| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আকাশের বয়স যখন ছয় মাস তখনই পিতাকে হারিয়ে অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে। মমতাময়ী মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাবার রেখে যাওয়া কৃষি জমির উপর ভর করে কায়ক্লেশে কাটতে থাকে আকাশের শৈশব। মেধাবী আকাশ নিজগুনে কষ্ট করে পড়ালেখা করে ভবিষ্যতে মানুষ হওয়ার পণ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে । স্কুল ড্রেস ও ব্যাগ সংগ্রহ করতে হিমশিম খাওয়া আকাশ অন্যের পুরাতন বই সংগ্রহ করে নিজ চেষ্টায় পড়ালেখা করে নবম শ্রেণিতে উঠে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করে কিন্ত রেজিস্ট্রেশন ফি যোগাড় করতে গিয়ে আটকে যায় হতভাগা। সরকারি চাকুরিজীবি ছোট চাচার নিকট রেজিস্ট্রেশনের জন্য ১০০(একশত) টাকা ধার চেয়ে নিরাশ হয়ে বসে থাকে। অতপর তার এক চাচাতো ভাবী একশত টাকা ধার দিয়ে যে সহযোগিতা করে তা সারা জীবনেও ভুলতে পারবে না আকাশ।
এসএসসি পরীক্ষার সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ ফরম ফিলাপের জন্য অতিরিক্ত ফি আদায় করলে আকাশ তার প্রতিবাদ করে এবং প্রকৃত ফি এর বিনিময়ে ফরম ফিলাপ করতে চাইলে শিক্ষকদের বিরাগভাজন হলেও উপজেলার মধ্যে প্রথম হয়ে পরিবারের নাম উজ্জ্বল করে। কিন্তু তাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার কেউ না থাকায় এইচএসসি তে ভর্তি হতে ঢাকায় যায় একটু দেরি করে যার কারনে নটরডেম কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে নাই। আকাশ যে দিন ঢাকায় পৌছায় সেই দিন ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে। অভাগিনি মায়ের ভর্তি ফি যোগাড় করে দিতে একটু সময় লেগেছে এবং স্কুল থেকে মার্কশীট হাতে পেতে একটু দেরি হয়েছে।
ঢাকায় তার বড় মামার বাসায় পর্যাপ্ত জায়গা থাকার পড়ও মাথা গোঁজার ঠাই পেলো না। মায়ের আশির্বাদ থাকায় বড় মামার বড় বাসায় জায়গা না হলেও বড় বোনের ছোট্ট নীড়ে আশ্রয় নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির চেষ্টা চালাতে গিয়ে দেখে পকেটে পর্যাপ্ত টাকা নাই। অতপরঃ ভালো কলেজ নির্বাচন না করে কম টাকায় ভর্তি হওয়া যায় এমন কলেজ খুঁজতে থাকে আকাশ। অবশেষে বোনের বাড়িয়ালার মেয়ের সহযোগিতায় পরবর্তীতে দেওয়ার শর্তে আংশিক ভর্তি ফি দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলেও পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে পারে নাই। ঢাকার শহরে থাকা-খাওয়া ও পড়া-লেখার খরচ নির্বাহের চিন্তা মাথায় নিয়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার। সারাদিন পরিচিত জনের নিকট টিউশনীর জন্য দেন দরবার করলেও সুবিধা করে উঠতে পারলো না। নিরূপায় হয়ে বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় ইকবাল গার্ড সিস্টেম এ সিকিউরিটি গার্ড এর চাকরি নিয়ে সেকেরটেক এ একটা জমি (প্লট) দেখাশোনার দায়িত্ব পায়। সেখানেই খুপড়ি ঘরে থাকা এবং নিজে পাক করে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এর মাঝে চলে পড়ালেখা।
