নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বেঁচে আছি; এই জন্যই সুখে আছি.........

জাহেদ মুরাদ

নিজের করা ভুল গুলো মনে করিয়ে দেয় যে আমি ও মানুষ, ভুলের অনুশোচনায় পুড়ি বলেই আমি নই অমানুষ।

জাহেদ মুরাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের আধার কুমিল্লায় একদিন।

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:৫৯




সকাল ৬ টা ২০ মিনিটে চট্টগ্রাম শহরের অলংকার মোড় থেকে ডিরেক্ট সার্ভিস প্রিন্স সৌদিয়া বাসে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলাম। অলংকার থেকে বাস ভাড়া জনপ্রতি ২৪০ টাকা। কুমিল্লা বিশ্বরোড যখন পৌঁছলাম ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৯ টা। সামান্য নাস্তা সেরে কুমিল্লা বিশ্বরোড থেকে সিএনজি বন্ধ হয়ে যাওয়ার বদৌলতে চালু হওয়া লোকাল মাইক্রোবাসে করে ১৫ টাকা ভাড়ায় গেলাম কোটবাড়ী বিশ্বরোড। ওখান থেকে মোটর চালিত রিক্সায় মাত্র ২০ টাকা ভাড়ায় গেলাম কোটবাড়ী।কোটবাড়ী থেকে পশ্চিমে দুই চার মিনিট হেঁটে চলে গেলাম লতিকোট মুড়ায়।

লতিকোট মুড়া : ধারণা করা হয় এটি ৮ম – ১০ম শতকের একটি স্থাপত্যশৈলী।সম্প্রতি খননের ফলে এখানে ৩৩ টি ভিক্ষুকক্ষ বিশিষ্ট একটি বিহারের সন্ধান পাওয়াগেছে। বিহারটি চার বাহু বিশিষ্ট আর প্রবেশ পথ ছিল উত্তর দিকে। বিহারটিতে দুইটি নির্মাণ যুগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২য় নির্মাণ যুগে পূর্ব বাহুর মাঝামাঝি স্থানে একটি মন্ডপের অস্তিত্ব পাওয়াগেছে। ঐ দিন যে সব মুড়া দেখেছি তার মধ্যে এটাই ছিল সব থেকে ছোট।

লতিকোট মুড়ার একেবারে লাগোয়া পশ্চিম পাশে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি।আর বিদ্যালয়ের সীমানা পেরিয়ে পশ্চিম পাশেই ইটাখোলা মুড়ায় যাওয়ার রাস্তা।

ইটাখোলা মুড়া : ধারণা করা হয় এটি সপ্তম – দ্বাদশ শতকে নির্মিত। প্রাচীনকাল থেকেই এই স্থানটি ইট পোড়ানোর খনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এজন্যই এর এরকম নামকরণ করা হয়েছে। খননের ফলে এখানে পূর্বমূখী একটি বৌদ্ধ মন্দিরের নকশা উন্মোচিত হয়। ধারণা করা হয়, এই প্রত্নস্থানটিকে পাঁচটি সাংস্কৃতিক যুগ অতিক্রম করতে হয়েছে।ভবনের মাঝখানে মাথাবিহীন বড় আকারের ধ্যানরত বুদ্ধের একটি মূর্তিটি আছে। সেখানে যাওয়ার জন্য সরু রাস্তা এবং রাস্তার দুপাশে প্রদীপ জালানোর খুপরি আছে। খননের সময় এ জায়গা থেকে ১৮ তোলা স্বর্ণ, ১টি রূপার মুদ্রা এবং একটি তাম্র লিপি পাওয়া যায়।এই মন্দিরের উত্তর দিকে সম্প্রতি একটি বিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে।

ইটাখোলা মুড়া হতে বের হয়ে সামান্য পশ্চিমে হাঁটলে একটা বিজিবি ক্যাম্প/চেকপোষ্ট চোখে পড়ে। ক্যাম্পের পূর্ব পাশের দেয়াল ঘেঁষেই রয়েছে রূপবান মুড়ায় যাওয়ার রাস্তা।

