![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
“Ask yourself often, why do I have to think like other people think?”
আসরের আজান হয়ে গেছে। সন্ধ্যে হতে আর বড়জোর তিন ঘণ্টা। রমজানের দিন, বড় কষ্টের দিন। কষ্টের পরে কেষ্ট আছে। পরপারে জামানত আছে ভালমানুষের জন্যে, পূণ্যবানদের জন্যে। খোদের জন্যে আছে ঝাটা, আর আগুন। আগুন থাকে মরুভূয়ের বাতাসে আর জমিনে। রমজান আসলে তাই শুকনো মরুর কথা মনে আসে খোদের। সারা দিন ঠায় দাড়িয়ে থেকে একটা খদ্দের জোটে নাই তার কপালে। অন্যসবার অবস্থাও প্রায় তাই, তবে তার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। পেটখান বুঝি আর চলে না। রমজান আসলেই তার কুফা লাগে গতরে, আর ব্যবসায়। চরম নোকসান গুণতে হয় তাকে। নোকসান গোণে এই ইংলিশ রোডের চৌহদ্দীতে ছড়ানো ছিটানো অগুণতি ছাপড়া হোটেলওলারাও। পর্দা টাঙ্গিয়েও খদ্দের জোটে না আজকাল। আগে জুটতো। আজকাল ভালমানুষের সংখ্যা বেড়েছে- ভাবে খোদে কানা গলির ঘুপচিতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে।
শেষবেলায় বড়শিতে মাছ বিঁধেছে খোদের। তারে নিয়ে সাড়েতিন ফুট উচু খাটের উপরে বসে চলছে তার পুটুর পুটুর। ছোট্ট একখান ঘর তার। ভাড়া মাসে দশ হাজার। ঘরের এককোণায় আবছা অন্ধকারে খাটের নীচে বসে আছে তার মা ‘আলোচুলা’ নিয়ে। তার উপরে চড়িয়েছে ভিজে ছোলা। চুলায় জ্বাল ধরানোর অপেক্ষায়। সাথে খোদের বাপও আছে। তারা শুকনো মুখে কিছু একটা পাওয়ার আশায় খাটের দিকে চেয়ে আছে। খাটের মাঝ বরাবর পর্দা দিয়ে আড়াল করা, তবু দেখা যায় খাটে সওয়ার মানুষের পা, শুনা যায় চাপা কথা। বড় বেশী গুজুর গুজুর করছে খোদে আজকে। একসময় ধৈর্য্য হারায়ে ফেলে তার মা নীচে বসে।
-খোদে এট্টু জলদি কর। তোর বাপ কিন্তুক রোজা। পিয়াজ কিনতি যাতি হবি।
বাজারের পেয়াজে আগুন। ঘরে একটুকরো পেয়াজ নেই। খোদের পয়সা দিয়ে পেয়াজ উঠবে কড়াইয়ে। তৈরি হবে ইফতার। মায়ের চড়া গলা শুনে জ্বলে উঠে খোদে, তবে খদ্দেরের সামনে চেতে উঠতে পারে না।
-তোরে না কইছি মাও, আমারে খোদে ডাকবি না। লাভলি কতি লজ্জা লাগে?
গলার ঝাল টের পায় মা। চুপ হয়ে যায় সন্ধ্যার তক্ষকের মতন।
পর্দার আড়ালে বসে বাপ-মা পাহারদার কুকুরের মতন চারকান খাড়া করে শোনে খাটের উপরের তাবৎ কথাবার্তা।
-তুমি ভদ্দরনোকের ছেলে পয়সা দিয়ে, কাজ না করে চলে যাইতে চাও কেন বাপু? আমার প্যাটে লাথি মারতি চাও? এইসব শুনলি সর্দার আমারে কাইটে ভাসাবে।
-আমাকে মাফ করে দেন। আমি এমনি একটু দেখতে এসেছিলাম এখানে কি হয়। আমি ছাত্র, আমার কাছে যা আছে তাই নেন। আমাকে ছেড়ে দেন। এমন জায়গায় আগে কোন দিন আসিনি আমি।
-রাখো…। ছেদো কতায় কাজ হবে না। কাম তোমার করাই লাগবে।
খোদের মা-বাপে শোনে। সব শুনে চাপা গলায় গজর গজর করে নিজেদের ভিতরে।
-হারামজাদা মেইয়ে এট্টা দুধের বাচ্চা ধইরে আনিছে। ঝাটা ওর কপালে।
একসময় খদ্দের লক্ষি চলে যায় কাজ সেরে। চড়া দামের পেয়াজ দিয়ে ছোলা ভাজা হয়। ইফতার তৈরি হয় খোদের ঘরের খাটের নীচে আলোচুলার ওমে। যুদ্ধের সতর্ক সংকেতের মতন তীব্র নিনাদে সাইরেন বেজে যায়, ইফতারের সাইরেন। কোটরাগত চোখে পূণ্যদৃষ্টি নিয়ে এইঘরের একমাত্র রোজাদার খোদের অশীতিপর বাপ শুরু করে ইফতার, সঙ্গে মাও। হঠাৎকরে কোথা থেকে খোদে এসে হাত ঢুকিয়ে দেয় ইফতারির থালায়। খাওয়া ছেড়ে রাগে গজগজ করে থালা সামনে ঠেলে দেয় বুড়ো।
-নাপাক হইয়ে গেইছে সব। আমি খাবো না।
সোয়ামীর কথা শুনে অবাক চোখে নিস্পলক তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে বুড়ি। ভাষায় কুলায় না তার।
মায়ের ভাষার ভাড়ারে শব্দ বাড়ন্ত হলেও, মেয়ের শব্দ ভাণ্ডারে ওঠে মহাপ্লাবন।
-ইহহ—-। মেইয়ের চিপা-নিংড়ানো টাকা নাপাক হয় না, নাপাক হয় তার হাত। বুড়ো ভাম! এইডেরে বিদেয় কর মাও। অমন বাপের আমার দরহার নেই।
গঙ্গার সুচীজল বা কৈলাশের বান, কোনটাই ভাসালো না খোদের চোখ। তবে কি যেন এক অচেনা কাঁপুনী শোনা গেল তার গলায়। “যা তোর নাপাক খাওন লাগবো না”- পায়ের এক ঘায়ে থালাটা উল্টে দিয়ে, আর কথাকটি উগরে ঘর থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল সে। সেকি কান্না লুকালো? গেরস্ত ঘরের কোন বউ-ঝির মতন?
মোয়াজ্জিনের মলিন কণ্ঠে শেষ হয় মগরিবের আজান। কিন্তু তার রেশ যেন জড়ায়ে থাকে নিষিদ্ধ পল্লির জমাট অন্ধকারকেও। একটা অপুষ্ট তিনপেয়ে নেড়িকুকুর খোদের ঘরের দরজায় এসে কুইকুই করে অকারণে কেঁদে চলে। মনে হয়, একমাত্র সেইই যেন জেনে ফেলেছে তার খোদে থেকে লাভলী, আর লাভলী থেকে খোদে জীবনে আসা যাওয়ার ইতিবৃত্ত।
©somewhere in net ltd.