল্টো ব্যাপক যানজট ও দূর্ঘটনা দেখা দিয়েছে। এবং জনজীবনে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কিন্তু এরমধ্যে যে অলিখিত সামাজিক চুক্তির কথা বারবার বলছি সেটা আসলে কি? এই অলিখিত সামাজিক চুক্তির নাম কি?
আমি আসলে এতক্ষণ ধরে একটি নির্বাচিত উদাহরণ দিয়ে একটি বিষয়ে আলোচনা করবার চেষ্টা করেছি। একটি সামাজিক তত্ত্ব বুঝানোর চেষ্টা করেছি। আর সেটা হলো সমাজবিজ্ঞানী গর্ড অলপোর্ট (Gordon Allport) দ্বারা ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘The Nature of Prejudice’ থেকে ‘সোশ্যাল কন্টাক্ট থিওরি (Social Contact Theory)’। তবে এর বীজ আরও আগে বিভিন্ন চিন্তাবিদের কাজে ছড়িয়ে ছিলো।
‘সোশ্যাল কন্টাক্ট থিওরি (Social Contact Theory)’ এর মূল উপাদানগুলো হলো, সমান মর্যাদা, সাধারণ লক্ষ্য, সহযোগিতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন। তাই সংবিধান হোক বা স্কুলের পাঠ্যবই, সোশ্যাল কন্টাক্ট থিওরির পুরোপুরি অনুপস্থিতি থাকলে তা মানুষকে কিছুটা হলেও অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিতে পারে।
শুধুমাত্র স্বর্ণাক্ষরে লিখা নিয়ম-নীতি ও আইন সবসময় কাজের হয় না!
ছবি: Grok 3
২৫ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১১:৫৮
মি. বিকেল বলেছেন: আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আনন্দিত যে আমার লেখাটি আপনার মনের কথার সাথে মিলে গেছে এবং সোশ্যাল কন্টাক্ট থিওরি নিয়ে আপনার আগ্রহ বাড়িয়েছে। অনলাইন গ্রুপ ডাইনামিক্স নিয়ে লেখার জন্য শুভকামনা রইলো। গর্ডন অলপোর্টের 'The Nature of Prejudice' বইটি পড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং বাস্তব উদাহরণ ও প্রয়োগের মাধ্যমে তত্ত্বগুলো ব্যাখ্যা করতে পারেন। সোশ্যাল কন্টাক্ট থিওরির মূল উপাদানগুলো যেমন সমান মর্যাদা, সাধারণ লক্ষ্য, সহযোগিতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে পারেন। অনলাইন গ্রুপ ডাইনামিক্সে কী কী প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে এবং সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। আপনার লেখা পড়ে মন্তব্য করতে আমি আগ্রহী।
- শুভেচ্ছান্তে, মি বিকেল।
©somewhere in net ltd.
১|
২৫ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৯:০১
মোহাম্মদ মোস্তফা সার্জিল বলেছেন: মি বিকেল, আপনার লেখাটার পেন পিকচার দেখে সমাজের গ্রুপ ডাইনামিক্স এর বিষয়ে বিষদ কিছু না হলেও আপনার মতামত জানতে পারবো মনে করেছিলাম, কিন্তু দেখলাম আপনি বিষয়টি উল্লেখ করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে, যার বর্ণনার সাথে আমি একমত। আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে আর গাড়িও আছে কিন্তু ঢাকার রাস্তায় চালাই না। আপনার কথাগুলো পরে মনে হলো সব আমার মনের কথার সাথে মিলে যায়। কিন্তু আমি লেখাটার উপরের পেন পিকচার সোস্যাল কন্টাক্ট থিওরির বিষয়ে বেশি আগ্রহী ছিলাম। আমি নিজেও লেখি, অনলাইন গ্রুপ ডাইনামিক্সের উপর একটা লেখা শুরু করেছি কিছু দুর আগিয়েছিও। আপনার কাছ থেকে এ প্রসঙ্গে কিছু দিকনির্দেশনা বা সূত্র পেলাম, (Gordon Allport, Social contact theory) ধন্যবাদ তার জন্য। আমার লেখা পড়ে আপনার মন্তব্য আশা করবো।