রূপবান মুড়া : “রহিম বাদশা রূপবান” বাংলা ছায়াছবিটির কথা মনে আছে? স্থানীয়রা ধারণা করে সিনেমার গল্পটা এখানকারই। গল্পটা ঠিক এমন যে, জ্যোতিষির নির্দেশে রূপবান নামক ১২ বছরের এক রাজকন্যাকে ১২দিনের শিশু রহিমের সাথে বিয়ে দিয়ে বনবাসে পাঠানো হয়। রূপবান এ পাহাড়ে এসে আশ্রয় নেয়। তার নাম অনুসারে এরনাম রূপবান মুড়া। এখানে একটি মন্দির, একটি বিহার, একটি স্তূপসহ একটি মঞ্চের স্থাপত্যিক নিদর্শন উন্মোচিত হয়। নিদর্শন বিবেচনায় বিহার ও মন্দির অষ্টম শতাব্দীর নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। খনন কালে এখান থেকে ১ টি স্বর্ণ মুদ্রা, ৪ টি মিশ্রিত ধাতুর মুদ্রা, ৩ টি রূপার মুদ্রা এছাড়া মুড়াটির পূর্ব পাশের প্রকৌষ্ঠ থেকে বেলে পাথরের কারুকাজ করাবৃহদাকার ১টি বৌদ্ধ মূর্তি পাওয়া যায়। ধারনা করা হয় মূর্তিটি ৭ম থেকে১২শ শতাব্দীর।

রূপবান মুড়া পরিদর্শন শেষে পায়ে হেঁটে আবার চলে আসলাম কোটবাড়ি। এখানে একটা বড় মার্কেট আছে যেটা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড মার্কেট নামে পরিচিত। মার্কেটের ঠিক সামনেই অবস্থিত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড)।

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) : Bangladesh Academy for Rural Development বা BARD ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনস্থ একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, গবেষণার মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নিরলস সহায়তা করে যাচ্ছে। বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক প্রখ্যাত পল্লী উন্নয়ন গবেষক, দার্শনিক ও সমাজসেবক ড. আখতার হামিদ খান।

বার্ড পরিদর্শন শেষে যখন ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড মার্কেটের সামনে আসলাম তখন বেলা ১১ টা। কড়কড়ে রোদের মধ্যে প্রায় দেড় ঘণ্টা হাঁটাহাঁটিতে পানির পিপাসা লেগেছিল খুব তাই চোখের সামনে লেবুর শরবত বিক্রেতার হাঁকে সাড়া না দেওয়ার কোন মানে ছিল না। বরফ মিশ্রিত লেবুর শরবত পান করে প্রবেশ করলাম ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড মার্কেটে যেখানে নিখুঁত আর নিখাদ খাদিঘর এর ছড়াছড়ি। যদিও কিনতে গিয়ে দেখলাম নিখুঁতে খুঁত আর নিখাদে খাদের কোন অভাব নাই। তারপরও নিখুঁত খাদিঘর থেকে একটি ফতুয়া কিনে নিলাম স্মৃতিস্বরূপ।

ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড মার্কেটের সামনে থেকে ময়নামতি জাদুঘর আর শালবন বিহার যাওয়ার জন্য জনপ্রতি মাত্র ১০ টাকা ভাড়ায় টমটম কিংবা মোটর চালিত রিক্সা পাওয়া যায়। নতুন জায়গা নতুন শহর তাই চারদিক ভাল করে দেখার সুবিধার্থে রিক্সাই ভাড়া করলাম। রিক্সায় চড়ে পথে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ পেছনে ফেলে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছেগেলাম ময়নামতি জাদুঘরে। জাদুঘরের সামনে যখন পৌঁছলাম তখন ১১ টা ৪০ মিনিট। এমনিতে জাদুঘর গ্রীষ্মকালে রবিবার আর সোমাবার ছাড়া অন্যান্য দিন ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে আর শীতকালে ৯ টা থেকে সন্ধ্যা ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে তবে মাঝখানে ১ টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বন্ধ থাকে। রবিবার জাদুঘর বন্ধ আর সোমবার বেলা ২ টা থেকে খোলা থাকে। কিন্তু শুক্রবার জুম্মার নামাজের জন্য ১২ টা ৩০ মিনিট থেকে ৩ টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। তাই শুক্রবারের কথা মাথায় রেখে ২০ টাকায় টিকেট কেটে প্রবেশ করলাম জাদুঘরে। অনেক গুলো জায়গা ঘুরে আসার পর এই প্রথম টিকেট কাটতে হল।