উচ্চ মাধমিক পরীক্ষার আগে এক প্রবাসী আত্মীয়ের আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে শুক্রাবাদে একটা মেসে ওঠে আকাশ। কিন্তু পড়ালেখার গতি বাড়াতে পারে না। পরীক্ষার মধ্যে চিকেন পক্স আক্রান্ত হয়ে আকাশ কোন রকম প্রথম বিভাগ নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কামরঙ্গির চরে একটা বাসায় লজিং থাকার সুযোগ পায়। সেনা বাহিনীর কমিশন অফিসার হওয়ার চেষ্টা করে আইএসএসবি তে রিজেক্ট হয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে বিএসসি(অনার্স) ভর্তি হয়ে টিউশনী খুঁজতে থাকে। অভাগা যে দিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়। আকাশের টিউশনীর ভাগ্য ভালো না। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সব বিষয়ে ভালো পড়াতে পাড়লেও ভালো টাকা পাওয়া যাবে এমন টিউশনী আকাশের ভাগ্যে জোটে না। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। অনেকেই বেশি টিউশনী করে টাকার লোভে পড়ে নিজের পড়া শেষ করতে পারে না বা ডিগ্রী শেষ করলেও ভালো চাকরি জোটাতে পারে না। আকাশ কোনরকম জীবন যাপন করে কৃতিত্বের সাথে পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়।
বিসিএস প্রস্তুুতির পাশাপাশি বেক্সিমকো ফার্মাসিটিউক্যাল এ পরীক্ষা দিয়ে ট্রেনিং এ অংশগ্রহণ করে ঔষধ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন ও ট্রেনিং ভাতা গ্রহণ করতে। তখনকার সামান্য ট্রেনিং ভাতাও আকাশের জন্য অসামান্য আর্থিক সহযোগিতা। এরই মধ্যে বুয়েটে এমফিল ভর্তি হয়ে শহীদ স্মৃতি হলে সিট পায়। কিন্তু সিট ভাড়া দেওয়ার মতো অর্থ আকাশের নিকট না থাকায় এক বন্ধুর নিকট থেকে ধার করে হলের ভর্তি নিশ্চিৎ করে। এটাই আকাশের একমাত্র ধার। ঢাকার শহরে আকাশ এমন ভাবে হিসাব-নিকাশ করে জীবন-যাপন করে যে কারও নিকট ধার করার প্রয়োজন হয় নি যদিও আকাশ আর্থিক দিয়ে যথেষ্ট স্বচ্ছল নয় তবুও টাকা ধার চেয়ে কেউ ফেরত যায় নি। পকেট উজাড় করে টাকা ধার দিলেও আকাশ কারও নিকট টাকা ধার চায়নি বা কোন বিশেষ প্রয়োজনে চাইলেও পায় নি। বিসিএস পরীক্ষার ভাইভা দিতে পিএসসিতে যাবে কিন্তু আকাশের পকেটে পর্যাপ্ত টাকা নেই। হলের এক বড় ভাইয়ের নিকট টাকা ধার চেয়ে না পেয়ে নিরাশ হয়ে ধানমন্ডি গিয়ে ভগ্নিপতির নিকট থেকে সামান্য কিছু টাকা নিয়ে হলে ফিরে আসে এবং বিসিএস ভাইভা দিতে পিএসসিতে যায়। দুইবার বিসিএস ভাইভায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়ে পছন্দ মাফিক ক্যাডার না পেলেও প্রথম শ্রেণির চাকরি পেয়ে যায়।
চাকরি পেলেই কি জীবন যুদ্ধ শেষ হয়। যে অভাগিনী মা চেয়েছিলেন আকাশ জীবন যুদ্ধে জয়ী হবে তিনি তা দেখে যেতে পারেন নি। আকাশ সারা জীবন চেষ্টা করেছে বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়ে মায়ের মুখে হাসি ফুটাবে। কিন্তু সৃষ্টি কর্তার লীলা খেলা বুঝা বড় দায়। যে মায়ের নিকট আকাশ ঋণী তাঁর জন্য কিছু করবে কিন্তু সেই সুযোগ হয়ে উঠলো না। চাকুরির প্রথম দিকে স্বল্প বেতনে অল্প করে মায়ের সেবা করলেও বেশি কিছু করার সুযোগ পেলো না। চাকুরির দুই বছরের মধ্যে দুনিয়ার মায়া ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন আকাশে মা। এখন আকাশ নিজের মাতাকে হারিয়ে দেশ মাতার সেবা করার ব্রত নিয়ে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
©somewhere in net ltd.