জাদুঘরে প্রবেশ করতেই হাতের ডান পাশে রাখা আছে শত শত বছর পুরনো গাছের জীবাশ্ম। দেখে মনে হল এগুলো সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষকে আরো যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল।

ময়নামতি জাদুঘরঃ শ্রীভবদেব মহাবিহার, কোটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, আনন্দ বিহার, রানীর বাংলা, ও ভোজ রাজার বাড়ি বিহার খননকালে অনেক মূল্যবান পুরা সামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায়। এসব পুরাবস্তু সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জনন্য ১৯৬৫ সালে যাদুঘরটি স্থাপন করা হয়। জাদুঘরের মূলভবনে গুরুত্বপূর্ণ পুরাবস্তু প্রদর্শনের জন্য স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৯৭০-৭১ সালে এর দক্ষিণ পাশ বর্ধিত করায় ভবনটি ইংরেজী ‘টি’র আকার ধারণ করে। পুরো জাদুঘর ভবনে মোট ৪২টি আধার রয়েছে। যাতে পুরাবস্তু সমূহ প্রদর্শিত হচ্ছে। জাদুঘরের প্রবেশ পথের বামদিকে থেকে ১নং প্রদর্শনী আধার দিয়ে প্রদর্শনী আরম্ভ করে ক্রমানুসারে চারদিক ঘুরে ঘুরে প্রবেশদ্বারের ডানদিকে ৪২নং আধারে প্রদর্শনী শেষ হয়েছে। প্রদর্শনী আধারগুলোতে প্রত্মতাত্ত্বিক স্থান খননের উম্মোচিত স্থাপত্য সমৃদ্ধ ধ্বংসাবশেষের ভূমি-নকশা, ধাতুলিপি ফলক, প্রাচীনমুদ্রা, মৃন্ময়মুদ্রক-মুদ্রিকা, পোড়া মাটির ফলক, ব্রোঞ্জমূর্তি, পাথরের মূর্তি, লোহার পেরেক, পাথরের গুটিকা, অলংকারের অংশ এবং ঘরে ব্যবহৃত মাটির হাড়ি পাতিল প্রদর্শিত হচ্ছে। এছাড়া আধারের ফাঁকে ফাঁকে মেঝের উপর জাদুঘর ভবনের বিভিন্নস্থানে কিছুপাথর এবং ব্রোঞ্জমূর্তি ও প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। এসব মূর্তির কয়েকটি প্রাচীন সমতটের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত। এছড়া জাদুঘরে রয়েছে ব্রোঞ্জের তৈরী বিশালাকায় একটি ঘন্টা। যার ওজন ৫শ’ কেজি।

জাদুঘরের চারপাশে সীমানা ঘেরা প্রাচীরের অভ্যন্তরের পরিবেশ ও খুব সুন্দর। পুরা চত্বরটা নানা রকম ফুল আর বাহারি গাছ দিয়ে সাজানো। জাদুঘর থেকে বের হয়ে বাকি সময়টা ঐ চত্বরেই কাটিয়েছি ঘুরেফিরে আর ছবি তুলে। জুম্মার নামাজের জন্য জাদুঘরের গেইট বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরাই ছিলাম শেষ দর্শনার্থী।
জাদুঘর থেকে বের হয়ে হালকা নাস্তা হিসেবে কেক আর ঠান্ডা কোমল পানীয় খেয়ে নিলাম।

জাদুঘরের বরাবর সামনেই রয়েছে কোটবাড়ী শালবন। এটাকে অনেকটা শিশুপার্ক বলা যায়। এখানে সারিসারি শালগাছের ফাঁকে ফাঁকে শিশুদের চিত্তবিনোদনের জন্য রয়েছে নাগরদোলা, ভালুক হরিণের প্রতিমূর্তি আর ঘোড়ার ঘাড়িতে চড়ার ব্যবস্থা।

জাদুঘর আর শালবনের দক্ষিণ পাশের রয়েছে ময়নামতি জাদুঘর মসজিদ। এখানেই ছিল জুম্মার নামজের বিরতি।

এরপর শালবন বিহার। ময়নামতি জাদুঘরের একেবারে লাগোয়া উত্তর পাশেই শালবন বিহারটি অবস্থিত। ২০ টাকায় টিকেট কেটে হাতের ডান দিকে কয়েক কদম হেঁটে উত্তর দিকে তাকালেই চোখে পড়ে ইট আর বাহারি গাছের কারুকাজে লিখা “স্বাগতম শালবন বিহার”।

শালবন বিহারঃ বিহারটির আশপাশে এক সময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল বলে এ বিহারটির নামকরণ হয়েছিল শালবন বিহার।১৮৭৫ সালের শেষ দিকে বর্তমান কোটবাড়ী এলাকায় একটি সড়ক তৈরির সময় একটি ইমারতের ধ্বংশাবশেষ উন্মোচিত হয়ে।সে সময় আবিষ্কৃত ধ্বংসাবশেষকে একটি দুর্গ বলে অনুমান করা হয়েছিল।১৯১৭ সালে ঢাকা জাদুঘরের অধ্যক্ষ নলিনী কান্ত ভট্টাশালী সে এলাকায় যান এবং উক্ত এলাকায় অনুসন্ধান পরিচালনাকালে ধ্বংশাবশেষটিকে রণবংকমল্ল হরিকেল দেবের তাম্রশাসনের (খৃষ্টীয় তের শতক) দুর্গ ও বিহার পরিবেষ্টিত পট্টিকেরা নগর বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।যদিও অপর প্রত্নতাত্তিকদের মত অনুযায়ী এটি ছিল জয়কর্মান্তবসাক নামক একটি প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ।যদিও অধিক সমর্থিত একাধিক মত অনুযায়ী ধারণা করা হয় যে খৃষ্টিয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এ বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ বিহারে ঢোকা বা বের হওয়ার মাত্র একটাই পথ ছিল।এ পথ বা দরজাটি উত্তর ব্লকের ঠিক মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে। বিহার অঙ্গনের ঠিক মাঝে ছিল কেন্দ্রীয় মন্দির। বিহারে সর্বমোট ১৫৫টি কক্ষ আছে। ধারণা করা হয় যে এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন এবং ধর্মচর্চ্চা করতেন।প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে তিনটি করে কুলুঙ্গি রয়েছে যেখানে অতীতে প্রতিমা বা তেলের প্রদীপ ইত্যাদি রাখা হতো।অন্যদিকে চার দিকের দেয়াল ও সামনে চারটি বিশাল গোলাকার স্তম্ভের ওপর নির্মিত হলঘরটি ভিক্ষুদের খাবার ঘর ছিল বলে ধারণা করা হয়। হলঘরের চার দিকে ইটের চওড়া রাস্তা রয়েছে।নানা সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিহারটির ধ্বংসাবশেষ থেকে আটটি তাম্রলিপি, প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা, সিলমোহর, ব্রৌঞ্জ ও মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে।

শালবন বিহারে প্রবেশ করে বিহারের পশ্চিম পাশের দেয়াল ঘেঁষে উত্তর দিকে হাঁটার যে রাস্তাটা আছে সেটা ধরে হেঁটে গেলে ভাল হয়। তাতে বিহারের সৌন্দর্য গুছিয়ে উপভোগ করা যায়।

শালবন বিহার থেকে বের হয়ে ৬০ টাকায় একটা টমটম ভাড়া করলাম কোটবাড়ী বিশ্বরোড পর্যন্ত। যখন কোটবাড়ী পৌঁছলাম তখন প্রায় বিকাল ৩ টা খিদায় পেট ছোঁ ছোঁ করছিল। কিন্ত কাছাকাছি ভাল কোন রেস্তোরাঁ না থাকায় সিদ্ধান্ত নিলাম দুপুরের খাওয়ারটা সেরে নিব কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট মোড়ে গিয়ে। কোটবাড়ী বিশ্বরোড থেকে সহজেই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট যাওয়ার গাড়ি পাওয়া যায়। ভাড়া জন প্রতি মাত্র ১০ টাকা।

গাড়ি থেকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট নেমে দুপুরের ভাত খেতে গেলাম জিহান রেস্তোরায়। ক্যান্টনমেন্ট মোড়ে রেস্তোরাটির বড় বড় কয়কটি সাইনবোর্ড যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অতিরিক্ত খিদায় শুধু ডাল ভাতটাকে ও অমৃতের মত মনে হচ্ছিল। মুখরোচক দুই পদের ভর্তা আর মুরগির মাংস দিয়ে খাওয়া শেষ করলাম। সত্যি কথা বলতে কি ঘুরাঘুরির তুলনায় অন্তত আমার জন্য খাওয়াটা পর্যাপ্ত হয়নি। বেশি খেতে পারলাম না বন্ধুর সতর্কতা মূলক নির্দেশনায়। বেশি খেলে নাকি শরীরে আলসেমি ভর করবে; ঘুম ঘুম ভাব চলে আসবে। চিন্তা করে দেখলাম এই সময়ে আলসেমিটাকে কোন ভাবেই জায়গা দেওয়া যাবে না। তাই ঊনপেটে বের হয়ে গেলাম ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রির উদ্দেশ্যে।

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট মোড় থেকে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক ধরে একটু সামনে গেলেই ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রি। মোটর চালিত রিক্সায় গেলে ভাড়া লাগে মাত্র ২০ টাকা।

ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রি: বাংলাদেশের কুমিল্লাতে অবস্থিত একটি কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি। ১৯৪১-১৯৪৫ সালে বার্মায় সংঘটিত যুদ্ধে যে ৪৫০০০ কমনওয়েলথ সৈনিক নিহত হন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৪৩-১৯৪৪ এটি সালে তৈরি হয়েছে। এই সমাধিক্ষেত্রটি Commonwealth War Graves Commission (CWGC) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ও তারাই এই সমাধিক্ষেত্র পরিচালনা করেন। এই সমাধিক্ষেত্রের ৭৩৬টি কবর আছে। বাহিনী অনুযায়ী এখানে এর মধ্যে রয়েছেন ৩জন নাবিক, ৫৬৭জন সৈনিক এবং ১৬৬জন বৈমানিক সহ সর্বমোট ৭২৩ জন নিহতের পরিচয় জানা সম্ভব হয়। সমাধিক্ষেত্রটির প্রবেশমুখে একটি তোরণ আছে, যার ভিতরের দেয়ালে এই সমাধিক্ষেত্রের ইতিহাস ও বিবরণ ইংরেজি ও বাংলায় লিখা আছে। ভিতরে সরাসরি সামনে প্রশস্থ পথ, যার দুপাশে সারি সারি কবর ফলক। সৈন্যদের ধর্ম অনুযায়ী তাদের কবর ফলকে নাম, মৃত্যু তারিখ, পদবির পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতীক লক্ষ করা যায়। খ্রিস্টানদের কবর ফলকে ক্রুশ, মুসলমানদের কবর ফলকে আরবি লেখা (যেমন: হুয়াল গাফুর) উল্লেখযোগ্য। প্রশস্থ পথ ধরে সোজা সম্মুখে রয়েছে সিঁড়ি দেয়া বেদি, তার উপরে শোভা পাচ্ছে খ্রিস্টধর্মীয় পবিত্র প্রতীক ক্রুশ। বেদির দুপাশে রয়েছে আরো দুটি তোরণ ঘর। এসকল তোরণ ঘর দিয়ে সমাধিক্ষেত্রের পিছন দিকের অংশে যাওয়া যায়। সেখানেও রয়েছে আরো বহু কবর ফলক। প্রতি দুটি কবর ফলকের মাঝখানে একটি করে ফুলগাছ শোভা পাচ্ছে। সমাধিক্ষেত্রের সম্মুখ অংশের প্রশস্ত পথের পাশেই ব্যতিক্রমী একটি কবর রয়েছে, যেখানে একসাথে ২৩টি কবর ফলক দিয়ে একটা স্থানকে ঘিরে রাখা হয়েছে। এই স্থানটি ছিল মূলত ২৩ জন বিমানসৈনিকের একটি গণকবর।

কবরস্থান, শশ্মান, গ্রেইভইয়ার্ড নাম গুলো শুনলেই আমাদের গা চমচম করে উঠে অথচ এই সমাধিক্ষেত্রটাকে এমন পরিপাটী করে সাজানো হয়েছে যে এটা রীতিমত পর্যটন স্পটে পরিণত হয়েছে। চারিদিকের নির্মল পরিবেশ যে কারো মনে প্রশান্তি এনে দেয়। বিভিন্ন ফুল গাছ গাছড়ার ছায়ায় বসে অনেকটা সময় ধরে উপভোগ করলাম এই শ্যামল পরিবেশটির সৌন্দর্য। বন্ধু মামুনের বেশি না খাওয়ার সতর্কবার্তাটা আমলে না নিলে হয়তো এখানেই ঘুমিয়ে যেতাম।

ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রি থেকে বের হতে হতে প্রায় সাড়ে ৪টা। রিক্সা নিয়ে আবার ফিরে এলাম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট মোড়ে। মোড় থেকে কুমিল্লা সদরে যাওয়ার অনেক গাড়ি পাওয়া যায়। ঐ রকম একটা গাড়ি করে ১০ টাকা ভাড়ায় এসে নামলাম কুমিল্লা সদরের শাসনগাছা বাস ষ্টেশন নামক জায়গায়। শাসনগাছা থেকে ২০ টাকা ভাড়ায় একটা রিক্সানিয়ে চলে গেলাম ধর্মসাগর পাড়ে।

ধর্মসাগরঃ এটি একটি প্রাচীন দীঘি।এটি কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। ধর্মসাগরের আয়তন ২৩.১৮ একর।ত্রিপুরার অধিপতি মহারাজা প্রথম ধর্মমাণিক্য ১৪৫৮ সালে ধর্মসাগর খনন করেন। ১৫০০ শ্রমিকের ৭৩০ দিনের শ্রমের বিনিময়ে এই দীঘি খনন করা হয়। এই অঞ্চলের মানুষের জলের কষ্ট নিবারণ করাই ছিল রাজার মূল উদ্দেশ্য। মহারাজা ধর্মমাণিক্যের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় ধর্মসাগর। ধর্মসাগর নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে বহু উপাখ্যান ও উপকথা।ধর্মসাগরের পূর্ব দিকে কুমিল্লা জিলা স্কুল, কুমিল্লা স্টেডিয়াম আর পশ্চিম পাড়ে বসার ব্যবস্থা আর হাঁটার পথ। ধর্মসাগরের উত্তর কোণে রয়েছে রানীর কুঠি আর পৌরপার্ক।

রাণীর কুঠিঃ কয়েকশ বছরের পুরোনো রাণীর কুঠি’র ইতিহাসও অনেক বিস্তৃত। লাল ইটের রাণীর কুঠিতে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। সামনেই রাজকীয় প্রবেশদ্বার, তৎকালীন বৃটিশ শাসক-কর্মকর্তারা তাদের প্রশাসনিক কাজে এটি ব্যবহার করত। কুঠির ভেতরে বসার জায়গাটাতে এখনো সেই পুরোনো ধাঁচ রয়ে গেছে। রুম পেরিয়ে পিছন দিকটায় শান বাঁধানো বড় একটা ঘাট। নামতে নামতে একদম পানির খুব কাছে গিয়ে মিশে গেছে। রাণীর কুঠি একসময় পল্লী উন্নয়ন একাডেমির আওতায় ছিল। তারা এটিকে অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহার করতো। পরে সরকার গেজেট করে রাণীর কুঠিকে প্রত্মতত্ব অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করে।রাণীর কুঠি দেখা শেষ করে ধর্মসাগরের পাড় ধরে যখন ফিরছিলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা।

এবার ফেরার পালা, তাই রিক্সা যোগে আবার চলে এলাম শাসনগাছায়। এখান থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার কোন বাসস্ট্যান্ড নেই। শাসনগাছা থেকে একটা টমটম ৬০ টাকায় ভাড়া করে চলে এলাম জাঙ্গালিয়া বাসস্ট্যান্ড।জাঙ্গালিয়া বাসস্ট্যান্ডে চট্টগ্রামগামী প্রিন্স সৌদিয়া বাস পাওয়া যায়। নাস্তা করে বাসের টিকেট কেটে রওয়ানা হয়ে গেলাম চট্টগামের উদ্দেশ্যে। বাস যখন ছাড়ল তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। রাস্তায় যানজটের কারণে অলংকার মোড়ে আসতে আসতে রাত প্রায় সাড়ে ১১ টা বেজে গেল। সারাদিন শরীরের বারটা বাজিয়ে ঠিক বারটায় বাসায় পৌঁছলাম সাথে রোমাঞ্চকর হাজার স্মৃতি।











মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.